প্রকাশ : ১৭ জুন ২০২৩, ০০:০০
ত্রিশ বছর। মানুষের জীবনে এ বয়স হচ্ছে জীবনের সোনালী সময়। নূতনকে জয় করার এবং চ্যালেঞ্জ মোকাবেলার এটাই সুবর্ণকাল। কিন্ত মফস্বলের একটা দৈনিক পত্রিকার জন্যে ত্রিশ বছরের পথপরিক্রমা অনেক পরিপক্ক একটা সময়। একটা পত্রিকার জন্যে এটা মহীরুহ হয়ে ওঠার উপযুক্ত নির্ণায়ক। ত্রিশ বছরের ব্যাপ্তিতে দৈনিক চাঁদপুর কণ্ঠ আজ মেঘনাপাড়ের ইলিশের বাড়ির জনগণের কণ্ঠরূপে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেছে। ত্রিশতম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর এ লগ্নে এটা বলতেই হয়, দৈনিক চাঁদপুর কণ্ঠ কেবলমাত্র একটি সংবাদপণ্য বিক্রয়ের প্রতিষ্ঠান নয়, এটি একটি নীতিনিষ্ঠ সামাজিক আন্দোলনও বটে। পাঠকের জন্যে এটি একদিকে যেমন লাইব্রেরি বা গ্রন্থাগারের ভূমিকা পালন করে যাচ্ছে, তেমনি অন্যদিকে এটি সামাজিক দায়িত্ব নিজের কাঁধে নিয়ে সার্ভিস ফর হিউম্যানিটির প্রতি নিজেকে নিবেদন করে যাচ্ছে। কিছু কিছু প্রতিষ্ঠান পেশাদারি যে কাজের জন্যে গড়ে উঠে, দেশ ও সমাজের প্রতি তার দায়বদ্ধতার কারণে তা আর ঐ পেশার প্রতিষ্ঠানরূপে সীমাবদ্ধ না থেকে হয়ে উঠে সাধারণ মানুষের হৃদয়ের সম্মিলন-কেন্দ্র। তখন অর্থনীতির অর্থ নয়, জীবনের অর্থকে অর্থবহ করে তোলাই তার মূলমন্ত্র হয়ে দাঁড়ায়। মানুষ তখন এর মাঝে খুঁজে পায় নিজ জীবনের আনন্দণ্ডবেদনার আপন সুর। এ ধরনের প্রতিষ্ঠান তখন হয়ে উঠে সাধারণ মানুষের জীবনকে যাপনের নিত্য অনুষঙ্গ। তিরিশে পদার্পণ করতে যাওয়া চাঁদপুর কণ্ঠ তেমনই এক প্রতিষ্ঠান, যা আজ এই মেঘনাপাড়ের মানুষের আশা-আকাঙ্ক্ষার প্রতিচ্ছবি হয়ে দাঁড়িয়েছে।
কোন্টি সংবাদ বা কোন্টি সংবাদ নয় তা নির্বাচনের দায়িত্বে এ পত্রিকাটি অত্যন্ত সতর্ক ও সাবধানী। প্রমিত বানান রীতি ও আদর্শ প্রকাশনার মান বজায় রেখে জনগণকে তথ্যের আলোকদীপে পথ দেখিয়ে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছে দৈনিক চাঁদপুর কণ্ঠ।
একটি পত্রিকাকে পাঠকের মনে স্থায়ী আসন করে নিতে হলে সময়ের সাথে নিজেকে তাল মিলিয়ে নিতে হয়। সংবাদ পরিবেশনে যেমন আধুনিক হতে হয় তেমনি মননশীল ও সৃজনশীল সমাজ গঠনে তাকে নিবেদিতপ্রাণ হতে হয়। সীমিত সামর্থ্যের মধ্যে থেকেও দৈনিক চাঁদপুর কণ্ঠ বিভিন্ন বিষয়ে সম্পূরক পাতা প্রকাশ করে পাঠকের সময়কে ফলপ্রসূ করে তোলার চেষ্টা করেছে। দীর্ঘদিন ধরে পাঠকফোরামণ্ডএর পাতা চলমান রেখে একদিকে যেমন পাঠক তৈরিতে সচেষ্ট আছে, তেমনি অন্যদিকে পাঠক হতে লেখক সৃষ্টির প্রক্রিয়াকেও অব্যাহত রেখেছে। চাঁদপুরে আজকের অনেক