প্রকাশ : ২৮ আগস্ট ২০২৩, ০০:০০
মহাকবি মাইকেল মধুসূদন দত্ত অমিত্রাক্ষর ছন্দসৃষ্টিতে, নূতন ধরনের আখ্যানকাব্য-রচনায়, এ দেশের একমাত্র খাঁটি মহাকাব্যসৃষ্টিতে, আধুনিক গীতিকবিতা ও সনেটের উদ্ভাবনায়, কাব্যচরিত্র সৃজনে ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্য ও গভীরতা প্রকাশ করায় যুগান্তকারী দায়িত্ব পালন করেছেন। তিনি বাংলা সাহিত্যকে আধুনিক বিশ্বসাহিত্যের সিংহদ্বারে পৌঁছে দিয়েছেন।
মধুসূদন ১৮২৪ সালের ২৫ জানুয়ারি যশোহর জেলার সাগরদাঁড়ি গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। পিতা রাজনারায়ণ দত্ত সেকালের রীতি অনুযায়ী ফারসি ভাষায় বিশেষ দক্ষতা লাভ করেছিলেন। কলকাতা সদর দেওয়ানি আদালতের ব্যবহারজীবীরূপে তিনি প্রভূত প্রতিষ্ঠা ও অর্থ উপার্জন করেছিলেন। খিদিরপুরের বড় রাস্তার উপরে একটি দোতলা বাড়ি কিনে যখন তিনি কলকাতায় পরিবারবর্গ নিয়ে এলেন, কবির বয়স তখন সাত বছর। গ্রামে মাতা জাহ্নবী দেবীর তত্ত্বাবধানে তাঁর শৈশব শিক্ষা শুরু হয়েছিল। রামায়ণ-মহাভারতের প্রতি আকর্ষণের বীজ সম্ভবত এই সূত্রেই তাঁর মনের কোণে উপ্ত হয়। তিনি ফারসি ভাষায়ও কতকটা জ্ঞান অর্জন করেছিলেন।
কলকাতায় এসে কবি হিন্দু কলেজে ভর্তি হলেন। ইংরেজি তথা ইউরোপীয় সাহিত্যরস ও বিচিত্র মানববিদ্যা যেসব প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে নব্য বাংলার অন্তরে প্রবেশ করেছিল, হিন্দু কলেজের স্থান তার মধ্যে খুবই গুরুত্বপূর্ণ। নূতন মানবমন্ত্রে বিশ্বাস, পাশ্চাত্য জীবনতন্ত্রে আসক্তি, গভীর ইংরেজি সাহিত্যপ্রীতি, দেশীয় আচার ও ভাবনার প্রতি অশ্রদ্ধা এসব বিষয়ে বিদ্রোহী মনোভাব হিন্দু কলেজের শিক্ষার সাধারণ ফল হয়ে দাঁড়িয়েছিল। মধুসূদনের ব্যক্তিচরিত্র এবং শিল্পীপ্রাণের গঠনে হিন্দু কলেজে অধ্যয়নের পর্ব অনেকখানি প্রভাব বিস্তার করেছিল।
হিন্দু কলেজে ছাত্র হিসেবে কলকাতার সর্বোৎকৃষ্ট স্তরটি এসে সমবেত হতো। তাদের মধ্যেও মধুসূদনের ঔজ্জ্বল্য সকলের চোখ ধাঁধিয়ে দিয়েছিল। পোশাক-পরিচ্ছদ-বিলাস-ব্যসনে, বাকপটুতায়, বুদ্ধির দীপ্তিতে তিনি বন্ধুদের কেন্দ্রে আসন পেতেছিলেন। এবং ভূদেব মুখোপাধ্যায়, রাজনারায়ণ বসু, গৌরদাস বসাক, ভোলানাথ চন্দ্র, বঙ্কুবিহারী দত্তের ন্যায় ব্যক্তিরা (পরবর্তী জীবনে এঁরা সবাই অল্প-অধিক খ্যাতি অর্জন করেছিলেন) ছিলেন কবির সহপাঠী। কখনো ফারসি গজল গান গেয়ে, কোনোদিন সাহেব-নাপিতের দোকানে চুল কাটিয়ে, কখনো মুহুর্মুহু শেক্সপিয়র-বায়রন আবৃত্তি করে তিনি বন্ধুদের চমকে দিতেন। আবার এর সঙ্গে ছিল কোনো কোনো শিক্ষকের প্রতি সরব অশ্রদ্ধা, মদ্যপান, অমিতব্যয়িতা, পিতার সঙ্গে একই আলবোলায় ধূমপান--এমনই আরও বিচিত্র সব আচরণ।
কলেজের পরীক্ষায় তিনি বৃত্তি পেতেন। ইংরেজিতে কবিতা লিখতেন, ছাপার হরফে তা প্রকাশিত হতো। বিখ্যাত বিলেতি পত্রিকায় প্রকাশের জন্য কবিতা পাঠাতে তাঁর কুণ্ঠা ছিল না। ওয়ার্ডসওয়ার্থকে কবিতা উৎসর্গ করতেও। আবার এরই মধ্যে নারীশিক্ষা বিষয়ে প্রবন্ধ লিখে পেলেন প্রথম পুরস্কার, একটি স্বর্ণপদক। একদিন হঠাৎ ধুতি ছেড়ে আচকান-পায়জামা ধরলেন, তারপরে সোজা সাহেবি প্যান্ট-কোট। এক কথায় সকলের কাছে ‘মধু’ একটি বিস্ময়, একটি প্রতিভা! প্রথম তারুণ্যের কবিতাগুলো নিয়ে তাঁর গর্বের অন্ত ছিল না, ভবিষ্যতে তিনি বিখ্যাত কবি হবেন, গৌরদাস তাঁর জীবনী রচনা করবেন এরূপ আশা বহু চিঠিতেই তিনি ব্যক্ত করেছেন। বিলেত গেলেই বড় কবি হতে আর কোনো বাধাই থাকবে না, এরূপ একটি অদ্ভুত ধারণা কোনো অজ্ঞাত কারণে তাঁর মনে দানা বেঁধেছিল। ইংল্যান্ডে যাওয়া মধুসূদনের তরুণচিত্তে কতবড় প্রবল ভাবাবেগের কেন্দ্র হয়ে উঠেছিল ওই সময়ে লেখা একাধিক কবিতা ও চিঠিতে তার প্রমাণ আছে। অবশেষে ১৮৪২ সালে, যখন তিনি সিনিয়র ডিপার্টমেন্টের দ্বিতীয় শ্রেণীর ছাত্র, তাঁর জীবনে এল এক গুরুতর পরিবর্তন।
