সোমবার, ২৫ নভেম্বর, ২০২৪  |   ২১ °সে
আজকের পত্রিকা জাতীয়আন্তর্জাতিকরাজনীতিখেলাধুলাবিনোদনঅর্থনীতিশিক্ষাস্বাস্থ্যসারাদেশ ফিচার সম্পাদকীয়
ব্রেকিং নিউজ
  •   ফরিদগঞ্জ পাকহানাদার মুক্ত দিবস পালন
  •   যৌথ অভিযানে কচুয়া থানার লুণ্ঠিত পিস্তলের ৮ রাউন্ড গুলি উদ্ধার
  •   দৈনিক ইনকিলাবের প্রশাসনিক কর্মকর্তা শহীদুল্লাহ্ মিজির দাফন সম্পন্ন
  •   শনিবার চাঁদপুরে ৪ শতাধিক নারী-পুরুষের অংশগ্রহণে ম্যারাথন প্রতিযোগিতা

প্রকাশ : ১৫ আগস্ট ২০২৩, ০০:০০

হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান
--------সেতারা কবির সেতু--------

‘সমবেত সকলের মতো আমিও গোলাপ ফুল খুব ভালোবাসি, রেসকোর্স পার হয়ে যেতে সেইসব গোলাপের একটি গোলাপ গতকাল আমাকে বলেছে আমি যেন কবিতায় শেখ মুজিবের কথা বলি। আমি তাঁর কথা বলতে এসেছি’।

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ১৯২০ সালের ১৭ মার্চ গোপালগঞ্জ জেলার টুঙ্গিপাড়ায় জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতার নাম শেখ লুৎফর রহমান আর মায়ের নাম সাহারা খাতুন। ৪ কন্যা ও ২ পুত্র সন্তানের মধ্যে শেখ মুজিবুর রহমান ছিলেন তৃতীয়। বঙ্গবন্ধুর ডাক নাম খোকা। তাঁর নানা শেখ আবদুল মজিদ তাঁর নাম রাখেন শেখ মুজিবুর রহমান।

১৯২৭ সালে ৭ বছর বয়সে শেখ মুজিবুর রহমান গিমাডাঙ্গা প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ভর্তির মাধ্যমে স্কুল জীবন শুরু করেন। নয় বছর বয়সে তথা ১৯২৯ সালে গোপালগঞ্জ পাবলিক স্কুলে ভর্তি হন এবং এখানেই ১৯৩৪ সাল পর্যন্ত পড়াশোনা করেন। সপ্তম শ্রেণীতে পড়ার সময় তিনি বেরিবেরি রোগে আক্রান্ত হন। এই কারণে দুই বছর পড়ালেখা বন্ধ ছিল। এরপর আবার চোখের গ্লুকোমা রোগ ধরা পড়ে। কলকাতায় নিয়ে গিয়ে অপারেশন করা হয়। তখন থেকেই তিনি চোখে চশমা ব্যবহার করেন।

১৯৩৮ সালে অবিভক্ত বাংলার প্রথম মুখ্যমন্ত্রী শেরে বাংলা একে ফজলুল হক এবং বাণিজ্য ও পল্লী মন্ত্রী হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী সাহেব গোপালগঞ্জে আসেন। মুসলিম লীগের নেতারা তাঁদের সংবর্ধনার ব্যবস্থা করেন। কিন্তু কংগ্রেস এতে বিরোধিতা করে। শেরে বাংলা একে ফজলুল হক এবং হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী সাহেব চলে যাওয়ার সময় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান তাঁদের গাড়ির সামনে এসে দাঁড়ান এবং ছাত্রাবাস সংস্কারের দাবি জানান। এভাবেই প্রথম অবিভক্ত বাংলার মুখ্যমন্ত্রী শেরে বাংলা একে ফজলুল হক এবং হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী সাহেবের সাথে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের প্রথম সাক্ষাৎ হয়। ওই দিন মন্ত্রীদের বিদায়ের পর কংগ্রেস নেতাদের অভিযোগের প্রেক্ষিতে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে গ্রেফতার করা হয়। এটিই বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জীবনে প্রথম কারাবাস।

