সোমবার, ২১ এপ্রিল, ২০২৫  |   ২৮ °সে
জাতীয়আন্তর্জাতিকরাজনীতিখেলাধুলাবিনোদনঅর্থনীতিশিক্ষাস্বাস্থ্যসারাদেশ ফিচার সম্পাদকীয় অন্যান্য
ব্রেকিং নিউজ
  •   চাঁদপুর জেলা আওয়ামী লীগের সহ-সভাপতি ইউসুফ গাজী গ্রেফতার

প্রকাশ : ২১ এপ্রিল ২০২৫, ০৯:০৯

খণ্ডে খণ্ডে অখণ্ড জীবন

পীযূষ কান্তি বড়ুয়া
খণ্ডে খণ্ডে অখণ্ড জীবন

॥ আটাশতম পর্ব ॥

আমার রোটারী জীবন

বংশ পরম্পরায় আমাদের জীবনে সেবা স্বার্থের ঊর্ধ্বে ছিলো সবসময়। আমার পিতামহ শিক্ষকতাকে ব্রত হিসেবে গ্রহণ করে অর্থকে গৌণ করে দেখেছেন। মাস্টারদার শিষ্যত্ব বরণ করে তিনি বৃটিশবিরোধী আন্দোলনের চেতনা রক্তে ধারণ করে স্কুল থেকে বহিষ্কৃত হন। তাঁর পুত্র সুরেশ চন্দ্র বড়ুয়া হলেন আমার পিতা, যিনি একাত্তরে মহান মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক ছিলেন এবং মুক্তিযোদ্ধাদের নেপথ্যে সহযোগিতা করে গেছেন। একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধকালীন কয়েকটি হিন্দু পরিবার আমাদের ঘরে নিরাপদে আশ্রিত ছিলেন। মহাসংঘনায়ক শ্রীমৎ বিশুদ্ধানন্দ মহাথেরো মহোদয়ের চায়না বুড্ডিস্ট থিয়োরির কারণে বড়ুয়ারা তুলনামূলক হিন্দুদের চেয়ে কিছুটা কম আক্রান্ত হয়। সেই সুযোগকে কাজে লাগিয়ে আমার বাবা আমাদের বাড়িতে কয়েকজন সনাতন সম্প্রদায়ের বিপন্ন মানুষকে আশ্রয় দেন। পাশাপাশি গ্রামে বাবার বদান্যতা লাভ করেনি তেমন মানুষ ও পরিবার বিরল ছিলো। আমাদের গ্রামে সরকারি বোর্ড স্কুল তথা প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ভবন নির্মাণের জন্যে বাবা অগ্রণী হয়ে অমূল্য ভূমিখণ্ড দান করেন। আমি বাবার তৃতীয় পুত্র হিসেবে আমার শোণিতধারাতেও সেই সেবার মানসিকতা ধারণ করি। ফলে যখনই আহ্বান এসেছে এবং সুযোগ পেয়েছি, তখনই বিনামূল্যে মেডিকেল ক্যাম্পে চিকিৎসা সেবা দিয়েছি। আমার সাংগঠনিক কর্মকাণ্ডের ব্যাপারে অগ্রজ সতীর্থ কাজী শাহাদাত ভাই বেশ ভালোভাবেই ওয়াকিবহাল ছিলেন। তিনি আমাকে আরও বড়ো ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট করার জন্যে চাঁদপুর রোটারী ক্লাবে অন্তর্ভুক্ত করে নেন। প্রয়াত আবুল কাশেম গাজী ভাইয়ের সভাপতি হিসেবে দায়িত্ব পালনকালে কাজী শাহাদাত ভাই আমাকে রোটারী পিন পরিয়ে এবং রোটারী প্রত্যয় পাঠ করিয়ে রোটারিয়ান হিসেবে পথ চলতে শুরু করিয়ে দেন। আবুল কাশেম গাজী ভাইয়ের নেতৃত্বে তৎকালীন চাঁদপুর সরকারি কলেজের ইংরেজি বিভাগের সহকারী অধ্যাপক জনাব গোলাম মোস্তফা অবৈতনিক সচিবের দায়িত্ব পালন করেন।