মধুসূদনের ইংরেজি কবিতাগুলো সমকালীন নানা পত্র-পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছিল। হিন্দু কলেজে ছাত্র থাকাকালে অনেক কবিতা তিনি লিখেছিলেন। তাদের উৎসাহী পাঠক ও স্তুতিগায়কের অভাব ছিল না। এই কবিতাগুলো ‘জ্ঞানান্বেষণ’, ‘বেঙ্গল স্পেকটেটর’, ‘ক্যালকাটা লিটারারি গেজেট’, ‘গ্লীনর’, ‘ব্লসম’, ‘কমেট’ প্রভৃতি সাময়িকপত্রে প্রকাশিত হতো। পরবর্তী কবিতাগুলো মাদ্রাজ-প্রবাসে রচিত। মাদ্রাজে তিনি ‘মাদ্রাজ সার্কুলেটর অ্যান্ড জেনারেল ক্রনিক্ল’, ‘স্পেকটেটর’, ‘এথেনিয়াম’, ‘হিন্দু ক্রনিক্ল’ প্রভৃতি পত্রিকায় কবিতা লিখতেন। প্রথমোক্ত পত্রিকায় ‘Timothy Penpoem’ ছদ্মনামে নিয়মিত কবিতা লেখা চলতো।
মধুসূদন হঠাৎ একদিন নিরুদ্দেশ হলেন। শোনা গেল তিনি খ্রিস্টান হবেন। প্রতিষ্ঠাবান ব্যক্তি রাজনারায়ণ লাঠিয়াল সংগ্রহ করে পুত্রকে ধর্মান্তর-গ্রহণে বাধা দেবেন এই অজুহাতে মধুসূদনকে ফোর্ট উইলিয়ামের মধ্যে আশ্রয় দেয়া হলো। ১৮৪৩ সালের ৯ ফেব্রুয়ারি মিশন রো-এ ওল্ড মিশন চার্চে আর্চডিকন ডিয়াল্ট্রি তাঁকে খ্রিস্টধর্মে দীক্ষিত করলেন। তাঁর নূতন পরিচয় হল মাইকেল।
মধুসূদন হঠাৎ কেন খ্রিস্টধর্ম গ্রহণ করলেন তা একটি গুরুতর সমস্যার ব্যাপার। খ্রিস্টধর্মের প্রতি আকর্ষণ বশে যে করেননি তা নিশ্চিত। মধুসূদনের ইংল্যান্ড গমনের বাসনা কী পরিমাণ প্রবল ও প্রগল্ভ হয়ে উঠেছিল তার পরিচয় আগেই পেয়েছি। বিশেষ করে নব্যতন্ত্রের প্রতি গভীর অনুরাগ হিন্দুধর্ম সংক্রান্ত কোনো সংস্কারকেই তাঁর মনের মধ্যে দৃঢ় হয়ে উঠতে দেয়নি। আরও একটি গুরুতর কারণ ছিল। কবির খ্রিস্টান হবার কিছুদিন আগে একটি গ্রাম্য বালিকার সঙ্গে তাঁর বিয়ের কথা উঠেছিলো। কবির তা মোটেই পছন্দ ছিল না। তা থেকে উদ্ধারের একটি সহজ উপায় খুঁজে পেলেন ধর্মান্তর গ্রহণের মধ্যে। তাছাড়া রেভারেন্ড কৃষ্ণমোহন বন্দ্যোপাধ্যায়ের দেবকী নাত্নী রূপবতী বিদুষী দ্বিতীয়া কন্যার সঙ্গে মধুসূদনের প্রেম-সম্পর্ক স্থাপিত হয়েছিল এমন সংবাদ পাওয়া যায়। গৌরদাস বসাক তাঁর স্মৃতিকথায় খুব স্পষ্ট করে না লিখলেও এ বিষয়ে কিছু ইঙ্গিত করেছেন। মধুসূদনের খ্রিস্টধর্ম গ্রহণ প্রসঙ্গে তিনি রেভারেন্ড কৃষ্ণমোহনের প্ররোচনাকে দায়ী করেছেন। নিজের পছন্দমতো শিক্ষিতা তরুণীর পাণিগ্রহণের বাসনা কবির ছিল।
খ্রিস্টান ছাত্রদের হিন্দু কলেজে পড়বার অধিকার ছিলো না। মধুসূদনকে হিন্দু কলেজ ছাড়তে হলো। খ্রিস্টধর্ম গ্রহণের প্রায় দুই বছর পরে তিনি শিবপুরে বিশপ্স কলেজে ভর্তি হলেন। ধর্মান্তরিত পুত্রের পড়ার খরচ দিতেন রাজানারায়ণ। বন্ধুদের সঙ্গে তখনও কবির ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক ছিল, সমকালে লেখা চিঠিগুলো পড়ে তা জানা যায়। বিশপ্স কলেজের সাধারণ বিভাগের ছাত্র হিসেবে তিনি গ্রিক, লাতিন এবং হিব্রু ভাষা শেখার সুযোগ পেলেন এখানে।
