প্রকাশ : ০৬ ডিসেম্বর ২০২২, ০০:০০
নদীমাতৃক বাংলাদেশের সোঁদা মাটির গন্ধ গায়ে মেখে বড় হয়েছেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। দক্ষিণ বাংলার জল-হাওয়ায় খোকা হতে মিয়া ভাই আর মিয়া ভাই হতে শেখ মুজিবুর রহমানরূপে বেড়ে ওঠা বঙ্গবন্ধু একজন আজন্ম সংগ্রামী রাজনীতিবিদ। তাঁর ভাষণের ইন্দ্রজালে বিমুগ্ধ হয়েই পশ্চিমা গণমাধ্যম তাঁকে পোয়েট অব পলিটিক্স অভিধায় অভিহিত করেছে। বঙ্গবন্ধুর অনন্য বাগ্মিতা যেমন সর্বজনবিদিত তেমনি তাঁর কলমের শাণিত শিল্পের কথাও আজ দিকে দিকে ছড়িয়ে পড়েছে 'অসমাপ্ত আত্মজীবনী'র মতো কালজয়ী সুখপাঠ্য গ্রন্থের মাধ্যমে। বিভূতি ভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায় যেমন বাংলা সাহিত্যে ‘পথের পাঁচালী’ দিয়ে অমর হয়ে আছেন, যেমন অমর হয়ে আছেন মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় তাঁর ‘পদ্মা নদীর মাঝি’ উপন্যাসের আখ্যানে কিংবা তারা শংকর বন্দ্যোপাধ্যায়কে যেভাবে কালজয়ী করে তুলেছে তাঁর ‘কবি’ উপন্যাসখানি, ঠিক তেমনি করেই রাজনীতিবিদ ও রাষ্ট্রনায়ক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান অমর হয়ে আছেন ও থাকবেন তাঁর ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’তে। গ্রন্থটিকে আত্মজীবনী বলা হলেও এটি আসলে সমকালের জীবনবেদ। এই গ্রন্থে যেমন রাজনৈতিক সময়ের পাঁচালী বিধৃত আছে, তেমনি বিধৃত আছে ব্যক্তি মানস। গ্রন্থটি একাধারে তাঁর ভ্রমণ বৃত্তান্তকে যেমন করে ধারণ করে, ঠিক তেমনি করেই ধারণ করে তাঁর কারাজীবনের সংগ্রামকে। আবার সংসারী মুজিবকেও গ্রন্থটি সমান গুরুত্বে পাঠকের কাছে পরিস্ফুটিত করে, যেমন করে পরিস্ফুটিত করে তোলে রাজনীতিবিদ শেখ মুজিবুরকে। ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’ আমাদেরকে বঙ্গবন্ধুর পাঠবিশ্ব সম্পর্কে একটি সম্যক চিন্তা নির্মাণ করে দেয়। এতে তাঁর পাঠের রুচি ও আগ্রহ, পাঠের ব্যাপ্তি ও গভীরতা বিষয়ে সুনির্দিষ্ট ধারণা তৈরি হয়ে যায়।
‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’ গ্রন্থটি আমাদেরকে পরিচয় করিয়ে দেয় বঙ্গবন্ধুর ভাষাশৈলীর সাথে। বঙ্গবন্ধু যেমন একদিকে মৃত্তিকালগ্ন ভাষাকে কলমের ডগায় নিয়ে এসেছেন, তেমনি প্রমিত বাংলাকেও আঁকড়ে ধরেছেন সমান দক্ষতায়। মুখের ভাষাকে শেখ মুজিব তাঁর বক্তব্যে যেমন জনপ্রিয় করে তুলেছেন, তেমনি লেখাতেও সমান গুরুত্ব দিয়ে ছাপিয়ে এনেছেন। তিনি এ গ্রন্থে বাগধারা-প্রবাদণ্ডপ্রবচনের যেমন আশ্রয় নিয়েছেন, তেমনি প্রশ্রয় দিয়েছেন লোকভাষার শব্দভা-ারকেও। তিনি আমাদের দক্ষিণ বাংলার ধান কাটার ‘দাওয়াল’ শ্রেণির পেশাজীবীকে যেমন পরিচয় করিয়ে দেন, তেমনি ভাষা না বুঝলেও কাওয়ালদের সুরকেও শ্রবণে এনে দেন তাঁর সুললিত বর্ণনায়। জেলখাটা দাগী আসামীদের গলার 'খোকর' এর সন্ধান আমরা যেমন পাই তেমনি পাই নৌপথে দুর্ধর্ষ ডাকাতদের যারা মুজিবের নাম শুনে সসম্ভ্রমে ছেড়ে দেয় নৌকাকে। ‘পণ্ডিত হওয়া’ বাগধারার শ্লেষ আমরা যেমন পেয়েছি, তেমনি পেয়েছি ‘কপাল’ বলে প্রগাঢ় আক্ষেপের দীর্ঘশ্বাসকেও। এসব বাগধারার পাশাপাশি ‘যেই না মাথার চুল তার আবার লাল ফিতা’র মতো প্রবাদকেও তিনি পাঠকের সামনে নিয়ে এসেছেন অতুলনীয় দক্ষতায়।