প্রসঙ্গত বলতে হয়, রোটারী হলো বিশ্বজুড়ে মানবসেবার সবচেয়ে বড়ো পরিবার। ঊনিশশো পাঁচ সালের তেইশে ফেব্রুয়ারি মার্কিন অ্যাটর্নি পল পার্সিভ্যাল হ্যারিস শিকাগোতে রোটারী ইন্টারন্যাশনালের প্রবর্তন করেন। এটি মূলত বিভিন্ন পেশাজীবীকে নিয়ে গঠিত সংগঠন, যার মুখ্য উদ্দেশ্য হলো পেশাগত সততা বজায় রেখে ব্যক্তিগত উৎকর্ষ সাধনের মাধ্যমে মানবসেবায় ব্রতী হওয়া। প্রথমদিকে এর মটো ছিলো, ‘ সে বেশি লাভবান হয় যে উত্তম সেবা দেয়।’ ঊনিশশো এগার সালে রোটারী ইন্টারন্যাশনালের দ্বিতীয় কনভেনশনে এই মটোটি রোটারীর মটো হিসেবে নির্বাচিত হয়। ঐ কনভেনশনে রোটারিয়ান আর্থার ফ্রেডরিক শেলডনের দেওয়া অনুপ্রেরণামূলক বক্তব্য হতে এই মটোটি নির্বাচিত হয়। ঊনিশশো পঞ্চাশ সালে মিশিগানের ডেট্রয়েটে অবস্থিত রোটারী কনভেনশনে উপরোক্তটার পাশাপাশি ‘ সেবা স্বার্থের ঊর্ধ্বে ‘ এই মূলমন্ত্রকেও মটো হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হয়। এটি ছিলো আসলে রোটারীর দ্বিতীয় কনভেনশনে মিনেসোটার মিনিয়াপলিস রোটারী ক্লাবের প্রেসিডেন্ট বেন কলিন্সের বক্তব্যের প্রতিধ্বনি। কলাম্বিয়া নদীভ্রমণে গিয়ে তিনি রোটারী ক্লাব সংগঠনের উপায় নিয়ে আলোচনা করতে গিয়ে বলেছিলেন, ‘সেবা, স্বার্থ নয়’। এটি ঊনিশশো পঞ্চাশ সাল থেকে রোটারীর অফিসিয়াল মটোর মর্যাদা পায়। পাশাপাশি আগের মটোটাও বলবৎ থাকে। মিটিং হতো আবর্তনমূলক পদ্ধতিতে এক একদিন একেকজন সদস্যের বাসায়। এ কারণেই রোটারী নামের প্রবর্তন। রোটেটরী অর্থাৎ ঘূর্ণন থেকেই এসেছে ‘রোটারী’। শুরুতে এটি ইন্টারন্যাশনাল অ্যাসোসিয়েশন অব রোটারী ক্লাবস নামে পরিচিত ছিল। ঊনিশশো বাইশ সালে এর নামকরণ করা হয় রোটারী ইন্টারন্যাশনাল। দুহাজার চৌদ্দ সালের আগস্টে আমার অন্তর্ভুক্তি হয়। প্রথম তিনটি সাপ্তাহিক সভায় অতিথি হিসেবে উপস্থিত থেকে আমি রোটারী প্রত্যয় পাঠের অনুমতি প্রাপ্ত হই। বোর্ড মিটিংয়ে আমার পরিচিতি উত্থাপিত হলে কোনো সদস্য ভেটো প্রয়োগ না করায় আমি রোটারিয়ান পরিচয় লাভ করি। রোটারী ফাউন্ডেশনে একশো ডলার দান করে নামের শেষে আরএফএসএম

