প্রকাশ : ১৩ ডিসেম্বর ২০২১, ০০:০০
তাজা ইলিশের ঘ্রাণে ছোট্ট এ শহরের আনাচে কানাচের অলিগলি এ'সময় মৌ মৌ করে। সময়টা ঠিক সেপ্টেম্বর। ‘ইলিশের বাড়ি’ নামে খ্যাতি পাওয়া জনপদে কোথা হতে এক পাগলিনী এসে পৌঁছেছে। কীভাবে এসেছে তা কেউ বলতে পারে না। কখন এসেছে ঠিক করে তাও কেউ জানতে পারেনি। তবে সে যে এ এলাকার নয়, এটা নিশ্চিত। কেউই তাকে চিনে না। পাগলিনীর বয়স অনুমানে বলা যায় পঁয়ষট্টির মতো। দুয়েক বছর তারচে’ বেশি হতে পারে। মাথার চুলগুলো সফেদ। যেন একমাথা সজীব কাশফুল নিয়ে সে পথ চলেছে। শহরের রেলওয়ে প্ল্যাটফর্ম হতে শিল্পকলা একাডেমির বারান্দা পর্যন্ত তার আনাগোনা। পাগলদের কোন নাম থাকে না। মানে তাদের সঠিক নাম কেউ উদ্ধার করতে পারে না। তাই নামে পাগলের পরিচয় বহন করে না। পাগলের পরিচয় তার কর্মে বা অ্যাকশনে। ছোটবেলায় এক পাগল দেখেছিলাম সার্কিট হাউজের সামনের রাস্তায়। পাগলটি এক হাত পেতে লোকের কাছে টাকা চাইত। না দিলে অন্যহাতে থাকা কাঁচা মল মাখিয়ে দিত গায়ে-মুখে। মলের ভয়ে পথচারীরা যারা এ পাগলের কর্মকা-ে পরিচিত ছিল তারা আগেভাগে এক টাকা বাগিয়ে ধরে দ্রুত হেঁটে বাঁচতো। এ পাগলের নাম ছিল মল পাগল। টাকা নিতো দেখে অনেকেই ডাকতো মল ফকির নামে। আরেকটা পাগল নিউ মার্কেটের জিরো পয়েন্টে দাঁড়িয়ে ট্রাফিক কন্ট্রোল করতো। যদি ট্রাফিকের পোশাক তার গায়ে থাকতো তবে কেউ বুঝতো না আদৌ সে পাগল না ট্রাফিক। পাগলা ট্রাফিক নামে পরিচিতি পাওয়া সেই পাগল কে আজ আর তেমন দেখা যায় না। অনেকের ধারণা, পাগলটি কোন নাট্যদলে ট্রাফিকের ভূমিকায় অভিনয় করতো। আরেক পাগল ছিল নদীর ধারে বসে মনের সুখে গান করতো। কেউ এক আধটুকু সিগারেট বা বিড়ির ভাগ দিলে সে কৃতজ্ঞচিত্তে চেয়ে থাকতো আর গান ধরতো। সব পুরানো দিনের সিনেমার গান। গান শুনে বুঝা যেতো পাগলটি সিনেমাখোর ছিল। হয়তো প্রেমে প্রত্যাখ্যাত হয়ে পাগল হয়ে গেছে। এ পাগলের গানগুলো সবই বিরহের গান। শুনলেই বুঝা যেত, এ হলো ছ্যাঁক খাওয়া পাগল। যে নবাগতা বৃদ্ধ নারী পাগলের কথা বলছি তার আচার-আচরণে তেমন কোন বৈশিষ্ট্য আজও চোখে পড়েনি। মাঝে মাঝে তার মুখ দিয়ে থুথু মারে নিজের দিকে। তবে থুথু আসলে মারে না। ভান করে থুথু মারার। প্রৌঢ়া পাগলিনীর গঠন চিকন। কিন্তু গলার স্বরে প্রচ- শক্তি ধরে। মাঝে মাঝে চিৎকার দেয়, জয় বাংলা। মাঝে মাঝে পাগলিনীর চোখেমুখে উদাস শূন্যতা ভর করে। বুঝা যায়, তখন তার পাগলামো কমে আসে।
