সোমবার, ২০ জানুয়ারি, ২০২৫  |   ২৪ °সে
আজকের পত্রিকা জাতীয়আন্তর্জাতিকরাজনীতিখেলাধুলাবিনোদনঅর্থনীতিশিক্ষাস্বাস্থ্যসারাদেশ ফিচার সম্পাদকীয়
ব্রেকিং নিউজ
  •   কুমিল্লা সীমান্তে পুকুরে দেয়াল নির্মাণ করছে বিএসএফ, সতর্ক অবস্থানে বিজিবি
  •   টিউলিপ সিদ্দিকের পদত্যাগের দাবির মধ্যে নতুন বিতর্ক
  •   স্বামী বিবেকানন্দের জন্মদিনে হাজীগঞ্জ রামকৃষ্ণ সেবাশ্রমের শীতকালীন ত্রাণসেবা
  •   খালেদা জিয়ার স্বাস্থ্য স্থিতিশীল, করা হবে বিশেষ কিছু পরীক্ষা
  •   সীমান্তে অস্থিরতা: পাগল বেশে ভারত থেকে বাংলাদেশে প্রবেশ কারা?

প্রকাশ : ২০ জানুয়ারি ২০২৫, ০৯:৩০

খণ্ডে খণ্ডে অখণ্ড জীবন

পীযূষ কান্তি বড়ুয়া
খণ্ডে খণ্ডে অখণ্ড জীবন

॥ তেইশতম পর্ব ॥

জেলা ব্র্যান্ডিং বিষয়টা কেবল জেলা প্রশাসকের সম্মেলন কক্ষে সীমাবদ্ধ রাখার বিষয় ছিলো তা নয়। এটাকে কেন্দ্র করে নেওয়া হয়েছিলো নানা কর্মসূচি যার বেশকিছু অংশে আমারও অংশগ্রহণ ছিলো। ঠিক করা হলো, সারাদেশকে জানান দিতে ঢাকায় ‘চাঁদপুর জেলা ব্র্যান্ডিং ফেস্টিভ্যাল-২০১৭’-এর আয়োজন করা হবে। তারিখ নির্ধারিত হলো ২৭ জানুয়ারি ২০১৭। অনুষ্ঠানের ভেন্যু ঠিক করা হলো রাজধানীর বসুন্ধরা ইন্টারন্যাশনাল কনভেনশন সিটির 'পুষ্পগুচ্ছ' হল। প্রায় তিন হাজার অতিথি ধারণক্ষমতাসম্পন্ন এই হলের বুকিং দিতে গেলেন চাঁদপুর চেম্বার অব কমার্সের নেতৃবৃন্দ। কেননা তারাই ছিলেন এর মূল স্পন্সর। এ উপলক্ষে বেশ কয়েকটি উপ-কমিটি করা হলো। আমাকে রাখা হলো সাংস্কৃতিক উপ-কমিটির আহ্বায়ক হিসেবে। এ কমিটির কার্যক্রমে মুখ্য সহযোগিতা করেন কমিটির সদস্য নূরুল আমিন খান আকাশ এবং আয়োজনে সহযোগী প্রতিষ্ঠান আকিজ বেভারেজের পক্ষে চাঁদপুরের রোটারিয়ান শেখ মঞ্জুরুল কাদের সোহেল। ফেস্টিভ্যাল আয়োজনে একটা গুরুত্বপূর্ণ বিষয় ছিলো থিম সং নির্মাণ। এ কাজে চাঁদপুরের কৃতী সন্তান, জাতীয় পুরস্কারপ্রাপ্ত গীতিকার কবির বকুল সহযোগিতা করেন। তিনি থিম সংয়ের লিরিক্স রচনা করেন এবং তাতে সুর দেন। থিম সংয়ে কণ্ঠ দেন শিল্পী এসডি রুবেল ও দিনাত জাহান মুন্নী, যারা প্রত্যেকেই চাঁদপুরের সন্তান। জেলা প্রশাসক মহোদয়ের ঐকান্তিক ইচ্ছায় এ অনুষ্ঠান সঞ্চালনার জন্যে পেশাদার টিভি উপস্থাপককে নিযুক্ত করা হয়। চাঁদপুরের সন্তান সফিউল আলম বাবু এ দায়িত্ব পালন করেন। কিন্তু চাঁদপুরের ছেলে হলেও ঢাকায় বসবাসের কারণে এবং অতি ব্যস্ততায় ঠিকমতো মহড়া না দিতে পারায় আগত সকল বরেণ্য অতিথির নাম তার পক্ষে নির্ভুল ঘোষণা করা কঠিন ছিলো কিছুটা। ফলে চাঁদপুরের তৎকালীন পুলিশ সুপার তাঁর ঘোষণাক্রমে পিছে পড়ে যান। বিষয়টি পুলিশ সুপার মহোদয়কে খানিকটা অসন্তুষ্ট করেছিলো বলে প্রতীয়মান হয়। এর ফাঁকে চাঁদপুরের আরেকজন উপস্থাপক মো. ইউনুছ উল্লাহ্ও তৈরি ছিলেন কখন তার ডাক পড়ে সঞ্চালনায়। নির্ধারিত উপস্থাপককে আয়োজন সম্পর্কে ওয়াকিবহাল করতে আমাকে বেশ তৎপর থাকতে হয়েছিলো। কাজী শাহাদাত ভাই ও পুরান বাজার ডিগ্রি কলেজের অধ্যক্ষ এবং অতিরিক্ত জেলা প্রশাসকরা সবাই এ ব্যাপারে সচেষ্ট ছিলেন, যাতে কোনো ত্রুটি না হয়। অনুষ্ঠানের স্ক্রিপ্ট তৈরি করার গুরু দায়িত্ব আমার ওপর অর্পিত হওয়ার কারণে আমাকে সর্বদা ডায়াস ও পোডিয়ামের কাছাকাছি থাকতে হয়েছিলো। অনুষ্ঠান শুরু হওয়ার মিনিট বিশেক আগে হৃদয়ে কৃষির জনক শাইখ সিরাজ স্ক্রিপ্ট দেখতে চেয়ে আমাকে ডেকে পাঠান। তিনি স্ক্রিপ্ট পাঠ করে প্রসন্ন হন এবং উপস্থাপককে জোর দিয়ে বলেন, যাতে আমন্ত্রিত অতিথিদের নাম ও পদবী নির্ভুল থাকে।