উপাধি ধারণ করার যোগ্যতা অর্জন করি। আরএফএসএমের পূর্ণাঙ্গ বিস্তার হলো রোটারী ফাউন্ডেশন সাস্টেইনিং মেম্বার। আরএফএসএম উপাধিধারী রোটারিয়ান তার সেবার প্রত্যয় ব্যক্ত করেই রোটারী ফাউন্ডেশনে একশো ডলার দান করতে হয়। রোটারী ক্লাবে প্রতিবছর জুনের শেষে নেতৃত্বের পরিবর্তন হয়। একবছর আগে থেকেই নূতন নেতৃত্ব নির্বাচন করা হয় এবং তাদের প্রশিক্ষণের মাধ্যমে উপযুক্ত করে তোলা হয়। জুলাই এক তারিখে নূতন রোটাবর্ষ শুরু হয় যা পরের বছর তিরিশে জুনে সমাপ্তি অর্জন করে। প্রথম বছর আমাকে সদস্য হিসেবে অন্তর্ভুক্ত করে পরের বছর বোর্ডে স্থান দিয়ে বুলেটিন এডিটর বানিয়ে দেওয়া হয়। আমি বুঝতে পেরেছিলাম, অগ্রজ রোটারিয়ানরা আমাকে স্নেহ করতেন যেমন তেমনি পছন্দও করতেন। বুলেটিন এডিটর হওয়া তাঁদের সেই স্নেহ ও পছন্দের ফসল বলা যায়। বুলেটিন এডিটর হিসেবে আমার দায়িত্ব যোগ্যতা অনুযায়ী পালন করতে না পারলেও খারাপ করিনি একেবারে। আমি প্রেসে ছাপিয়ে বুলেটিন না দিয়ে কম্পিউটার কম্পোজ করে তা ফটোকপি করে বিতরণ করি। এতে প্রকাশনার মান হয়তো উন্নত ছিলো না, কিন্তু ধারাবাহিকতা ছিলো। ছাপাতে গেলে খরচের পাশাপাশি সময়েরও একটা ব্যাপার ছিলো। ধীরে ধীরে সময় অতিক্রান্ত হলে আমি ক্লাব ডিরেক্টর, জয়েন্ট সেক্রেটারি, সেক্রেটারি ও ভাইস প্রেসিডেন্ট হই।

আমি যে ক্লাবের সদস্য হই, সে ক্লাবটি বাংলাদেশের সপ্তম ক্লাব এবং বৃহত্তর কুমিল্লার তৃতীয় ক্লাব। ঊনিশশো সত্তর সালের নভেম্বরের কুড়ি তারিখ ক্লাবটির জন্ম হলেও মহান মুুক্তিযুদ্ধের কারণে ঊনিশশো চুয়াত্তর সালের বার এপ্রিল চার্টার সনদ অর্জন করে। বরেণ্য চিকিৎসক ও সমাজ নির্মাতা ডা. নূরুর রহমান সাহেবের হাত ধরে জন্ম নেওয়া এ সেবা সংগঠন আজ পরিণত হয়েছে মহীরুহে। এ ক্লাবের সাবেক প্রেসিডেন্ট, প্রয়াত রোটারিয়ান আবুল কাশেম গাজী ভাইকে সবাই অঘোষিতভাবে ডাকে খাদ্যমন্ত্রী হিসেবে। কারণ তিনি ছিলেন ফুড কমিটির বাঁধাধরা আহ্বায়ক। তাঁর প্রতিটা আয়োজনে খাবার অত্যন্ত সুস্বাদু যেমন হতো তেমনি পরিমাণ মতোও হতো। কখনও কম-বেশি হয়নি।

