প্রকাশ : ২৬ ডিসেম্বর ২০২৩, ০০:০০
শিক্ষাক্রম প্রসঙ্গ : কথা আর কাজ-এই তো মানুষ
মানুষের কর্মের সঙ্গে তার মূল্যবোধের সম্পর্ক সবচেয়ে গভীর ও তাৎপর্যময়। দক্ষতা, সততা ও নিষ্ঠার সঙ্গে মানুষ যদি কোনো কাজ সম্পন্ন করতে পারে এবং সব ধরনের বৈধ কাজের প্রতি মানুষের যদি শ্রদ্ধাবোধ থাকে, তাহলে বুঝতে হবে তার মধ্যে নাগরিক হিসেবে মূল্যবোধ তৈরি হয়েছে। যখন প্রতিজন নাগরিকের মধ্যে এই মূল্যবোধ তৈরি হয়, তখন বুঝতে হবে যে, সমাজ অনেকটা পথ এগিয়েছে এবং আধুনিক ও বিজ্ঞানমনস্ক হয়ে উঠেছে। আমাদের শিক্ষিত নাগরিক কি এখনো এই মানসিকতা অর্জন করতে পেরেছে? পারেনি। অধিকন্তু দিন যতই অতিবাহিত হচ্ছে, ততই কর্মভিত্তিক ব্যবধান বাড়ছে। বিশেষ করে রেজাল্ট বেইজড শিখন-শেখানো পদ্ধতিতে শিক্ষার্থীদের মধ্যে কাজ করার প্রবণতা মারাত্মকভাবে কমেছে।
সত্তর ও আশির দশকে আমরা যারা স্কুলকলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়েছি, তাদের জীবনযাপনের দিকে একটু তাকিয়ে দেখুন। আমরা কি পরিবারের কাজ করিনি? যখন ফোর-ফাইভে বা সিক্স-সেভেনে পড়তাম, তখন থেকেই ভোরে উঠে বড় ভাই ও বাবা-চাচাকে কৃষিকাজে সহযোগিতা করতাম। খেতে মাটির বড় বড় চাকা ভাঙা, বেড়া দেওয়া, মই দেওয়ার কাজ করা, খেত নিড়ানো, ফসল তোলা, আগাছা পরিষ্কার করা, ফসল মারানোর কাজ করা, পাট তোলা, ধোয়া, শুকানো, মাছ ধরা, বাড়িঘর পরিষ্কার করা, বাজার করা ইত্যাকার কত কাজ যে আমাদের করতে হয়েছে, তার ইয়ত্তা নেই। তাতে আমাদের পড়াশোনার ক্ষতি হয়নি, মানসম্মানও যায়নি।
একজন শিক্ষার্থীকে পরিবারের সব কাজ দক্ষতার সঙ্গে শিখতে হবে। কারণ ছেলে বা মেয়ে যা-ই হোক না কেন, কোনো না কোনো পরিবার এবং কোনো না কোনো প্রতিষ্ঠানের মধ্যে তার এক জীবন কাটাতে হয়। সেখানে তাকে কাজ করতে হবে। সেই কাজের তালিকা প্রণয়ন করা সম্ভব নয়। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের দায়িত্ব হলো তাকে পরিপূর্ণ মানুষ হিসেবে তৈরি করা। এই পরিপূর্ণ মানুষ হিসেবে তৈরি করার জন্য তার মধ্যে পারিবারিক ও প্রাতিষ্ঠানিক কাজের মানসিকতা ও দক্ষতা (সাইকোমটর ডোমেইন) তৈরি করাও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের দায়িত্বের গুরুত্বপূর্ণ অংশ।
এতকাল একজন শিক্ষার্থীর মুখস্থ রাখার ও চিন্তা করার ক্ষমতা কিছুটা পরিমাপ করা গেলেও তার স্বভাব-চরিত্রের উন্নয়ন ও তা যাচাই করার পদ্ধতি শিক্ষাক্রমে থাকলেও মূল্যায়ন পদ্ধতিতে ছিল না। অর্থাৎ একজন শিক্ষার্থী মানুষ হিসেবে কেমন, বিচিত্র কর্মকাণ্ডে সে কতটা দক্ষ, জীবনযাপনে সে কতটা পরিশীলিত, কতটা সুশৃঙ্খল; মানুষের ও প্রকৃতির প্রতি তার মমত্ববোধ আছে কি না; একজন শিক্ষার্থী কতটা অসাম্প্রদায়িক জীবনভাবনায় সমৃদ্ধ; তার মধ্যে কতটা সততা ও সৌন্দর্যবোধ আছে, দেশপ্রেম ও দেশের মানুষের প্রতি তার দায়বোধ কতটা ইত্যাকার বিচিত্র বিষয়ে তাকে