পাগলের নিজের চাহিদা কম। কখন খায় কোথায় শোয় তার ঠিক নেই। তবে শিল্পকলার ক্যান্টিনের পাশে টংয়ের দোকানের চা দিলে সে বেশ আগ্রহভরে খায়। এককাপ চা-ই যেন তার আজীবন স্বপ্নসাধ। প্রৌঢ়ার গায়ের বর্ণ দেখে বুঝা যায়, কালে সে সুন্দরীই ছিলো। অনেক পাগলের কথায় মন্দ গালাগাল থাকে। তবে এর কথা শালীনই বলা যায়।
সেপ্টেম্বর এলেই ইলিশের বাড়িতে উৎসবের ধূম পড়ে। সাতদিন ধরে শিল্পকলাতে চলে আনন্দ-যজ্ঞ। ছোটদের-বড়দের, পুরুষের-নারীদের, কর্তার-গিন্নীর সবার উৎসব। জেলেরাও আসে। আসে ইলিশের ভোক্তারাও। মূলতঃ জাটকা ইলিশ রক্ষার প্রচারণা চালিয়েই এ উৎসব। সামাজিক একটি আন্দোলনকে আয়োজকের মুন্সীয়ানায় সাংস্কৃতিক উৎসবে রূপদান। এ উৎসবের যে রূপকার তার আসল নাম ভুলে সবাই তাকে বয়াতি বলেই ডাকে। খুব মজার মানুষ। অসম্ভব তার সাংগঠনিক শক্তি। তবে মাইক হাতে পেলে অনবরত বলতে পারে লোকটি। সাতদিনের দক্ষযজ্ঞে ম্যালা হ্যাপা পোহাতে হয় লোকটিকে। মাঝে মাঝে অনুষ্ঠানের ফাঁকে ফাঁকে কে কত অনুদান দিলো তা ঘোষণা করে নিজেকে অনুপ্রাণিত রাখার সর্বাত্মক চেষ্টা করে বয়াতি।
আশেপাশের জেলা তো বটেই, খোদ রাজধানী ছাপিয়ে পাশের দেশ থেকেও সাংস্কৃতিক সংগঠনগুলো আসে এ উৎসবে। প্রতিদিন রাতে সবার শেষ পরিবেশনা থাকে নাটক। আজকের নাটকের নাম ‘বীরাঙ্গনা’। ক’দিন আগে থেকেই এ নাটকের পোস্টার সাঁটানো ছিলো শিল্পকলা একাডেমির দেয়ালে। পাগলিনী বেশ আগ্রহভরে সে পোস্টারের দিকে তাকিয়ে থাকতো। পোস্টারে ছিল একটি ষোড়শী ভীত সন্ত্রস্ত তরুণী ও তার দিকে পাশবিক দৃষ্টি হেনে আগুয়ান এক পাকিস্তানী মেজরের ছবি। সে ছবি দেখে পাগলিনীর যেন নিজেকে নিজে থুথু দেওয়ার প্রবণতা বেড়ে যায়। মাঝে মাঝে তাকে গোঙাতেও দেখা গেছে।
নাটকের শুরুতে পাগলিনীকে শিল্পকলার বাইরে দেখা গেছে। আজ তার মন-মেজাজ বেশ ফুরফুরে। একটু পরেই নাটক শুরু হবে। নাটকের পরিবেশনার আগে দর্শকদের হাতে একটা করে লিফলেট বিতরণ করা হলো। লিফলেটে আছে কাহিনী সংক্ষেপ এবং প্রযোজনার পরিচিতি। নাটকটি দুইঘন্টার। নাটকটি যিনি রচয়িতা তিনিই নির্দেশক।
