প্রকাশ : ১৬ জুন ২০২৩, ০০:০০
হরিৎকে অবাক করে দিয়ে সদরঘাটের পন্টুনে একাকী দাঁড়িয়ে আছে লীলা। দূর থেকে লীলাকে দেখে সম্বিৎ হারানোর জোগাড় তার। এসময় এখানে লীলা আসার কথা নয়। লীলা জানেও না হরিৎ আজ ঢাকায় আসবে। লঞ্চ থেকে নেমে তাই হরিৎ কিংকর্তব্যবিমূঢ়। লীলা মেয়েটার কেমন জানি সবকিছু আগাম জানার ক্ষমতা আছে। শুধু আজকেই নয়, আগেও বেশ কয়েকবার হরিৎ যা করবে ভেবেছিল তা আগে আগে লীলা করে ফেলেছে। হরিতের একবার ইচ্ছে করেছিল, নৌকায় পূর্ণিমা জোছনা দেখতে দেখতে তাজা ইলিশ ভাজা খাবে। সে ইচ্ছে চরিতার্থ করার জন্যে নদীর ঘাটে আসতে না আসতেই দ্যাখে, কোথা হতে আগে ভাগে সেখানে লীলা হাজির। হরিৎ তাকে নদীর ঘাটে আসার কারণ শুধালে সে জবাব দিয়েছিল, আমি জানি আজকে তুমি জোছনা দেখতে দেখতে নদীর বুকে নৌকায় বসে ইলিশ ভাজা খাবে। আমিই বা বাদ যাই কেন। তাই সময়মত হাজির হলাম। সেদিন অবশ্য আর নৌকায় চড়া হয়নি। ঘূর্ণিঝড়ের আশঙ্কা ছিল নদীতে। তাই কূলে বসেই তারা ইলিশ সাবাড় করেছিল। জোছনারও সেদিন আর বান জাগেনি। কিন্তু আজ সদরঘাটে লীলা আসলো কখন! কেনই বা আসলো? হরিৎ এখনও লঞ্চ থেকে নামেনি। লঞ্চ মাত্র ঘাটে ভিড়েছে। বুড়িগঙ্গার পচা জলের দুর্গন্ধ তাকে আজ আর তেমন কাবু করতে পারেনি। আজ তার ভাবনায় কেবল লীলা আর লীলা।
হাতে টিকিট নিয়ে লাইন ধরে বের হয়ে আসে হরিৎ। লীলা এগিয়ে এসে তার সামনে দাঁড়ায়। হাই হরিৎ! লীলা হাত নেড়ে হরিতের দৃষ্টি আকর্ষণ করে। হরিৎ লীলাকে না দেখার ভান করে এগিয়ে যাচ্ছিল। কিন্তু লীলার আন্তরিক ডাক আর এড়াতে পারলো না। চাঁদপুর হতে যে লঞ্চগুলো সদরঘাটে যায় সেগুলো লালকুঠি ঘাটে থামায়। লীলা আর হরিৎ দুজনেই সদরঘাটের কোলাহল থেকে মুক্তি পেতে পন্টুন ছেড়ে লালকুঠি বরাবর গ্যাংওয়ে দিয়ে বের হয়ে আসে। কিন্তু তারা সদরঘাট ছেড়ে যায় না। সদরঘাটের জটলা আর কোলাহল দেখতে দেখতে পাথরের ব্লকে বসে গল্পে মশগুল হয়ে উঠে। এখন ঘড়িতে সকাল এগারোটা বাজে প্রায়। একটা চাকরির ইন্টারভিউ দিতে হরিৎ এসেছে ঢাকায়। তার কাজ বিকেল তিনটায়। সময় গুণে দেখে, ঢাকার যানজটকে আমলে নিলেও গন্তব্যে পৌঁছাতে তার আরও দুঘন্টা সময় হাতে আছে। কাজেই লীলার মতো বকবক যন্ত্রের সাথে কিছুক্ষণ খেজুরে আলাপ করাই যেতে পারে। অদূরে লাল জামা পরা কুলিদের হাতে লাগেজওয়ালা যাত্রীদের মাঝে মাঝে হেনস্তা