প্রকাশ : ১৬ জুন ২০২৩, ০০:০০
প্রযুক্তির কল্যাণে এদেশে অনলাইন মিডিয়া বেশ এগিয়েছে। ঠিক উল্টো পথ ধরে প্রিন্ট মিডিয়া পিছিয়ে পড়েছে অনেকটাই। অনলাইন মিডিয়ার মাধ্যমে এতো দ্রুত সংবাদ জনসাধারণের মধ্যে পৌঁছে যাচ্ছে যে, পরদিন প্রিন্ট মিডিয়ার সংবাদগুলো সকালে আর নয়া থাকছে না। তাই ঘরে ঘরে অফিস-আদালত, পাড়া-মহল্লার চায়ের দোকানে আর আগের মতো সংবাদপত্র রাখা হয় না। সকালে নেই পত্রিকা নিয়ে কাড়াকাড়িও। প্রশ্ন হলো, প্রযুক্তির এই যুগে তাহলে কি প্রিন্ট মিডিয়া হারিয়ে যাবে? প্রিন্ট মিডিয়া বন্ধ হয়ে না গেলেও যে অনলাইন প্রযুক্তির এই যুগে মুদ্রিত দৈনিক সঙ্কটে পড়েছে এটা স্পষ্টই বোঝা যাচ্ছে। প্রিন্ট মিডিয়া হিসেবে বাংলাদেশের পত্র-পত্রিকার সেই আগের চেহারা আর নেই। সেখানে টেকনোলজির অনুপ্রবেশ ও অভিঘাত আজ সুস্পষ্ট। পুরানো ট্রেডিশন ভেঙ্গে ছাপা পত্রিকার চেয়ে অনলাইন সংস্করণ আজ বেশি জনপ্রিয় হয়ে উঠছে। এ অবস্থায় আমরা ভাবছি, ভবিষ্যতে কাগজের প্রিন্ট মিডিয়া আদৌ থাকবে কিনা।
৪৯ বছর আগে যুক্তরাষ্ট্রে ইলিনয়েস স্টেট ইউনিভার্সিটি থেকে ১৯৭৪ সালে ‘নিউজ রিপোর্ট’ নামে প্রথম অনলাইন নিউজ পোর্টাল প্রথম প্রকাশিত হয়। এরপর বিশ্বজুড়ে বিভিন্ন সংবাদপত্র তাদের অনলাইন সংস্করণ চালু করে। তবে ২০০০ সালে যুক্তরাজ্য থেকে প্রকাশিত ‘সাউথপোর্ট রিপোর্টার’ আধুনিক অনলাইন নিউজ পোর্টাল হিসেবে পরিচিতি পায়। বিশ্বে অনলাইন জগতের যাত্রা শুরুর ৩৪ বছর পর ২০০৪ সালে যাত্রা শুরু করে বাংলাদেশের প্রথম অনলাইন নিউজ পোর্টাল বিডিনিউজ২৪.কম। বিশিষ্ট সাংবাদিক আলমগীর হোসেন ছিলেন এর প্রধান সম্পাদক ও অন্যতম উদ্যোক্তা। তবে আর্থিক সঙ্কটের কারণে ২০০৬ সালের সেপ্টেম্বরে বিডিনিউজের মালিকানা কিনে নেন বিবিসির সাবেক সাংবাদিক তৌফিক ইমরোজ খালেদী। এর কিছু সময় পরেই যাত্রা শুরু করে আরেক অনলাইন নিউজ পোর্টাল দ্য এডিটর ডট নেট। ২০০৭ সালে আলমগীর হোসেন আবারও শুরু করেন নতুন একটি অনলাইন নিউজ পোর্টাল ও বার্তা সংস্থা একাত্তর নিউজ সার্ভিস (ইএনএস)। তবে যাত্রা শুরুর কয়েক মাসের মধ্যেই এটিও বন্ধ হয়ে যায়। বিডিনিউজের পরে অনলাইন সাংবাদিকতায় জনপ্রিয় হয়ে উঠে অনলাইন নিউজ পোর্টাল শীর্ষ নিউজ ডট কম। ২০০৯ সালের ১৯ আগস্ট যাত্রা শুরু করা শীর্ষ নিউজের সম্পাদক একরামুল হক ২০১১ সালের শেষ দিকে গ্রেফতার হওয়ার পর পোর্টালটি দীর্ঘদিন বন্ধ ছিল। পরবর্তীতে ২০১৩ সালের ১ জুন নতুনভাবে আপডেট শুরু করে শীর্ষ নিউজ।
