প্রকাশ : ০২ ডিসেম্বর ২০২৩, ০০:০০
এনামুল হক রাসেল। ফরিদগঞ্জ উপজেলার মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক ও যুদ্ধাহত বীর মুক্তিযোদ্ধা আমিনুল হক মাস্টারের ছোট সন্তান। তার বাবা জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের কনিষ্ঠ সন্তান শেখ রাসেলের নামের সাথে মিলিয়ে তার ডাক নাম রেখেছিলেন রাসেল। পেশায় একজন দলিল লেখক। মৃদুভাষী এবং সদালাপী। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে সত্য ও ন্যায়ের পক্ষে লিখেন সর্বদা। ফরিদগঞ্জ পৌর এলাকার ৬নং ওয়ার্ডের সাফুয়া গ্রামে তার বসবাস।
মহান বিজয়ের মাসে চাঁদপুরের শীর্ষ দৈনিক চাঁদপুর কণ্ঠের ধারাবাহিক প্রতিবেদন ‘মুক্তিযোদ্ধার সন্তানদের ভাবনা’ শীর্ষক প্রতিবেদনে তিনি বলেছেন নিজের কথা, বাবার কথা এবং জাতির প্রতি আমাদের কর্তব্য কী হওয়া উচিত।
চাঁদপুর কণ্ঠ : আপনার বাবা (যিনি একজন বীর মুক্তিযোদ্ধা)-এর নাম ও সংক্ষিপ্ত পরিচয় কী? তিনি কোথায় যুদ্ধ করেছেন?
এনামুল হক রাসেল : মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক ও যুদ্ধাহত বীর মুক্তিযোদ্ধা আমিনুল হক মাস্টার, যিনি ১৯৭১ সালে মহান মুক্তিযুদ্ধে ফরিদগঞ্জ থানা সংগ্রাম কমিটির আহ্বায়ক ছিলেন। তিনি ২নং সেক্টরের অধীনে কুমিল্লা অঞ্চলের চাঁদপুর জেলাধীন হাজীগঞ্জ, ফরিদগঞ্জ ও চাঁদপুর সদরের সম্মুখযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন।
চাঁদপুর কণ্ঠ : মুক্তিযোদ্ধার সন্তান হিসেবে আপনার অনুভূতি কী?
এনামুল হক রাসেল : একজন মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক ও যুদ্ধাহত বীর মুক্তিযোদ্ধার সন্তান হিসেবে আমি খুবই গর্বিত। যখন খুবই ছোট ছিলাম তখন থেকেই বাবার কাছে মুক্তিযুদ্ধের অনেক গল্প শুনেছি। তখন যদিও সব বুঝতাম না। আজ যে লাল-সবুজের পতাকা, মানচিত্র নিয়ে আমরা গর্ব করি এর অবদান তাঁদেরই। সেখানে কিছুটা অবদান আমার বাবারও রয়েছে এবং ছিলো। এ কথা ভাবতে গেলেই গর্বে বুকটা ভরে উঠে।
আমরা একটি স্বাধীন দেশ পেয়েছি। দেশ উন্নত হচ্ছে। সামনে এগিয়ে যাচ্ছে। কিন্তু অনেকেরই সময় হয় না এগুলো কারা করলো, কীভাবে করলো--তাঁদের কথা ভাবার। মুক্তিযোদ্ধাদের কখনো সঠিকভাবে মূল্যায়ন করা হয়নি।
আমার প্রশ্ন, কেনো বীর মুক্তিযোদ্ধারা তাঁদের প্রাপ্য সম্মানটুকু পান না? বছরের বিশেষ বিশেষ দিনে শুধু স্মরণ না করে তাঁদের পরিবার ও তাঁদের প্রাপ্য সম্মানটুকু দিতে হবে সব সময়। এটাই আমার একান্ত কামনা।
চাঁদপুর কণ্ঠ : মুক্তিযুদ্ধের চেতনা সঞ্চারে আপনার করণীয় কী কী হওয়া উচিত বলে মনে করেন?