ইংল্যান্ড থেকে আগত বহুভাষাবিদ বিশপ পণ্ডিতদের কাছ থেকে প্রাচীন ভাষা শিক্ষা মধুসূদনের জীবনের উপরে গভীর প্রভাব বিস্তার করেছিল। মধুসূদন ভবিষ্যতে বহুভাষাবিদ রূপে প্রতিষ্ঠা পেয়েছিলেন। তার বীজবপন হলো বিশপ্স কলেজে। তার চেয়েও বড় কথা কালক্রমে মধুসূদনের মনের গভীরে যে ক্লাসিক রুচি, জীবনদৃষ্টি ও শিল্পচেতনা গড়ে উঠেছিল তার ভিত্তি স্থাপিত হলো এই ভাষাশিক্ষায়। অবশ্য কবি সে সম্বন্ধে অনেক সচেতন হয়েছিলেন পরবর্তী কালে।
বিশপ্স কলেজে ইউরোপীয় ছাত্রদের সঙ্গে ভারতীয় ছাত্রদের সহাবস্থানের ফলে নানা ধরনের সমস্যার সৃষ্টি হতো। কর্তৃপক্ষের অগণতান্ত্রিক আচরণ মধুসূদনকে বিক্ষুব্ধ করে তুললো। মধুসূদন খাবার টেবিলে গ্লাস ভেঙে ফেলে, আহার্য বিষয়ে বৈষম্য এবং নানা রঙের পোশাক পরে পরিচ্ছদ সংক্রান্ত বিধিনিষেধের তীব্র প্রতিবাদ করে প্রবল আলোড়নের সৃষ্টি করেছিলেন। শেষ পর্যন্ত কলেজ কর্তৃপক্ষ বিধানের বৈষম্য দূর করতে বাধ্য হয়েছিলেন।
কয়েক বছর বিশপ্স কলেজে কাটিয়ে ১৮৪৮-এর গোড়ার দিকে তিনি হঠাৎ মাদ্রাজ চলে গেলেন। কাউকে কোনো খবর দিলেন না। অকস্মাৎ কবির এই মাদ্রাজ যাবার কারণ ঠিক করে বলা কঠিন। তবে কয়েকটি ঘটনার কথা এ প্রসঙ্গে মনে আসে। রাজনারায়ণ দত্ত তাঁর পড়ার খরচ হঠাৎ বন্ধ করে দিলেন। পিতার বিরক্তির কারণ জানা যায়নি। কিন্তু এর ফলে বিশপ্স কলেজ থেকে তাঁকে চলে যাবার ব্যবস্থা করতে হলো। তিনি একটি ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেটের চাকরির চেষ্টা করলেন। কিন্তু সে চেষ্টা ব্যর্থ হলো। ইংল্যান্ডে যাবার সম্ভাবনা আগেই বিনষ্ট হয়েছিল। মধু পিতার বিরাগভাজন হওয়ায় পরিচিত সকলে ভয় পেলেন, রাজনারায়ণ পুত্রকে উত্তরাধিকারচ্যুত করবেন। মধুসূদনের মতো লোকের পক্ষে সবদিকের এই পরাজয়ের লজ্জা বহন করে কলকাতায় পরিচিত সমাজে বাস করা সম্ভব হলো না। তিনি স্বেচ্ছা-নির্বাসন বরণ করলেন মাদ্রাজে।
১৮৪৮ সালের প্রারম্ভে সহায়সম্বলহীন মধুসূদন সম্পূর্ণ অপরিচিত মাদ্রাজ নগরে উপস্থিত হলেন। তিনি দেশীয় খ্রিস্টান এবং অ্যাংলো-ইন্ডিয়ান সম্প্রদায়ের কৃপায় প্রথমে একটি আশ্রয় এবং অবশেষে একটি চাকরি পেলেন। ‘মাদ্রাজ মেল অরফ্যান এসাইলাম’ নামক বিদ্যালয়ে ইংরেজি শিক্ষকের পদ। মধুসূদন মাদ্রাজে সাত বছর ছিলেন। শিক্ষক, সাংবাদিক এবং কবি হিসেবে তিনি সামাজিক প্রতিষ্ঠা লাভ করেছিলেন। মাদ্রাজ প্রবাসে তাঁর দাম্পত্য জীবনের দিকও গুরুতর আলোড়নের সৃষ্টি করেছিল।
১৮৪৮ থেকে ১৮৫২ সাল পর্যন্ত তিনি ছিলেন উক্ত অনাথ বিদ্যালয়ের শিক্ষক। ১৮৫২ থেকে ১৮৫৬ সাল পর্যন্ত তিনি মাদ্রাজ বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে সংযুক্ত বিদ্যালয় বিভাগের দ্বিতীয় শিক্ষকের পদে অধিষ্ঠিত ছিলেন। সেকালে এই সরকারি পদটি সম্মান ও যোগ্যতার চিহ্নবাহী ছিল। অল্পকালের মধ্যে মধুসূদন আপন পাণ্ডিত্যের সুনিশ্চিত পরিচয় দিয়েছিলেন মাদ্রাজের শিক্ষাবিদদের কাছে।
সাংবাদিক ও কবি হিসেবে ইংরেজি-জানা সমাজে মধুসূদনের খ্যাতি ছড়িয়ে পড়েছিল। এক সময়ে 'Athenaeum'-এর সম্পাদকও ছিলেন। 'Hindu Chronicle ' নামক একটি ইংরেজি সাপ্তাহিক পত্রের সম্পাদকও ছিলেন মধুসূদন। এইসব পত্রপত্রিকায় মধুসূদনের যেসব রচনা প্রকাশিত হতো তাতে ভাষায় ওজস্বিতা ও স্বাধীন তীক্ষ্ন মনোভাবের ছাপ গুণগ্রাহীদের দৃষ্টি এড়াত না। কলকাতার ‘হরকরা’ প্রভৃতি পত্রিকায় কোনো কোনো রচনা পুনর্মুদ্রিত হয়েছিল। প্রবন্ধাদি ছাড়াও মধুসূদন সাময়িক পত্রের পৃষ্ঠায় নিয়মিত কবিতা লিখতে লাগলেন। বিশেষ করে 'Madras Circulator and General Chronicle' নামক পত্রিকায় Timothy Penpoem এই ছদ্মনামে তাঁর অনেক গীতিকবিতা, সনেট, খণ্ডকাব্য প্রকাশিত হয়েছিল। Visions of the Past এবং The Captive Ladie- এই দুটি কবিতা একসঙ্গে প্রকাশিত হলো। এটিই পুস্তকাকারে কবির রচনার প্রথম প্রকাশ।