১৯৪২ সালে তিনি ম্যাট্রিক পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে উচ্চ শিক্ষার জন্য কলকাতায় গিয়ে বিখ্যাত ইসলামিয়া কলেজে ভর্তি হন। এই কলেজে পড়ার সময় বঙ্গবন্ধু বেকার হোস্টেলের ২৪ নং কক্ষে থাকতেন। ১৯৪৬ সালে তিনি বিএ পাস করেন। পরবর্তীতে ১৯৯৮ সালে পশ্চিমবঙ্গের সরকার ২৩ ও ২৪ নং কক্ষকে একত্রিত করে বঙ্গবন্ধু স্মৃতি কক্ষ ঘোষণা দেন।

১৯৪৭ সালে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগে ভর্তি হন। ১৯৪৯ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের তৃতীয় শ্রেণির কর্মচারীরা তাদের দাবি-দাওয়া আদায়ের জন্য ধর্মঘট করেন। বঙ্গবন্ধুসহ আরো ২৬জন ছাত্র এই আন্দোলনে নেতৃত্ব দেন। আর এ জন্যে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ এই ২৭ জন ছাত্রের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেয়। সেই সাথে এই ২৭জন ছাত্রের মধ্যে কিছু ছাত্রকে বহিষ্কার করা হয়। ফলে বঙ্গবন্ধুর আর আইন পড়া হয় নি। এ কথা শুনে বঙ্গবন্ধুর পিতা শেখ লুৎফর রহমান খুব কষ্ট পান। তিনি ছেলেকে বলেছিলেন, ‘যদি ঢাকায় না পড়তে চাও, তবে বিলাত যাও। সেখান থেকে বার এট ল’ ডিগ্রি নিয়ে এস। যদি দরকার হয় আমি জমি বিক্রি করে তোমাকে টাকা দিব।’ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান তাঁর ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’ বইটির ১২৫ পৃষ্ঠায় এ কথা উল্লেখ করেছেন।

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ১৮ বছর বয়সে শেখ ফজিলাতুন্নেছা (রেনু)কে বিয়ে করেন। তাঁরা দুই কন্যা শেখ হাসিনা, শেখ রেহানা এবং তিন পুত্র শেখ কামাল, শেখ জামাল ও শেখ রাসেল এর জনক-জননী ছিলেন।

১৯৫২ সালের ২৬ জানুয়ারি পাকিস্তানের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী খাজা নাজিমুদ্দিন ঘোষণা দেন, একমাত্র উর্দুই হবে পাকিস্তানের রাষ্ট্র ভাষা।’ জেলে বন্দী অবস্থাতেই শেখ মুজিবুর রহমান রাষ্ট্র ভাষা আন্দোলনে সক্রিয়ভাবে নিজেকে জড়িত রেখেছিলেন। সেই সাথে আন্দোলন সফল করার জন্যে জেল থেকেই পাঠাতেন গুরুত্বপূর্ণ নির্দেশনা।

১৯৫৩ সালের ৪ ডিসেম্বর যুক্তফ্রন্ট গঠিত হয়। যুক্তফ্রন্টের নির্বাচনী প্রচারণা ২১ দফা দাবির ভিত্তিতে পরিচালিত হয়। প্রথম দফা ছিল বাংলাকে রাষ্ট্র ভাষা করা। ১৯৫৪ সালের ১০ মার্চ যুক্তফ্রন্টের নির্বাচন হয়। এই নির্বাচনে ২৩৭টি আসনের মধ্যে যুক্তফ্রন্ট ২২৩টি আসন পেয়ে জয় লাভ করে। মুসলিম লীগ অল্প সংখ্যক আসন পেয়ে শোচনীয়ভাবে পরাজিত হয়। সেই সাথে মুসলিম লীগের শাসনের অবসান ঘটে। ১৯৫৪ সালের ২ এপ্রিল মন্ত্রীসভা গঠিত হয়। মোট সদস্য ১৪ জন। শেরে বাংলা একে ফজলুল হক ছিলেন মুখ্যমন্ত্রী। ১৯৫৪ সালের যুক্তফ্রন্ট নির্বাচনে শেখ মুজিবুর রহমান গোপালগঞ্জ আসন থেকে নির্বাচিত হন এবং ১৫মে নতুন প্রাদেশিক সরকারের বন ও কৃষিমন্ত্রী হিসেবে শপথ গ্রহণ করেন। যদিও ১৯৫৪ সালের ৩০ মে যুক্তফ্রন্ট সরকার বাতিল করা হয়।

