প্রকাশ : ২৭ ডিসেম্বর ২০২২, ০০:০০
মানুষের সুপ্ত প্রতিভা ও সৃজনশীল ক্ষমতা বিকাশে শিক্ষার গুরুত্ব অপরিসীম। শিক্ষা মানবসম্পদ উন্নয়নের সর্বোত্তম পন্থা। শিক্ষা ছাড়া জীবন ও জগত সম্পর্কে সুধারণা অর্জন করা যায় না। শিক্ষা দেহ, মন ও আত্মার বিকাশ সাধন করে। শিক্ষার মাধমে একজন মানুষ তার ব্যক্তিত্ব গঠন, মানবিক মূল্যবোধ অর্জন এবং সামাজিক দায়িত্ব ও কর্তব্য সম্পর্কে সচেতন হয়। আর সবার জন্য মানসম্মত শিক্ষা নিশ্চিত করতে শিক্ষার্থী ঝরে পড়া একটি বড় প্রতিবন্ধকতা। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে গমনোপযোগী শিক্ষার্থীদের শিক্ষাচক্র শেষ হওয়ার পূর্বে মধ্যবর্তী যে কোনো সময়ে যে কোনো শ্রেণি থেকে যদি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ত্যাগ করে লেখাপড়া ছেড়ে দেয় তখন তাকে ঝরে পড়া বলে।
শিক্ষার্থী ঝরে পড়া রোধ করতে হলে প্রথমে ঝরে পড়ার সাথে সংশ্লিষ্ট কারণ চিহ্নিত করতে হবে। কারণগুলোর মধ্যে দারিদ্র্য ও নিরাপত্তাহীনতা, অভিভাবকের অসচেতনতা, শিশু যত্নের ঘাটতি, লিঙ্গ বৈষম্য, অনাকর্ষণীয় পাঠ্যবই, ভোগ ও চাহিদা তাড়িত মনোবৃত্তির চাপ, শিক্ষা ব্যয়ের ঊর্ধ্বগতি, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ও শ্রেণিকক্ষের অনুন্নত পরিবেশ, শিক্ষাক্রমের অসংগতি, শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের সময়সূচি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ভৌত সুবিধাদি, সহপাঠক্রমিক কার্যক্রম, যাতায়াতব্যবস্থা, বাল্যবিবাহ, শিশুশ্রম, শিক্ষক ও অভিভাবকদের সম্পর্ক, শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের দূরত্ব, দাম্পত্য কলহ, পারিবারিক বিচ্ছেদ, হতাশা, মাদকাসক্ত, বৈশি^ক মহামারি করোনার প্রভাবে দীর্ঘদিন যাবত শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকা, শিক্ষক ও শিক্ষার্থীর মধ্যকার ব্যবধান, ইভটিজিং, পরীক্ষায় অকৃতকার্য কিংবা আশানুরূপ ফলাফল না হলে, ছাত্রাবস্থায় প্রেমের সম্পর্ক, শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে শিক্ষার্থীদের উপর নিপীড়ন, অভিভাবকহীন পথশিশু, বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন শিশু, মেধা ও দক্ষতাভিত্তিক পেশা নির্বাচনের নিশ্চয়তা না থাকা, চাকুরি ক্ষেত্রে মেধার অবমূল্যায়ন, দুর্নীতি, ব্যয়বহুল প্রাইভেট কোচিং ইত্যাদি শিক্ষার্থী ঝরে পড়ার পেছনে নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে।
শিক্ষার্থী ঝরে পড়া রোধ করার জন্য সরকারের গৃহীত বেশ কিছু পদক্ষেপ ইতিবাচক ভূমিকা পালন করছে। বিশেষ করে অবৈতনিক শিক্ষা, বই বিতরণ, শিক্ষা উপবৃত্তি, স্কুল ফিডিং ইত্যাদি। কিন্তু নতুন নতুন সামাজিক বাস্তবতার সাথে সঙ্গতি রক্ষা করে আর ও টেকসই ব্যবস্থা নেয়ার প্রয়োজনীয়তা দেখা দিয়েছে। শিক্ষার্থী ঝরে পড়া রোধ করার জন্য আরও কী কী পদক্ষেপ নেয়া যায়, তার কিছু সুপারিশ এখানে উল্লেখ করা হলো।
