প্রকাশ : ২৪ অক্টোবর ২০২২, ০০:০০
মানব জীবনচক্রের Teen Age শুরুর পূর্ব পর্যন্ত সময়কালটি হলো শৈশব। মানবজীবনকে সার্থক, নৈষ্ঠিক এবং সর্বস্তরে পরিপূর্ণ করার প্রধান ভিত্তি হলো মায়ের কাছ থেকে নৈতিকতার মৌলিক শিক্ষা। এ থেকে বঞ্চিতরা হতভাগ্য এবং জীবনের মূলধারা থেকে ছিটকে পড়ে যায়।
মাতৃক্রোড় থেকে বেরিয়ে এসে কবে, কখন শৈশবের দুরন্তপনায় মেতে উঠেছিলাম তা বিস্মৃতির অতলে ডুবে গিয়েছে। স্মৃতি অতিশয় নিষ্ঠুর। বারবার স্মৃতি গহ্বর থেকে বেরিয়ে এসে মনের পর্দায় উঁকি-ঝুঁকি মেরে বেঘোরে বেদনাহত করে তোলে। প্রত্যেকটি শৈশব স্মৃতি মনের অবচেতন কুঠুরিতে জড় হয়ে আছে। জাগতিক ভাইরাস কিন্তু কম্পিউটারে স্মৃতিকোষকে অকেজো করতে পারে। কিন্তু জীবনের স্বাভাবিক অবস্থার সুখকর অথবা বেদনাহত স্মৃতিগুলো এমনভাবে কুঠুরিতে সুসজ্জিত থাকে, যেনো চাহিবা মাত্র পর্দায় ভেসে উঠে। সুখকর স্মৃতিগুলো মানুষকে আনন্দের আতিশয্যে ভাসিয়ে দেয়। আবার মন্দ স্মৃতি মুহূর্তের মধ্যেই মানুষকে বেদনাহত করে তোলে। বিশ্বপ্রপঞ্চের মধ্যে ইন্দ্রিয়গ্রাহ্যাতীত তা একটি স্বকপোলকল্পিত অনুভূতি মাত্র।
আমার বাবা বাবুরহাট উচ্চ বিদ্যালয় থেকে লেখাপড়া শেষ করে অবিভক্ত পশ্চিম বাংলায় আয়ুর্বেদ শাস্ত্রে লেখাপড়া করেন। পরবর্তীকালে দেশে প্রত্যাবর্তন করে একজন স্বনামধন্য আয়ুর্বেদীয় চিকিৎসক হয়ে যান। এঁরা জনসাধারণ্যে ‘কবিরাজ’ নামে খ্যাত ছিলো। কালক্রমে এ চিকিৎসায় ভাটা নেমে আসে। আমার ‘মা’ও বাবুরহাট উচ্চ বিদ্যালয় থেকে ‘মাইনর’ পর্যন্ত লেখাপড়া করেই বিবাহিতা হয়ে যান। আমি আমার পিতা-মাতার চতুর্থ সন্তান।
যখন বয়সটা তিন হতো তখনই একজন শিক্ষাগুরু নির্দিষ্ট সময়ে শ্লেট-পেন্সিল দ্বারা সর্বপ্রথম কয়েকটি স্বরবর্ণ এবং কয়েকটি ব্যঞ্জনবর্ণ লিখিয়ে আনুষ্ঠানিকভাবে লেখা শেখাতেন। এ অনুষ্ঠানটি ‘হাতেখড়ি’ দেয়া নামে অভিহিত হতো। বাবা প্রত্যুষেই ঘুম থেকে জেগে উঠেই আমাকে আদর্শলিপির বর্ণভিত্তিক নীতিবাক্যগুলোকে মুখস্থ করাতেন। যেমন : অসৎ সঙ্গ ত্যাগ কর/আলস্য দোষের আকর ইত্যাদি আর যত্ন করিলে রত্ন মিলে/লম্ফ দিয়া পথ চলিও না ইত্যাদি নৈতিক শিক্ষা রপ্ত করাতেন।