মাদ্রাজে মধুসূদন একটি বক্তৃতা দিয়েছিলেন। সেটিও ‘The Anglo-Saxon and the Hindu’ নামে গ্রন্থবদ্ধ হয়ে প্রকাশিত হয়েছিল। ‘রিজিয়া’ নামে ইংরেজি অমিত্রাক্ষর ছন্দে একটি নাটকও কবি লিখেছিলেন। ‘ইউরেশিয়ান’ পত্রিকায় সেটি প্রকাশিত হয়। ‘ক্যাপটিভ লেডি’ গ্রন্থটি মাদ্রাজে প্রশংসিত হলেও কলকাতায় বিশেষ সমাদৃত হল না।
গৌরদাসও বন্ধু মধুসূদনকে বাংলা কাব্য রচনায় উৎসাহিত করছিলেন। কিন্তু দূর প্রবাসে কবির মনে মাতৃভাষার প্রতি সুপ্ত আকর্ষণ দানা বাঁধছিল। বেথুনের পরামর্শের পূর্বেই গৌরদাসের কাছে শ্রীরামপুর সংস্করণ কৃত্তিবাসী রামায়ণ ও কাশীদাসী মহাভারত চেয়ে পাঠিয়েছিলেন তিনি। বাংলা ভাষা ভুলতেই তো চাইতেন এক কালে; না ভোলার এই সাধনা কেন? মাদ্রাজে গৃহে, কর্মস্থলে, সমাজে কোথাও বাংলা কথার স্থান ছিলো না। সাহিত্যপাঠ বিশ্বের বহু শ্রেষ্ঠ ভাষার; সাহিত্যরচনা তাও ইংরেজিতে। এ প্রায় বৈদবাণীর মতো। বিশ্বভাষার এই চর্চা কোনোদিন বাংলা সাহিত্য-সৃষ্টিতে নিয়োজিত হবে এ ধারণা তাঁর মনে কী করে এলো? অজানিতভাবেই কি কবির মনের গভীরে নূতন মহাদেশ সৃজিত হচ্ছিল? অন্তত ইংরেজি কাব্যরচনায় ও প্রকাশনায় কবির উৎসাহ অনেকটা কমে গিয়েছিল এ কথা বলা যায়। ‘ক্যাপটিভ লেডি’র পরে আর কোনো কাব্যগ্রন্থ মাদ্রাজ থেকে প্রকাশিত হয়নি-এ ঘটনা লক্ষ্য করবার মতো।
মাদ্রাজে কবির পারিবারিক জীবনে এই পর্বে উল্লেখযোগ্য নানা ঘটনা ঘটেছিল। মাদ্রাজ গমনের তিন বছর পরে তাঁর মাতৃবিয়োগ ঘটে। তিনি একবার কলকাতায় এসে শুধু পিতার সঙ্গে দেখা করে মাদ্রাজে ফিরে যান। কেন তা জানা যায়নি। কিন্তু সবচেয়ে আলোড়ন-সৃষ্টিকারী ব্যাপার দেখা দিল তাঁর বিয়েকে কেন্দ্র করে। মাদ্রাজ গমনের অল্প দিন পরে তিনি অরফ্যান এসাইলামের বালিকা বিভাগের ছাত্রী রেবেকা ম্যাক্টাভিসকে বিয়ে করেন।
মধুসূদন-রেবেকার দাম্পত্যজীবনে শান্তি কী পরিমাণ ছিল বলা কঠিন। তাঁর চিঠিপত্রে কোনো সিদ্ধান্ত করার মতো প্রমাণ বা ইঙ্গিত মেলে না। কিন্তু কবি তৃপ্ত ছিলেন না। কবির অন্তর শান্তির একটি আশ্রয় খুঁজে বেড়াচ্ছিল হয়তো নিজের অজ্ঞাতসারেই। হেনরিয়েটার সঙ্গে পরিচিত হয়ে কবি তাঁকে পেতে চাইলেন। প্রাপ্তি, অতৃপ্তি এবং কামনা তাঁকে প্রবল উত্তেজনা ও শৃঙ্খলাহীন চাঞ্চল্যে প্রতিনিয়ত তরঙ্গিত করতে লাগলো। মধুসূদনের সঙ্গে হেনরিয়েটার আইনত ও ধর্মসঙ্গত বিবাহ হয়েছিল কি না এ বিষয়ে ড. রবীন্দ্র কুমার দাশগুপ্ত স্পষ্ট করে কিছু গুরুত্বপূর্ণ নূতন কথা শোনাতে চেয়েছেন। রেবেকার সঙ্গে কবির নিয়মমতো বিবাহবিচ্ছেদ যেমন ঘটেনি তেমনি হেনরিয়েটার সঙ্গেও কবির আইনানুমোদিত বা ধর্মানুমোদিত বিবাহ সম্পন্ন হয়নি। তাঁর সিদ্ধান্তের পক্ষে অনেক যুক্তি আছে। ২৭ ডিসেম্বর কবি কলকাতা ফিরে আসবার সংকল্প করেছিলেন। পিতার মৃত্যুসংবাদ, জ্ঞাতিদের কাছ থেকে সম্পত্তি উদ্ধারের বাসনা, গৌরদাসের আমন্ত্রণ এর অন্যতম কারণ হতে পারে। কিন্তু মূল কারণ কবির দাম্পত্যজীবনের সমস্যা। মাত্র এক মাসের মধ্যে রেবেকার সঙ্গে তাঁর সম্পর্কচ্ছেদ ঘটেছে এবং হেনরিয়েটার সঙ্গে সম্পর্ক স্থাপিত হয়েছে। এত অল্প সময়ের মধ্যে আইনসম্মত বিবাহবিচ্ছেদ এবং নূতন বিবাহ হওয়া সম্ভব নয়। কলকাতায় আসার সময়ে তিনি ‘মিঃ হোল্ট’ এই ছদ্মনাম গ্রহণ করেছিলেন কেন তাও ভাববার মতো। কবি মাদ্রাজ ত্যাগ করার সঙ্গে সঙ্গে ঘুচল সেই অজ্ঞাতবাস, যেখানে নিজে জেনে এবং না জেনে ভবিষ্যৎ কাব্যজগতে প্রতিষ্ঠালাভের জন্যে প্রস্তুত হয়েছিলেন; কবির ব্যক্তিগত প্রেমজীবনেরও বহু গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা এই পর্বে প্রায় লোকচক্ষুর অন্তরালে সংঘটিত হলো।