কেন্দ্রীয় চরিত্রে যে অভিনয় করছে তার বয়স ষোল। মেয়েটি বীরাঙ্গনার কঠিন চরিত্রে রূপদান করছে। একাত্তরে পাকিস্তানী হানাদার বাহিনীর নির্মম অত্যাচারই নাটকের মূল বক্তব্য। নাটকের শুরুতেই বঙ্গবন্ধুর সাত মার্চের ভাষণ বেজে উঠলো। হলভরা মানুষের মধ্যে বাঙালির রক্তে দোলা দেওয়া এ ভাষণের চুম্বক অংশ বাজানো হলো। হলের ভিতর বঙ্গবন্ধুর বজ্রকণ্ঠ যেন সবাইকে মন্ত্রমুগ্ধ করে রাখলো। ভাষণে বঙ্গবন্ধু আদেশ দিচ্ছেন, ‘যার যা কিছু আছে তা-ই নিয়ে প্রস্তুত থাকো। মনে রাখবা, রক্ত যখন দিয়েছি রক্ত আরো দেব। তবু বাংলার মানুষকে মুক্ত করে ছাড়বো ইনশাআল্লাহ। বাংলার মানুষকে আর দাবায়া রাখতে পারবা না।' বঙ্গবন্ধুর ভাষণ শুনে সবার গায়ের রোম খাড়া হয়ে গেল। নাট্যকার বেশ সুন্দর করেই মঞ্চ পরিকল্পনা করেছেন। একদিকে বঙ্গবন্ধুর সাত মার্চের জনসভার একটা ছবি। অন্য অংশে গ্রামের আবহ। সবুজ তরুশোভিত শ্যামল বাংলার যুদ্ধগ্রস্ত এক গ্রাম। গ্রামের নাম বনমায়া। গ্রামজুড়ে সবুজের সমারোহ সেই নামের উৎস বলেই প্রতীয়মান। মঞ্চসজ্জায় সবুজের সেই প্রাধান্য ফুটে উঠেছে। বঙ্গবন্ধুর সাত মার্চের জনসভার প্রভাব ছুঁয়ে গেছে দূরের সেই গ্রামকেও। মঞ্চের এই ম্যাসেজ সবার মনে পৌঁছে গেছে। গ্রামের কয়েকজন স্বাধীনতাকামী তরুণ জনসভায় যোগ দিয়ে বঙ্গবন্ধুর ভাষণ শুনে আবার গ্রামে ফিরে এসেছে। বঙ্গবন্ধুর নির্দেশ মোতাবেক তারা সবাই সংগঠিত হওয়ার চেষ্টা করছে। গ্রামটিতে মুসলিম লীগের প্রভাব বেশি। এই প্রভাব কাটিয়ে স্বাধীনতার দুর্গ গড়ে তোলা চাট্টিখানি কথা নয়। তরুণরা সেই চেষ্টাই করে যাচ্ছে। যে তরুণ এই আন্দোলনে নেতৃত্ব দিচ্ছে তার নাম সংগ্রাম। গ্রামের কলেজে ডিগ্রি পড়ে। বিএসসি। সংগ্রাম বেশ মেধাবী। ইতিহাসের বই পাঠে তার অধিক ঝোঁক। ইংরেজদের একশ নব্বই বছরের দুঃশাসনের ইতিহাস তার মুখস্থ। সংগ্রামের ছোট একটা বোন আছে। ষোড়শী। কৈশোর পেরিয়ে মাত্র পড়েছে যৌবনে। দেখতে মায়াবতী। নাম তার মুক্তি। ভাইয়ের মতো সেও আন্দোলনমুখী। তবে এতো প্রকাশ্যে নয়। যারা তার ভাইয়ের সাথে ঘরে আসে, মিটিং করে সে তাদের কখনো কখনো চা করে খাওয়ায়। আর কখনো তাদের পোস্টার-ব্যানার লিখে দেয়।
পোস্টারে একটা কথা তার খুবই ভালো লাগে, ‘তোমার আমার ঠিকানা পদ্মা মেঘনা যমুনা।’ হলের আলো নিভে আসে। অর্থাৎ প্রথম দৃশ্য শেষ। প্রথম দৃশ্য শেষে সবাই জেনে গেলো, বঙ্গবন্ধু ওয়্যারলেসে ঘোষণা দিয়েছেন স্বাধীনতার।