চাঁদপুর রোটারী ক্লাবের হার্ট প্রজেক্ট হলো শুক্রবারের দাতব্য চিকিৎসালয়, যেখানে শূন্য থেকে বারো বছরের শিশুদের বিনামূল্যে চিকিৎসা ও ঔষধ বিতরণ করা হতো। করোনাকালে চাঁদপুর রোটারী ক্লাব অক্সিজেন সিলিন্ডার সরবরাহ করেছে। প্রতিবছর এ ক্লাবের পক্ষ থেকে স্কুল বয়েজ ও গার্লসদের দৃষ্টিশক্তি পরীক্ষণ যেমন করা হয় তেমনি প্রবীণদের চোখের অপারেশন এবং চশমারও ব্যবস্থা করা হয়। আমি যুক্ত হওয়ার পরে বেশ কয়েকটা বোর্ড পাই। কয়েকজন প্রবীণ রেটারিয়ান যেমন প্রেসিডেন্ট হয়েছেন, তেমনি কয়েকজন তরুণও প্রেসিডেন্ট হয়েছেন। এ সময়ের মধ্যেই কাজী শাহাদাত ভাই অধ্যাপক ড. তৈয়ব চৌধুরীর গভর্নরশিপকালে ক্লাবের পক্ষে সর্বোচ্চ ডিস্ট্রিক্ট পদ ‘লেফটেন্যান্ট গভর্নর ‘ হিসেবে বরিত হন। বাবু ভাইয়ের সভাপতিত্বকালে আমরা চাঁদপুরে ‘মেঘনা বিলাস’ নামে রিভার ক্রুজের আয়োজন করি। এটি ছিলো ডিস্ট্রিক্ট জোনাল প্রোগ্রাম। দিনব্যাপী এ আয়োজন স্মরণীয় হয়ে থাকবে। ফকির শাহাবুদ্দিনের গান, কাজলের কৌতুক, মোটু-পাতলুর বিনোদন, আতশবাজির রোশনাই সবই ছিলো। নাসির খানের আমলে আমরা পঞ্চাশ বছর পূর্তিতে উপনীত হই। দুহাজার কুড়ি-একুশের রোটাবর্ষে করোনা ছিলো আমাদের প্রধান বাধা। এ সময় নতুন এক অভিজ্ঞতার সম্মুখীন হয় ক্লাব। ক্লাবের সাপ্তাহিক সভা অনুষ্ঠিত হয় জুম প্লাটফর্মে। বাড়ি থেকে সবাই মিটিংয়ে অংশ নিতেন। প্রেসিডেন্টসহ দুয়েকজন সশরীরে হয়তো ক্লাবে যেতেন। ধীরে ধীরে ফিজিক্যাল মিটিংয়ের প্রবণতা বাড়তে থাকে এবং সবার মাঝে ক্লাবের প্রতিষ্ঠার পঞ্চাশ বছর উদযাপনের তাগিদ অনুভূত হয়।