২০১০ সালের ফেব্রুয়ারিতে আলমগীর হোসেন আবারও শুরু করেন নতুন অনলাইন নিউজ পোর্টাল বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম। এর কয়েক মাস পরেই সাংবাদিক সরদার ফরিদ আহমেদের নেতৃত্বে যাত্রা শুরু করে বার্তা টুয়েন্টি ফোর ডট নেট। গণমাধ্যম বিষয়ক সংবাদ প্রকাশের জন্যে এই পোর্টাল বেশ জনপ্রিয় হয়েছিল। আর্থিক সঙ্কটের কারণে ২০১২ সালের শেষ দিকে বন্ধ হয়ে যায় বার্তা টুয়েন্টি ফোর ডট নেট। এরপর তারই নেতৃত্বে প্রতিষ্ঠা লাভ করে নতুন বার্তা ডট কম। এরই ধারাবাহিকতায় ২০১৩ সালে দেশে বেশ কিছু অনলাইন নিউজ পোর্টাল জনপ্রিয় হয়ে উঠে। এর মধ্যে রয়েছে বাংলামেইল২৪.কম, প্রিয়.কম, দ্য রিপোর্ট ডট কম, পরিবর্তন ডট কম, রাইজিংবিডি.কম। দেশে অনলাইন মিডিয়া এগিয়ে গেলেও প্রিন্ট মিডিয়া পিছিয়েছে অনেকটাই।
বিশেষ করে করোনা মহামারির আগে থেকে প্রথাগত মুদ্রণমাধ্যম বেশ সমস্যার মধ্যে ছিলো সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের ব্যাপক বিস্তারের ফলে। কোভিড-১৯-এ যখন মানুষ ঘরবন্দি হলো, তখন প্রিন্ট পত্রিকা হোঁচট খেতে শুরু করে। স্বাস্থ্য বিজ্ঞানীরা যখন বললেন প্রিন্ট পত্রিকা থেকেও কোভিড ছড়ায় তখন মানুষ পত্রিকা কেনা বন্ধ করে দেয়। প্রিন্ট সংবাদপত্রের কফিনের শেষ পেরেকটা সম্ভবত তখনই ঠোকা হয়েছিলো। এই মহামারির পর মুদ্রণমাধ্যম বাংলাদেশসহ সারা পৃথিবীতে গভীরতর সঙ্কটের মধ্যে পড়ে যায়। পত্রিকার মালিকরা ছাপা সংস্করণের ভবিষ্যৎ নিয়ে সঙ্কটে পড়ে। এ সময় দেশের প্রথম সারির একটি ইংরেজি দৈনিক তাদের মুদ্রণ সংস্করণ বন্ধ করে দেয়। মানুষ যখন পত্রিকা থেকে দূরে সরতে থাকে বিভিন্ন পত্র-পত্রিকার সার্কুলেশন একেবারে নিচে নামতে থাকে। কোভিড মহামারির দাপট এখন নেই, নেই পত্রিকা হাতে নিলে আক্রান্ত হওয়ার ভয়। সেই যে মানুষ প্রিন্ট পত্রিকা থেকে সরে এলো আর ফিরলো না সেখানে। প্রিন্ট মিডিয়ার জন্যে এটা একটা বিশাল ধকলই বলা চলে। অন্যদিকে দিনদিন অনলাইন মিডিয়া তরতর করে বেড়ে উঠে। মন্দ কথা হলো, অনলাইন মিডিয়াগুলো সহজলভ্যতার কারণে মানহীন মানুষের হাতে চলে যাচ্ছে। দুই হাজার ৫ হাজার টাকায় অনলাইন মিডিয়ার ওয়েবসাইট তৈরি করে সাংবাদিকতা বোঝেন না এমন মানুষের হাতে অনলাইন মিডিয়া চলে যায়।
সময় সব কিছু বদলে দেয়। সময়ের ধর্মই হলো বদলে যাওয়া। এই বদল গণমাধ্যমেও অনিবার্য হয়। www. বললেই এক সময় মানুষ নাক সিঁটকাতো। ২০০৮ সালের কথা। জনকণ্ঠের সাথে আছি। বর্তমান প্রধানমন্ত্রীর ফটোগ্রাফার ইয়াসিন কবির জয় ভাই ফটো সাংবাদিক হিসেবে বেশ দাপুটে ছিলেন। ফটো সেকশনে জয় ভাইয়ের সাথে বিভিন্ন বিষয় নিয়ে কথা বলছিলাম। এক ফাঁকে তিনি অনলাইন মিডিয়া করছেন বলে জানালেন। নাম ফোকাস বাংলা। আমাকেও উদ্বুদ্ধ করলেন। আমিও সে সময় নিউজ বাংলাদেশ.