শুক্রবার, ১৭ জানুয়ারি, ২০২৫  |   ১৯ °সে
আজকের পত্রিকা জাতীয়আন্তর্জাতিকরাজনীতিখেলাধুলাবিনোদনঅর্থনীতিশিক্ষাস্বাস্থ্যসারাদেশ ফিচার সম্পাদকীয়
ব্রেকিং নিউজ
  •   কুমিল্লা সীমান্তে পুকুরে দেয়াল নির্মাণ করছে বিএসএফ, সতর্ক অবস্থানে বিজিবি
  •   টিউলিপ সিদ্দিকের পদত্যাগের দাবির মধ্যে নতুন বিতর্ক
  •   স্বামী বিবেকানন্দের জন্মদিনে হাজীগঞ্জ রামকৃষ্ণ সেবাশ্রমের শীতকালীন ত্রাণসেবা
  •   খালেদা জিয়ার স্বাস্থ্য স্থিতিশীল, করা হবে বিশেষ কিছু পরীক্ষা
  •   সীমান্তে অস্থিরতা: পাগল বেশে ভারত থেকে বাংলাদেশে প্রবেশ কারা?

প্রকাশ : ১৭ জানুয়ারি ২০২৫, ১৫:২৬

রাষ্ট্রে অস্থিতিশীলতা ও মানুষের জীবনের মূল্য

প্রতিবেদন: মো. জাকির হোসেন
রাষ্ট্রে অস্থিতিশীলতা ও মানুষের জীবনের মূল্য

রাষ্ট্রে অস্থিতিশীলতা ও মানুষের জীবনের মূল্য

বর্তমান সময়ে বাংলাদেশের বিভিন্ন ঘটনাপ্রবাহ আমাদের রাষ্ট্রের স্থিতিশীলতা ও মানুষের জীবনের প্রতি শ্রদ্ধার বিষয়ে নতুন করে প্রশ্ন তুলছে। সম্প্রতি ঢাকার মতিঝিলে জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড (এনসিটিবি)-এর সামনে আদিবাসী শিক্ষার্থীদের ওপর সংঘটিত হামলা কেবল একটি নির্দিষ্ট ঘটনা নয়; বরং এটি আমাদের সমাজে সহনশীলতা, বহুত্ববাদ এবং গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের প্রতি হুমকির ইঙ্গিত দেয়। এ উপসম্পাদকীয়র লক্ষ্য হলো এই ঘটনার মাধ্যমে রাষ্ট্রে অস্থিতিশীলতা, মানবাধিকারের অবনতি এবং ভিন্নমতের প্রতি অসহিষ্ণুতার দিকগুলো আলোকপাত করা।

ঘটনার পটভূমি: গত ১৫ জানুয়ারি, ২০২৫ সালে মতিঝিলে এনসিটিবি ভবনের সামনে আদিবাসী শিক্ষার্থীরা তাদের পূর্বনির্ধারিত কর্মসূচি পালন করতে গিয়েছিলেন। এ কর্মসূচির মূল উদ্দেশ্য ছিল পাঠ্যপুস্তকে ‘আদিবাসী’ শব্দের অপসারণের প্রতিবাদ জানানো এবং আগের গ্রাফিটিকে পুনর্বহাল করা। এদিকে, ‘স্টুডেন্ট ফর সভরেন্টি’ নামের আরেকটি সংগঠন পাঠ্যপুস্তকে ‘আদিবাসী’ শব্দ সংযোজনের বিরোধিতায় অবস্থান কর্মসূচি পালন করছিল। দুই পক্ষের মধ্যে উত্তেজনা শুরু হয়, যা পরিণত হয় সংঘর্ষে।

এ হামলায় অন্তত ১০ জন আদিবাসী শিক্ষার্থী আহত হন এবং তাদের ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নেওয়া হয়। পুলিশের উপস্থিতি সত্ত্বেও পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনা সম্ভব হয়নি। অভিযোগ রয়েছে, হামলাটি ছিল পরিকল্পিত এবং ‘স্টুডেন্ট ফর সভরেন্টি’র সদস্যরা লাঠিসোঁটা নিয়ে আগে থেকেই প্রস্তুত ছিলেন। এ ঘটনায় উভয় পক্ষই পরস্পরের বিরুদ্ধে হামলার অভিযোগ তুলেছে।