হতে দেখে হরিতের কেমন জানি খিটখিটে অনুভূতি হয়। খেটে খাওয়া মানুষগুলোর জন্যে মনের ভেতর যে কোমল প্রশ্রয় ছিলো তা এই কুলি-সিন্ডিকেটের কারণে নষ্ট হয়ে গেছে। লাগেজ নিয়ে যাত্রীদের এরা যে কী হেনস্তা করে! পঞ্চাশ টাকার মোট বইতে তারা চেয়ে বসে দেড়-দুশো টাকা! আগে সে বিশ্বাস করতো না এসব। কিন্তু একবার নিজেই হলো ভুক্তভোগী। একটা ব্যাগ বইতে দিয়ে অনেক ঝামেলার পর একশ টাকা দিয়ে সে নিস্তার পেয়েছিলো। কুলি-সিন্ডিকেট খুব শক্তিশালী সিন্ডিকেটগুলোর একটা। ভালো কুলিগুলোও সিন্ডিকেটের কারণে বদমায়েশের মতো আচরণ করে মাঝে মাঝে।
কুলি ছাড়াও হরিতের নজরে আসে পাউরুটির স্তূপ। সদরঘাটের পাউরুটিগুলো সব সময় মনে হয় তাজা ও মজাদার। হরিৎ ও লীলা ছোট ছোট দুটি পাউরুটি আর কলা নিয়ে খেতে শুরু করে দিলো। খাওয়া শুরুর আগ পর্যন্ত তাদের মনেই হয়নি খিদের কথা। কিন্তু চোখের খিদেয় খেতে গিয়ে বুঝলো, সত্যি সত্যি তাদের পেটেরও খিদে লেগেছিল। আসলে বুড়িগঙ্গার পচা পানির দুর্গন্ধ সবার খাওয়ার খিদা কেড়ে নেয়।
সাধারণত হরিৎ খাওয়ার সময় কোনো কথা বলে না। কথা বললেই বিষম খায়। একবারতো তার এমন বিষম উঠেছিল যে অজ্ঞান হওয়ার জোগাড়। সেই হতে খেতে বসলে হরিৎ কথা বলে না। তবে পাশে বকবক যন্ত্র বসে থাকলে কথা না বলে পারা যায় না। মাঝে মাঝে লঞ্চের ভেঁপুতে তাদের কথায় ছেদ পড়ে। কত জায়গা থেকেই না এখানে লঞ্চ ভিড়ে! পঁয়তাল্লিশটা রুটে দৈনিক প্রায় দেড় হাজার ট্রিপ লঞ্চ প্রতিদিন সদরঘাটে আসা-যাওয়া করে। নারায়ণগঞ্জ, চাঁদপুর, বরিশাল, ভাণ্ডারিয়া, পিরোজপুর, হুলারহাট, বরগুনা, ঝালকাঠি, মাদারীপুর ইত্যাদি বিভিন্ন জায়গার লঞ্চ ভিড়তেই থাকে সদরঘাটে। কোনো কোনো লঞ্চে পরিবার-পরিজন নিয়ে উঠে রান্না করেও খায় যাত্রীরা। কেউ কেউ পাটি-মাদুর বিছিয়ে ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে গন্তব্যে পৌঁছায়। সদরঘাট কখনো ঘুমোয় না। সারাদিন সারারাত কোনো না কোনো লঞ্চ হয় এখানে ভিড়ে, না হয় এখান থেকে গন্তব্যে যাত্রা করে।