রাজধানী ঢাকায় যুদ্ধ শুরু হয়ে গেছে। শুঁয়োপোকার মতো গোঁফ নিয়ে দানবাকৃতি পাকিস্তানী আর্মির অপারেশন সার্চ লাইটে হাজার হাজার নিরীহ মানুষ নির্মমভাবে নিহত হয়েছে। ধীরে ধীরে যুদ্ধ ছড়িয়ে পড়েছে গ্রামে গ্রামে। এভাবেই দ্বিতীয় দৃশ্যের অবতারণা। দ্বিতীয় দৃশ্য শেষে জানা গেলো, সংগ্রাম ও তার বন্ধুরা সীমান্ত পাড়ি দিয়ে যুদ্ধে গেছে। মুক্তিদের গ্রামে শান্তি কমিটির সভা বসেছে। সভা থেকে সবাইকে জানিয়ে দেওয়া হয়েছে, এই গ্রামে কোন জয় বাংলা চলবে না। এই গ্রাম শান্তির গ্রাম। শান্তি কমিটির যে চেয়ারম্যান সে মূলত গ্রামের সবচেয়ে বড় কালোবাজারী। তার সাঙ্গপাঙ্গগুলো সব বখাটে বেয়াদব, যারা রাস্তায় রাস্তায় শিস্ মারে আর ঘুরে ফিরে খায়।
শান্তি কমিটির লোকদের মুখে মুখে পেয়ারা পাকিস্তানের কথা। ‘লড়কে লেঙ্গে পাকিস্থান’ই তাদের মূলকথা।
দুটো দৃশ্য মঞ্চায়িত হওয়ার পর মানুষের মধ্যে গুঞ্জন বাড়ে। দর্শকের মধ্যে যারা বয়সে নবীন তারা উসখুস করে। যারা বয়স্ক তারা দম ধরে বসে থাকে যেন একটু নড়লেই সব শেষ হয়ে যাবে। এর মধ্যে কারও ছোট বাচ্চা গরমে কেঁদে ওঠে। শিল্পকলার এসিগুলোর অনেকদিন হয়ে গেছে কোন সার্ভিসিং হয়নি। তাই কার্যকারিতা কমে গেছে। হলভর্তি দর্শকের শীতাতপ নিয়ন্ত্রণে অক্ষম হয়ে গেছে এসিগুলো। পাগলিনী কখন যে শিল্পকলার হলের ভিতরে ঢুকে গেছে জানা গেল না। মঞ্চের কার্যক্রম দেখে তার চোখেমুখে অস্থিরতা তৈরি হয়ে গেছে। মুখের আদলে কিছুটা কাঠিন্য জমা হয়েছে। আলো নিভানো পরিবেশে প্রযোজনার স্বেচ্ছাসেবকেরা সেট পরিবর্তন করে। সবকিছু তৈরি হলে পরে আলো জ্বলে ওঠে। অর্থাৎ তৃতীয় দৃশ্যের শুরু। শুরুতে দেখা যায় মুক্তির গাঁয়ে অন্যঘরে ফর্সা একটা মেয়ের মুখে কালিয়ে মাখিয়ে দিচ্ছে নিজ হাতে তার মা। একটু পরেই এক এক করে হাতে-পায়ে-মুখে কালি মাখানো ষোড়শী মেয়েরা মঞ্চে ভিড় করে। সবাই এ ওর মুখের দিকে চাওয়া-চাওয়ি করে। একজন বলে ওঠে, কী রে আলো! তোর মুখেও কালি লাগাইছে? আলো নামের মেয়েটি জবাব দেয়, হ রে জ্যোৎ¯œা, আমার বাপে কইছে মুখে কালি লাগাইয়া রাখতে। পাকিস্তানী মেলেটারি নাকি গেরামে গেরামে যাইয়া যুবতী মাইয়াদের ধইরা লইয়া যাইতাছে। মুখে কালি লাগাইলে নাকি আর নেয় না। ধূর! কে কইলো? কালি লাগাইলেও ধইরা লইয়া যায়। আমাগো গেরামের শরীফে আছে না, সে হইলো আর্মিগো দালাল। তারে দেখলাম গত কাইল আমাগো বাড়ির আশেপাশে ঘুরাঘুরি করতে। এভাবে সংলাপ আর অভিনয়ে ষোড়শী