রাষ্ট্রে অস্থিতিশীলতার লক্ষণ: এ ধরনের ঘটনা আমাদের সমাজের গভীরতর সমস্যাগুলোর প্রতি আলোকপাত করে। গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে ভিন্নমতের প্রতি শ্রদ্ধা ও মতপ্রকাশের স্বাধীনতা থাকা অত্যাবশ্যক। কিন্তু সাম্প্রতিক বছরগুলোতে বাংলাদেশে মতপ্রকাশের স্বাধীনতা ক্রমশ সংকুচিত হচ্ছে। বিভিন্ন ক্ষেত্রে সহিংসতা ও দমনমূলক আচরণ রাষ্ট্রের অস্থিতিশীলতার প্রকৃত রূপ তুলে ধরছে।

১.শিক্ষাপ্রাঙ্গনে সহিংসতা: শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো সহনশীলতা ও গণতান্ত্রিক চর্চার প্রধান ক্ষেত্র হওয়ার কথা থাকলেও বর্তমানে এগুলোই সহিংসতার কেন্দ্রস্থলে পরিণত হচ্ছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়, এবং অন্যান্য প্রতিষ্ঠানে ছাত্র সংগঠনগুলোর মধ্যে দ্বন্দ্বের ফলে প্রাণহানি, আহত হওয়া, এবং শিক্ষার পরিবেশ নষ্ট হচ্ছে।

২.সাম্প্রদায়িক উত্তেজনা: বাংলাদেশে বিভিন্ন সময়ে সাম্প্রদায়িক উত্তেজনা ও সহিংসতার ঘটনা ঘটেছে। পার্বত্য চট্টগ্রামের আদিবাসী জনগোষ্ঠী বা ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীগুলোর প্রতি বৈষম্যমূলক আচরণ এবং তাদের সাংবিধানিক অধিকার নিয়ে বিতর্ক আমাদের সমাজে বহুত্ববাদের চর্চাকে প্রশ্নবিদ্ধ করে। মতিঝিলের সাম্প্রতিক ঘটনাটি সাম্প্রদায়িক বৈষম্যের আরেকটি উদাহরণ, যেখানে আদিবাসীদের সাংস্কৃতিক পরিচিতি নিয়েই প্রশ্ন তোলা হয়েছে।

৩.রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ ও দমনমূলক নীতি: রাষ্ট্রের রাজনৈতিক কাঠামোতে একধরনের দমনমূলক নীতি কার্যকর রয়েছে, যা মতপ্রকাশ ও প্রতিবাদের অধিকারকে হ্রাস করছে। রাজনৈতিক দলগুলো নিজেদের স্বার্থে সামাজিক বিভাজনকে কাজে লাগিয়ে ক্ষমতা ধরে রাখার চেষ্টা করে। ফলে সাধারণ মানুষের জীবন ও মতামতের গুরুত্ব হারিয়ে যায়।

মানুষের জীবনের মূল্য: বাংলাদেশের সাম্প্রতিক ঘটনাগুলো স্পষ্টভাবে দেখায় যে এখানে মানুষের জীবনকে যথেষ্ট মূল্যায়ন করা হয় না। মতিঝিলের ঘটনায় আহতদের চিত্র, রক্তাক্ত অবস্থায় হাসপাতালে নেওয়ার দৃশ্য আমাদের মনে করিয়ে দেয় যে, মানুষের জীবনের প্রতি শ্রদ্ধা হারিয়ে যাচ্ছে। এ ধরনের সহিংসতায় বেশিরভাগ ক্ষেত্রে দোষীদের শাস্তি হয় না, যা দায়মুক্তির সংস্কৃতিকে আরও শক্তিশালী করে।

প্রশাসনের ভূমিকা: পুলিশ প্রশাসনের ভূমিকা প্রায়শই প্রশ্নবিদ্ধ হয়। মতিঝিলের ঘটনায় পুলিশ উপস্থিত থাকলেও তারা সহিংসতা ঠেকাতে ব্যর্থ হয়। এর কারণ হয়তো প্রয়োজনীয় প্রশিক্ষণের অভাব, রাজনৈতিক চাপে নিরপেক্ষতা হারানো, বা পরিস্থিতি মোকাবিলার প্রতি উদাসীনতা।

বিচারহীনতা: বাংলাদেশে সহিংসতার ঘটনার পর প্রায়ই দেখা যায়, তদন্ত কার্যক্রম ধীরগতিতে চলে বা দোষীদের শাস্তি হয় না। এতে অপরাধীরা আরও উৎসাহিত হয় এবং সাধারণ মানুষের নিরাপত্তাহীনতা বাড়ে।

মারামারি ও সংঘর্ষের বিস্তার: বাংলাদেশে সহিংসতার ঘটনা শুধু ঢাকায় সীমাবদ্ধ নয়। চট্টগ্রাম, রাজশাহী, সিলেটসহ দেশের বিভিন্ন জায়গায় ছোট-বড় সংঘর্ষ ও সহিংসতা ঘটছে। বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে ছাত্র সংগঠনগুলোর মধ্যে দ্বন্দ্ব, ধর্মীয় বা জাতিগত উত্তেজনা, এবং রাজনৈতিক সংঘাত প্রতিদিনকার ঘটনা হয়ে দাঁড়িয়েছে।