উদযাপন কমিটির আহ্বায়ক হিসেবে বিদিত রোটারিয়ান জনাব কাজী শাহাদাত দায়িত্বপ্রাপ্ত হন। তিনি অনুষ্ঠানের কয়েকদিন আগে থেকে ক্লাব ভবনের দ্বিতীয়-তৃতীয় তলায় অবস্থিত হোটেল গ্র্যান্ড হিলশায় অধিষ্ঠান গ্রহণ করেন। দুশো এক নম্বর কক্ষটি হয়ে উঠে তাঁর উদযাপনী কার্যালয়। বিভিন্ন কমিটির সাথে তিনি দফায় দফায় বৈঠক করেন যাতে সুবর্ণজয়ন্তী উৎসব সর্বাঙ্গীণ সুন্দর হয়। আমার ওপর একটা বড়ো দায়িত্ব অর্পিত হয়। আমাকে স্মারক প্রকাশনার দায়িত্ব দেওয়া হয়। মানসম্পন্ন ছাপায় আমরা বুক সাইজে গ্লোসি পেপারে একশো বাহান্ন পৃষ্ঠার চাররঙা একটা স্যুভেনির বের করি। এতে চাঁদপুর রোটারী ক্লাবের থিম সং এবং পঞ্চাশ বছর পূর্তির থিম সং দুটো পত্রস্থ হয়। চাঁদপুর রোটারী ক্লাবের থিম সংটি কবি ও গীতিকার মোখলেসুর রহমান মুকুল ভাই রচনা করেন এবং সুরারোপ করেন শীতল ঘোষাল। পঞ্চাশ বছর পূর্তির থিম সংটি আমি রচনা করি এবং সুরারোপ করেন চম্পক সাহা ও রূপালীদি। গানটি অনুষ্ঠানস্থলে পরিবেশন করেন রূপালীদি, চম্পকদা, নাসির ভাই, মাহমুদা ভাবী, প্রত্ন-প্রখরসহ আরও দুয়েকজন। এছাড়াও শম্ভু আচার্যী লিখিত ও চম্পক সাহা সুরারোপিত আরও একটি গান এখানে স্থান পায়। স্মারকগ্রন্থে চাঁদপুর রোটারী ক্লাবের ইতিহাস নিয়ে একটি ইংরেজি গদ্য আছে যা সাবেক সভাপতি ও ইংরেজি বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক জনাব গোলাম মোস্তফার লেখা। বাংলায় ক্লাবের ইতিহাস ও সদস্যদের নিয়ে একটা লেখা আছে কাজী শাহাদাত ভাইয়ের। এ বইটি আমরা উৎসবের পরেও বিভিন্ন উপলক্ষে অনেককেই উপহার দিয়েছি। পঞ্চাশ বছর উদযাপনের স্মারক হিসেবে ক্লাব ভবনের ভেতরের দেয়ালে অর্থাৎ ডা. নূরুর রহমান কনফারেন্স হলে দক্ষিণ দেয়ালের গায়ে একটি শ্বেত পাথরের ফলক স্থাপন করি, যাতে অতীত অগ্রজদের কৃতজ্ঞতা জানানো হয় এবং ভবিষ্যতের নতুন প্রজন্মকে স্বাগত জানানো হয়। কাব্যিক আবেদনে লেখা এ স্মারক-ফলকটির কথাতে আমি জড়িয়ে আছি লেখক হিসেবে, যদিও ফলকের কোথাও তা লিপিবদ্ধ নেই।

নাসির ভাইয়ের আমলে একুশে ফেব্রুয়ারি উপলক্ষে মাহবুবুর রহমান সুমনের দূতিয়ালিতে আমরা একটা অনলাইন সেমিনারে অংশগ্রহণ করি। কোলকাতা রোটারী ক্লাবের আয়োজনে বাংলা ভাষা বিষয়ক সেমিনারে মুখ্য আলোচক হিসেবে আমাকে রাখা হয়, যা ছিলো আমার জন্যে অতি গৌরবের। এর ফলস্বরূপ আয়োজক কর্তৃপক্ষ আমাদের জন্যে অনলাইনে সনদ পাঠায়। করোনার কারণে সকল ডিস্ট্রিক্ট প্রোগ্রাম সশরীরে করা থেকে বিরত থাকায় ডিসট্রিক্ট কনফারেন্স ও অ্যাওয়ার্ড গিভিং সিরোমনি অনুষ্ঠিত হয়নি।

