প্রকাশ : ২১ ফেব্রুয়ারি ২০২৪, ০০:০০
চাঁদপুর হাসান আলী সরকারি উচ্চ বিদ্যালয় প্রাঙ্গণে শহিদ মিনার বানিয়ে স্বাধীন বাংলাদেশে প্রথম মাতৃভাষা দিবস পালন করি
২১ মানে মাথা নাত না করা। ১৯৭২ সাল, অমর একুশে ফেব্রুয়ারির আর মাত্র ক’টি দিন বাকী। এমতাবস্থায় আমরা ক’জন মিলে তাৎক্ষণিক একটি সিদ্ধান্ত নেই যে আমরা আমাদের স্কুলের সামনের নারিকেল গাছতলায় শহীদ মিনার বানিয়ে মহান ভাষা শহিদদের প্রতি শ্রদ্ধা জানাবো। এই কথাটি খুব দ্রুতই স্কুলের ছাত্রদের মধ্যে ছড়িয়ে পড়লো এবং আমাকে বলা হলো একটি মিটিং ডাকতে। আমরা ক্লাসে ক্লাসে গিয়ে আমাদের স্কুলের অ্যাসেম্বলীর মিটিংয়ে উপস্থিত থাকতে ছাত্রদের অনুরোধ করি। পরের দিন ক্লাস শেষে মিটিংয়ের সময় দেখি অ্যাসেম্বলী ছাত্রবন্ধুগণ কানায় কানায় পূর্ণ করে ফেলে। সে কি আনন্দ। যেন এক উৎসবমুখর অবস্থা। যা ভাবতে আমি আজও অনুপ্রাণিত হই। আমার সভাপতিত্বে মিটিং শুরু হলো, ২১ মানে মাথা নত না করা। শহিদ মিনার বানিয়ে স্বাধীন বাংলাদেশে মুক্ত চাঁদপুর মহান ভাষা দিবস পালন করার পক্ষে আবেগময় বক্তৃতা। বক্তৃতা যেন শেষ হয় না। অবশেষে উপস্থিত সকলের সমর্থনে আমরা সিদ্ধান্ত নেই যে, আমরা সকলের স্বেচ্ছাশ্রমের মাধ্যমে পবিত্র শহিদ মিনার বানাবোই। আরও সিদ্ধান্ত নেই যে, আমাদের স্কুলের প্রধান শিক্ষক মাননীয় জয়নাল আবদীন স্যারকে শহিদ মিনার বানানোর ছাত্রদের সিদ্ধান্তের কথা জানাবো। রাতে আমরা ১০/১২জন ছাত্রবন্ধু স্কুলের অফিস কক্ষে স্যারের সাথে দেখা করি এবং আমাদের শহিদ মিনার বানানোর কথা জানাই। সাথে সাথে প্রধান শিক্ষক, সহকারী প্রধান শিক্ষক ও অন্যান্য স্যারগণ রাজী হয়ে গেলেন এবং স্কুলের তহবিল থেকে ৩,০০০/- টাকা শহিদ মিনার বানানোর জন্য অনুদান ঘোষণা করেন। আমরা যেন আকাশে চাঁদ পাই। এতোটাই উৎসাহিত হই, রাতেই আমরা কাজের ছক তৈরি করি। কে কিভাবে শহিদ মিনার তৈরির মালামাল সংগ্রহ করবো। কেউ দায়িত্ব নেয় ইট, বালু, সিমেন্ট সংগহের, কেউ দায়িত্ব নেয় রড, কাঠ, বাশ সংগ্রহের, দায়িত্ব নেই রাজমিস্ত্রী সংগ্রহের।
পরের দিন দুপুরেই প্রধান শিক্ষকসহ অন্যান্য স্যারগণ শহীদ মিনারের স্থান নির্বাচনের জন্য নারিকেল গাছতলায় আসেন এবং নির্মাণ কাজ উদ্বোধন করেন। শুরু হয়ে গেলো নির্মাণ কাজ। পানি আনাসহ যুগালীর কাজ ছাত্র বন্ধুগণই করেছেন। আমরা শ্রম, ঘাম ও নাস্তার টাকা দিয়েই ৪ দিনের মাথায় পবিত্র শহিদ মিনার নির্মাণ কাজ শেষ করি।
এই শহিদ মিনার নির্মাণের কাজে যারা ছিলেন তারা হলেন আমি এস.এম সালাহ্ উদ্দীন, আবু নঈম দুলাল পাটোয়ারী, রফিকুল ইসলাম ভূঁঞা, এমদাদুল হক ভূঁঞা, রুস্তম গাজী, সেলিম, সফিকুর রহমান, আবু বকর, খোরশেদ, সাহাবুদ্দিন, সবুজ, মুসলিম, মাকসুদ, রাগিব উদ্দীন, সদর উদ্দীন, টুনু তালুকদার, মাহফুজ, দেলোয়ার হোসেন, আমির হোসেন, হাবিব, নুরুল ইসলাম, তপন সাঈদ, জামাল, মফিজুল ইসলাম, সাহাদাৎ, মঞ্জুর, সগির আহমদ, আকবর, ছালেহ আহম্মদ, মুরাদ খান, তাপোস, নোমান আজিজ, উৎফল, চন্দন, প্রদীপসহ আরো অনেকে। আমি তাদের সকলের প্রতি কৃতজ্ঞতা ও শ্রদ্ধা জানাই।