কম নামে একটি অনলাইন পোর্টাল চালু করলাম। রাজধানীর দিলকুশার বিসিআইসি ভবনের ১৭ তলায় কার্যক্রম শুরু করি। বিপদে পড়লাম, কারণ অনলাইনে কাজ করার লোকও ছিলো না তখন। আর অনেকের এ নিয়ে আগ্রহও ছিলো কম। তখন এটা মানুষের কাছে সহজ কিংবা পরিচিত বিষয় ছিলো না। এরপর থেকেই দেখলাম অনলাইন মিডিয়া দিনদিন দ্রুত এগুচ্ছে। এই পরিবর্তনের সঙ্গে অনেক দৈনিক কেউ মানিয়ে নিতে তাদের পত্রিকার অনলাইন ভার্সন চালু করে। তা ছিলো নেহাৎই হাতে গোণা কয়েকটা। এখনতো অখ্যাত আর আন্ডরগ্রাউন্ড পত্রিকারও অনলাইন ভার্সন আছে। ‘সারভাইভ্যাল অব দ্য ফিটেস্ট’ এই সূত্র আমাদের প্রিন্ট পত্রিকায় পরিবর্তন শুরু হয়। এখনতো মানুষ প্রিন্ট পত্রিকা যতোটা না পড়ে তার চেয়ে বহুগুণ ঐ পত্রিকার অনলাইন সংস্করণে যুক্ত থাকে পাঠক। পরিবেশ-প্রতিবেশের সঙ্গে বদলাতে তাই আমাদের দেশের প্রিন্ট পত্রিকাগুলো সময়ের সঙ্গে নিজেদের বদলে নিয়েছে। প্রিন্ট মিডিয়া তাদের অনলাইন সংস্করণ শুরু করলেও তারা কিন্তু আর্থিকভাবে লাভবান হতে পারেনি। বেশির ভাগ পত্রিকার অনলাইন ভার্সন পাঠককে ফ্রিতেই দিতে হচ্ছে।
যেভাবেই হোক, গত দুই দশকে বাংলাদেশে অনলাইন পত্রিকার বিকাশ ঘটেছে বিস্তৃত আকারে। এদেশে অনলাইন পোর্টাল তৈরি সহজলভ্য হওয়ার কারণে সংখ্যায় নিয়ন্ত্রণহীন হারে বাড়লেও মানসম্মত ও বিশ্বাসযোগ্য অনলাইন পত্রিকা সে অর্থে এখনো বিরল। মানসম্পন্ন যেগুলোকে বলা চলে, তার প্রায় সবই প্রথম সারির মুদ্রিত পত্রিকা বা টেলিভিশন চ্যানেলের অনলাইন ভার্সন। তবে নতুন প্রযুক্তিনির্ভর অনলাইন প্ল্যাটফরমই যে আগামী দিনের গণমাধ্যমের সূতিকাগার হতে যাচ্ছে, গণমাধ্যম বিশেষজ্ঞরা অন্তত সে বিষয়ে নিঃসন্দেহ। খুব কম আয়োজনের মধ্য দিয়েই একটি অনলাইন পত্রিকার মালিক বা প্রকাশক বা সম্পাদক হওয়া যায়। ফলে অনেকেই কেবল এই সুযোগটি উপভোগ করতেই এক বা একাধিক অনলাইন পত্রিকা চালু করে থাকেন। পরে সেটিকে চালু রাখার তাগিদে অন্যান্য মাধ্যম থেকে সংবাদ ও অন্যান্য আধেয় ‘চুরি’ করা ছাড়া তাদের আর গত্যন্তর থাকে না। নিজেদের পরিচিতি বাড়াতে অনেকে মিথ্যা এবং ‘মুখরোচক’ সংবাদ তৈরি করে প্রচার করেন। কষ্টের কথা হলো, এসব মুখরোচক সংবাদের কারণে অখ্যাত অনলাইনগুলোর সংবাদও ভাইরাল হয়ে যায়। তাতে অনলাইন মালিকের হয় পোয়াবারো। চৌর্যবৃত্তির ফলে একজনের মনগড়া সংবাদ অনলাইন পত্রিকার জনপ্রিয় বা ‘সর্বাধিক পঠিত’ খবর হয়ে উঠছে।