মুজিব তাঁর ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’ গ্রন্থে বাংলার প্রকৃতিকে এঁকেছেন শিল্পীর চোখ নিয়ে সাদা-কালো হরফে। তাঁর বর্ণনায় মধুমতী নদী যেন জীবন্ত হয়ে উঠেছে। ফরিদপুর আর খুলনাকে আলাদা করে ছুটে চলা মধুমতী মুজিবের সখা। সেই নদীর বুকের ওপর রাতের গভীরে যখন তিনি ছুটে যান তাঁর গ্রামের ঠিকানায়, তখন আমাদের চোখের ওপর দিয়েই যেন বাসুকীর কুণ্ডলীর মতো ছুটে যায় তাঁর আবাল্য সখা মধুমতী। কৃষ্ণনগরে স্কুল উদ্বোধন করে ফেরার পথে আশুগঞ্জের কাছাকাছি এসে মুজিব নদীতে নৌকায় বসে গান শোনেন আব্বাসউদ্দিনের দরাজ কণ্ঠে। সেই গান শোনার সময় তিনি নদীর যে বর্ণনা দেন তাতে মনে হয়, নদী যেন আমারও কানে ফিসফিস করে বলে যায় তার গান শোনার উপলব্ধির কথা। শেখ মুজিবের চোখে নদী তখন হয়ে ওঠে আব্বাসউদ্দিনের গানের মগ্ন শ্রোতা। ফরিদপুর-মাদারীপুরের কাছে সিন্ধিয়াঘাটের যে বর্ণনা শেখ মুজিব এঁকেছেন তাঁর ভাষ্যে, তাতে তিন নদীর সঙ্গম জীবন্ত হয়ে ওঠে রাতের নান্দনিক সমাহারে। বাঙালির পরশ্রীকাতরতা নিয়ে ক্ষোভের কথা বলতে গিয়ে মুজিব এ মাটির সুজলা-সুফলা উর্বরতাকে ফুটিয়ে তুলেছেন অত্যন্ত যথার্থতায়। তাঁর আফসোস, এ রকম উর্বর ভূমি অন্যরা যদি পেতো তবে কী না করতো।
নিজের জন্মভূমির রূপ-রস তিনি আরো গভীরভাবে অনুভব করেন লাহোরে গিয়ে। নাতিশীতোষ্ণ জন্মভূমিতে তাঁর শীতকাল কেটে যায় একটামাত্র চাদর গায়ে দিয়ে। কিন্তু লাহোরের শীতে তাঁর সেই অভ্যস্ত জীবনের স্বাভাবিকতা টুটে যায়, শীত তাঁকে কাবু করে ফেলে সহজেই। এভাবে লাহোরের শীতকে কয়েকটা শব্দে উন্মোচিত করে তিনি নিজ জন্মভূমির আরামদায়ক আবহাওয়াকে প্রকাশ করেন নিজের বেকায়দার অনুভূতিতে। শুধু তাই নয়, লাহোরের জেল জীবনও তাঁর কাছে আপন জন্মভূমিতে কাটানো কারাজীবনের চেয়ে কষ্টকর, কেননা, বাংলাদেশের (তৎকালীন পূর্ব বঙ্গ) জেলে ভাত-মাছ পাওয়া যায় কিন্তু লাহোরের জেলে কেবল রুটি আর মাংসের শুকনো খাবার। শেখ মুজিবের এই বর্ণনা জন্মভূমিকে মহিমান্বিত করে তোলে। লাহোরে দীর্ঘ ভ্রমণে তাঁর কাছে পশ্চিম পাকিস্তানিদের রূঢ়তার কারণ আবিষ্কৃত হয়। তিনি বুঝতে পারেন, পশ্চিম পাকিস্তানে বাংলাদেশের মতো নদী নেই, নেই সবুজের প্রাচুর্য। তাই তাদের মনও কঠিন। পক্ষান্তরে বাঙালির মন পলিমাটির মতোই কোমল ও মানবিক। পশ্চিম পাকিস্তানে মরুভূমির বালির মতো মানুষের মন। বালি যেমন উড়ু উড়ু তেমনি তাদের মনেরও কোনো নিজস্ব নিকেতন নেই, উড়নচণ্ডী যেন। দুদেশের প্রকৃতির তুলনার মাধ্যমে স্বদেশের প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের যে চমৎকার বর্ণনা তিনি তুলে ধরেছেন তাতে কেবল জন্মভূমির প্রতি তাঁর প্রেমই প্রকাশিত হয়নি, বরং একজন সাহিত্যিকের দৃষ্টিতে দুই আবহাওয়ার ব্যবধানে মনোজগতের নির্মাণের বৈপরীত্য ফুটে ওঠে। এ প্রসঙ্গে বলতে হয়, ‘আমার দেখা নয়া চীন’ গ্রন্থেও শেখ মুজিবুর রহমান নিজেকে পানির দেশের মানুষ হিসেবে উল্লেখ করে বাংলাদেশের নদীমাতৃক সৌন্দর্য ও নৌ-চালনায় অভ্যস্ততার চিত্র ফুটিয়ে তুলেছেন।