নির্মাণ কাজের ফাঁকে কাছে গিয়ে বসতাম, চা খেতাম যে আমাদের সকলের প্রিয় ছানাউল্যা ভাই, মাথা ভর্তি পাকা চুল, কি মনখোলা হাসি ঐতিহাসিক সেই ছানাউল্যা লাইব্রেরীর ছানাউল্যা ভাইয়ের কথা আজ খুব মনে পড়ে, তার আত্মার মাগফিরাত কামনা করছি।
২০ ফেব্রুয়ারি ১৯৭২ সাল বিকেল থেকে শুরু করি আমাদের স্কুল ভবনটি সাজানো, ছাদের কার্নিশ প্রদীপ স্থাপনের এক স্বতঃস্ফূর্ত কর্মযজ্ঞ। সবক্লাসের ছাত্রদের অংশগ্রহণের এক উৎসবমুখর পরিবেশে আমরা স্কুল ক্যাম্পাসটি সাজিয়ে তুলি। পরের দিন ২১ ফেব্রুয়ারি সকালে আমরা খালি পায়ে আমাদের প্রধান শিক্ষক স্যারসহ সকল কর্মকর্তা-কর্মচারী ও ছাত্রগণ র্যালি করে শহিদ মিনারের বেদিতে ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা জানাই। সকলে মিলে গেয়ে উঠি আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙ্গানো একুশে ফেব্রুয়ারি আমি কি ভুলিতে পারি। এইভাবেই প্রথম প্রহরের কর্মসূচি পালন করি।
বিকেলে শহিদ মিনার প্রাঙ্গণে শুরু হলো মহান ভাষা আন্দোলনের স্মৃতিচারণ। স্মৃতিচারণের পরই শুরু হয় আলোকসজ্জার জন্য প্রদীপ জ্বালানোর পর্ব। শত শত ছাত্র এক সাথে। প্রদীপ জ্বালানোর সাথে সাথে আমাদের স্কুল ভবনটি এক নতুন রূপ নেয়। শুরু হয় এক আনন্দঘন পরিবেশ, তখন স্কুলের চতুর্দিকে ছিল ফাঁকা। ফলে স্কুলের আলোকসজ্জা অনেক দূর থেকে দেখা যেত। সন্ধ্যার পর থেকেই বিভিন্ন কলেজ, স্কুল, মাদ্রাসার ছাত্র-ছাত্রীগণ, পথচারীগণ দলে দলে আমাদের স্কুলের আলোকসজ্জা দেখতে আসেন এবং গভীর রাত পর্যন্ত ক্যাম্পাসটি জমজমাট থাকে। সদ্য স্বাধীন দেশে এমন একটি দেশপ্রেমমূলক অনুষ্ঠান দেখে সকলেই আমাদের বানানো শহিদ মিনারের ভূয়সি প্রশংসা করেন।
হাসান আলী সরকারি উচ্চ বিদ্যালয়ের ছাত্রদের নির্মিত শহিদ মিনার গৌরবদৃপ্ত মহিমায় চির অম্লান হয়ে আছে এবং থাকবে। যতদিন বেঁচে থাকবো ততদিন সেই স্মৃতি আমাদের হৃদয়ে ভাস্বর হয়ে থাকবে।
আজকের এই দিনে আমি সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, সকল ভাষা শহিদ, মহান মুক্তিযুদ্ধের শহিদদের প্রতি শ্রদ্ধা জানাই। সাথে সাথে সকল ভাষা সৈনিক, স্বাধীনতার জন্য আত্মত্যাগকারী লক্ষ লক্ষ মা-বোনদের, বীর মুক্তিযোদ্ধাদের সুস্বাস্থ্য ও দীর্ঘায়ু কামনা করে এই লেখাটি আগামী প্রজন্মের জন্য উৎসর্গ করছি।
চিরজীবী হোক আমার প্রিয় মাতৃভূমি বাংলাদেশ। জয় বাংলা, জয় বঙ্গবন্ধু।
লেখক : বীর মুক্তিযোদ্ধা এস.এম. সালাহ্ উদ্দীন, উপদেষ্টা, জেলা আওয়ামী লীগ, চাঁদপুর।
ফোন : ০২৩৩৪৪৮৫২৬৪, ০১৮১৯-৮৪০০৮৫।