স্থানীয় কবি-সাহিত্যিক চাঁদপুর কণ্ঠের পাঠক ফোরামের অবদান। পাঠক ফোরামে বিষয়ভিত্তিক লেখার পাশাপাশি মাঝে মাঝে প্রতিযোগিতার আমেজ এনে পাতাটিকে উপভোগ্য করে তোলার ব্যবস্থা করা হয়েছে। চাঁদপুর কণ্ঠের একটি সমৃদ্ধ পাতা হলো পাক্ষিক সাহিত্য পাতা। এতে কেবল স্থানীয় সাহিত্যিকই নয়, জাতীয় ও প্রবাসী বাঙালি লেখকদের সৃজনশস্যের আবাদ করা হয় মানের বিবেচনায়। চিকিৎসাঙ্গনের পাতার মাধ্যমে সাধারণ মানুষ যেমন নিজেদের স্বাস্থ্য বিষয়ে সচেতন হতে পারছে, তেমনি অনেকের রোগের চিকিৎসাও এ পাতায় বর্ণিত পরামর্শে সুসম্পন্ন হয়। ক্রীড়াকণ্ঠের বিপুল পাঠক অধীর আগ্রহে বসে থাকে মঙ্গলবার আসবে বলে। স্থানীয় ক্রীড়াঙ্গনের খুঁটিনাটি খুব সুন্দর করে তুলে ধরা হয় এ পাতাটিতে। শুক্রবারের শিশুকণ্ঠ এবং ইসলামী কণ্ঠের মাধ্যমেও সমাজে বহু মানুষকে একদিকে যেমন নৈতিক শিক্ষায় আলোকিত করে তোলা হচ্ছে, তেমনি অন্যদিকে আগামীদিনের আদর্শ নাগরিক হিসেবে গড়ে তোলা হচ্ছে। এছাড়াও কৃষিকণ্ঠ, তথ্য-প্রযুক্তি, প্রবাসী কণ্ঠ কিংবা শিক্ষাঙ্গন পাতার মাধ্যমে সমাজে সংশ্লিষ্ট শ্রেণিকেও পাঠক হিসেবে বিনোদিত করার পাশাপাশি জ্ঞানভিত্তিক সমাজ বিনির্মাণে অবদান রাখার চেষ্টা করা হচ্ছে। হাল আমলে দৈনিক চাঁদপুর কণ্ঠে সংযুক্ত হয়েছে 'সুচিন্তা' নামের একটি মননশীল পাতা, যাতে জাতির চিন্তা¯্রােত কোন্দিকে ধাবমান তার একটা গতিপথ পাওয়া যায়। মুক্তবুদ্ধির জাতি বিনির্মাণে 'সুচিন্তা'র মতো পাতা এক দূরদর্শী প্রজ্ঞার বাস্তবায়ন। দৈনিক চাঁদপুর কণ্ঠের সম্পাদকীয় কলাম বর্তমানে প্রধান সম্পাদক মহোদয় নিজেই লেখেন। এর মাধ্যমে কখনো কখনো স্থানীয় সমস্যাগুলোকে জাতির কাছে উপয্ক্তু গুরুত্ব সহকারে যেমন উপস্থাপন করা হয়, তেমনি কিছু কিছু অর্জন ও কিছু কিছু প্রত্যাশারও প্রতিফলন ঘটে। সম্পাদকীয় কলামে প্রকাশিত হওয়ার পর কিছু কিছু সমস্যার সমাধানও হতে দেখেছি ত্বরিৎ সিদ্ধান্তে। কাজেই দৈনিক চাঁদপুর কণ্ঠ কেবল সংবাদপণ্য বিক্রয়কারী প্রতিষ্ঠান হিসেবে নিজেকে সীমাবদ্ধ না রেখে সত্যিকার অর্থেই জনতার সংসদ হিসেবে নিজেকে সুপ্রতিষ্ঠিত করেছে।
জাতিকে যুক্তিঋদ্ধ সৃজনশীল ও মুক্তচিন্তার সূতিকাগার হিসেবে গড়ে তুলতে হলে বিতর্কচর্চার বিকল্প নেই। দৈনিক চাঁদপুর কণ্ঠ নিজেই পাঞ্জেরী পাবলিকেশন্সের সহযোগিতায় প্রায় একযুগ ধরে জেলাব্যাপী বিতর্ক প্রতিযোগিতা চালিয়ে আসছে। এর মাধ্যমে একদিকে তৃণমূল থেকে নতুন নতুন বিতার্কিক যেমন উঠে এসেছে, তেমনি গাঁ-গঞ্জের শিক্ষকদের মধ্যে বিতর্ক ও যুক্তিচর্চার দিকে মনোযোগী হওয়ার প্রবণতা