এক. শিক্ষার্থী ঝরে পড়া রোধ করতে প্রতিটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানকে অগ্রণী ভূমিকা পালন করতে হবে। ক্লাসে শিক্ষার্থী অনুপস্থিতি দেখে ঝরে পড়াদের চিহ্নিত করতে হবে এবং তাদের ব্যাপারে খোঁজখবর নিয়ে মোটিভেশনসহ প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে হবে। তাদের ব্যক্তিগত ও পারিবারিক সমস্যাগুলো কাটিয়ে তারা কীভাবে পড়াশোনা চালাতে পারে সে ব্যাপারে পরামর্শ দিতে হবে।
দুই. গরিব শিক্ষার্থীদের বিনামূল্যে মৌলিক মানবিক চাহিদা পূরণ নিশ্চিত করতে হবে। যেমন : খাদ্য, বস্ত্র ও চিকিৎসা ইত্যাদি।
তিন. শিক্ষার গুরুত্ব সম্পর্কে ঝুঁকিপ্রবণ শিক্ষার্থীদের পারিবারিক সচেতনতা বৃদ্ধি করতে হবে। প্রতি শিক্ষাবর্ষে কতজন শিক্ষার্থী অকৃতকার্য হচ্ছে তাদের মাঝে কতজন পরবর্তীতে পড়াশোনা চালিয়ে যাচ্ছে কিংবা ঝরে পড়ছে তার ফলো-আপ করতে হবে। অকৃতকার্য হওয়ার কারণে ঝরে পড়া শিক্ষার্থীদের শিক্ষায় ফিরিয়ে আনতে বিশেষ পাঠদানের ব্যবস্থা করতে হবে। তাদের পুনরায় ভর্তির জন্য উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে এক্ষেত্রে যেই বয়সী শিক্ষার্থীদের মাঝে ঝরে পড়ার প্রবণতা বেশি তাদের বিশেষ কাউন্সিলিং প্রোগ্রামের অধীনে নিয়ে আসতে হবে।
চার. প্রতিটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে অভিভাবক সভার আয়োজন করতে হবে। শিক্ষার্থীর পড়াশোনা নির্বিঘেœ চলার জন্য এবং প্রয়োজনীয় নজরদারি ও যত্নপ্রাপ্তি নিশ্চিত করার জন্য শিক্ষার্থী সম্পর্কে প্রয়োজনীয় তথ্য বিনিময় করতে হবে।
পাঁচ. শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের নিয়মিত ক্লাসে উপস্থিতি নিশ্চিত করতে হবে। শিক্ষার্থীর পাঠ অনুধাবন ক্ষমতার দিকে নজর দিয়ে শিক্ষক কর্তৃক প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে হবে। ক্লাসে শিক্ষকের আন্তরিক পাঠদান নিশ্চিত করতে হবে।
ছয়. পাঠ্যক্রম ও পাঠ্যসূচি সুপরিকল্পিত হতে হবে। যোগ্য ও মেধাবী শিক্ষক দ্বারা পাঠ্যবই রচনা করতে হবে। পাঠ্যপুস্তকের লেখক নির্বাচনের ক্ষেত্রে দলীয় বিবেচনা, স্বজনপ্রীতি ও হটকারী ব্যবস্থা নেয়া থেকে বিরত থাকতে হবে। পাঠ্যবই মানসম্মত ও আকর্ষণীয় হচ্ছে কী না দেখতে হবে।
সাত. যৌনহয়রানি বন্ধ করতে হবে। ইভটিজিং এবং সামাজিক যোগযোগ মাধ্যমে মেয়েদের উত্যক্ত করার বিরুদ্ধে কার্যকর ব্যবস্থা নিতে হবে। বিদ্যমান আইনি কাঠামোয় মেয়েদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হবে এবং প্রয়োজনে নতুন আইন প্রণয়ন করতে হবে। সামাজিকভাবে মেয়েবান্ধব পরিবেশ তৈরি করতে সচেতনতা বাড়াতে হবে।
আট. বাল্যবিবাহ বন্ধের ব্যবস্থা করতে হবে। এক্ষেত্রে শিক্ষার্থীর পরিবার ও শিক্ষার্থীকে শিক্ষার গুরুত্ব ও বাল্যবিবাহের কুফল সম্পর্কে সচেতন করতে হবে।
নয়. মেয়েদের জন্যে পৃথক টয়লেট ও কমনরুমের ব্যবস্থা করতে হবে।
দশ. শিক্ষাক্ষেত্রে জাতীয় বাজেট ও বরাদ্দ বাড়াতে হবে। শিক্ষাকে বোঝা হিসেবে নয়, বরং একে সেবা এবং শিক্ষাক্ষেত্রে ব্যয়কে বিনিয়োগ হিসেবে দেখতে হবে। শিক্ষাক্ষেত্রে ব্যয় বাড়লে শুধু শিক্ষার হারই বাড়বে না, আমাদের অনেক সামাজিক সমস্যার সমাধান হবে।
