শনিবার, ১৮ জানুয়ারি, ২০২৫  |   ১৮ °সে
আজকের পত্রিকা জাতীয়আন্তর্জাতিকরাজনীতিখেলাধুলাবিনোদনঅর্থনীতিশিক্ষাস্বাস্থ্যসারাদেশ ফিচার সম্পাদকীয়
ব্রেকিং নিউজ
  •   কুমিল্লা সীমান্তে পুকুরে দেয়াল নির্মাণ করছে বিএসএফ, সতর্ক অবস্থানে বিজিবি
  •   টিউলিপ সিদ্দিকের পদত্যাগের দাবির মধ্যে নতুন বিতর্ক
  •   স্বামী বিবেকানন্দের জন্মদিনে হাজীগঞ্জ রামকৃষ্ণ সেবাশ্রমের শীতকালীন ত্রাণসেবা
  •   খালেদা জিয়ার স্বাস্থ্য স্থিতিশীল, করা হবে বিশেষ কিছু পরীক্ষা
  •   সীমান্তে অস্থিরতা: পাগল বেশে ভারত থেকে বাংলাদেশে প্রবেশ কারা?

প্রকাশ : ১৭ জানুয়ারি ২০২৫, ২১:৩৪

ইলিশ গবেষণার ৩৪ কোটি টাকা পানিতে

গিয়াসউদ্দিন মিলন
ইলিশ গবেষণার ৩৪ কোটি টাকা পানিতে

মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউট চাঁদপুর নদী কেন্দ্রে ইলিশ গবেষণার নামে ৩৪ কোটি টাকা খরচ করা হয়েছে। ফ্যাসিস্ট সরকারের আমলে সংশ্লিষ্টরা একটি বই, তিনটি বুকলেট প্রকাশনা করেই সমাপ্ত করেছেন তাদের গবেষণার কাজ। উৎপাদন বৃদ্ধির লক্ষ্যে গবেষণা হলেও প্রতিনিয়তই নদীতে কমছে ইলিশ। ফলে ব্যবসায়ী ও গবেষকরা বলছেন, গবেষণার পুরো টাকাটাই অপচয় হয়েছে।

চাঁদপুর মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউটে গিয়ে জানা যায়, বরাদ্দের টাকা গবেষণায় খরচ না করে অন্য কাজে ব্যয় করা হয়েছে। ১২ কোটি টাকা দিয়ে অভ্যন্তরীণ উন্নয়ন কর্মকাণ্ড করা হয়েছে। বাকি টাকায় পাঁচ বছর মেয়াদি প্রকল্পে কর্মরত কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বেতন-ভাতা দেওয়া হয়েছে। জেলেদের নিয়ে কয়েকটি কর্মশালা হয়েছে। নির্মাণ করা হয়েছে মুখ্য বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তার বাসভবন। পাকা করা হয়েছে অভ্যন্তরীণ রাস্তা । বসানো হয়েছে গভীর নলকূপ। নির্মাণ হয়েছে অভ্যন্তরীণ দুটি ড্রেন। তৈরি হয়েছে ফিশ ফিড শেড এবং বৈদ্যুতিক সাব-স্টেশনের ঘর, ডরমিটরি ভবন ও ব্লক দিয়ে বাঁধা হয়েছে পুকুরপাড়।

প্রকল্পের কম্পিউটার অপারেটর সাজ্জাদুল ইসলাম জানান, প্রকল্পের টাকায় চাঁদপুর মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউটের তিনদিকের সীমানা প্রাচীরের কিছু অংশ বানানো হয়েছে। অফিসের কাজের জন্যে কেনা হয়েছে দুটি কম্পিউটার। গবেষণা কাজের জন্যে কেনা হয়েছে দুটি স্পিডবোট ও একটি ছোট্ট জাহাজ।