বেড়েছে। জেলায় প্রথম বিতর্ক শিক্ষণের প্রতিষ্ঠান তথা চাঁদপুর বিতর্ক একাডেমি চালু করে দৈনিক চাঁদপুর কণ্ঠ রেকর্ড সৃষ্টি করেছে এবং জেলাকে গৌরবের অধিকারী করেছে। করোনা-সঙ্কটে একাডেমির কার্যক্রম স্থগিত থাকায় অনেকেই উদ্বেগের সাথে খোঁজ-খবর করেছেন, একাডেমির কার্যক্রম আবার কবে চালু হবে। এই অনুসন্ধানই বলে দেয়, এ কার্যক্রম কতোটুকু জনপ্রিয় ও গ্রহণযোগ্য ছিল বিতার্কিক ও অভিভাবক মহলে। জাতীয় বিতর্ক উৎসব, জাতীয় রবীন্দ্র সঙ্গীত সম্মিলন পরিষদের উৎসব ও দূরপাল্লার সাঁতারুদের নিয়ে সফল সাঁতারের আয়োজনেও দৈনিক চাঁদপুর কণ্ঠ মুখ্য ভূমিকা পালন করেছে। চাঁদপুর জেলা ব্র্যান্ডিং কার্যক্রমে দৈনিক চাঁদপুর কণ্ঠের ভূমিকা ছিল অসাধারণ।
দুপাতার মাত্র চার পৃষ্ঠার পত্রিকা হলেও চাঁদপুর কণ্ঠ সবার পিপাসাকে মেটানোর চেষ্টা করে। ফলে দ্বিতীয় পৃষ্ঠায় ডানদিকে অষ্টম কলামে ‘হেরার আলো’ থেকে শুরু করে ‘বাণী চিরন্তনী’ এবং ‘এইদিনে’ শিরোনামে অতীত বছরের কিছু গুরুত্বপূর্ণ তথ্য সংযোগ করে চাঁদপুর কণ্ঠ চেষ্টা করেছে মানুষকে মনে করিয়ে দিতে ইতিহাসকে। সংবাদে-ফিচারে সমৃদ্ধ পত্রিকাটি হলুদ সাংবাদিকতা থেকে হাজার মাইল দূরে রেখে নিজেকে দ্যুতি ছড়িয়ে চলেছে মননশীল মহলে। আর্থিক সঙ্গতির জন্যে বিজ্ঞাপনকে আঁকড়ে ধরলেও বিজ্ঞাপনে পত্রিকাটি গিলতে পারেনি কখনো। ফলে খবরের কাগজের পরিচয়টা তার সর্বদাই ছিল পরিচ্ছন্ন ও জ্বলজ্বলে। চাঁদপুর কণ্ঠ বর্তমানে অনলাইন ভার্সনেও পাঠকদের কাছে পৌঁছে যাচ্ছে দেশে-বিদেশে। লক্ষ লক্ষ পাঠক অনলাইনে পত্রিকাটি পড়ছে। চাঁদপুর কণ্ঠের আরেকট বড় অর্জন হলো দক্ষ সংবাদকর্মী গড়ে তোলা ও সাংবাদিক নেতা সৃজন করা। এ পত্রিকায় কাজ করা অনেকেই পরবর্তীতে অন্য পত্রিকার সম্পাদক যেমন হয়েছেন তেমনি প্রেসক্লাবের সভাপতি-সেক্রেটারির পদও অনেকেই অলঙ্কৃত করেছেন।
দৈনিক চাঁদপুর কণ্ঠের সাথে আমার সম্পর্ক দীর্ঘদিনের। প্রায় বিশ বছর ধরে চাঁদপুর কণ্ঠ হাতে নিতে নিতে এর একটা নিজস্ব ঘ্রাণ আমার নাকে তৈরি হয়ে গেছে। বানান ভুলের অত্যাচার যেমন নেই, তেমনি শিরোনামেও থাকে না কোনো অসঙ্গতি। আজকাল সপ্তাহে দু-একদিন চাঁদপুর কণ্ঠ প্রথম ও শেষ পৃষ্ঠা বর্ণিল হয়ে প্রকাশিত হয়। এটা পাঠকের জন্যে সোনায় সোহাগা। ঊনিশশো চুরানব্বই সালে যে পত্রিকার যাত্রা শুরু, সে পত্রিকা আজ পাঠকের কল্যাণে পরিণত হয়েছে ত্রিশ বছরের মহীরুহে। এভাবে পথ চলতে চলতে একদিন এই পত্রিকা পঞ্চাশ অতিক্রম করে শতবর্ষী হবে। একদিন এই চাঁদপুর কণ্ঠই জাতীয় দৈনিকরূপে মুক্তবুদ্ধি চর্চার ঝর্ণাতলা হয়ে উঠবে। এ আশা মিছে নয় মোটেই।