চটকদার এবং মিথ্যা তথ্য দিয়ে পরিবেশিত খবরে কখনোই বিশ্বাসযোগ্যতা অর্জন করা যায় না। তবে সাময়িকভাবে পাঠক বিভ্রান্ততো হয় বটেই। আস্থার জায়গা তৈরি করতে না পারলে স্থায়ী পাঠক পাওয়া যায় না। একসময় সেই পোর্টালগুলোতে মানুষ আর প্রবেশ করতে চায় না। ফ্লোটিং বা ভাসমান পাঠক যখন যেখানে তাদের পছন্দের বিষয় পাবে, তখন সেখানেই চলে যাবে। তাই অনলাইন পত্রিকাগুলোকে প্রথম সারির মুদ্রিত পত্রিকা, রেডিও বা টেলিভিশন চ্যানেলের মতোই দায়িত্বশীলতার পরিচয় দিতে হবে; সস্তা জনপ্রিয়তা বা কেবল ক্লিক বাড়ানোর মাধ্যমে সাময়িক ফললাভের মনোভাবের পরিবর্তে নির্ভুল ও বিশ্বাসযোগ্য খবর প্রচারের দিকে মনোনিবেশ করতে হবে। অন্য গণমাধ্যম থেকে খবর সরাসরি ‘ধার’ বা ‘চুরি’ না করে বরং সেগুলোকে খবরের প্রাথমিক উৎস হিসেবে বিবেচনা করতে হবে এবং নিজের সোর্স কাজে লাগিয়ে এর সত্যতা যাচাই করে নিতে হবে। সবচেয়ে বড় কথা, নিজের সোর্স কাজে লাগিয়ে এক্সক্লুসিভ সংবাদ, ফিচার বা মতামত প্রকাশ করতে হবে। মনে রাখতে হবে, এ ধরনের আধেয় দিয়ে কখনোই সফলতা লাভ করা সম্ভব নয়।
আমাদের দেশের অনলাইনগুলো নকল আর চুরি করা খবর দিয়ে ভরা থাকে। তাতে করে পাঠককে বিশ্বাসযোগ্যতায় ফেরানো কঠিন। যেহেতু অনলাইন প্ল্যাটফরম সামনের দিনগুলোতে গণমাধ্যমের মূল আশ্রয়স্থল হতে যাচ্ছে, তাই অনলাইনের মালিক কিংবা সম্পাদককে সংবাদ প্রকাশের ব্যাপারে অনেক বেশি দায়িত্বশীল হতে হবে। অনলাইন প্ল্যাটফরমের বিশ্বাসযোগ্যতা এখন প্রশ্নবিদ্ধ। অনলাইন গণমাধ্যমের কারণে দেশে ‘হলুদ সাংবাদিক’ অনেক বেড়ে গেছে। সেদিন জাতীয় প্রেসক্লাবে সিনিয়র ক’জন সাংবাদিকের সাথে আড্ডা দিচ্ছিলাম। এ প্রসঙ্গে জাতীয় প্রেসক্লাবের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক বাসসের বার্তা সম্পাদক আইয়ুব ভূঁইয়া ভাই বলেন, ‘চারদিকে সবইতো দেখি সাংবাদিক’। ২/৩ হাজার টাকা দিয়ে কোনো রকমে একটা অনলাইন পোর্টাল খুলেই আর সাংবাদিক পরিচয় দেয় না, বলে আমি অমুক দৈনিকের সম্পাদক। প্রকৃত এবং ভুয়া অনলাইন পোর্টালের মধ্যে পার্থক্য নিরূপণ করা খুব কঠিন হয়ে গেছে। মানুষ এখন আর অনলাইনের সংবাদ বিশ্বাস করতে চায় না। কোন্টা সঠিক আর কোন্টা ভুয়া সংবাদ তা দিয়ে বিভ্রান্ত পাঠক। সামনের দিনগুলোতে টিকে থাকতে হলে গণমাধ্যমগুলোকে এই আস্থাহীনতা কাটিয়ে উঠতে হবে। প্রতিদিন চটকদার খবর কিংবা অসার চমৎকারিত্ব নয় বরং বিশ্বাসযোগ্যতাই একটি গণমাধ্যমের সাফল্যের মূল শক্তি। মনে রাখতে হবে, মিথ্যার ওপর ভর করে যতটুকু আগানো যায় তার চেয়ে পিছিয়ে যেতে হয় অনেক। ভুল বা মিথ্যা তথ্যের ‘সরস’ উপস্থাপন দিয়ে বিশ্বাসযোগ্যতা অর্জন করা যায় না। নয়া এই প্রযুক্তি আমাদের কল্যাণেই সৃষ্টি। তা শতভাগ কাজে লাগাতে হবে। অনলাইন মাধ্যমে সঠিক সংবাদ প্রচার করা না গেলে প্রিন্ট পত্রিকার মতো অনলাইন গণমাধ্যমগুলোকে অচিরেই অস্তিত্ব সঙ্কটে পড়তে হবে।