বঙ্গবন্ধু তাঁর জীবনী গ্রন্থ ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনীতে’ বলেছেন, একদিন সকালে আমি ও রেনু বিছানায় বসে গল্প করছিলাম। হাচু ও কামাল নিচে খেলছিল। হাচু মাঝে মাঝে খেলা ফেলে আমার কাছে আসে আর আব্বা আব্বা বলে ডাকে। কামাল চেয়ে থাকে। এক সময় কামাল হাসিনাকে বলছে, হাচু আপা, হাচু আপা তোমার আব্বাকে আমি একটু আব্বা বলি। আমি আর রেনু দুজনই শুনলাম। আাস্তে আস্তে বিছানা থেকে উঠে গিয়ে ওকে কোলে নিয়ে বললাম, আমিতো তোমারও আব্বা। কামাল আমার কাছে আসতে চাইত না। আজ গলা ধরে পড়ে রইল। বুঝতে পারলাম এখন আর ও সহ্য করতে পারছে না। নিজের ছেলেও অনেক দিন না দেখলে ভুলে যায়! আমি যখন জেলে যাই তখন ওর বয়স মাত্র কয়েক মাস। রাজনৈতিক কারণে একজনকে বিনা বিচারে বন্দী করে রাখা আর তার আত্মীয়-স্বজন ছেলেমেয়েদের কাছ থেকে দূরে রাখা যে কত বড় জঘন্য কাজ তা কে বুঝাবে? মানুষ স্বার্থের জন্য অন্ধ হয়ে যায়।’

১৯৬৬ সালের ৫ ফেব্রুয়ারি লাহোরে অনুষ্ঠিত এক সম্মেলনে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ৬ দফা দাবি উত্থাপন করেন। আনুষ্ঠানিকভাবে ৬ দফা দাবি উত্থাপন করা হয় ২৩ মার্চ। এই ৬ দফা ঐতিহাসিক লাহোর প্রস্তাবের ভিত্তিতে পূর্ব পাকিস্তানের স্বায়ত্ত শাসনের জন্য রচিত হয়েছিলো। বাঙালি জাতির মুক্তির সনদ ছিল এই ৬ দফা দাবি।

১৯৬৮ সালে পাকিস্তান সরকার রাষ্ট্রদ্রোহিতার অভিযোগ এনে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে প্রধান আসামি করে আরো ৩৪ জনের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করেন। যা আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা নামে পরিচিত ছিলো। এ মামলায় পাকিস্তান সরকার অভিযোগ করে যে, ভারতের ত্রিপুরা রাজ্যের রাজধানী আগরতলাতে শেখ মুজিবুর রহমান এক সশস্ত্র বিপ্লবের মাধ্যমে পাকিস্তানকে বিভক্ত করার ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হয়েছে। এই মামলার নাম ছিল রাষ্ট্রদ্রোহিতা বনাম শেখ মুজিব ও অন্যান্য।

আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলাকে কেন্দ্র করে ছাত্ররা সারা দেশে গণআন্দোলনের ডাক দেন। ১৯৬৯ সালে গণঅভ্যুত্থান শুরু হয়। ১৯৬৯ সালের ২০ জানুয়ারি ছাত্রনেতা আসাদকে গুলি করে হত্যা করা হয়। ২৪ জানুয়ারি মতিউর রহমানসহ আরো তিনজনকে গুলি করে হত্যা করা হয়। জনগণের চাপের মুখে ২০ ফেব্রুয়ারি ১৯৬৯ সালে পাকিস্তান সরকার আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা প্রত্যাহার করে। ২২ ফেব্রুয়ারি শেখ মুজিবুর রহমানকে মুক্তি দেয়া হয় এবং ২৩ ফেব্রুয়ারি ছাত্রনেতা তোফায়েল আহমেদ শেখ মুজিবুর রহমানকে ‘বঙ্গবন্ধু’ উপাধিতে ভূষিত করেন। গণঅভ্যুত্থানের সময় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ ১১ দফা কর্মসূচি ঘোষণা করে।