এগার. কোচিং ও প্রাইভেটবাণিজ্য বন্ধ করতে হবে। সেক্ষেত্রে শিক্ষকদের বেতন ও মর্যাদা বাড়াতে হবে, যাতে করে শিক্ষকরা কোচিং ও প্রাইভেট পড়ানো হতে বিরত থাকে। শিক্ষকদেরকে নৈতিক প্রশিক্ষণ দিয়ে তাদের ইতিবাচক মনোভাব তৈরি করতে হবে। কোচিং ও প্রাইভেটবাণিজ্য সামাজিক অবিচারের পথ খুলে দিচ্ছে, যা শিক্ষার্থীদের মধ্যে মেধা ও দক্ষতার অন্যায্য বৈষম্য সৃষ্টি করছে যার পেছনে ব্যবসায়ী মনোভাবাপন্ন শিক্ষকগণ দায়ী। গরিব শিক্ষার্থীদের মানবিক অধিকার প্রতিষ্ঠায় জন্য এ ব্যাপারে সমন্বিত ও কার্যকর ব্যবস্থা নিতে হবে।
বার. শিক্ষিত বেকারদের জন্য নতুন নতুন কর্মসংস্থানের সৃষ্টি করতে হবে। আমাদের দেশে দিন দিন শিক্ষিত বেকারের সংখ্যা বৃদ্ধি পাচ্ছে। তা দেখে শিক্ষার্থীদের শিক্ষার প্রতি অনীহা সৃষ্টি হয়। তাই যোগ্যতা ও দক্ষতার ভিত্তিতে শিক্ষিত বেকারদের মেধার মূল্যায়ন করে তাদের কর্মসংস্থান নির্বাচনের সুযোগ দিতে হবে।
তের. শিক্ষার্থী সম্পর্কে ইতিবাচক ধারণা পোষণ করতে হবে। শিক্ষার্থীর সাথে দুর্ব্যবহার ও রুঢ় আচরণ বন্ধ করতে হবে। তাদের প্রতি শারীরিক নির্যাতন বন্ধ করতে হবে।
চৌদ্দ. শিক্ষা উপরকণের দাম কমাতে হবে। শিক্ষাকে ব্যবসায় রূপান্তরিত করার মানসিকতা কমাতে হবে। বেসরকারি স্কুলের গলাকাটা ফি কমাতে হবে। গরিব শিক্ষার্থীদের জন্য বেসরকারি স্কুলে বিশেষ ছাড় ও বৃত্তির ব্যবস্থা করতে হবে।
পনের. শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে বার্ষিক ক্রীড়া, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান, আন্তর্জাতিক দিবস, বিভিন্ন জাতীয় দিবস উদযাপন এবং প্রত্যেক বছর শিক্ষা সফরের ব্যবস্থা করতে হবে।
ষোল. যোগাযোগব্যবস্থা উন্নত করতে হবে এবং প্রত্যন্ত অঞ্চলে স্কুল, কলেজ প্রতিষ্ঠা করতে হবে। বেসরকারি সংস্থাগুলো এক্ষেত্রে এগিয়ে আসলে সবার কাছে শিক্ষার সুযোগ পৌঁছে দেয়া সম্ভব হবে।
সতের. আয়-রোজগারের ক্ষেত্রে ধনী-দরিদ্রের বৈষম্য কমাতে হবে। জিডিপির প্রবৃদ্ধির সুফল যাতে সবাই পায় সে ধরনের সামাজিক নিরাপত্তামূলক কর্মসূচি নিতে হবে। এতে করে দরিদ্র জনগণ উপকৃত হবে এবং দরিদ্র শিক্ষার্থীরা শিক্ষার সুযোগ পাবে।
আঠার. বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন শিক্ষার্থীদের জন্য আলাদা শিক্ষার ব্যবস্থা করতে হবে। অভিভাবক ও শিক্ষকদের তাদের প্রতি বিশেষ যত্নবান হতে হবে। তাদের মধ্যে যে উদ্ভাবনী ক্ষমতা ও দক্ষতা রয়েছে তা বিকশিত করার জন্য শিক্ষক ও অভিভাবকদের আন্তরিক হতে হবে। তাহলে তারা ও স্বাভাবিক মানুষের মতো দক্ষতা দেখাতে পারবে এবং সমাজের বোঝা হয়ে থাকবে না।
শিক্ষা জাতীয় উন্নয়নের একটি গুরুত্বপূর্ণ দিক। সবার জন্য মানসম্মত শিক্ষা নিশ্চিত বর্তমান সময়ের সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ। শিক্ষাজীবন সমাপ্তির আগেই বিপুল সংখ্যক শিক্ষার্থী ঝরে পড়া ‘ডিজিটাল বাংলাদেশ’ গঠনের পথে প্রধান বাধা। তাই শিক্ষার্থী ঝরে পড়ার কারণগুলোকে গুরুত্বের সাথে বিবেচনা করে তা প্রতিরোধে কার্যকর ব্যবস্থা নেয়া খুবই জরুরি। তাহলে পরিবার, সমাজ ও জাতি তথা দেশ উপকৃত হবে।
মেহেরুন নাহার : প্রভাষক (সমাজকর্ম), জয়পুরা এসআরএমএস উচ্চ বিদ্যালয় এন্ড কলেজ, বলোড়া, রামগঞ্জ, লক্ষ্মীপুর।