গণমাধ্যম একটি ক্ষমতাধর প্রতিষ্ঠান। তবে এ ক্ষমতা কেবলই সাধারণ মানুষের হিতার্থে প্রয়োগযোগ্য। এ কথা যে গণমাধ্যম প্রতিষ্ঠান ভুলে যাবে, সে আগামীদিনের সচেতন পাঠকের কাছে নিশ্চিতভাবেই গ্রহণযোগ্যতা হারাবে। কোনো রাজনৈতিক দল বা বিশেষ গোষ্ঠী কিংবা পুঁজির ঢাল হিসেবে নিজেকে নিয়োগ করলে ওই গণমাধ্যম বিশ্বাসযোগ্যতা ও গ্রহণযোগ্যতা হারাতে বাধ্য। তাই ক্ষমতা নয়, বরং দায়িত্বের বাটখারা দিয়ে যে গণমাধ্যম প্রতিষ্ঠান নিজেকে মাপবে, ওই প্রতিষ্ঠানই সামনের দিনের পাঠকসমাজে আস্থাভাজন হবে।
এ কথা সত্য যে, প্রিন্ট মিডিয়া ও ইলেকট্রনিক মিডিয়ার পাশাপাশি বাংলাদেশে জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে অনলাইন মিডিয়া। হাতেগোণা কয়েক বছর ধরেই আমরা অনলাইন মিডিয়ার এই অগ্রগতি লক্ষ্য করছি। ইন্টারনেট প্রযুক্তিকে ব্যবহার করে এই মাধ্যম তথ্যকে নিমিষেই ছড়িয়ে দিচ্ছে সারা বিশ্বে। অনলাইন মাধ্যম মানেই অবাধ ও দ্রুতগামী তথ্যপ্রবাহ করা। কয়েক বছর আগেও অনলাইন মিডিয়ার সাংবাদিক বললে মানুষ নাক সিঁটকাতো। এখন সময় বদলে গেছে। বাংলাদেশে অনলাইন মিডিয়ার সাংবাদিকতা অনেক এগিয়ে গেছে। অনলাইন মিডিয়ার সাংবাদিকরা এখন সামনের সারিতে চলে আসছে। অনলাইন সাংবাদিকতার সংবাদ প্রিন্ট মিডিয়ার সাংবাদিকতা আলাদা কিছু নয়। এর লেখার ধরণ একই রকম। একটা প্রিন্টে যাচ্ছে আর অন্যটা অনলাইনে। আর অনলাইনের খবরটাই এখন মানুষের কাছে বেশি গুরুত্ব পাচ্ছে। প্রিন্ট মিডিয়া ও ইলেকট্রনিক মিডিয়াতে একটি সংবাদের জন্যে সীমাবদ্ধ স্পেস থাকে। অনলাইন মিডিয়ায় তা থাকে না। ফলে অনলাইন সংবাদ প্রকাশে অসীম স্পেস থাকায় ইচ্ছামতো লেখা ও ছবি সেখানে সংযোজন করা যায়। তাই অনলাইন মিডিয়া জনপ্রিয় হচ্ছে। অনলাইন সাংবাদিকতার জনপ্রিয়তার কারণেই প্রিন্ট মিডিয়ার জাতীয় দৈনিকগুলো বেশিরভাগই এখন অনলাইন সংস্করণ বের করছে। দৈনিক, সাপ্তাহিকের পাশাপাশি টিভি মিডিয়াও অনলাইন ভার্সন চালু করেছে। প্রথম আলো, জনকণ্ঠ, ইত্তেফাক, যুগান্তর, কালের কণ্ঠ, সমকাল, ডেইলি স্টার, ইনডিপেনডেন্ট থেকে শুরু করে ইলেকট্রনিক মিডিয়া চ্যানেল আই, এটিএন বাংলা, একুশে টিভি, আরটিভি, এনটিভি, বাংলা ভিশন, বৈশাখী টিভি, দেশটিভি, মাইটিভি, মোহনা টিভিসহ প্রায় সব চ্যানেলেরই অনলাইন সংস্করণ আছে।