শয্যা ত্যাগের পর পরই প্রক্ষালন কক্ষে যেতে হতো। তারপর মায়ের উপদেশ মতো নিয়মিত মুখ ধোয়া এবং দাঁত মাজা ছিলো আবশ্যিক কাজ। বলা বাহুল্য, তখন ছাঁই অথবা কাঁকড়া মাটি ছিলো গ্রামে-গঞ্জে দাঁত মাজার প্রধান উপকরণ। শেষ পর্বের কাজটি হলো প্রাতঃরাশ। সে সময়ের প্রাতঃরাশের উপাদন ছিলো চিড়া-মুড়ি-খৈয়ের যে কোনো একটি, আর এক টুকরা গুড়। এর সাথে কখনো থাকতো নারিকেলের কোঁড়া।
তারপর মমতাময়ী মায়ের নির্দেশে শ্লেট-পেন্সিল-আদর্শলিপি বই এবং এক টুকরা ন্যাকড়া নিয়ে মায়ের পাশে বিছানো এক টুকরা ‘চিয়নীতে’ বসে পড়তাম। মা সস্নেহে আরো একটু কাছে টেনে নিয়ে হাতে হাত ঘুরায়ে বর্ণমালার সুস্পষ্ট লেখার ধরণ শিখিয়েছেন। আরো বুঝিয়েছেন স্বরবর্ণের সাথে ব্যঞ্জনবর্ণের অবিচ্ছেদ্য সম্পর্ক রয়েছে। যেমন ‘ই’-এর প্রতীক ‘-িকার’, ‘উ’-এর প্রতীক ‘ ু-কার’, এ-এর প্রতীক ‘-েকার’ ইত্যাদি প্রত্যেকটি স্বরবর্ণের পৃথক ব্যঞ্জন প্রতীক আছে। যা ব্যতীত বাংলা শব্দ উচ্চারিত হতে পারে না। এখানে বিশেষভাবে উল্লেখ্য যে, ‘হাতেখড়ি’ অনুষ্ঠানের পর থেকে কিছুকাল অবধি বাঁশের কঞ্চি দিয়ে কড়াইয়ের তলার কালি দ্বারা কদলি পত্রে স্বরবর্ণ এবং ব্যঞ্জন বর্ণ লেখার চেষ্টা করতে হতো। পিতা-মাতাই নৈতিক শিক্ষার এবং মৌলিক শিক্ষার মেরুদণ্ডের কারিগর। পরিণত বয়সে এটুকু শুধু উপলব্ধি করলাম যে, মৌলিক প্রাথমিক শিক্ষার স্তরে সীতানাথ বসাক রচিত নৈতিক শিক্ষাসম্বলিত সমতুল্য পুস্তক বাংলায় অদ্বিতীয়। শুধুমাত্র ঈশ্বর শব্দটির স্থলে ‘স্রষ্টা’ শব্দটি প্রতিস্থাপিত হলেই বোধ হয় কোনো সমস্যা থাকে না।
প্রভাতকালীন বাংলার প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের যে অপরূপ বর্ণনা কবিতায় ভেসে উঠেছে তা শিশুদের মনোমুগ্ধকর এবং বাস্তব। যেমন : ‘পাখী সব করে রব রাতী পৌহাইল’...কবিতার পংক্তিগুলো।
পাঁচ বছর বয়সে প্রথম শ্রেণীতে ভর্তি হয়ে যাই। এখানেই শতকিয়া, কড়াকিয়া, পনকিয়া, গ-াকিয়া, চার পয়সায় এক আনা-ষোল আনা বা চৌষট্টি পয়সায় এক টাকা। সাথে শুভঙ্করের আর্যাসহ পুরো আদর্শলিপি বইখানা পড়ানো দ্বিতীয় বারের মতো শেষ করানো হতো। দ্বিতীয় শ্রেণীতে একখানা বাংলা বই পাঠ্য ছিলো ‘বাল্য শিক্ষা’ নামে। এর মধ্যে নৈতিকতায় ভরপুর কিছু কবিতা এবং