লীলা জানে, হরিৎ একটু নির্জনতাপ্রিয় মানুষ। জনসমক্ষে লীলার আসা সে পছন্দ করে না। তবু লীলা লোকালয়ে আসে, হরিতের সঙ্গ সে উপভোগ করে। বলা চলে সে-ই হরিৎকে নিঃসঙ্গতা থেকে মুক্তি দেয়। হাতের পাউরুটি-কলা শেষ হলে লীলার লেকচার শুরু হয়। লীলার লেকচারে হরিৎ মাঝে মাঝে বিরক্ত হলেও অনেককিছু জানতে পারে। সে যেন হরিতের সর্বাধুনিক চ্যাট-জিপিটি। কেবল কমান্ড দিলেই হোলো। তারপর গড়গড় করে বলে যায়। এই যে মশায়, কী ভাবছো? আচ্ছা বলো তো, বুড়িগঙ্গা কার মেয়ে? হরিৎ প্রশ্ন শুনে হকচকিত হয়ে যায়। এ আবার ক্যামন প্রশ্ন? নদী তো নদীই। তার আবার বাবা-মা কী? আরে আছে আছে। পণ্ডিতেরা বলেন, বুড়িগঙ্গা নাকি আসলে ব্রহ্মপুত্র আর শীতলক্ষ্যার মেয়ে। গঙ্গার ধারা হিমালয় থেকে ছুটতে ছুটতে এখানে এসে বুড়ো হয়ে যায়। অর্থাৎ শক্তিহীনা হয়ে যায়। যেন সে বার্ধক্যে উপনীত। আর একারণেই এ নদীকে লোকে ডাকে বুড়িগঙ্গা বলে। হুম। হরিৎ বলে উঠে, এখন কেউ নামকরণ করলে তার নাম হতো ব্যাধিগঙ্গা। হাজার রকম ব্যাধির আধার। কলকারখানার বর্জ্য মিশে এ নদীর জল হয়ে গেছে বিষের চেয়েও বিষময়। লীলা হেসে উঠে। বাহ্! নামটা তো বেশ ভালোই হয়েছে শুনতে। তা এই বুড়িগঙ্গাতেও কিন্তু ডুবে মরে গঙ্গা। বলে কী মেয়েটি! কী রকম? হরিৎ জিজ্ঞাসু হয়ে উঠে। আরে! এ নদীর বিনা স্মৃতি স্নানঘাটে দুর্গাপূজার সময় দশমীতে প্রতিমা বিসর্জন দেয়া হয়। তাই বছরে দুদিন দুর্গাপূজোয় এ ঘাট বন্ধ থাকে। দুর্গার অপর নাম গঙ্গা। তাই বলা যায়, বুড়িগঙ্গাতেই ডুবে মরে গঙ্গা। ব্যাখ্যা শুনে হো হো করে হেসে উঠে হরিৎ। প্রতিমা নিরঞ্জন আর ডুবে মরা এক নয় রে বোকা। লীলা বলে, সে তো আমি জানি। তোমাকে একটু চমকে দিলেম আর কি। বলে যায় লীলা, বিনা স্মৃতি ঘাটের নাম দেয়া হয়েছে ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনের অবিভক্ত বাহাত্তর নম্বর ওয়ার্ডের ওয়ার্ড কমিশনার বিনয় কৃষ্ণ সরকার ওরফে বিনা-র নামে। বিনা সরকার আততায়ীর হাতে খুন হন। হরিৎ একটু দুঃখ পায় শুনে। এরকম একটা জনবহুল অনিস্তব্ধ এলাকায় গুলিবিদ্ধ হয়ে ওয়ার্ড কমিশনার খুন হয়ে যায়! মানুষগুলো যেন ক্যামন হয়ে গেছে। প্রতিবাদ না করে মোবাইলে ভিডিও করতেই আজকাল মনোযোগী হয় বেশি। হরিতের কথা শুনে লীলা হেসে উঠে। হাসি থামিয়ে তারপর বলে, মাঝে মাঝে এমনও খবর পত্রিকায় আসে, সদরঘাটে ডিঙ্গি নৌকায় সেল্ফি তুলতে গিয়ে মোবাইলসহ বুড়িগঙ্গায় সলিল সমাধি। হুম। আমরা আসলে এখন সেল্ফিবাজ আর সেল্ফিশ প্রজন্মে পরিণত হয়ে গেছি। লীলা মাথা নেড়ে সায় দ্যায়। কথা থামে না। হরিৎকে বলে, পেছনের যে লালকুঠি, এটা আসলে নর্থব্রুক হল। মোঘল নির্মাণশৈলী