আগে কী দেখেছি আমরা? সংবাদপত্র ছিলো মুখে মুখে। পরে তা হাতের লেখা পত্রিকায় রূপ নেয়। মুদ্রণ মাধ্যম আবিষ্কৃত হবার পর প্রিন্ট পত্রিকার বিপ্লব ঘটে। মুদ্রণ যন্ত্রটিও নানা বিবর্তনে পরিবর্তিত হয়েছে। বিকশিত করেছে প্রযুক্তিকে। প্রযুক্তির কল্যাণে আমাদের সংবাদ মাধ্যমগুলোও যুগের সাথে তাল মিলিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে। আগের মুখে মুখে বলা সংবাদপত্র এখন নেই। এটা এ প্রজন্মের কাছে অবিশ্বাস্য মনে হবে। আর হাতের লেখা সংবাদপত্রের কথাও কি এ যুগে ভাবা যায়? হারিয়ে গেছে হাতের লেখা সংবাদপত্রও।
হাতের লেখা সংবাদপত্রের ক্ষেত্রেও কয়েকটি ধাপ ছিল। প্রাচীন যুগের হাতের লেখা সংবাদ সংগ্রাহকদের সঙ্গে পরবর্তীকালের সাংবাদিকদের পার্থক্য ছিল। সুলতানি আমলে সাংবাদিকরা গোপনে সংবাদ সংগ্রহ করতেন। তাদের ডাকা হতো ‘বারিদ’ বলে। অন্যদিকে সরকারি প্রতিবেদকদের বলা হতো ‘আখবর-নবিশ’। মোঘল আমলেও এই আখবর-নবিশরা ছিলেন। আরও একশ্রেণির লোক ছিলেন ‘হরকরা’ নামে। তারা ছিলেন স¤্রাটের খাস প্রতিবেদক। তাদের অবস্থান ছিল প্রদেশভিত্তিক। আখবর-নবিশরা ছিলেন হরকরাদের নিয়োজিত সংবাদদাতা। সাংবাদিকতার এই প্রতিষ্ঠানটি টিকেছিল ১৮৫৭ সালের সিপাহী বিদ্রোহ পর্যন্ত। মুদ্রণযন্ত্র আবিষ্কারের পরে সংবাদপত্র প্রকাশে জোয়ার আসে। তবে উপমহাদেশে সেটা এসেছে কিছুটা ধীর গতিতে। কলকাতায় বেসরকারি প্রথম মুদ্রণযন্ত্র ‘বেঙ্গল গেজেট প্রেস’ প্রতিষ্ঠা করেন জেমস্ অগাস্টাস হিকি। তার সম্পাদনায় প্রকাশিত হয় প্রথম মুদ্রিত পত্রিকা ‘বেঙ্গল গেজেট’। প্রথম প্রকাশিত মাসিক বাংলা পত্রিকা ‘দিগদর্শন’ শ্রীরামপুর থেকে প্রকাশিত হয় ১৮১৮ সালে। বাংলা ভাষায় প্রথম মুদ্রিত দৈনিকের নাম ‘সংবাদ প্রভাকর’। কবি ঈশ্বরগুপ্তের সম্পাদনায় এটি প্রকাশিত হয় ১৮৩৯ সালের ১৪ জুন। এর আগে ১৮৩১ সালের ২৮ জানুয়ারি থেকে এটি প্রকাশিত হতো সাপ্তাহিক হিসেবে।
ব্রোঞ্জ যুগের নগর সভ্যতায় ক্রমপ্রসারণমান ব্যবসা-বাণিজ্যের স্বার্থেই মেসোপটেমিয়া ও মিসরে লিখন পদ্ধতি ও বর্ণমালার আবির্ভাব ঘটে। কিন্তু সেই লিখন পদ্ধতির চরম বিকাশটা ঘটে ১৪৫০ সালে এবং তার আগে পর্যন্ত মুদ্রণ সাংবাদিকতারও সত্যিকারের সূচনা হয়নি। সে সময় জার্মানির জোহানেস জেনসফিচ গুটেনবার্গ টাইপ আবিষ্কার করেন। তাঁর আবিষ্কৃত টাইপের সাহায্যেই তিনি ১৪৫৬ সালে একটি বই মুদ্রণ করেন। যার নাম তিনি দিয়েছিলেন ‘গুটেনবার্গ বাইবেল’। আর তখন থেকেই ইউরোপে মুদ্রণ ইতিহাসের শুরু। এদিকে এ উপমহাদেশে প্রথম মুদ্রণ যন্ত্রটি ইউরোপ থেকে আসে ১৫২৬-২৭ সালের দিকে। পর্তুগিজ পাদ্রীরা আবিসিনিয়া যাবার পথে ঘটনাক্রমে তাদের মুদ্রণ যন্ত্রটি গোয়ায় ফেলে যেতে বাধ্য হন। ‘গুটেনবার্গ বাইবেল’ বের করলেও মুদ্রণ সাংবাদিকতার সূচনা তারও অনেক পরে শুরু হয়। পনেরো শতকে লিখন পদ্ধতির আবিষ্কার হয়ে গেলেও ষোড়শ শতকেও ভেনিস শহর থেকে Acta-diurna -এর মতো একই ধরনের হাতে-লেখা প্রাচীরপত্র প্রকাশিত হতো। তার নাম ছিল Notiæiescritte or written notices বা লিখিত নোটিস।