লেখক তাঁর ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’ গ্রন্থে অত্যন্ত স্বল্প পরিসরে ‘দাওয়াল’দের কথা উলেখ করে ধান কাটার মৌসুমের বাংলাদেশকে এঁকেছেন অত্যন্ত সুনিপুণতায়। হেমন্তে পাকা সোনার ধানে বাংলার মাঠ-ক্ষেত ও নিচু জমি ভরে যায় সোনালি ধানের অমলিন হাসিতে। এ সময় ধানগুলো একত্রে পেকে ওঠে। এই পাকা ধান দ্রুত কেটে গোলায় ওঠাতে হয়। কিন্তু স্থানীয় মানুষের পক্ষে দ্রুত এতো ধান কাটা সম্ভব হয় না। তাই এ সময় ডাক পড়ে দাওয়ালদের। দাওয়ালেরা ফরিদপুর, খুলনা এলাকা হতে বরিশাল, সিলেট, চট্টগ্রামে গিয়ে ধান কেটে দিয়ে আসে। ধান কাটতে যেতে হলে তারা অন্যের নৌকা ভাড়ায় নিয়ে যায় এবং ধান কাটার মজুরি হিসেবে প্রাপ্ত ধানের অর্ধেক ভাগ নৌকার মালিককে দিয়ে দিতো। এর ফলেও তারা যে ধান পেতো তাতে তাদের সারা বছর চলে যেতো খেয়ে-পরে। দাওয়ালদের কাটা ধানের নিজেদের অংশ যখন নৌকা বোঝাই করে নদীপথে পাঠানো হতো আপন গন্তব্যে, তখন সেই দৃশ্য মনে হতো যেন কোনো শিল্পীর তুলিতে আঁকা। লেখক তাঁর আপন বর্ণনায় চমৎকারভাবে মিঃ রাইন নামক ইংরেজের কারণে উদ্ভূত দাওয়ালদের সমস্যা নিরসনের কথা বলতে গিয়ে ঋতুবৈচিত্র্যের বাংলাদেশকেও এখানে ফুটিয়ে তুলেছেন। সত্যিকার অর্থেই ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’ কেবল শেখ মুজিবুর রহমানের জীবনের ভাষ্যে সীমাবদ্ধ থাকেনি, বরং এটা হয়ে উঠেছে সাদা-কালো হরফে আঁকা এক গরীয়সী বাংলাদেশের অনিন্দ্য প্রতিকৃতি।
ছবি আঁকিয়ে প্রাতঃস্মরণীয় শিল্পীদের তালিকায় এক অগ্রগণ্য নাম অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের আদরের ভ্রাতুষ্পুত্র অবনীন্দ্রনাথের চিত্রকলা সম্পর্কে বলা হয়, ‘অবনঠাকুর ছবি আঁকে না, ছবি লেখে।’ অর্থাৎ তাঁর আঁকা ছবি লেখার মতো সহজেই পাঠযোগ্য এবং অনুধাবনযোগ্য। বঙ্গবন্ধু বিরচিত ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’ গ্রন্থটিও অবন ঠাকুরের ছবি লেখার মতো হরফে আঁকা এক অনিন্দ্য বাংলাদেশ। এ কেবল প্রকৃতির শোভা কিংবা জল-হাওয়ার সমৃদ্ধি নয়, বরং তাতে বিধৃত আছে বাঙালি পিতামাতার আদর-স্নেহ-মমতার আখ্যান। আরো আছে বাংলার জনগণের কোমল মনের অমল পরশ। বুড়িমায়ের হাতে একবাটি দুধ আর চার আনা পয়সার কথা আমরা যেমন এই গ্রন্থে নেতা মুজিবের জন্যে স্নেহাশিস হিসেবে পেয়েছি, তেমনি পেয়েছি গ্রাম বাংলার মানুষের সরল জীবনের প্রতিচ্ছবি। যদিও ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’ গ্রন্থটি একজন রাজনীতিকের নির্মিত হওয়ার জীবনচিত্র, তবুও এর মাধ্যমে ফুটে ওঠা বাংলাদেশের প্রতিকৃতির আবেদনও তাতে কম নেই। এক কথায় বলতে হয়, ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’ গ্রন্থটি একজন রাজনীতির কবির মনের হরফে এঁকে রাখা এক মনোরম বাংলাদেশ।