নাসির ভাইয়ের পরে দায়িত্ব বর্তায় শাহেদুল হক মোর্শেদের ওপর। তখন কিন্তু করোনার দ্বিতীয়-তৃতীয় ঢেউ এসে আছড়ে পড়েছে জনজীবনে। লক ডাউনের পাশাপাশি ইতোমধ্যে রেড অ্যালার্ট জারি হয়েছে কয়েকটা জেলায়। চাঁদপুর রোটারী ক্লাবের ইতিহাসে এ সময়টা স্মরণীয় হয়ে থাকবে। আমাদের অভিষেক ও পিকনিক একযোগে আয়োজন করা হয় দুহাজার বাইশের মধ্য জানুয়ারিতে। রাঙামাটিতে রেড অ্যালার্ট থাকায় আমরা খাগড়াছড়িতে অভিষেক সম্পন্ন করি এবং সাজেকে পিকনিকের স্পট নির্ধারণ করি। অত্যন্ত উপভোগ্য হয়েছিলো সে সময়টুকু। চোখে আজও ভাসে আমাদের বাবু ভাইয়ের লুসাই পোশাকে রাজা সেজে ছবি তোলার দৃশ্যটি। পাশে অবশ্যই নার্গিস ভাবী ছিলেন। এ আয়োজনের অন্যতম দিক ছিলো আয়োজক কমিটির পক্ষ থেকে সবাইকে টুপি-মাফলার বিতরণ করা। মোর্শেদ-পলাশের আমলে অনেকগুলো কাজ হয় যার ফলস্বরূপ আমাদের ক্লাব সতেরোটা পুরস্কার অর্জন করে। পরের বছর অর্থাৎ দুহাজার বাইশ-তেইশে দায়িত্ব পড়ে কাঞ্চন এবং আমার ওপর। কাঞ্চন খুব ঠাণ্ডা মাথায় তার সময়টুকু অতিবাহিত করে। রোটাবর্ষ উদ্বোধনী, ক্লাব ভিজিট, অভিষেক, ফ্যামিলি নাইট ইত্যাদি বড়ো বড়ো আয়োজন সুসম্পন্ন হয়। এ সময় ডিস্ট্রিক্ট থেকে একটা নতুন বিষয়ের অবতারণা করা হয়। মিটিং মিনিটস্ লিপিবদ্ধ করার জন্যে ফর্ম্যাট করা বই দেওয়া হয়। ঐ বইতে লিপিবদ্ধ করার বিষয়ে আমরা ডিস্ট্রিক্টে একটা পুরস্কার অর্জন করি। সাকুল্যে সে বছর আমরা বারোটি পুরস্কার অর্জন করি, যার মধ্যে সেরা ক্লাব, সেরা প্রেসিডেন্ট, সেরা সেক্রেটারি, সেরা ডেপুটি গভর্নর, সেরা অ্যাসিস্ট্যান্ট গভর্নর, সেরা মিডিয়া কাভারেজ ইত্যাদি পুরস্কারগুলো ছিলো।

আমাদের সময়ে ডিস্ট্রিক্ট একটা বেকায়দায় পড়ে। একদিকে ডিস্ট্রিক্ট গভর্নর নিজে কিডনি রোগে কাহিল, আর অন্যদিকে গভর্নর নির্বাচনে দুর্নীতি হয়েছে মর্মে আদালতে ঠুকে দেওয়া হয় মামলা। ফলে বেশ কিছু সময় ধরে আমাদের কোনো ডিস্ট্রিক্ট গভর্নর ছিলেন না। তাঁর হয়ে পিডিজি দিলনাশিন মোহসীন এ দায়িত্ব পালন করেন। রোটারীর ইতিহাসে এ এক কালো অধ্যায় হয়ে থাকলো।