২৪ মার্চ আইয়ুব সরকারের পতন হলে ২৫ মার্চ ইয়াহিয়া ক্ষমতা দখল করে। সামরিক সরকারের বিরুদ্ধে আন্দোলন করা হলে ইয়াহিয়া ১৯৭০ সালে নির্বাচন দিতে সম্মত হয়। ১৯৭০ সালের ৭ ডিসেম্বর জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয় এবং ১৭ ডিসেম্বর প্রাদেশিক নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। এই নির্বাচনে আসন বন্টিত হয় জনসংখ্যার ভিত্তিতে। পূর্ব পাকিস্তানে কেন্দ্রীয় পরিষদে মোট আসন ছিলো ১৬৯টি। ১৬২টি নির্বাচিত আসন আর ৭টি সংরক্ষিত আসন। এর মধ্যে আওয়ামী লীগ লাভ করে ১৬৭টি আসন। পূর্ব পাকিস্তানের প্রাদেশিক পরিষদের মোট আসন ছিলো ৩১৩টি। ৩০০টি নির্বাচিত আর ১৩টি সংরক্ষিত। এর মধ্যে আওয়ামী লীগ লাভ করে ২৮৮টি আসন। আওয়ামী লীগ বিপুল সংখ্যক আসন পেয়ে জয়লাভ করলেও পশ্চিম পাকিস্তান ক্ষমতা হস্তান্তর করতে টালবাহানা শুরু করে। যার কারণে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ঐতিহাসিক ৭ মার্চের ভাষণ দেন।

১৯৭১ সালের ৭ মার্চ এক বিশাল জনসভায় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ঢাকার রমনায় অবস্থিত রেসকোর্স ময়দান (বর্তমান সোহরাওয়ার্দী উদ্যান) ঐতিহাসিক ৭ মার্চের ভাষণ দেন। ১৮ মিনিটের এই ভাষণে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের বাঙালিদের স্বাধীনতা সংগ্রামের জন্য প্রস্তুত হওয়ার আহ্বান জানান। ১২টি ভাষায় ভাষণটি অনুবাদ করা হয়। ২০১৭ সালের ৩০ অক্টোবর ইউনেস্কো এই ভাষণকে ঐতিহাসিক দলিল হিসেবে স্বীকৃতি দেয়। এই ভাষণে ৪ টি দাবির কথা বলা হয়। যথা :

ক) চলমান সামরিক আইন প্রত্যাহার।

খ) সৈনদের ব্যারাকে ফিরিয়ে নিতে হবে।

গ) গণহত্যার তদন্ত ও বিচার করতে হবে।

ঘ) নির্বাচিত প্রতিনিধিদের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করতে হবে।

১৯৭১ সালের ২৩ মার্চ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ধানমন্ডির ৩২ নম্বর বাড়িতে জাতীয় পতাকা উত্তোলন করেন। ২৪ মার্চ ইয়াহিয়া-মুজিব-ভুট্টো আলোচনা হয়। ২৫ মার্চ আলোচনা ব্যর্থ হবার পর সন্ধ্যায় ইয়াহিয়া ঢাকা ত্যাগ করেন। ২৫ মার্চ দিবাগত রাতে নিরীহ নিরস্ত্র বাঙালির ওপর পাকিস্তান সেনাবাহিনী ঝাঁপিয়ে পড়ে। আক্রমণ করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, পিলখানা রাইফেল সদর দপ্তর ও রাজারবাগ পুলিশ হেডকোয়ার্টার। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ২৫ মার্চ রাত ১২টা ২০ মিনিটে বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করেন :

This may be my last message, from to-day Bangladesh is independent. I call upon the people of Bangladesh wherever you might be and with whatever you have, to resist the army of occupation to the last.Your fight must go on until the last soldier of the Pakistan occupation army is expelled from the soil of Bangladesh and final victory is achieved.

অনুবাদ : এটাই হয়ত আমার শেষ বার্তা, আজ থেকে বাংলাদেশ স্বাধীন। বাংলাদেশের জনগণ তোমরা যে যেখানেই আছ এবং যার যা কিছু আছে তাই নিয়ে শেষ পর্যন্ত দখলদার সৈন্য বাহিনীকে প্রতিরোধ করার জন্য আমি তোমাদের আহ্বান জানাচ্ছি। পাকিস্তান দখলদার বাহিনীর শেষ সৈনিকটিকে বাংলাদেশের মাটি থেকে বিতাড়িত করে চূড়ান্ত বিজয় অর্জিত না হওয়া পর্যন্ত তোমাদের যুদ্ধ চালিয়ে যেতে হবে।

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের এই স্বাধীনতার ঘোষণাটি ওয়্যারলেসযোগে চট্টগ্রামে প্রেরণ করা হয়। ১৯৭১ সালে ২৬ মার্চ দুপুরে তৎকালীন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক আবদুল হান্নান বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের পক্ষে কালুরঘাট বেতার কেন্দ্র থেকে স্বাধীনতার ঘোষণাটি পাঠ করেন।