এনামুল হক রাসেল : আজকাল দুটি শব্দ ‘মুক্তিযুদ্ধের চেতনা’ ব্যাপকভাবে ব্যবহৃত হতে দেখা যায়। কথার ফাঁকে যে কোনো প্রসঙ্গে এই শব্দগুলোর উল্লেখ প্রায়ই শোনা যায়। দুঃখের বিষয় হলো, অনেকে মুক্তিযুদ্ধের চেতনার দোহাই দিয়ে ঠিক এর বিপরীত কাজ করে যাচ্ছেন।
মুক্তিযুদ্ধের চেতনার ক্যানভাসটা আসলে কী? মুক্তিযুদ্ধের চেতনার ক্যানভাসটা হলো সর্বাগ্রে দেশপ্রেম। দেশের মঙ্গলার্থে নিবেদিতপ্রাণ এবং প্রগতিশীল একটা জাতিই হবে সত্যিকারের মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় সমৃদ্ধ একটা জাতি। এ দেশের আকাশ-বাতাস-সবুজকে যারা ভালোবাসে, এ দেশের জনসাধারণকে যারা ভালোবাসে, এ দেশের উন্নয়নে যারা সুখী হয় তারাই মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে লালনকারী। তারাই ভালোবেসে লাল-সবুজের পতাকাটা হৃদয়ে ধারণকারী। তারাই ১৯৭১ সালে পাকিস্তানের শোষণকে মনেপ্রাণে ঘৃণাকারী।
এ চেতনাধারীরাই ১৯৭১-এর লড়াইকে জাতির মুক্তির লড়াই বলে মনে করেন। এসবই হলো একজন বাঙালির মুক্তিযুদ্ধের চেতনার নিয়ামক। সর্বোপরি মুক্তিযুদ্ধের চেতনা মানে অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশ এবং এ বাংলার মানুষের অন্যায়ের কাছে কখনো মাথা নত না করা।
জাতির পিতা আমাদের মুক্তি চেয়েছিলেন। তিনি সোনার বাংলা গড়তে চেয়েছিলেন। কিন্তু পঁচাত্তরের ১৫ আগস্টের পর তার স্বপ্নের সোনার বাংলায় শুরু হয়েছিল মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস নিয়ে এক জঘন্য লুকোচুরি।
এই যে মুক্তিযুদ্ধের চেতনার সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা, তাকে আমরা কী বলবো! এটি আসলে একটা জাতির নিজের অস্তিত্বের সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা। নিজের শেকড়ের সঙ্গে লড়াই।
এ দেশের স্বাধীনতার ইতিহাসে ২৬ মার্চ স্বাধীনতা দিবস, ১৬ ডিসেম্বর বিজয় দিবস। মুক্তিযুদ্ধকে উপলক্ষ করে এ দুটি দিবসেও অনেকের আপত্তি। তারা একটি দিনকেই স্বাধীনতা দিবস হিসেবে রাখতে চান। হায়রে কপটেরা! চোখ বন্ধ করলেই কি সত্যকে ধামাচাপা দেয়া যায়? ২৬ মার্চ ও ১৬ ডিসেম্বর- দুটি দিবসের মাহাত্ম্য ও তাৎপর্য ভিন্ন হলেও তা বাঙালির কাছে চিরকাল ভাস্বর হয়েই থাকবে। কেবল তাই নয়, স্বাধীনতার পক্ষশক্তির কাছে ২৬ মার্চ, ১৬ ডিসেম্বরের মতো ৭ মার্চও সমান তাৎপর্যপূর্ণ।
এ জাতিকে অবশ্যই মনে রাখতে হবে, স্বাধীনতার বীজ বপন করা হয়েছিল সেই ১৯৫২ সালে। আর মুক্তিযুদ্ধের চূড়ান্ত দিকনির্দেশনা এসেছিলো ১৯৭১ সালের ৭ মার্চে বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক ভাষণের মাধ্যমে। সুতরাং স্বাধীনতার ইতিহাসে যে বা যারা ক্ষিপ্র হয়ে আঁচড় কাটে কিংবা নখর বসাতে চায়, তারা আসলে তাদের নিজেদের কুৎসিত-লোলুপ-বিশ্বাসঘাতক-প্রতিক্রিয়াশীল দৃষ্টিভঙ্গিটারই প্রতিফলন ঘটায়।
প্রকৃত মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ও আদর্শের অনুসারীদের এ দেশের স্বার্থে, রাজনৈতিক আদর্শের স্বার্থে, জনগণের স্বার্থে, উন্নয়নের স্বার্থে সতর্ক থাকতে হবে। সুতরাং সতর্কতাই হতে পারে মুক্তিযুদ্ধের চেতনার একমাত্র রক্ষাকবচ।