এ প্রকল্পের বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা মোহাম্মদ আবু কাওসার দিদার বলেন, এসবই করা হয়েছে গবেষণার কাজে। ইলিশ গবেষণা কার্যক্রম ৫ বছর মেয়াদি ছিল। আমি শেষের এক বছর কাজ করার সুযোগ পেয়েছি। প্রকল্পটির পুরো নাম ছিল ‘চাঁদপুর নদী কেন্দ্রে ইলিশ গবেষণা জোরদারকরণ (২য় সংশোধিত) প্রকল্প’। এটি বাস্তবায়ন করেছে বাংলাদেশ মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউট, চাঁদপুর। প্রশাসনিক মন্ত্রণালয় ছিলো কৃষি, পানিসম্পদ ও পল্লী প্রতিষ্ঠান বিভাগ। আয়ের উৎস ছিলো অর্থ মন্ত্রণালয়।

বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা দিদার আরও বলেন, প্রকল্পটি ২০১৭ সালের জুন থেকে ২০২২ সালের জুন পর্যন্ত চলে। প্রকল্প পরিচালক ছিলেন বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা মো. আবুল বাশার। তিনি বর্তমানে জাপানে। ইলিশ নিয়ে আরও গবেষণার প্রয়োজন। জলবায়ুজনিত পরিবর্তনে ইলিশের বিচরণ ও প্রজননক্ষেত্র পুনরুদ্ধারে প্রচুর গবেষণা দরকার। ইলিশ যেহেতু একধরনের পরিযায়ী প্রাণী, ফলে তাদের চলাচল নির্বিঘ্ন করা প্রয়োজন। জেলেদের বিকল্প কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করা প্রয়োজন। চাঁদপুরে আধুনিক একটি মৎস্য অবতরণ এবং বিতরণ কেন্দ্র প্রয়োজন। মাছঘাটের জন্যে একটি নতুন জেটি দরকার এবং প্রকৃত জেলেদের চিহ্নিত করা দরকার।

গবেষণার ফলাফল জানতে চাইলে দিদার বলেন, এ বিষয়ে আমাদের পরিচালক সবচেয়ে ভালো বলতে পারতেন। তারপরও আমি যতোটুকু জানি, তা হলো দেশের দক্ষিণাঞ্চলে বলেশ্বর নদীর মোহনা অঞ্চলে ইলিশের নতুন প্রজননক্ষেত্র চিহ্নিত করা হয়েছে। এর ফলে পূর্বের শনাক্ত করা ৭ হাজার বর্গকিলোমিটার এলাকার সঙ্গে নতুন ৩৪৮ বর্গকিলোমিটার এলাকা যুক্ত হচ্ছে।

জানা যায়, গবেষণায় নদ-নদী ও সাগরে ইলিশের প্রকৃত মজুত এবং সর্বোচ্চ সহনশীল উৎপাদন নিরূপণ করা হয়েছে। ইলিশের ভ্যালুয়েডেড পণ্য যেমন ‘ইলিশ ক্রেকার্স’ প্রযুক্তি উদ্ভাবন করা হয়েছে। ইলিশ সংরক্ষণের জন্য বরফ ও হিমায়িত স্টোরেজ পরিস্থিতিতে ভেকুয়াম প্যাকেজিংয়ের মাধ্যমে ইলিশের সেলফ লাইফ বাড়ানোর প্রযুক্তি উদ্ভাবন করা হয়েছে। এছাড়াও পূর্বে চিহ্নিত অভয়াশ্রমগুলোর বর্তমান অবস্থা যাচাইকরণ, ইলিশের খাদ্যের প্রাচুর্য, ছোট আকারের ইলিশের পরিপক্বতার প্রকৃত কারণ, ইলিশ প্রজননের সময় নির্ধারণ, মা ইলিশ রক্ষা ও জাটকা সংরক্ষণ ইত্যাদি বিষয় নিয়ে বিস্তারিত গবেষণা পরিচালিত হয়েছে।

মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউট চাঁদপুরের মুখ্য বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ড. মোহাম্মদ আমিরুল ইসলাম বলেন, গবেষণাকালে আমি চাঁদপুরে ছিলাম না। তবে আমি এসে গবেষকদের একটি বই ও কয়েকটি বুকলেট পেয়েছি। তাতে যতোটুকু জেনেছি, মনে হয়েছে ইলিশ নিয়ে আরও অনেক গবেষণার প্রয়োজন। বর্ণিত প্রযুক্তিগুলোর মধ্যে ইলিশের প্রকৃত মজুত ও সর্বোচ্চ সহনশীল উৎপাদন এবং প্রজননক্ষেত্র চিহ্নিতকরণ ও প্রযুক্তি/ম্যানেজমেন্ট কৌশল দুটি ইতোমধ্যে মৎস্য অধিদপ্তরে প্রেরণ করা হয়েছে। বলেশ্বর নদীর মোহনা অঞ্চলে ইলিশের নতুন প্রজননক্ষেত্র শনাক্তকরণে বাংলাদেশ সরকার গেজেট জারি করেছে। এখন শুধু প্রয়োজন গবেষণা অনুযায়ী মাছের উৎপাদন বৃদ্ধির জন্যে সুপারিশ অনুযায়ী কাজ করা।

গবেষণা বিষয়ে চাঁদপুর মৎস্য ও বণিক সমিতির সভাপতি আব্দুল বারী জমাদার মানিক বলেন, সরকার গবেষণা ও অভিযানের নামে বছরের পর বছর কোটি কোটি টাকা ব্যয় করছে। এতে কতোটুকু লাভ হচ্ছে, তা আমার জানা নেই। আমার মনে হয় বিগত সরকার টাকা খরচ করেছে ঠিকই, কিন্তু তা পরিকল্পিতভাবে ব্যয় হয়নি । ফলে ইলিশ সম্পদ এখন ধ্বংসের মুখে। ৫ থেকে ৬ বছর আগেও নদীতে প্রচুর পরিমাণে ইলিশ পাওয়া যেতো। এখন আর মেঘনায় সে পরিমাণ ইলিশ পাওয়া যায় না। নদীতে প্রচুর পরিমাণে ডুবোচর। পরিকল্পনামাফিক এগুলো ড্রেজিং প্রয়োজন।

চাঁদপুর মৎস্য বণিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক শবেবরাত সরকার বলেন, গবেষণা-অভিযান কত কী দেখলাম। এসব যখন থেকে শুরু হয়েছে, তখন থেকে আর নদীতে ইলিশ পাওয়া যাচ্ছে না। এ পর্যন্ত কতো গবেষক এলেন, তারা কোনোদিনই আমাদের সঙ্গে আলোচনা করেননি। জেলেদের মতামত নেওয়া হয়নি। ৫ থেকে ৬ বছর আগে চাঁদপুর ঘাটে প্রতিদিন ৩ থেকে ৪ হাজার টন ইলিশ বেচাকেনা হতো। এখন দিনে এক থেকে দেড় টন মাছও আসে না। এ বিষয়ে সরকারের গবেষণা করা উচিত এবং মাছের উৎপাদন বৃদ্ধির লক্ষ্যে কাজ করা উচিত।

গবেষণার সময়ে চাঁদপুরে থাকা সিনিয়র মুখ্য বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ড. আনিসুর রহমান বলেন, বাজারে গিয়ে যখন দেখি বড় একটি ইলিশের দাম ৩ থেকে ৪ হাজার টাকা, তখন ভাবি গবেষণার পুরো অর্থটাই বুঝি বৃথা গেলো।

উল্লেখ্য, এর আগে ২০১২ ও ২০১৩ সালে পুকুরে ইলিশ চাষের নামে গবেষণা করা হয়েছিল। সে প্রকল্পেও ৬ কোটি টাকা বরাদ্দ ছিলো। তার ফলও শূন্য।

স্বত্ব: আমার দেশ।

  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়