বিশেষ কয়েকটি উদাহরণ:

১. চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়: সম্প্রতি ছাত্রলীগের দুই গ্রুপের মধ্যে সংঘর্ষে কয়েকজন আহত হয়েছে। এর ফলে ক্যাম্পাসে এক সপ্তাহের জন্য ক্লাস বন্ধ রাখতে হয়েছে।

২. রাজশাহী: জাতিগত পরিচিতি নিয়ে মতবিরোধ থেকে দুই গোষ্ঠীর সংঘর্ষে ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে।

৩. সিলেট: ছাত্রদের মধ্যে সহিংসতা থেকে সাধারণ মানুষের সম্পত্তি নষ্ট হয়েছে, যা স্থানীয় প্রশাসনকে কঠিন অবস্থায় ফেলেছে।

সমস্যার গভীরতা ও সমাধানের উপায়:

উপরে আলোচিত ঘটনাগুলো আমাদের সমাজের মৌলিক সমস্যাগুলোর ইঙ্গিত দেয়। এ সমস্যাগুলোর মূলে রয়েছে সহিষ্ণুতার অভাব, ভিন্নমতের প্রতি শ্রদ্ধার ঘাটতি, এবং দায়মুক্তির সংস্কৃতি।

১.শিক্ষা ও সচেতনতা বৃদ্ধি:

সহনশীলতা, বহুত্ববাদ, এবং ভিন্নমতের প্রতি শ্রদ্ধা শিক্ষা কারিকুলামের অন্তর্ভুক্ত করতে হবে। প্রাথমিক পর্যায় থেকেই শিক্ষার্থীদের এ বিষয়ে সচেতন করা জরুরি।

২.ন্যায়বিচার নিশ্চিত করা:

যে কোনো সহিংসতার ঘটনার পর নিরপেক্ষ তদন্ত এবং দোষীদের শাস্তি নিশ্চিত করতে হবে। বিচার ব্যবস্থার প্রতি মানুষের আস্থা পুনঃস্থাপন করতে হবে।

৩.প্রশাসনের প্রশিক্ষণ ও সংস্কার:

পুলিশসহ অন্যান্য প্রশাসনিক সংস্থাগুলোর সদস্যদের গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ ও সহিংসতা প্রতিরোধের কৌশল সম্পর্কে প্রশিক্ষণ দেওয়া প্রয়োজন। পাশাপাশি প্রশাসনের স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা নিশ্চিত করতে হবে।

৪. রাজনৈতিক সংস্কৃতি পরিবর্তন:

রাজনৈতিক দলগুলোর উচিত ক্ষমতার রাজনীতির পরিবর্তে জনগণের স্বার্থে কাজ করা। ভিন্নমতের প্রতি শ্রদ্ধা প্রদর্শন এবং মতপ্রকাশের স্বাধীনতাকে সমর্থন করতে হবে।

উপসংহার: মতিঝিলের সাম্প্রতিক ঘটনাটি আমাদের সমাজের সহিষ্ণুতা, ন্যায়বিচার, এবং মানবাধিকারের প্রশ্নে গুরুত্বপূর্ণ বার্তা দেয়। এ ধরনের ঘটনা কেবল ক্ষুদ্র একটি ঘটনার উদাহরণ নয়; বরং এটি রাষ্ট্রে অস্থিতিশীলতা এবং মানুষের জীবনের প্রতি অবহেলার গভীর সমস্যার চিত্র তুলে ধরে আমাদের উচিত জাতিগত, ধর্মীয় এবং সামাজিক ভিন্নতাগুলোকে সম্মান করা এবং বহুত্ববাদী সমাজ গড়ে তোলার জন্য একযোগে কাজ করা। প্রশাসন, রাজনীতি এবং সাধারণ মানুষের মধ্যে সচেতনতা বৃদ্ধি এবং দায়বদ্ধতা নিশ্চিত করতে হলে আমাদের সবাইকে ঐক্যবদ্ধ প্রচেষ্টা চালাতে হবে। রাষ্ট্রের স্থিতিশীলতা এবং মানুষের জীবনের মর্যাদা রক্ষা করা প্রতিটি নাগরিকের দায়িত্ব।

লেখক : মো. জাকির হোসেন, তথ্য ও গবেষণা সম্পাদক, চাঁদপুর জেলা বিএনপি।

  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়