লেটার প্রেস থেকে অফসেট প্রেস, হাতের কম্পোজ থেকে ফটো কম্পোজ, তারপর কম্পিউটার কম্পোজ হয়ে প্রযুক্তি এখন সংবাদপত্রকে নিয়ে গেছে অনলাইনে। প্রায় তিন দশক ধরে গণমাধ্যমের চেহারা-চরিত্র থেকে শুরু করে আধেয় অবধি যে বিশাল পরিবর্তন ঘটেছে, এর পেছনেও প্রযুক্তির একটি বড় ভূমিকা রয়েছে। পত্রিকার পৃষ্ঠাসজ্জায় ঔজ্জ্বল্য বেড়েছে, বৈচিত্র্য বেড়েছে। টেলিভিশন কিংবা রেডিও রেকর্ডেড অর্থাৎ ‘পূর্বে ধারণকৃত’ অনুষ্ঠানের শৃঙ্খল থেকে মুক্তি পেয়েছে। ‘লাইভ’ প্রযুক্তির বদৌলতে স্থান-কালের সীমাকে অতিক্রম করা সম্ভব হয়েছে। সব ধরনের গণমাধ্যমে চমৎকার সব গ্রাফিক্স ব্যবহার করে খবরকে আরও সহজবোধ্য ও আকর্ষণীয় করে তোলা সম্ভব হয়েছে। মোট কথা, নবতর প্রযুক্তির ছেঁাঁয়ায় গণমাধ্যমগুলোর সর্বাঙ্গে আধুনিকতা এসেছে। সম্প্রতি করোনা মহামারীর সময়েও প্রযুক্তি ব্যবহারের মাধ্যমে গণমাধ্যমগুলো যাবতীয় সীমাবদ্ধতাকে অতিক্রম করে দায়িত্ব পালন করতে সক্ষম হয়েছে।
হতাশ হবার কিছু নেই। আধুনিকতার ¯্রােতে প্রিন্ট মিডিয়া হোঁচট খেয়েছে এবং আরও খাবে এটা সত্য, কিন্তু একেবারে হারিয়ে যাবে না। ৪৯ বছর আগে যুক্তরাষ্ট্রে ইলিনয়েস স্টেট ইউনিভার্সিটি থেকে ১৯৭৪ সালে ‘নিউজ রিপোর্ট’ দিয়ে যে অনলাইন শুরু হয়, সেখানে কিন্তু এখনও প্রিন্ট ভার্সন দাপটের সাথেই রয়ে গেছে। প্রিন্ট ভার্সন হোঁচট খাবে হারিয়ে যাবে এমনটা নয়। আর যারা অনলাইন মিডিয়া তৈরি করছেন তারাতো প্রিন্ট ভার্সনেরই সাংবাদিক। মানুষকে খবর জানানো ও খবর বিশ্লেষণে দীর্ঘদিন ধরে একচেটিয়া আধিপত্য বিস্তার করে এসেছে মুদ্রিত সংবাদপত্র। টেলিভিশনের আবির্ভাব এই একাধিপত্য খানিকটা খর্ব করলেও পুরোপুরি পারেনি। এক সময় অনেকে ধারণা করেছিলেন, চলমান ছবিসহ খবর পরিবেশনা মুদ্রিত সংবাদপত্রের বিলুপ্তি ঘটাবে। কিন্তু এই ধারণা সঠিক বলে প্রমাণিত হয়নি। স্বাধীন বাংলাদেশে বহুল প্রচারিত সংবাদপত্রের সংখ্যা কম নয়। এমন বাস্তবতায় একবিংশ শতাব্দীর শুরুতে বিকশিত হতে শুরু করে ওয়েবভিত্তিক নিউজ পোর্টাল। ইন্টারনেটের ব্যাপক প্রসার, কম্পিউটার ও মোবাইল ফোনের সহজলভ্যতা প্রযুক্তিভিত্তিক নতুন এই সংবাদমাধ্যমকে দ্রুত জনপ্রিয়তা এনে দিয়েছে। নিউজ পোর্টালের কল্যাণে মানুষ এখন বাসা, অফিস তো বটেই, চলতি পথেও জেনে নিতে পারছেন দেশ-বিদেশের সর্বশেষ সংবাদ। পোর্টালগুলোতে