আমাদের পরে দায়িত্ব আসে শাহীন ভাই ও উজ্জ্বলের ওপর। তারা প্রথম দিকে গভর্নর পেলেও পরে রোটারী ইন্টারন্যাশনালের নির্দেশে ডিস্ট্রিক্টই বাতিল হয়ে যায়। ফলে ডিস্ট্রিক্ট গভর্নরের পদটি কার্যত বিলোপ হয়ে যায়। ডিস্ট্রিক্ট পঁয়ষট্টি-এর অধীনে আমরা এসে পড়ি এবং কয়েক বছর এ ব্যবস্থায় চলতে হবে বলে ঘোষণা দেওয়া হয়। দুহাজার চব্বিশ-পঁচিশে দায়িত্ব বর্তায় অ্যাডভোকেট নজরুল ইসলাম ও রোটারিয়ান মাহবুবুর রহমান সুমনের ওপর। সুমন ভাই এ সময় চাঁদপুর প্রেসক্লাবের সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্বেও আসীন হয়। রোটারীতে তাদের এ দায়িত্ব এখনও চলমান। তাদের পরে দায়িত্ব নিতে প্রস্তুত আছেন মো. মোস্তফা ফুল মিয়া এবং নাজিমুল ইসলাম এমিল। নজরুল-সুমনের বোর্ডকে জুলাই অসন্তোষে বেশ কঠিন একটা সময় অতিক্রম করতে হয়েছে। এ সময়ে আটাশে জুলাই ঘটে যায় এক মর্মান্তিক ঘটনা। ক্লাবের সাবেক সভাপতি ও প্রাণবন্ত রোটারিয়ান অ্যাডভোকেট সাইয়্যেদুল ইসলাম বাবু ভাই ফুসফুসের জটিল রোগে আক্রান্ত হয়ে হঠাৎ নাই হয়ে গেলেন। তাঁর মৃত্যু আমাদের জন্যে দুর্বহ শোক নিয়ে আসে। ক্লাবের পক্ষ থেকে তাঁর মৃত্যুতে শোকসভার আয়োজন করা হয়। চাঁদপুর রোটারী ক্লাবে বাবু ভাই তাঁর বাবার হাত ধরেই পদার্পণ করেন। তাঁর বাবা মরহুম অ্যাডভোকেট সিরাজুল ইসলামের আমল থেকেই তিনি রোটারী লেটস্ হিসেবে আসেন। তারপর রোটার‌্যাক্টর হন। এরপর নিজে রোটারী ক্লাবের সভাপতি হন। তিনি বর্তমান রোটারী ক্লাবের তরুণ ও প্রবীণের সেতুবন্ধ ছিলেন। তাঁর অভিষেক অনুষ্ঠানে আমরা বাংলাদেশ সরকারের বেশ কয়েকজন সচিবকে পাই, অতিথি হিসেবে।

রোটারী জীবনে আমার নতুন বন্ধু ও শুভাকাঙ্ক্ষী যেমন হয়েছে তেমনি একটা নতুন পরিচিতিও তৈরি হয়েছে। রোটারী যেমন মানবতার জন্যে কাজ করতে উদ্বুদ্ধ করে তেমনি মানুষে মানুষে মৈত্রী ও সহমর্মিতার বাণীও হৃদয়-গভীরে পৌঁছে দেয়। তবে মানুষ বলেই এ মহান পরিবারেও আজকাল রাজনীতির কূটকচাল ঢুকে পড়েছে। ঢুকে পড়েছে সম্পর্কের টানাপোড়েন, ঈর্ষা আর ক্ষমতার লোভ। যাকে-তাকে সদস্য বানিয়ে এর গুণগত মানের হানি করা হয়েছে। যদিও সদস্য বৃদ্ধিতে তাগিদ থাকে, কিন্তু এটাও সত্য, সবার জন্যে রোটারী নয়। রোটারীতে চিত্ত-বিত্তের সমন্বয় যেমন জরুরি, তেমনি জরুরি উদার ও মুক্তমন। সমাজে পরিচিতি পেতে, জনস্রোতে প্রভাব নিয়ে চলতে অনেকেই রোটারীতে এলেও রোটারীর মূল্যবোধকে ধারণ করতে পারে না। ফলে পল পার্সিভ্যাল হ্যারিসের ঘূর্ণায়মান রোটারী চক্র আজ পাকেচক্রে আবদ্ধ হয়ে পড়েছে। এরই নমুনা দেখতে পাই, রোটারী ইন্টারন্যাশন্যাল কর্তৃক ডিস্ট্রিক্ট ৩২৮২-কে সাময়িক অচেতন করে রাখার মধ্যে। (চলবে)

  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়