১৮৫৬ সালে কবি কলকাতায় ফিরে এলেন। কবির জীবনের শ্রেষ্ঠ অধ্যায় সূচিত হলো। প্রথমে বিশপ্স কলেজে এসে উঠলেন। পরে বন্ধুদের চেষ্টায় পুলিশকোর্টে একটি কেরানির পদ পেলেন। কিছুকাল পরে তিনি দ্বিভাষিকের পদে উন্নীত হলেন। কলকাতায় চাকরিজীবনের এই গ্লানি কবির অভিমানী অন্তরকে বিদ্ধ করেছিল। তবে সাহিত্যসৃষ্টির মহোৎসবে মেতে সাত বছর কবি আপনাকে সংযত রেখেছিলেন। সাহিত্যসৃষ্টি ছাড়াও তিনি সংবাদপত্র-সাময়িকপত্রে প্রবন্ধাদি লিখে অর্থোপার্জন করতেন। ১৮৬২ সালে কিছুদিন 'Hindo Patriot ' পত্রিকার সম্পাদনার কাজেও তিনি যুক্ত ছিলেন।
মধুসূদনের জীবনে এই পর্ব সবচেয়ে গৌরবোজ্জ্বল। সাহিত্যসৃষ্টির অতন্দ্র তপস্যায় তাঁর সর্বশক্তি নিয়োজিত করলেন। অপরাপর ঘটনা তাই যেমন বাহুল্যবর্জিত তেমনি অনুল্লেখ্য। রত্নাবলী নাটকের ইংরেজি অনুবাদ করতে গিয়ে কবির সঙ্গে ১৮৫৮ সালে বেলগাছিয়া রঙ্গমঞ্চের ঘনিষ্ঠতা। তারপর একে একে শর্মিষ্ঠা, একেই কি বলে সভ্যতা, বুড় সালিকের ঘাড়ে রোঁ, পদ্মাবতী, কৃষ্ণকুমারী প্রভৃতি নাটক ও প্রহসন রচনা। যতীন্দ্রমোহন ঠাকুরের সঙ্গে বিতর্কের উত্তরে তিলোত্তমাসম্ভব কাব্য প্রণয়ন। তারপরে ব্রজাঙ্গনা, মেঘনাদবধ, বীরাঙ্গনার সৃষ্টি। এ ছাড়া শর্মিষ্ঠা এবং দীনবন্ধুকৃত নীলদর্পণ নাটকের ইংরেজি অনুবাদ। মাত্র পাঁচ বছরের মধ্যে বাংলা ভুলে-যাওয়া, কোটপ্যান্টলুনপরা মাইকেল বাংলা সাহিত্যের নবজন্ম ঘটালেন, গোটা দেশের চিত্তপদ্মের মধু হয়ে উঠলেন মধুসূদন। তাঁর সাহিত্যসৃষ্টিকে কেন্দ্র করে প্রবল ভাবান্দোলনের সৃষ্টি হলো এদেশীয় বুদ্ধিজীবী মহলে। সংশয়বাদী এবং সমালোচক হয়তো অনেকেই ছিলেন, কিন্তু বাঙালি জাতির মূল ভাবনাটি বাণীরূপ পেল কালীপ্রসন্ন সিংহ আয়োজিত কবি-সংবর্ধনায়।
মধুসূদন জ্ঞাতিশত্রুদের বিরুদ্ধে মামলায় জিতে পিতৃসম্পত্তি উদ্ধার করলেন ১৮৬০ সালে। অবশেষে বিষয় সম্পত্তির প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা করে, আর্থিক সমস্যার একটা সমাধান করে ব্যারিস্টারি পড়বার উদ্দেশ্যে ইউরোপযাত্রার জন্য প্রস্তুত হতে লাগলেন। খিদিরপুরের বাড়ি তিনি সাত হাজার টাকায় বিক্রয় করলেন কবি রঙ্গলালের ভাই হরিমোহন বন্দ্যোপাধ্যায়কে। সুন্দরবনের ভূসম্পত্তি মহাদেব চট্টোপাধ্যায়ের স্ত্রী মোক্ষদা দেবীকে পত্তনী দিলেন। চুক্তি হলো, তাঁরা চার দফায় মোট প্রায় তিন হাজার টাকা ইউরোপ পাঠাবেন এবং কবির স্ত্রী-পুত্রকে কলকাতায় মাসিক দেড়শ’ টাকা হিসেবে দেবেন। এই চুক্তির প্রতিভূ ছিলেন বিখ্যাত রাজা দিগম্বর মিত্র এবং কবির পিসতুতো ভাই বৈদ্যনাথ মিত্র।
আর্থিক ব্যবস্থা মোটামুটি পাকা করেই কবি ইউরোপ চললেন ৯ জুন, ১৮৬২ সালে ‘ক্যান্ডিয়া’ জাহাজে করে। ইউরোপ গমনের ব্যাপারটি বিশ্লেষণ করলে কবির মনোলোকের কিছু নিগূঢ় তাৎপর্যের দিকে দৃষ্টি পড়বে। ইউরোপ ভ্রমণের ইচ্ছা কৈশোর থেকেই কবির কাছে একটা অপ্রতিরোধ্য ভাবাবেগের প্রবলতা নিয়ে দেখা দিয়েছিল। তখন তাঁর ধারণা ছিল ইংল্যান্ড গেলেই তিনি বড় কবি হতে পারবেন। বড় কবি তিনি হয়েছেন, দেশের সর্বশ্রেষ্ঠ কবি, কিন্তু ইংল্যান্ড যাওয়া এখনও হয়নি। বরং কাব্যসৃষ্টিতে পরিপূর্ণভাবে নিমগ্ন থাকার কালে ইংল্যান্ড গমনের বাসনা তাঁকে বিশেষ বিচলিত করতে