মেয়েদের শঙ্কা আর আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে দর্শকদের মাঝেও। দর্শকরা অদৃশ্য পাকিস্তানী আর্মিকে গালাগাল দিয়ে খিস্তি করে ওঠে। তৃতীয় দৃশ্যের পর্দা পড়ে যায়। তৃতীয় দৃশ্য শেষে পাকিস্তানী আর্মি আর তাদের এদেশীয় দোসর রাজাকারদের নারী লোলুপতা ফুটে ওঠে। যারা মুক্তিযুদ্ধের সময় বড় ছিলো, তারা এ দৃশ্য দেখে ফুঁসে ওঠে চোখেমুখে। মুক্তিযুদ্ধ-পরবর্তী প্রজন্মের দর্শকেরা অবাক চেয়ে থাকে। পাগলিনী আবার উধাও হয়ে যায় হলের ভিতর থেকে। দৃশ্যান্তরের ফাঁকে সামনের টেবিলে নাস্তাপানি পরিবেশন করে গেছে ক্যান্টিনের বেয়ারা। আজ যিনি প্রধান অতিথি তারে নিয়ে কানাঘুষা আছে বাজারে। একাত্তর সালে তার ভূমিকা পরিষ্কার না। যারা একাত্তরে এই এলাকার মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন তাদের অনেকেই তাকে দেখে শুরুতেই হল ছেড়ে চলে গেছেন। প্রথমে মনে হয়েছিল ব্যাপারটা অন্যকিছু। কিন্তু শেষে বোঝা গেল, কয়েকজন মুক্তিযোদ্ধা ঐ রাজাকার প্রধান অতিথিকে বয়কট করেছেন। কিন্তু আয়োজকরা এ কথা জানলেও তারা চুপ করে ছিলেন, কেন না, উনি বিশাল একটা অঙ্ক পৃষ্ঠপোষকতা করেছেন। নাটক করতে তো পয়সা লাগে। তাই পয়সার জন্যেই তাকে আজ প্রধান অতিথি করতে বাধ্য হয়েছেন নাট্যদলের অধিকর্তা। একটা নাটক নামাতে অনেক খরচ। তিনমাস ধরে একটা নাটক রিহার্সেল দিতে হয়। প্রতিদিন নারী আর্টিস্টদের যাতায়াত ভাড়া দিতে হয়। তারপর দুই দফা চা-বিস্কুট। এরপর নাটকের সেট, মঞ্চভাড়া, কস্টিউম আরও কত কী আছে। পৃষ্ঠপোষকতা না পেলে নাটক নামানোই কঠিন।
চতুর্থ দৃশ্যের সূচনায় নাটকের এ পর্যায়ে শোনা যায় স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের গান। জয় বাংলা বাংলার জয়। কানে রেডিও লাগিয়ে গান শুনছে মুক্তির বাবা। ঘরের দরজা-জানালা আটকানো আছে এমন এক পরিবেশ ফুটিয়ে তোলা হয়েছে। মাঝে মাঝে চরমপত্রের খবর দর্শকদের মজা দিচ্ছিল। একটু পরেই দরোজায় ঠক ঠক। মুক্তিদের বাড়ির ভিতরে নিস্তব্ধতা। হঠাৎ একটা ভয় গ্রাস করে। চাপা একটা শব্দ শোনা যায়, চাচা, আমি আজাদ। আজাদের নাম শুনে মুক্তির বাবা ও মায়ের মুখে স্বস্তি ফিরে আসে। আজাদ হলো সংগ্রামের বন্ধু। সেও মুক্তিযুদ্ধে যোগ দিয়েছিল। সন্তর্পণে দরোজা খুলে তাকে ঘরে ঢুকানো হলো। মুক্তি এক প্লেট খাবার এনে দিল। গপাগপ খেয়ে