প্রকাশ : ০৩ মার্চ ২০২৪, ০০:০০
ঠিকাদারের কাছে যখন কর্তৃপক্ষ ঠেকা-

দশম জাতীয় সংসদ (২০১৪-২০১৮) নির্বাচনে নির্বাচিত হবার পর চাঁদপুর সদর (চাঁদপুর-৪) আসনের এমপি ডাঃ দীপু মনি তাঁর মেয়াদের শেষ দিকে ফরিদগঞ্জ (চাঁদপুর-৪) আসনের এমপি ড. মোহাম্মদ শামছুল হক ভূঁইয়া ডাকাতিয়া নদীর ওপর ভাষাবীর এমএ ওয়াদুদ সেতুর ভিত্তি প্রস্তর স্থাপন করেন। সবাই আশাবাদী ছিলেন নির্দিষ্ট সময়ে সেতুটির নির্মাণ কাজ শেষ হলে চাঁদপুর সদর ও ফরিদগঞ্জের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের সাথে সংক্ষিপ্ত সেতুবন্ধন স্থাপিত হবে। কিন্তু না, একাদশ জাতীয় সংসদ (২০১৯-২০২৩) নির্বাচনে দীপু মনি নির্বাচিত হবার পর শিক্ষামন্ত্রী হলেন এবং তারপর কেটে গেল পাঁচ বছর, কিন্তু তাঁর বাবার নামের সেতুটির কাজ আর শেষ হলো না। দ্বাদশ জাতীয় সংসদ (২০২৪-২০২৮) নির্বাচনে নির্বাচিত হবার পর ডাঃ দীপু মনি সমাজকল্যাণমন্ত্রী হলেন, আর ফরিদগঞ্জের সাবেক এমপি ড. শামছুল হক ভূঁইয়া অতি সম্প্রতি হলেন গতায়ু। তারপরও এই দুজনের ভিত্তি প্রস্তর স্থাপনকৃত সেতুটির কাজ শেষ হলো না। অথচ জীবন শেষ হয়ে গেল একজনের, যিনি সেতুটির ওপর দিয়ে নিজ গাড়ি নিয়ে পাড়ি দেবার সুযোগ পেলেন না। তাহলে সেতুটির সর্বশেষ অবস্থা কী? এটা নিয়েই সচিত্র সংবাদ পরিবেশন করেছেন চাঁদপুর কণ্ঠের ফরিদগঞ্জ ব্যুরো ইনচার্জ প্রবীর চক্রবর্তী।
‘মই বেয়ে সেতুতে উঠছে যাত্রীরা’ শিরোনামের সংবাদটিতে প্রবীর চক্রবর্তী লিখেছেন, মই বেয়ে সেতুতে উঠলেন, অতঃপর স্বামীর মোটরসাইকেলে চড়ে সেতু দিয়ে চলে গেলেন স্বামীর বাড়ি। দৃশটি বেমানান হলেও ভাষাবীর এমএ ওয়াদুদ সেতুর বর্তমান চিত্র এটি। সেতু দিয়ে এখন সিএনজি অটোরিকশা, অটোবাইকে যাত্রী পারাপার করলেও সেতুর ফরিদগঞ্জ অংশের শেষ ভায়াডাক্টটির ঢালাইয়ের কাজ সম্পন্ন না হওয়ায় যাত্রীদের মই বেয়ে পারাপার হতে হচ্ছে। এ যেনো রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ছোটগল্পের সংজ্ঞা ‘শেষ হইয়াও হইলো না শেষ’-এর অবস্থায় দাঁড়িয়েছে।
২০১৭ সালের ১১ ফেব্রুয়ারি তৎকালীন সংসদ সদস্য বর্তমান সমাজকল্যাণমন্ত্রী ডাঃ দীপু মনি এমপি ও চাঁদপুর-৪ (ফরিদগঞ্জ) আসনের তৎকালীন সংসদ সদস্য ড. মোহাম্মদ শামছুল হক ভূঁইয়া যৌথভাবে ডাকাতিয়া নদীর উপর ২৭৪.২০ মিটারের এ সেতুটির ভিত্তি প্রস্তর স্থাপন করেন। ৩৬ কোটি ৮৬ লাখ টাকা ব্যয়ে ঢাকার প্রথম শ্রেণির ঠিকাদার নবারণ ট্রেডার্স লিঃ নদীর উপরে সেতুটির মূল কাজ সম্পন্ন করে। পরে ২০২০-২১ অর্থ বছরে দ্বিতীয় ধাপের কাজের জন্যে ২৮ কোটি ৯৫ লাখ ৮২ হাজার ৮৫৪ টাকা ব্যয়ে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান রিজভী কনস্ট্রাকশন ও ইউনুছ আল মামুন (জেবি) যৌথভাবে কাজ শুরু করে। নির্মাণ কাজের মেয়াদ ডিসেম্বর ২০২১-এ শেষ হওয়ার কথা থাকলেও পরবর্তীতে মেয়াদ বৃদ্ধি করে তা জুন ২০২৩ পর্যন্ত করা হয়। পরে তা ডিসেম্বর পর্যন্ত বৃদ্ধি করা হলেও অদ্যাবধি নির্মাণ কাজ শেষ হয়নি। সেতুটির চাঁদপুর সদর উপজেলা অংশের ভায়াডাক্টের কাজ সম্পন্ন হলেও গত ৮ মাসে ফরিদগঞ্জ অংশের কাজ শেষ করতে পারেনি ঠিকাদার। এলজিইডি তাদেরকে বারংবার নির্মাণ কাজ শেষের জন্যে তাগাদা দিয়ে সময় বেঁধে দিলেও অদ্যাবধি ভায়াডাক্টের কাজই শেষ করতে পারেননি ঠিকাদার। এরপর সংযোগ সড়কের নির্মাণ কাজতো রয়েছেই।
সরজমিনে ২৬ ফেব্রুয়ারি সোমবার সেতুর নির্মাণ স্থানে গিয়ে দেখা যায়, সেতুর চাঁদপুর সদর অংশের ভায়াডাক্টয়ের কাজ শেষে সংযোগ সড়ক সম্পন্ন হয়েছে। কিন্তু রেলিংয়ের কাজ হয়নি। অপরদিকে ফরিদগঞ্জ অংশে শেষ ভায়াডাক্টটির রড বাঁধাই হলেও ঢালাই না হওয়ায় সড়কের সাথে সংযোগ হয়নি। ফলে সেতুটি ব্যবহারে ইচ্ছুক যাত্রীদের মই বেয়ে সেতুতে উঠে গাড়িতে চড়তে হচ্ছে। স্ত্রী-সন্তান নিয়ে মই বেয়ে উঠে গাড়িতে চড়া আলাউদ্দিন, শহিদ হোসেন, ইব্রাহিম হোসেনসহ বিক্ষুব্ধ যাত্রীরা জানান, ৭ বছরেও সেতুটির নির্মাণ কাজ শেষ করতে পারেনি কর্তৃপক্ষ। আর কতদিন লাগবে তাদের সেতুটি যান চলাচল উপযোগী করতে? শিমুল সর্দার, ইব্রাহিম সর্দারসহ বেশ ক’জন জানান, মই বেয়ে উঠতে গিয়ে ইতিমধ্যেই নারীসহ বেশ ক’জন গুরুতর আহত হয়েছেন। এই অঞ্চলের মানুষের স্বপ্ন কবে যে বাস্তবে রূপ নিবে তা কেউই বলতে পারছে না। স্থানীয় বাসিন্দারা জানান, জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগেই সেতুর কাজ বন্ধ হয়ে যায়। এছাড়া নির্বাচনের পর চুরির ঘটনাকে কেন্দ্র করে এখানে ঝামেলা হয়। ঠিকাদারের লোক ও অবৈধ সুবিধাভোগীদের কারণে আমাদের দুঃখ শেষ হচ্ছে না। সেতুর দায়িত্বে থাকা এলজিইডির উপ-সহকারী প্রকৌশলী আইউব খান মুঠোফোনে জানান, জাতীয় সংসদ নির্বাচন এবং পরবর্তীতে চুরিজনিত ঘটনাকে কেন্দ্র করে অস্থিরতা তৈরি হওয়ায় শেষের দিকে এসে কাজ থমকে দাঁড়িয়েছে। ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের কিছু বিল ছাড় হলে তাদেরকে দিয়ে বাকি কাজ শেষ করানো সম্ভব হবে।
৩০ হাজার ১৯৩ কোটি ৩৯ লাখ টাকা ব্যয়ে বাংলাদেশের বৃহত্তম সেতু পদ্মা বহুমুখী সেতু নির্মাণে ২০১৪ থেকে ২০২২ সাল পর্যন্ত সময় লেগেছে ৭ বছর ৬ মাস ২৭ দিন। আর চাঁদপুর সদর ও ফরিদগঞ্জের মধ্যে সংযোগ রক্ষাকারী ৩৬ কোটি ৬ লাখ টাকার ভাষাবীর এম এ ওয়াদুদ সেতু নির্মাণে তারচে' বেশি সময় লাগে কিনা সেটাই এখন দেখার বিষয়। কারণ, সেতুটির ভিত্তি প্রস্তর স্থাপনের পর ৭ বছর ১৮ দিন ইতিমধ্যে পার হয়ে গেছে। একটি সেতু নির্মাণে যথাযথ তাগিদ ও তদারকির অভাব থাকলে ঠিকাদার তার কাজ নিয়ে যে কতোটা দীর্ঘসূত্রিতা অবলম্বন করে এবং কর্তৃপক্ষকে কতোটা ঠেকিয়ে রাখেন, তার নিকৃষ্ট উদাহরণ হচ্ছে ভাষাবীর এম এ ওয়াদুদ সেতু। আমরা এই সেতু নিয়ে আর কোনো মন্তব্য করতে চাই না। কারণ, সেটা আমাদের রুচিতে বাধছে ভীষণভাবে।