পারেনি। মহৎ কবির সৃষ্টিকালীন সংযম তাঁকে অন্য সর্ববিধ কামনার অতিরেক থেকে নিবৃত্ত করে এসেছে। কিন্তু বীরাঙ্গনা কাব্য শেষ করতে গিয়ে তাঁর মনে হয়েছে " The fit has passed away ". বীরাঙ্গনার কয়েকটি পত্র তিনি আরম্ভ করেও শেষ করতে পারেননি। উপাদান সংকলন এবং পরিকল্পনা রচনা করেও নূতন মহাকাব্য ‘সিংহল-বিজয়’-এর কয়েকটি চরণমাত্র লিখে তিনি ছেড়ে দিয়েছেন। অন্তরের গভীরে তিনি সুনিশ্চিতভাবে অনুভব করেছেন কাব্যজগত থেকে এবার অবশ্য-বিদায়ের পালা। সৃষ্টিকালীন সেই সংযম বিচলিত হয়েছে।
কাব্যের কল্পলোক থেকে বাস্তব পৃথিবীতে পা দিয়ে দোভাষীর সামান্যপদ তাঁকে পীড়িত করতে লাগলো। মানুষ মধুসূদনের পক্ষে কিশোরীচাঁদের অধীন চাকরি নিশ্চয়ই অবমাননাকর মনে হয়েছে। যেখানে তিনি কবি সেখানে আকাশে উঠেছে তাঁর মাথা। যতীন্দ্রমোহন ঠাকুর, পাইকপাড়ার রাজা, দিগম্বর মিত্রের সহায়তা লাভে, আর্থিক আনুকূল্যে যেন তাঁর স্বাভাবিক অধিকার। কিন্তু সেই ধ্যানলোক ভেঙে যাওয়ার ব্যক্তি মধুসূদনের নিজেকে অপরের কৃপাপ্রার্থী বলে মনে হলো। তিনি বিলেত যাবেন, আবাল্যের কামনা চরিতার্থ করবেন, তিনি ব্যারিস্টার হবেন, সামান্য চাকরির অপমান থেকে ঊর্ধ্বে উঠবেন ঠিক করে ফেললেন। আর্থিক সংস্থানও এক রকম হয়ে গেলো।
মধুসূদন ১৮৬২ সালের জুলাই মাসের শেষদিকে ইংল্যান্ড পৌঁছে ব্যারিস্টারি শিখবার জন্য ‘গ্রেজ-ইন’-এ যোগ দিলেন। প্রথম কিছুকাল সবই পূর্ব ব্যবস্থা মতো চলছিল। কিন্তু পত্তনিদার মহাদেব চট্টোপাধ্যায় চুক্তির খেলাপ করায় সব পরিকল্পনা বিপর্যস্ত হয়ে গেল। কিছুকাল টাকা না পেয়ে হেনরিয়েটা কোনোক্রমে পাথেয় সংগ্রহ করে ইউরোপ রওনা হলেন, মধুসূদনের কাছেও মহাদেব টাকা পাঠানো বন্ধ করেছিলেন। এই অবস্থায় ১৮৬৩ সালের ২ মে হেনরিয়েটা পুত্র-কন্যাসহ ইংল্যান্ড পৌঁছোলেন। অর্থাভাবে মধুসূদন চরম বিপদে পড়লেন। প্রতিভূ দিগম্বর মিত্র ও বৈদ্যনাথ মিত্রকে অনেকগুলো চিঠি লিখেও কোনো ফল পাওয়া গেল না।
১৮৬৩ সালের মধ্যভাগে তিনি সপরিবারে ফ্রান্সে গেলেন। প্রথমে প্যারিসে এবং পরে ভার্সাই শহরে বাস করতে লাগলেন। প্রায় বৎসরকাল কলকাতা থেকে টাকা না পাওয়ায় সপরিবারে মধুসূদন শোচনীয় অবস্থায় পড়লেন। পত্নীর আভরণ, গৃহসজ্জার উপকরণ এবং পুস্তকাদি বন্ধক দেওয়া ও বিক্রয় করা হতে লাগলো। প্রচুর ঋণের দায়ে জেলে যাবার উপক্রমও একবার হয়েছিল। ঈশ্বর চন্দ্র বিদ্যাসাগর পত্রপাঠ দেড় হাজার টাকা পাঠিয়ে দিলেন। পরে অনুকূলচন্দ্র মুখোপাধ্যায়ের কাছ থেকে তিন হাজার টাকা এবং শ্রীশচন্দ্র বিদ্যারত্নের কাছ থেকে পাঁচ হাজার টাকা ধার করে জোগাড় করলেন। মধুসূদন প্রয়োজনীয় দলিলপত্র পাঠিয়ে দিলে তাঁর পিতৃসম্পত্তি অনুকূলচন্দ্রের কাছে বাঁধা রেখে আরও বারো হাজার টাকা সংগ্রহ করা বিদ্যাসাগরের পক্ষে সম্ভব হলো। বিদ্যাসাগর কবিকে নিদারুণ বিপদ থেকে উদ্ধার করলেন। ১৮৬৫ সালের শেষভাগে তাঁর পক্ষে আবার ইংল্যান্ড এসে ‘গ্রেজ-ইন’-এ যোগ দেওয়া সম্ভব হলো। ১৮৬৫ সালের ১৭ নভেম্বর তিনি ব্যারিস্টার হয়ে বেরুলেন।
ইউরোপ-প্রবাসে মধুসূদনের জীবনের অন্যতম মুখ্য ঘটনা চতুর্দশপদী কবিতাবলি রচনা। ১৮৬৫ সালে তিনি ভার্সাই বাসকালে এই সনেটগুলো লেখেন এবং প্রকাশের জন্য কলকাতায় পাঠিয়ে দেন। কয়েকটি নীতিগর্ভ কবিতাও এই সময়ে লেখা হয়। ফ্রান্সে সম্ভবত কতকগুলো কাহিনীকাব্যও লিখতে আরম্ভ করেছিলেন, কিন্তু শেষ করতে পারেননি।
