প্রকাশ : ২৪ জুন ২০২৩, ০০:০০
আমার এই সবুজ গতরে বাসা বাঁধতো। মায়না, টুনটুনি, কোয়েল, ঘুঘু, দোয়েলসহ আরো কত নাম অজানা পাখি। দীর্ঘ উড্ডয়নের বিরাম নিতো চিল, কাক কোকিলও। আমি বিরক্ত হতাম না, বরং এটাই যে কাজ আমার। প্রত্যেক বস্তু দৃশ্য অদৃশ্যমান কার্যসম্পাদনে প্রকৃতি বক্ষে জন্মায়। আমিও বিপরীত ছিলাম না এর। যাত্রাপথে আসতো মানুষও, আমার শ্যামল ছায়ায় গা এলিয়ে জিরাতো। সন্ধ্যায় লাগতো, অস্থায়ী টঙ ঝুপড়ির সারি। সেই দোকান ঘিরে ভিড় হতো, সোর হতো জোয়ান বুড়ো শিশুদের। করতলে কম্পিত হাওয়ায় ডালপালা নেড়ে মৃদু জানান দিতাম আমার অস্তিত্ব। সেই পবনে আগত লোকেরা শীতল সুখে আকুল হয়ে উঠতো।
মৌসুমি ফলপুঞ্জে নতজানু হতো আমার গগণচুম্বী শরীর, যাতে ফল ছিড়তে কসরত না পোহাতে হয় সকলের। কেবল আমার ডালে ঘর বাঁধতো না পক্ষী, বিশ্রাম বা অস্থায়ী সন্ধ্যার বাজার বসতো না আমায় ঘিরে। মরসুমে ফল উগাতাম না শুধুমাত্র। হাজারো অযুত পূর্বকাল হতে আমার এই ছায়াতলে চর্চা হতো বিদ্যা। আমার কায়া পৃষ্ঠে ওস্তাদ আসন গ্রহণ করতেই সমাগম ঘটতো সহস্র জ্ঞান পিপাসুর।
কথায় বলে না নিখুঁত এক কল্পনা মাত্র চাঁদেরও আছে কলঙ্ক। নিউটনের মাথায় সহসা আপেল ফেলে আমারও হয়েছে সেই দশা। জানি আমার সেই অসাবধানতার মাশুল এখন কোটি আদম সন্তানকে গুনতে হচ্ছে। আমি জন্মজন্মান্তর দুঃখি হয়ে রইলাম এই অসতর্কতার জন্যে।
এখন সব অতীত। আমি আর আমি নেই, আমায় উচ্ছেদের মহোৎসবে মেতেছে সকলে। আগে কুড়াল, করাত টেতে মৃত্যু হলেও, বর্তমান আমায় নির্মূলের জন্যে আবিস্কৃত হয়েছে কত অত্যাধুনিক যন্ত্রের! সবুজ ভূখণ্ড মরুতে রূপান্তর ইচ্ছের ব্যপার শুধু।
এমন কেন করছো তোমরা? কী পূর্ব ভুলের মাশুল নিচ্ছো বুঝি? কত বৃক্ষের বদলে ভরপাই হবে এই অসাবধানতার মাশুল? আমার মনে হয় না তোমরা অতটাও প্রতিশোধ পরায়ণ যতটা না লালসা কাতর। একমাত্র লোভে বশীভূত হয়ে তোমরা প্রকৃতি হত্যায় মেতেছো। সেই বাসনা নগর ছাড়িয়ে গ্রাম মাড়িয়ে হ্রদ ডিঙিয়ে পৌঁছেছে পর্বত চূড়ায়।
গ্রামগুলো এখন মায়াহীন পাথুরে শহরে প্ররিণত হচ্ছে, শ্যামল পাহাড় ছেঁটে নির্মাণ হচ্ছে বসতভিটা রোড ঘাট। মানবসমাজ বড়ই বোকা। নাহলে নিজের পায়ে নিজে কখনো কুড়াল মারে? আমায় গায়ে করাত চালালেও আদতে নিজেদের মৃত্যু ডেকে আনছে তারা। মানুষের পরম বন্ধু বাতাস, যেই হাওয়া ছাড়া মানব জীবন অচল। আর আমরা, সেই বাতাস থেকে কার্বন-ডাই-অক্সাইড শোষণ করে গ্রিন হাউস ইফেক্টের মাত্রা কমাতে সাহায্য করি।
আবার বাতাসে অক্সিজেন যোগ করে বায়ুমণ্ডলে বিভিন্ন গ্যাসের অনুপাত বজায় রাখতে সহায়তা করি। এভাবে বায়ুদূষণ কম হয় বাতাস থাকে বিশুদ্ধ। সাহায্য করি বৃষ্টিপাত ঘটাতেও। আমাদের অভাবে উর্বর উৎপাদনশীল মাটি ধীরে ধীরে মরুভূমিতে পরিণত হয়। মাটির উর্বরতা বজায় রাখতে দরকার হয় বৃষ্টিপাতের। আর বৃষ্টিপাত ঘটাতে আমাদের অবস্থান জরুরি।
এত কিছুর পরো আমরা এখন মনুষ্য পথের কাটা। তাই হয়তো আমাদের বিনাশে ভিষম তোড়জোড়। মনে রেখো প্রকৃতির চেয়ে আপন স্বয়ং তোমার প্রেয়সীও না।
একি...
একি...
কেউ হয়তো শুনে ফেলেছে আমার এই নির্মম আর্তনাদ। মারতে আসছে আমায় কে বা কারা! নগর ছাড়িয়ে গ্রাম মাড়িয়ে হ্রদ ডিঙিয়ে পর্বত চিঁড়ে। কিন্তু তাদের কাছে তো কুড়াল, করাত নেই। নেই কোন আধুনিক উচ্ছেদ যন্ত্র। সে কী? হাতে নিউটনের আপেল আকৃতি বোমাবৃত্ত!