আজাদ বললো শুকনো খাবার কী আছে তা দিতে। মুক্তির মা বোঁচকা বেঁধে চিড়ামুড়ি দিয়ে দিলো মুক্তিযোদ্ধাদের জন্যে। মুক্তির বাবা আজাদকে বুকে জড়িয়ে বললেন, সংগ্রামকে বলবি, সে যেন দেশ স্বাধীন কইরা গাঁয়ে ফিরে। বড়দের দোয়া নিয়ে আঁধারে পিছনের দরোজা দিয়ে চলে যায় আজাদ। চতুর্থ দৃশ্য যেন দ্রুতই শেষ হয়ে যায়। আজাদের খাওয়ার ভঙ্গি দেখে কেউ কেউ আফসোস করে। আফসোসের দীর্ঘশ্বাস যেন পুরো হলটাতে ছড়িয়ে পড়ে।
দর্শকদের সবাই এতোক্ষণে কাহিনীতে ঢুকে পড়েছে। মনোযোগ বেড়ে গেছে সবার। পাশাপাশি বসে যে ফিসফাস চলছিল তা বন্ধ হয়ে গেছে। হঠাৎ হলজুড়ে শোরগোল শুরু হয়ে গেলো। আস্তে আস্তে পর্দা উঠছে আর এরই মধ্যে শোনা গেল, আর্মি আইছে, আর্মি আইছে। হলের ভিতর দিয়ে একদল অস্ত্রসজ্জিত আর্মির মতো দেখতে, উর্দুতে 'মুক্তি হ্যায়, মুক্তি হ্যায়' বলতে বলতে মঞ্চে উঠে গেলো। মঞ্চে উঠেই তছনছ শুরু করে দিলো তারা। তাদের সাথে জুটেছে গ্রামের শান্তি কমিটির চ্যালা-চামুন্ডা। গ্রামের ঘরগুলোতে আগুন লাগিয়ে দিলো। মুক্তিদের বাড়িতে ঢুকে মুক্তির বাবাকে বেয়নেট দিয়ে খুঁচিয়ে জিঞ্জেস করা শুরু করলো, আপকো বেটা মুক্তিকা বাচ্চা কাঁহা হ্যায়? মুক্তির বাবা যতই বলে, আমি জানিনা, ততই তাকে বেয়নেটের খোঁচা খেতে হয়। একসময় তাদের ঘরেও আগুন লাগিয়ে দেয়। মুক্তির বাবাকে গুলি মেরে মুক্তিকে টেনে হিঁচড়ে নিয়ে চলে যায়। পোড়া ঘর আর মৃত স্বামী আর পাকিস্তানী আর্মির শিকারে পরিণত হওয়া মেয়েকে বাঁচাতে না পেরে মুক্তির মা চেতনা হারিয়ে ফেলে। এরই মাঝে কয়েকজন রাজাকার মুক্তিদের বাড়ি হতে সিন্দুক বের করে সোনাদানা খুঁজে নিয়ে চলে যায়। পঞ্চম দৃশ্য শেষে পুরো হলজুড়ে নেমে আসে নিস্তব্ধতা। পরবর্তী দৃশ্যের জন্যে আলো নিভে যায়।
এরই মধ্যে পাগলিনী আবার শিল্পকলার হলে ঢোকে। তার প্রতি গেটের দায়িত্বে থাকা ছেলেদের মায়া পড়ে গেছে। তারা তাকে আর বাধা দেয় না। সে তার ইচ্ছেমতো ঢোকে আর বের হয়। এবার ঢুকে সে তার হাতে কাপড়ে প্যাঁচানো কী একটা ধরে রাখে। অন্ধকারে ভালো দেখা যায় না। নাটকও আর বেশি নাই। যারা অভিনয় করছে তাদের কেউই পেশাদার শিল্পী নয়। পেশাদার শিল্পী পাওয়া আসলে মফস্বলে সম্ভবও নয়। এসব জায়গায় এখনও কেউ নগদ টাকায় টিকিট কেটে নাটক দেখে না। তবুও নাটকের প্রতি, শিল্পের প্রতি অসম্ভব ভালোবাসা