ও কৌশল অবলম্বনে আঠারোশ বাহাত্তর সালের দিকে বুড়িগঙ্গার তীরে এটার নির্মাণ শুরু হয়। শেষ হতে হতে প্রায় সাত বছর লাগে। বৃটিশ রাজনীতিবিদ টমাস বেয়ারিং নর্থ ব্রুকের নামে হলটির নামকরণ করা হয়। তিনি বৃটিশ ভারতের ভাইসরয় ছিলেন। লীলার কথা শুনে হরিতের বিরক্তি শুরু হয়। সে ক্ষোভ ঝেড়ে বলে উঠে, অত্যাচারী বৃটিশদের নিয়ে এতো চর্চা করার কী আছে? আছে আছে। বলে উঠে লীলা। তিনি অত্যাচারী ছিলেন না। আঠারোশ চুয়াত্তর সালের দুর্ভিক্ষ তিনি দক্ষতার সাথে মোকাবেলা করেন। তবে তাকে মহান করার জন্যে লালকুঠিকে জানতে বলছি না। আসলে ঊনিশশো ছাব্বিশ সালের আট ফেব্রুয়ারিতে এ ভবনে কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরকে ঢাকা পৌরসভার পক্ষ থেকে সংবর্ধনা দেয়া হয়। একথা বলতেই নর্থব্রুক সাহেবের কথা উঠে আসলো। রবীন্দ্রনাথ সেবার যে ক'দিন ঢাকায় ছিলেন, এই সদরঘাটেই বুড়িগঙ্গা নদীতে তুরাগ হাউসবোটে নৌ-ভ্রমণ করতেন প্রতিদিন ভোর বেলায়। এটুকুন বলেই লীলা বুড়িগঙ্গায় বসে লেখা কবিগুরুর কবিতা আবৃত্তি করতে শুরু করে, ‘ভারী কাজের বোঝাই তরী কালের পারাবারে
পাড়ি দিতে গিয়ে কখন ডোবে আপন ভারে
তার চেয়ে মোর এই ক-খানা হালকা কথার গান
হয়তো ভেসে বইবে স্রোতে তাই করে যাই দান।’
লীলার কথা শুনে হরিৎ আর একবার পেছন ফিরে তাকায় লালকুঠির দিকে। মনে মনে কল্পনা করে, এখানে রবীন্দ্রনাথ এসেছিলেন। আহা! সে সময় যদি জন্ম হতো আমাদের! দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলে উঠে সে। লীলা তার এ দীর্ঘশ্বাসে সায় দিয়ে বলে, আসলে ঊনবিংশ শতকের মতো সময় বাঙালির আর আসবে না। চলো চা খাই। হরিৎ উঠে গিয়ে বলে। দাঁড়িয়ে পড়ে লীলাও। হাঁটতে হাঁটতে চায়ের টংয়ের কাছে যায়। এর মধ্যে তাদের বেশ কয়েকটা সিএনজি-রিকশাঅলা জিজ্ঞেস করেছে কোথায় যাবেন। তারা মাথা নেড়ে না সূচক জবাব দিয়ে এগিয়ে গেছে। কাকা, দুকাপ চা দেন। একটাতে চিনি কম। হরিৎ নিজে চিনি খাওয়া কমিয়ে দিয়েছে। তার ওপর কন্ডেন্সড মিল্কের চা একটু মিষ্টি বেশি হয়। দোকানি একসাথে আট-দশ কাপে গরম লিকার ঢেলে চামচ নাড়িয়ে দুধ-চিনি মেশায়। তারপর যার যারটা হাতে ধরিয়ে দেয়। হরিৎ আর লীলা দুকাপ চা নিয়ে আবার আগের জায়গায় বসে পড়ে। এ জায়গা থেকে সদরঘাটের চারপাশের দৃশ্য খুব ভালোভাবে পর্যবেক্ষণ করা যায়। এই