ইউরোপ-প্রবাসের অপর দুটি ঘটনারও উল্লেখ করা চলে। তিনি যখন লন্ডনে ছিলেন, বিশিষ্ট সংস্কৃতজ্ঞ পণ্ডিত গোল্ডস্টুকর লন্ডন বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা ভাষার অধ্যাপকের পদটি গ্রহণ করতে তাঁকে অনুরোধ করেন। পদটি অবৈতনিক হওয়ায় কবির পক্ষে সে অনুরোধ রক্ষা করা সম্ভব হয়নি। ভার্সাই নগরে বাসকালে মধুসূদন দান্তের ষষ্ঠ শতবার্ষিকী জন্মোৎসব উপলক্ষে একটি সনেট রচনা করে ইতালীয় অনুবাদসহ ইতালির রাজা ভিক্টর ইমানুয়েলের নিকট প্রেরণ করেন। আন্তর্জাতিক সাংস্কৃতিক ঐক্যের দিক থেকে ঊনবিংশ শতাব্দীতে কবির এই চেষ্টা বিশেষ তাৎপর্যপূর্ণ।
অবশেষে ১৮৬৭ সালের ৫ জানুয়ারি কবি ভারত অভিমুখে যাত্রা করলেন। ভারতে আইনব্যবসায়ে সাফল্য লাভ না করা পর্যন্ত পরিবার ফ্রান্সেই থাকবে স্থির করলেন। পুত্র-কন্যাদের ইউরোপীয় শিক্ষাদানের উদ্দেশ্যও তাঁর ছিলো। কবির ইউরোপবাসকালীন ঘটনাবলি এবং সেখান থেকে লেখা চিঠিপত্র বিশ্লেষণ করলে তাঁর অন্তর্জীবনের তাৎপর্যপূর্ণ পরিচয় লাভ করা যায়। ঋণের দায়ে জেলে যেতে যেতে ফরাসি, ইতালীয় ও জার্মান ভাষা-শিক্ষায় একাগ্রচিত্ত তাঁকে হয় পাগল না হয় প্রতিভাবান বলে মেনে নিতে হবে। এবং পণ্ডিতদের মতে, এ-দুয়ের মধ্যে ঘনিষ্ঠ সাদৃশ্য আছে। মধুসূদন কাব্য-রাজ্য থেকে তখন প্রায় বিদায় নিয়েছেন। কিন্তু শুধু কবিতায়ই নয়, সুখে-দুঃখে, আচারে ও বাক্যে তিনি একটি অগ্নিগর্ভ প্রতিভা, যার নিদর্শন সর্বত্র ছড়িয়ে আছে।
মধুসূদন যে ইংল্যান্ডকে কামনা করেছেন আবাল্য " I sigh for Albion's distant shore "- আসলে তা ইউরোপীয় আধুনিক ভোগবাদী সভ্যতার প্রতি কবির গভীর আসক্তির পরিচায়ক। ইংল্যান্ডে ও ফ্রান্সে অনেক দুঃখ তিনি পেয়েছেন, অভীষ্ট সিদ্ধির পথে ঘটেছে বহু বিঘ্ন। ইউরোপীয় সভ্যতাকে শুধু সাহিত্যিক আদর্শের মধ্যে নয়, জীবনাদর্শের মধ্যেও কবি গ্রহণ করতে চেয়েছিলেন। মধ্যযুগীয় চিন্তা ও মনোভাব বৈরাগ্য ও নিবৃত্তি-প্রধান হয়ে উঠেছিল। নবযুগ নিয়ে এল তার বিরুদ্ধে এক উচ্চকণ্ঠ বিদ্রোহ। জীবনকে ভালোবাসা এবং পার্থিব ভোগবাসনাকে মূল্য দেয়া পরম পুরুষার্থ বলে গণ্য হতে লাগলো। আমাদের পরাধীন, দরিদ্র দেশে এই জীবনাদর্শ চরিতার্থ হবার সম্ভাবনা ছিল না। মধুসূদনের কাছে ইউরোপ ছিল সেই কামনার মোক্ষধাম। এই কামনা যুগপ্রভাবজাত, মধুসূদনের একান্ত ব্যক্তিগত জীবনচেতনার সঙ্গে তা হয়ে পড়েছিল অন্বয়-সম্বন্ধ।
১৮৬৭ সালের ফেব্রুয়ারি মাসের প্রথম দিকে কবি কলকাতায় ফিরলেন। ব্যয়বহুল স্পেনসেস হোটেলে বাসস্থান ঠিক করলেন। কিন্তু হাইকোর্টে প্রবেশের ব্যাপারে বিচারপতিদের মধ্যে অনেকে প্রশ্ন তুলে বাধার সৃষ্টি করলেন। ২০ ফেব্রুয়ারির আবেদনপত্রটি গৃহীত হলো না। আরও সুপারিশপত্র দাখিল করতে বলা হলো। বিচারপতিদের এই আপত্তির প্রকৃত কারণটি সুনিশ্চিতভাবে বলা যায় না। তবে মনে হয় ‘নীলদর্পণ’ অনুবাদের কথা ইংরেজ বিচারপতিদের অজানা ছিলো না। সম্ভবত হেনরিয়েটার সঙ্গে অবৈধ বিবাহের ব্যাপারটিও তাঁদের কানে উঠেছিল। মধুসূদনের বিরুদ্ধে প্রভাবশীল কোনো গোষ্ঠী যে বিচারপতিদের মতামতকে অনেকটা নিয়ন্ত্রিত করেছিল, তাঁদের সভার বিবরণ পড়ে সেকথা স্পষ্টই বোঝা যায়। মধুসূদন অবশ্য কলকাতার শ্রেষ্ঠ ব্যক্তিদের বহুসংখ্যক প্রশংসাপত্র হাইকোর্টে পাঠিয়ে দিলেন। একরূপ জনমতের চাপে ৩ মে তারিখে তাঁকে ব্যারিস্টাররূপে গ্রহণ করা হলো।