থেকেই তারা অভিনয়কে নিজের জীবনের সাথে জড়িয়ে রেখেছে। মফস্বলের শিল্পকলা একাডেমিতে প্রতিধ্বনি আটকানো কঠিন। সাউ- প্রুফের উপযুক্ত ব্যবস্থা এখানে নেই। একবার এই মঞ্চে দেশের বিখ্যাত লালনশিল্পী এসে বিরক্ত হয়ে গেছেন সাউ- প্রুফ না দেখে। এরকম একটা বিরূপ পরিবেশে প্রযোজনাকারী নাট্যদল প্রচুর মুন্সীয়ানা দেখিয়েছে। পরবর্তী দৃশ্য শুরু হলো। মঞ্চের সেটে কিছুটা পরিবর্তন এসেছে। একটা আর্মি ক্যাম্প। তাতে জড়ো করা হয়েছে দুপুরে গ্রাম থেকে ধরে আনা ষোড়শী মেয়েদের। এর মধ্যে মুক্তিও আছে। আছে আলোরাও। টেনে হিঁচড়ে একে একে সবাইকে আর্মির মেজরের সামনে হাজির করছে রাজাকার চ্যালারা। গায়ের বস্ত্র প্রায় টেনেটুনে ছিঁড়ে ফেলেছে। জড়ো করা মেয়েদের দিকে তাকিয়ে আস্তে আস্তে মেজর মুক্তির সামনে এলো। মুক্তির চিবুকে হাত দিয়ে মুখের দাঁতগুলো বের করে সে তার চ্যালা রাজাকারদের বলে, ইয়ে বহুত আচ্ছা হ্যায়। রাজাকার শয়তানও তার দিকে মুখ ব্যাদান করে বলে, হুজুর মেরা মা-বাপ। আপকি লিয়ে বান্দা হাজির। কথা শুনে মেজর হাসি দিয়ে সবাইকে বাম হাতে ইশারা করে। ঘরে থাকা অন্য মেয়েদের পেছনের কক্ষে নেওয়া হয়। ওখানে রাজাকাররা হামলে পড়ে। মেজরের কক্ষে কেবল জড়সড় মুক্তি আর শ্বাপদ মেজর। মেজর সিগারেট ধরিয়ে ধোঁয়া ছাড়ে মুক্তির মুখেচোখে। মুক্তি একদলা থুথু মারে মেজরের মুখে। মেজর ক্ষেপে যায়। মুক্তির গায়ে ধাক্কা মেরে খাটে ফেলে দেয়। তারপর নিজে উঠে বসে শায়িত দেহের উপর। মুক্তি চিৎকার করে, বাঁচাও বাঁচাও! সমস্ত হলজুড়ে এক ধরণের অস্থিরতা বিরাজ করে। কেউ কিছু বুঝে উঠার আগেই পাগলিনী দৌড়ে উঠে পড়ে মঞ্চে। কেউ বাধা দেওয়ার আগেই হাতের লোহার ডা-া দিয়ে সে ইচ্ছেমতো মেজরের গায়ে আঘাত করে আর বলতে থাকে, একাত্তর সালে আমারে করছস, কিন্তু অহন আর কাউরে করতে দিমু না, দিমুই না। আহত অভিনেতা মেজর পড়ে থাকে মঞ্চে আর দর্শক নিজের অজান্তেই হাতে তালি দিয়ে ওঠে। ডা-া হাতে রক্তচক্ষু, ঘর্মাক্ত দেহের কৃশকায় পাগলিনীকে মুহূর্তের মধ্যেই মনে হয় চিরকালীন এক সিংহী যার গর্জনে প্রকম্পিত সমগ্র বাংলাদেশ। পাগলিনী হঠাৎ চিৎকার দিয়ে ওঠে, ‘জয় বাংলা’। পাগলিনীর সেই চিৎকার ক্রমশ প্রতিধ্বনিত হতে থাকে। এ ধ্বনি ঢুকে যায় নতুন প্রজন্মের কর্ণকুহরে। এ ধ্বনি আন্দোলিত হতে থাকে সমগ্র শিল্পকলার দেয়ালে-বাতাসে।