থাকছে খবরের বিশ্লেষণও। সুযোগ রয়েছে যে কোনো খবরের ব্যাপারে মন্তব্য করারও। ফলে সত্যিকারভাবেই মুদ্রিত সংবাদপত্রগুলোর জন্য চ্যালেঞ্জ হয়ে উঠেছে নিউজ পোর্টাল। এ চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় হাত গুটিয়ে বসে নেই সনাতনী সংবাদপত্রগুলোও। অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখতে তারাও খুলছে অনলাইন ভার্সন। ঘুরে ফিরে তাদের হাতেই থাকছে অনলাইন মিডিয়াও। এ অর্থে প্রিন্ট পত্রিকার মালিকরা যখন দেখবেন প্রিন্ট পত্রিকা প্রকাশে খরচ বেশি, লোকবলও অনেক প্রয়োজন হয় সে ক্ষেত্রে তারা হয়তো কোনো এক সময় প্রিন্ট পত্রিকা বন্ধ করার কথা ভাববেন।
এ প্রসঙ্গে নিউইয়র্ক টাইমস বন্ধ হয়ে যেতে পারে এমন খবরেও এখন আর কেউ বিচলিত নয়। ছাপার কাগজ যেভাবে একের পর এক বন্ধ হচ্ছে, তাতে নিউইয়র্ক টাইমস-এর মতো সংবাদপত্র বন্ধ হয়ে গেলে বিস্ময়ের খুব কিছু থাকবে না। অনলাইনের এই যুগে প্রিন্ট দৈনিক পত্রিকা পা হড়কে পড়বে, তাতে চমকানোর কী আছে?
যুক্তরাষ্ট্রে গত কয়েক সপ্তাহে পুরানো ও নামজাদা একাধিক পত্রিকা হয় বন্ধ হয়ে গেছে, নয়তো দেউলিয়া হয়ে যাওয়ার আশঙ্কায় আদালতের আশ্রয় প্রার্থনা করেছে। আশঙ্কা করা হয়েছে, এ অবস্থা না বদলালে ২০৪০ সালের মধ্যে অনেক শহরেই নিজস্ব কোনো মুদ্রিত পত্রিকা থাকবে না। কোনো ক্রেতা না মিললে দৈনিক পত্রিকা বন্ধ হয়ে যাবে এটাই স্বাভাবিক। উন্নত দেশের অনেক প্রিন্ট পত্রিকা ফ্রিতে দিতে দেখা যায়। এভাবে কতদিন চলবে? একুশ শতকের গোড়ার দিকে বাংলাদেশের সংবাদপত্রে আসে অনলাইনের ঝোঁক। পৃথিবীর উন্নত দেশগুলোতে আগে থেকেই এর যাত্রা শুরু হলেও বাংলাদেশে এটি আসে বিশ শতকের শেষের দিকে। অনেক পত্রিকাই লোকবল কমিয়ে দিয়েছে। এভাবে চলতে থাকলে কোনো একদিন হয়তো মালিক পক্ষ বলবেন, লাভ হচ্ছে না, লোকসান দেয়া আর সম্ভব নয়। সে সময় পত্রিকাটি হয়তো বন্ধ হয়ে যাবে। অনলাইনের এই জনপ্রিয়তার কারণে দেশের প্রধান সব দৈনিক পত্রিকা অনলাইন সংস্করণ বের করছে। শুধুমাত্র অনলাইন নির্ভর সংবাদপত্রও বের হচ্ছে। তাতে প্রিন্ট পত্রিকা হারিয়ে না গেলেও এর যে ভবিষ্যৎ উজ্জ্বল তা বলা যাবে না। প্রিন্ট মিডিয়া হিসেবে বাংলাদেশের পত্র-পত্রিকার সেই আগের চেহারা আর নেই। সেখানে টেকনোলজির অনুপ্রবেশ ও অভিঘাত আজ সুস্পষ্ট। পুরানো ট্রেডিশন ভেঙ্গে ছাপা পত্রিকার চেয়ে অনলাইন সংস্করণ আজ বেশি জনপ্রিয় হয়ে উঠছে। এ অবস্থায় আমরা ভাবছি, ভবিষ্যতে কাগজের প্রিন্ট মিডিয়া আদৌ থাকবে কি না।
মীর আব্দুল আলীম : সমাজ গবেষক; সাধারণ সম্পাদক, কলামিস্ট ফোরাম অফ বাংলাদেশ।