মধুসূদন আইনব্যবসায়ে প্রবৃত্ত হলেন এবং ক্রমেই অধিক অর্থাগম হতে লাগলো। কিন্তু আয়ের সঙ্গে কোনোরূপ সমতা না রেখে দু-হাতে ব্যয় করাই তাঁর চিরকালের স্বভাব। আইনব্যবসায়ে আশাতিরিক্ত আয় করা কিছুতেই সম্ভব হলো না। এদিকে পুরানো ও নূতন ঋণ নিয়ে বিদ্যাসাগর মহাশয় বিপদগ্রস্ত হলেন। মধুসূদন ১৮৬৮ সালে সম্পত্তি কুড়ি হাজার টাকায় বিক্রয় করে বিদ্যাসাগরকে বিপদমুক্ত করলেন। ১৮৬৯ সালে হেনরিয়েটা পুত্র-কন্যাসহ কলকাতায় চলে এলেন। মধুসূদন হোটেল ছেড়ে লাউডন স্ট্রিটে বাগান-ঘেরা দোতলা বাড়ি ভাড়া করলেন। মাসিক বাড়িভাড়া ছিলো ৪০০ টাকা। এর দ্বারাই সামগ্রিক খরচের ধারণা করা যায়।
মধুসূদন আইনব্যবসায়ে সাফল্যের পরিমাণ নিয়ে স্পষ্ট করে তাঁর জীবনীকারেরা কিছু বলেননি। সমকালীন ব্যক্তি ও পত্রিকাগুলোর সাক্ষ্যে পরস্পরবিরোধী নানা কথা বলা হয়েছে। মাসে দেড় থেকে দুই হাজার টাকা তিনি অবশ্যই উপার্জন করতেন। কিন্তু তাঁর মতো প্রতিভাশালী ব্যক্তির কাছ থেকে যতটা প্রত্যাশা করা যায় ততটা আর্থিক সফলতা তিনি পাননি। শেষ দিকে সম্ভবত তাঁর আয়ের পরিমাণও কমে আসছিল এবং অনিশ্চিত হয়ে পড়ছিল।
১৮৭০ সালে হাইকোর্টের প্রিভি কাউন্সিল আফিসের অনুবাদণ্ডবিভাগে পরীক্ষকের পদ লাভ করলেন মধুসূদন। বেতন হাজার থেকে দেড় হাজার টাকা। প্রায় দুই বছর তিনি এই চাকরি করেছিলেন। কিন্তু এই বেতনে তাঁর প্রয়োজন কিছুই মিটত না। তাই শেষ পর্যন্ত তিনি কাজটি ছেড়ে দিলেন। বেশি আয়ের আশায় তিনি আবার আইনব্যবসা আরম্ভ করলেন। কবির স্বাস্থ্য তখন ভেঙ্গে পড়েছে। ১৮৭২ সালে মানভূমে পঞ্চকোট রাজ্যের আইন-উপদেষ্টার পদটি তিনি গ্রহণ করেছিলেন। কিন্তু কয়েক মাসের মধ্যেই কাজটি তিনি ছেড়ে দিলেন।
কবি আবার আইন ব্যবসায়ে ফিরে এলেন। কিন্তু এখন তিনি নানা রোগে জীর্ণ। জীবন নিঃশেষিত প্রায়। কবি শেষ জীবনে নানা সময়ে সাময়িক কারণে কয়েকটি সনেট এবং সনেটকল্প কবিতা লিখেছিলেন। কতকগুলো অসমাপ্ত থেকে গিয়েছে। ‘মায়া-কানন’ নামে একটি নাটক সম্পূর্ণ করেছিলেন। ‘বিষ না ধনুর্গুণ’ নামে আর-একটি নাটক হয়তো আরম্ভ করেছিলেন। তার কোনো খোঁজ মেলেনি। ‘হেক্টর-বধ’ নামে একটি গদ্য আখ্যান সম্পূর্ণ আকারেই এই পর্বে প্রকাশিত হয়েছে। এই পর্বে কবির সাহিত্যসাধনা যেমন খণ্ডিত তেমনি ক্লান্ত। দীপশিখা আজ নির্বাণোন্মুখ।
মধুসূদন খুবই অসুস্থ হয়ে উত্তরপাড়ার জমিদারের লাইব্রেরি-গৃহে বাস করতে গেলেন। রোগযন্ত্রণা, অর্থাভাব, ঋণ সব মিলে মধুসূদনের এই শেষজীবন বড়ই দুঃখবহ হয়ে পড়েছিল। ক্রমে তিনি উত্থান শক্তিরহিত হয়ে পড়লেন। উত্তরপাড়ায় রোগের উপশম হলো না দেখে তিনি সপরিবারে বেনেপুকুর রোডের বাড়িতে চলে এলেন। পত্নী হেনরিয়েটাও তখন শেষশয্যায়। অবশেষে মুমূর্ষু মধুসূদনকে জেনারেল হাসপাতালে ভর্তি করা হলো। ইউরোপীয়ান ছাড়া সেকালে এ হাসপাতালে অপর কোনো শ্রেণীর প্রবেশাধিকার ছিল না। কিন্তু তখন আর চিকিৎসা করে রোগ সারাবার অবস্থা ছিল না।
১৮৭৩ সালে ২৬ জুন হেনরিয়েটা পরলোকগমন করলেন। মুমূর্ষু কবি হাসপাতালে সে সংবাদ শুনে শুষ্ককণ্ঠে রুদ্ধস্বরে কেবল বললেন, ‘জগদীশ! আমাদিগের দুইজনকেই একত্র সমাধিস্থ করিলে না কেন? কিন্তু আমার আর অধিক বিলম্ব নাই, আমি সত্বরই হেনরিয়েটার অনুবর্তী হইবো। এই শোক সংঘাতেই মধুসূদনের জীর্ণ বক্ষপিঞ্জর চূর্ণ হইয়া গেল!’ ১৮৭৩ সালের ২৯ জুন রোববার বেলা দুটোয় কবি মধুসূদন প্রাণত্যাগ করলেন।
লেখক : মোঃ নূর ইসলাম খান অসি। নাট্যকার, প্রবন্ধকার ও সংগঠক। সাবেক পরিচালক, ঘূর্ণিঝড় প্রস্তুতি কর্মসূচি (সিপিপি), দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়, গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার । মোবাইল : ০১৭১১-৫৮৫৮৭৫