পাকিস্তান সেনাবাহিনী ১টা ৩০ মিনিটে বঙ্গবন্ধুকে ধানমন্ডির ৩২ নম্বর বাসা থেকে গ্রেফতার করে ঢাকা সেনানিবাসে নিয়ে যায় এবং ৩ দিন পর তাকে বন্দী অবস্থায় পাকিস্তানে নিয়ে যায়। ১০ এপ্রিল বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে রাষ্ট্রপতি করে প্রবাসী সরকার গঠিত হয়। ১৭ এপ্রিল মেহেরপুরের বৈদ্যনাথতলার আম্রকাননে (মুজিবনগর) বাংলাদেশ সরকারের শপথ গ্রহণ অনুষ্ঠিত হয়। বঙ্গবন্ধু রাষ্ট্রপতি, সৈয়দ নজরুল ইসলাম অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি এবং তাজউদ্দীন আহমদ প্রধানমন্ত্রী নির্বাচিত হন। প্রবাসী বাংলাদেশ সরকারের পরিচালনায় মুক্তিযুদ্ধ শেষে ১৬ ডিসেম্বর ঐতিহাসিক রেসকোর্স ময়দানে পাকিস্তানি বাহিনীর আত্মসমর্পণের মধ্য দিয়ে মুক্তিযুদ্ধে বিজয় অর্জিত হয়।

১৯৭২ সালের ৮ জানুয়ারি পাকিস্তান সরকার আন্তর্জাতিক চাপে বঙ্গবন্ধুকে মুক্তি দেয়। জুলফিকার আলী ভুট্টো বঙ্গবন্ধুর সাথে সাক্ষাৎ করেন। মুক্তি পেয়ে ৮ জানুয়ারি বঙ্গবন্ধু প্রথম লন্ডন যান। ৯ জানুয়ারি লন্ডনে ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী এডওয়ার্ড হীথের সাথে সাক্ষাৎ করেন। লন্ডন থেকে ঢাকা আসার পথে বঙ্গবন্ধু দিল্লীতে যাত্রাবিরতি করেন। বিমানবন্দরে ভারতের রাষ্ট্রপতি ভি.ভি. গিরি ও প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী বঙ্গবন্ধুকে স্বাগত জানান। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ১০ জানুয়ারি ঢাকায় পৌঁছান। ১০ জানুয়ারি ‘স্বদেশ প্রত্যাবর্তন’ দিবস। ১২ জানুয়ারি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান রাষ্ট্রপতির পদ থেকে প্রধানমন্ত্রীর পদ গ্রহণ করেন। একই দিনে রাষ্ট্রপতির পদে নিয়োগপ্রাপ্ত হন বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরী। ১৯৭২ সালের ৬ ফেব্রুয়ারি ভারত সরকারের আমন্ত্রণে প্রথম আন্তর্জাতিক সফর হিসেবে তিনি ভারতে যান। ২৮ ফেব্রুয়ারি সোভিয়েত ইউনিয়ন সফরে যান। ১২ মার্চ বঙ্গবন্ধুর অনুরোধে ভারতীয় মিত্র বাহিনী বাংলাদেশ ত্যাগ করে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ ১৯৪৯ সালে বঙ্গবন্ধুকে দেয়া বহিষ্কারাদেশ প্রত্যাহার করে।

১৯৭৩ সালে জাতীয় সংসদের প্রথম নির্বাচনে ৩০০ আসনের মধ্যে আওয়ামীলীগ ২৯৩টি আসন লাভ করে। ১৯৭৩ সালের ৬ সেপ্টেম্বর জোটনিরপেক্ষ আন্দোলনের শীর্ষ সম্মেলনে যোগদানের জন্য বঙ্গবন্ধু আলজেরিয়া যান। ১৭ অক্টোবর তিনি জাপান সফর করেন।

আলজেরিয়ায় ১৯৭৩ সালে জোট নিরপেক্ষ সম্মেলনে নেতা ফিদেল কাস্ট্রো জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু সম্পর্কে বলেন, - I have not seen the Himalayas. But I have seen Sheikh Mujib. In personality and in courage, this man is the Himalayas. I have thus had the experience of witnessing the Himalayas. অর্থাৎ, আমি হিমালয় দেখিনি। তবে শেখ মুজিবকে দেখছি। ব্যক্তিত্ব ও সাহসে এ মানুষটি হিমালয়ের সমান। এভাবে আমি হিমালয় দেখার অভিজ্ঞতা অর্জন করলাম।