গল্প ছিলো। কবিতাগুলো ছিলো ‘সকালে উঠিয়া আমি মনে মনে বলি, সারাদিন যেন আমি ভালো হয়ে চলি’ ইত্যাদি। হরিশ্চন্দ্র মিত্রের লেখা ‘আপনাকে বড় বলে বড় সে নয়’ ইত্যাদি। এখানে টাকাণ্ডআনা পাই, কড়া গ-ার সঠিক লিখন পদ্ধতি শ্লেটে লিখে শিখিয়ে দেয়া হতো। বাংলা সংযুক্তি বর্ণের শিখন এবং উচ্চারণভঙ্গি ধারাবাহিকভাবে শ্লেটে লিখে শেখানো হতো। বাড়ির কাজ যথাযথভাবে শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে পাওয়া না গেলে শিক্ষকগণের ভর্ৎসনা পাওয়া যেতো।
বিদ্যালয় ছুটি হওয়ার অব্যবহিত পরে বাড়ি চলে আসতাম এবং হাত-পা ধুয়ে ভাত খেতে বসতাম, খাওয়া শেষ হওয়ার পর পরই লেগে যেতাম বিদ্যালয়ে দেয়া বাড়ির কাজগুলোকে সামাল দিয়েই শিশুসুলভ দুরন্তপনায় লেগে যেতাম। গ্রামের মেঠো ধব ধবে পথের দু পাশে নবদুর্বাদল শ্যমল চাদর বিছানো পথের পাশে শুধুই ফল আর ফল। যেমন : পেয়ারা-বুতিজামণ্ডকালোজামণ্ডপাকা গাব অথবা বিলাতি গাব তৃপ্তি পূরণ করে খেয়ে বাড়ি চলে আসতাম। আবার কোনো দিন বা দল বেঁধে জংলি পথে বাগান বাড়িতে ঢুকতাম। তখন কিন্তু কম-বেশি সকল বাগানেই বানরের বসতি ছিলো। বাগানগুলোতে আমরা যেসব ফলের সন্ধান পেতাম সেগুলো হলো গুঁড়ি এলনা-জামুল-বকুল-কাউ-মেওয়া, মণ্ডা, লিচু ইত্যাদিসহ আরো কত মৌসুমী ফল।
ছুটির দিনে শুধু খেলা আর খেলা। মুক্তস্থানে সুনির্দিষ্ট আকৃতির কোঠা তৈরি করে হা-ডু-ডু-দাঁড়িয়াবন্ধা-ষোল গুঁটি ইত্যাদি আবার নাড়াক্ষেতে ফুটবল-গোল্লাছুট-ডাংগুঁটি-ভলিবল ইত্যাদি খেলা নিয়মিত চলতো। তখনকার দিনে খেলার মাঠের সংখ্যা অত্যন্ত কম ছিল বিধায় নাড়াক্ষেতকে বিনোদনের বিকল্প মাধ্যম হিসেবে ব্যবহারের প্রচলন ছিলো।
প্রদোষ তিমিরের পূর্বেই আমরা বাড়ি ফিরতাম। আমাদের শৈশবের সেই মধুমাখা স্মৃতিগুলো নির্ঘণ্ট পরম্পরায় বর্তমানে ঢুকে পড়েছে শুধুমাত্র মোবাইল আসক্তিতে। যা শিশু মনের সুবিকাশে মারাত্মক বিকর্ষণ মাত্র। খেলাধুলা-শিক্ষা-নিয়মানুবর্তিতা জীবন গঠনের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ।
বিমল কান্তি দাশ : কবি ও প্রবন্ধকার; অবসরপ্রাপ্ত সিনিয়র শিক্ষক, বলাখাল যোগেন্দ্র নারায়ণ উচ্চ বিদ্যালয় ও কারিগরি কলেজ, বলাখাল, হাজীগঞ্জ, চাঁদপুর।