সদরঘাটেই নদীর দুপাশে প্রায় পঞ্চাশটির অধিক ঘাট আছে। প্রতিটা ঘাটে পঞ্চাশ-ষাটটা নৌকার আনাগোনা। কোনোটায় কলা বোঝাই, কোনোটায় যাত্রী। কোনোটা অন্য কোনো মালামাল নিয়ে নিজেদের ব্যস্ত রাখে। তার সাথে ব্যস্ত রাখে সদরঘাটকেও। আগে লালকুঠি হতে নদীর নৈসর্গিক দৃশ্য দেখা যেত। এখন স্থাপনাগুলো এমনভাবে তৈরি হয়েছে যে, নদী দেখা তো দূরে থাক, রাস্তাও দেখা যায় না ঠিকমতো। এ নিয়ে অবশ্য সিটি কর্পোরেশন আর বিআইডব্লিউটিএ'র মধ্যে চাপান-উতোর চলছে। হরিৎ হিসেব করে কূল পায় না, কতো লোকের কর্মসংস্থান হয় এই সদরঘাটে। কত রকমের ভিক্ষুক আর কতো শতো মতলববাজের আখড়া সদরঘাট। গভীররাতে যে লঞ্চগুলো ভিড়ে তার প্রতিটিই যেন এক একটা প্রমোদতরী। কারো জৈবিক তাড়নার প্রশমন কারো জন্যে করে আহারের সংস্থান। বড় অদ্ভুত এ জায়গা। লঞ্চের স্টাফদের প্রতিযোগিতা চলে যাত্রী টেনে নেয়ায়। কোন্টা আগে ছাড়বে এটা হয়ে দাঁড়ায় কোটি টাকার প্রশ্ন। পনর মিনিট আগে ছাড়বে শুনলেই তা হয়ে যায় সোনার হরিণ। কিন্তু লঞ্চে উঠে বসার পর আধঘন্টায়ও ছাড়ার নাম নেয় না। অনেকবার এভাবে হরিৎ প্রতারিত হয়েছে। শুধু সে নয়, প্রতিনিয়ত আরো অনেকেই হয়। কতো প্রেমের গ্রন্থি বেঁধে দিয়েছে সদরঘাট! আবার কতো কিশোরী প্রতারিত হয়েছে প্রেমে এ সদরঘাটেই।
হাতের কাপে চুমুক দিয়ে লীলা গুনগুনিয়ে গানের কলি ভাঁজে, যদি একখান সুন্দর মন পাইতাম, সদরঘাটের পানের খিলি তারে বানাই খাওয়াইতাম...। লীলার গান শুনে হেসে দ্যায় ফিক করে হরিৎ। তুমি যেটা জানো সেটা সত্য নয়। আসলে গানটা আঞ্চলিক গানের রানি চট্টগ্রামের শেফালি ঘোষ গেয়েছেন, যদি একখান সোন্দর মন পাইতাম, বক্সিরহাডর পানর খিলি তারে বানাই খাবাইতাম। এখানে মহেশখালির মিষ্টি পান পাওয়া যায়। লীলা মাথা নাড়ায়। কথা সত্যি। মানুষের ঠাট্টা-উপহাসের তালিকায় সদরঘাট উঠে এসেছে নির্মমভাবে। হরিৎ লীলাকে উদ্দেশ্য করে বলে। হুম। আমিও ভেবেছি, কী প্রসঙ্গে যে 'উপরে ফিটফাট ভিতরে সদরঘাট' কথাটার প্রচলন হলো! মানুষ সদরঘাটের মতো ব্যস্ত বন্দর এলাকাকে নিয়েও কুৎসা রটায়। লীলার কথায় হরিৎ তথ্য যোগান দেয়, জানো, আমাদের চাঁদপুরের তিনজন দূরপাল্লার বীর সাঁতারু সদরঘাট থেকে চাঁদপুরে সাঁতরে গিয়েছিলেন। এই সদরঘাট থেকেই বাষট্টি সালে সাঁতারু আব্দুল মালেক সাঁতার দিয়েছিলেন। লীলা শুনে অবাক হয়। আগেকার