১৯৭৪ সালের ২২ ফেব্রুয়ারি বাংলাদেশকে পাকিস্তান স্বীকৃতি দেয়। ২৩ ফেব্রুয়ারি ইসলামী সম্মেলন সংস্থার (ওআইসি) শীর্ষ সম্মেলনে যোগদানের উদ্দেশ্যে বঙ্গবন্ধু পাকিস্তান গমন করেন। ১৭ সেপ্টেম্বর ১৯৭৪ সালে বাংলাদেশ জাতিসংঘের সদস্যপদ লাভ করে এবং বঙ্গবন্ধু ২৫ সেপ্টেম্বর জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের অধিবেশনে প্রথমবারের মত বাংলায় ভাষণ দেন।

১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট বাঙালির শোকের দিন। জাতির ইতিহাসে কলঙ্কময় দিন। ১৯৭৫ সালের এই দিন ভোরে একদল উচ্চাভিলাষী বিশ্বাসঘাতক সেনাবাহিনীর অফিসারদের হাতে হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি বাংলাদেশের স্থপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান নিহত হন। সেদিন বঙ্গবন্ধুর সহধর্মিণী মহীয়সী নারী শেখ ফজিলাতুন্নেছা, বঙ্গবন্ধুর জ্যেষ্ঠপুত্র মুক্তিযোদ্ধা লেঃ শেখ কামাল, পুত্র লেঃ শেখ জামাল, কনিষ্ঠ পুত্র শেখ রাসেল, দুই পুত্র বধূ সুলতানা কামাল ও রোজি জামালসহ অন্যান্য স্বজনকে হত্যা করে। বঙ্গবন্ধুর দুই কন্যা মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও শেখ রেহানা জার্মানিতে থাকায় প্রাণে বেঁচে যান। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার প্রয়াত স্বামী ড. এমএ ওয়াজেদ মিয়া ‘বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবকে ঘিরে কিছু ঘটনা ও বাংলাদেশ’ গ্রস্থে বর্ণনা করেছেন শেখ রাসেলকে হত্যার ঘটনা। সেখানে তিনি উল্লেখ করেন, ‘মৃত্যুর আগে শেখ রাসেল বলেছিলেন, আল্লাহর দোহাই আমাকে জানে মেরে ফেলবেন না। আমার হাসু আপা দুলাভাইয়ের সাথে জার্মানিতে আছেন। আমাকে মারবেন না, দয়া করে আপনারা আমাকে জার্মানিতে তাদের কাছে পাঠিয়ে দিন।’ সেদিন রাসেলের এই আর্তচিৎকারে খোদার আরশ কেঁপে উঠলেও টলাতে পারেনি খুনি পাষাণদের মন। বঙ্গবন্ধু এবং তাঁর পরিবারের অন্যান্য সদস্যের মতো এই নিষ্পাপ শিশুকেও পঁচাত্তরের ১৫ আগস্ট ঠাণ্ডা মাথায় খুন করা হয়।

বঙ্গবন্ধু মোট ৪৬৮২ দিন কারাগারে ছিলেন। এর মধ্যে ব্রিটিশ আমলে ছিলেন ৭ দিন কারাগারে। (কোন ব্যক্তিগত মামলায় না জড়িয়ে)

বঙ্গবন্ধু ১৯৬৯ সালের ৫ ডিসেম্বর হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী সাহেবের মৃত্যুবার্ষিকীতে ভাষণ দেয়ার সময় পূর্ব পাকিস্তানের নাম বাংলাদেশ রাখেন। সেই বুকে ১৮টি গুলি নিয়ে বিদায় নিলেন। ক্ষমা কর আমাদের, হও জান্নাতি।

তথ্য সূত্র : অসমাপ্ত আত্মজীবনী, কারাগারের রোজনামচা, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিকে ঘিরে কিছু ঘটনা ও বাংলাদেশ।

লেখক : সেতারা কবির সেতু, প্রভাষক, সমাজকর্ম বিভাগ, আল আমিন একাডেমি স্কুল এন্ড কলেজ।

  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়