সমৃদ্ধ করে তোলা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। অর্থাৎ একবিংশ শতকের আধুনিক বিশ্বব্যবস্থার সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলার মতো শক্তি, সামর্থ্য ও দক্ষতা একজন শিক্ষার্থীর মধ্যে তৈরি করা অপরিহার্য। শুধু পুথিগত বিদ্যা এবং পরীক্ষায় ভালো ফলাফলই যে একজন মানুষকে যোগ্য মানুষ করে তুলতে পারে না, তার প্রমাণ প্রতিনিয়তই আমরা পাচ্ছি। ব্যক্তিজীবন থেকে শুরু করে পারিবারিক, সামাজিক, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও বৈশ্বিক পরিবেশে আমরা যে কতটা পিছিয়ে আছি, তার প্রমাণ দেওয়ার জন্য গবেষণার প্রয়োজন হয় না। আমরা প্রতিনিয়ত দেখতে পাচ্ছি, কী পরিমাণ অসহিষ্ণু, অসুন্দর, অবিবেচক ও অপরিজ্ঞাত মানুষ হয়ে উঠছি আমরা! নিজের প্রতি দায়দায়িত্ব; সন্তানসন্ততি, পিতামাতা ও আত্মীয়স্বজনের প্রতি দায়দায়িত্ব; সমাজ ও রাষ্ট্রের প্রতি দায়দায়িত্ব; দেশের সংস্কৃতি, ইতিহাস ঐতিহ্যের প্রতি দায়দায়িত্ব, অর্থনৈতিক উন্নয়নে দক্ষতা; বিশ্বব্যবস্থার সঙ্গে খাপ খাইয়ে চলার যোগ্যতা; শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানের মানসিকতা ইত্যাকার সব দিক থেকে আমরা বাদবাকি বিশ্ব থেকে অনেকাংশেই পিছিয়ে আছি। এই পরিস্থিতি থেকে মুক্তির জন্য শিক্ষাক্রম পরিমার্জন ও তা বাস্তবায়িত করা ছাড়া আর কোনো উপায় ছিল না। শিক্ষাক্রম পরিমার্জনের মাধ্যমে শিক্ষার্থীদের চিন্তা করার দক্ষতার পাশাপাশি মানুষ হিসেবে তাদের যোগ্য মানুষ করে তোলার জন্য নানা রকমের ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়েছে। এই ব্যবস্থাটা ধারাবাহিক মূল্যায়নের ভেতর দিয়ে করা হচ্ছে। যারা বলেন, বর্তমান শিখন-শেখানো কার্যক্রমে পরীক্ষা বাদ দেওয়া হয়েছে, এই কথাটি সম্পূর্ণরূপে ভুল। অধিকন্তু ছয় মাস ও বারো মাস অন্তর দুইটি পরীক্ষা তো আছেই, তার সঙ্গে প্রতিনিয়ত ধারাবাহিক মূল্যায়নের ভেতর দিয়ে শিক্ষার্থীর নিরন্তর উন্নয়নের চেষ্টা চালিয়ে যাওয়া হচ্ছে এবং এই উন্নয়নের পথে কী ধরনের সীমাবদ্ধতা আছে, তা যাচাই করার জন্য প্রতিনিয়ত শিক্ষার্থীদের পর্যবেক্ষণের মধ্যে রাখা হচ্ছে। উল্লেখ থাকে যে, বছরান্তে ধারাবাহিক মূল্যায়ন ও দুইটি সামষ্টিক মূল্যায়নে প্রাপ্ত নম্বরের ভিত্তিতে শিক্ষার্থীর ব্যক্তিগত স্কোর নির্ধারণ করা হবে। তবে এক্ষেত্রে সামষ্টিক মূল্যায়নে প্রাপ্ত নম্বরের সঙ্গে ধারাবাহিক মূল্যায়নে প্রাপ্ত নম্বরের সমন্বয় সাধনের জন্য কোনো ব্যবস্থা রাখা হয়েছে কি না, তা জানা নেই। ঐ ব্যবস্থা থাকলে সামষ্টিক মূল্যায়নে দুর্নীতির আশঙ্কা থাকবে না।
সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে অনেকেই বলছেন, পাঠ্যপুস্তকে তেমন কোনো টেক্সট নেই। পড়ানোর জন্য কোনো নির্দেশনাও নেই। তাদের এই মনে করাটা অবান্তর নয়। কারা আমরা যে ধরনের পাঠ্যপুস্তকের সঙ্গে পরিচিত, পরিমার্জিত শিক্ষাক্রম অনুসারে প্রণীত পাঠ্যপুস্তকগুলো সে রকম নয়। সম্পূর্ণরূপে পাঠ্যপুস্তকনির্ভর পড়াশুনা থেকে বের হয়ে আসার জন্যই এই উদ্যোগ। এই পাঠ্যপুস্তক পড়ানোর জন্য দেশের প্রায় সব শিক্ষককে প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়েছে এবং রচনা করা হয়েছে টিচার্স গাইড। সুতরাং অভিভাবকগরা এই পাঠ্যপুস্তক পড়াতে পারবেন না। এই না পারাটা কোনো অপারগতা নয় বা অন্যায়ও নয়। কারণ শিক্ষার্থীদের পড়ানোর দায়িত্ব শিক্ষকদের, অভিভাবকদের নয়। কারো পোশাক বানানোর দায়িত্ব যেমন দরজির, চুল কাটার দায়িত্ব যেমন নরসুন্দরের, চিকিৎসা করার দায়িত্ব যেমন ডাক্তারের, তেমনি পড়ানোর দায়িত্বও শিক্ষকের। সারা পৃথিবীতেই এই বিধান প্রচলিত। আমার বাবা বলতেন, ‘যার কাজ তার সাজে, অন্য লোকের লাঠির মাঝে।’ সুতরাং চলুন, আমরা যার কাজ তাকে করতে দিই।
দুঃখের সঙ্গে বলি, আমরা অধিকাংশই যে যোগ্য মানুষ হয়ে উঠতে পারিনি, তার দায় আমাদের নয়, আমাদের অভিভাবকদের নয়, আমাদের শিক্ষকদেরও নয়-তার দায় আমাদের শিক্ষাব্যবস্থার। আবারও বলি, অধিকাংশ ক্ষেত্রে আমরা ন্যায়-অন্যায়ের পার্থক্য, সুন্দর ও সুন্দরের পার্থক্য, সত্য ও মিথ্যার পার্থক্য বুঝতে পারি না। আমরা বুঝতে যে পারি না, সেটাও বুঝতে পারি না। এর চেয়ে দুর্ভাগ্যের আর কিছু হতে পারে না। যদি আমাদের শিক্ষাব্যবস্থায় আগে থেকেই ধারাবাহিক মূল্যায়নের বিষয়গুলো থাকত, তাহলে প্রতিনিয়ত আমাদের স্বভাব-চরিত্রের ও কর্মকাণ্ডের পরিমার্জন করে করে, শিক্ষকরা আমাদের সুনাগরিক হিসেবে গড়ে তুলতে পারতেন। কিন্তু দুর্ভাগ্যের বিষয়, আমাদের সময় এই শিক্ষাব্যবস্থা ছিল না। ফলে আমরা অনেকেই শিক্ষিত হয়েছি, কিন্তু ভালো মানুষ হতে পারিনি, হৃদয়বান মানুষ হতে পারেনি, দক্ষ নাগরিক হতে পারিনি, অসাম্প্রদায়িক মানুষ হতে পারিনি, শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানের মানসিকতা লাভ করিনি। আমাদের এই সীমাবদ্ধতার কথা আপনারা স্বীকার করতে পারেন, না-ও করতে পারেন। কিন্তু এটাই বাস্তবতা।
নতুন এই শিক্ষাক্রম বাস্তবায়নের পথে নানা রকমের প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি হতেই পারে। বিশেষ করে, নতুন একটি ব্যবস্থা যখন বাস্তবায়ন করতে যাওয়া হয়, তখন নানা রকমের ত্রুটি-বিচ্যুতি হয়, নানা রকমের ভুলভ্রান্তি হয়। অভিভাবক হিসেবে, শিক্ষক হিসেবে কিংবা দেশপ্রেমিক একজন মানুষ হিসেবে আমাদের উচিত, ব্যবস্থাটি সম্পর্কে ভালোভাবে জেনে সততার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের পরামর্শ দেওয়া। একটি আশঙ্কার কথা বলে শেষ করি। আগামী ৭ জানুয়ারি, ২০২৪-এর নির্বাচনের পরে কী হবে তার ওপর কি এই ব্যবস্থার নিয়তি নির্ভর করবে? নাকি ব্যবস্থাটি সুষ্ঠুভাবে পরিচালিত হতে থাকবে? যদি তাই থাকে, তাহলেই জাতির মঙ্গল।