দিনের মানুষের স্ট্যামিনার কোনো তুলনা নেই। এতদূর পথ সাঁতরে পাড়ি দেয়া হার্কিউলিস ছাড়া আর কারো কাজ নয়। হরিৎ লীলাকে জিজ্ঞেস করে, আচ্ছা বলতো, সদরঘাট কবে পত্তন হয়েছিল? লীলা এ প্রশ্ন শুনে বলে উঠলো, আসলে এর কোনো সুনির্দিষ্ট তথ্য কারো কাছে নেই। তবে এই বুড়িগঙ্গা হাজার বছরের পুরোনো। এর কথা কালিকা পুরাণে উল্লেখ করা আছে। সম্ভবত খ্রিস্টীয় সতরশ শতকে এসে মোঘলেরা 'ঢাক্কা' বা 'ঢাক' গাছের প্রাচুর্য সম্পন্ন বুড়িগঙ্গার তীরে সদরঘাটের গোড়াপত্তন করেন। তখনকার মাত্র নয় হাজার লোকের স্থলে আজ ঢাকা হয়ে গেছে দুকোটি লোকের শহর। হরিৎ আর লীলার কথোপকথনের মগ্নতা ভেঙ্গে যায় নতুন এক লঞ্চের ভেঁপুতে। লঞ্চটা চাঁদপুর থেকে এসেছে। ঘাটে ভিড়েই ভেঁপু দিয়েছে। হরিৎ ঘড়ির দিকে তাকায়। সময় প্রায় হয়ে এসেছে। লীলার ইচ্ছে আরও কিছুক্ষণ গল্প করে। কিন্তু হরিতের হাতে সময় বাঁধা। হরিৎ মনে মনে ভেবেছে, দুপুরে বার্গার খেয়ে ইন্টারভিউ দিবে। ইন্টারভিউ শেষ হলে তারপরে দুপুরের খাবার খাবে। কিন্তু এখন দোনোমনায় পড়েছে। কী করবে কিছু বুঝে উঠতে পারছে না। এমন সময় পেছন থেকে নারী কণ্ঠে ডাক শুনতে পেলো, হরিৎ ভাই, অ্যাই হরিৎ ভাই। কানে ডাক শুনতে পেয়েই হরিৎ পেছনে ফিরে তাকায়। উরিব্বাস! এ যে বৃষ্টি। মেয়েটা বড় সাংঘাতিক ঠোঁট কাটা। সব স্পষ্ট বলে দেয়। বৃষ্টি এরই মধ্যে হরিতের কাছে এসে পৌঁছায়। একা একা এই খাঁ খাঁ রোদে কী বিড়বিড় করছেন? হরিৎ বৃষ্টির কথায় অবাক হয়। সে কি লীলাকে দেখছে না? হরিৎ তাকায় আশেপাশে। সত্যিই তো! তার চারপাশে লীলা নেই। হরিৎ চোখ ড্যাব ড্যাব করে তাকিয়ে থাকে। বৃষ্টি জোর করে হরিৎকে টেনে নিয়ে যায়। চলেন, আমি আপনাকে ড্রপ করে দিচ্ছি আপনার গন্তব্যে। বৃষ্টি হরিৎকে বগলদাবা করে নিয়ে সিএনজিতে উঠে যায়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ে বৃষ্টি অনেক স্মার্ট হয়েছে। কিন্তু হরিতের সেদিকে মন নেই। সে কেবল পেছনে তাকায়। লীলা কই লীলা! নিজেকে নিজে প্রশ্ন করে হরিৎ। এর মধ্যে তার কানে বাজে, বৃষ্টি বলছে, হরিৎ ভাই, আপনার সাথে মাঝে মাঝে যে আপুটাকে দেখা যায়, নাম কী জানি! ওহ্! লীলা। লীলা আপু আজ সকালে তাদের গ্রামের বাড়িতে মারা গেছেন। বৃষ্টির কথা হরিতের কানে ঢোকে না। সে তখন ভাবতে থাকে আজ সকাল বেলায় সদরঘাটের পন্টুনের দৃশ্যের কথা।