অনুষ্ঠানে আকিজ গ্রুপের তৈরি করা ভিডিও চিত্র প্রদর্শিত হয়, যা ছিলো চাঁদপুর বিষয়ক এবং এর পেছনে শ্রম দেন শেখ মঞ্জুরুল কাদের সোহেল। শাইখ সিরাজের ইলিশকেন্দ্রিক ভিডিওগ্রাফিতে খুব সুন্দর করে ইলিশের বাড়ি চাঁদপুর বিষয়টি উঠে আসে। এ অনুষ্ঠানেই এক পর্যায়ে মোড়ক উন্মোচন করা হয় চাঁদপুর জেলা ব্র্যান্ডিং বিষয়ক দ্বিভাষিক প্রকাশনা ' ইলিশের বাড়ি চাঁদপুর, Chandpur The City Of Hilsha.' আক্ষেপ একটু থেকেই যায়, প্রকাশনা কমিটির সদস্য হিসেবে মোড়ক উন্মোচনকালীন আমরা সংশ্লিষ্টরা স্থানাভাবে মঞ্চে বইটি হাতে নিতে পারিনি, যা আমাদের প্রাপ্য ছিলো।

মাননীয় ত্রাণ ও পুনর্বাসন মন্ত্রী মহোদয় কর্তৃক উদ্বোধিত এ অনুষ্ঠানে শুভেচ্ছা বক্তব্যের শেষে মনোজ্ঞ সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান পরিবেশিত হয়। এতে চাঁদপুরের সন্তান শিবলী মুহাম্মদ, দিনাত জাহান মুন্নী, এসডি রুবেলসহ শামীম আরা নীপার নেতৃত্বে একদল সহশিল্পী নৃত্য ও সংগীত পরিবেশন করেন।

চাঁদপুর জেলা ব্র্যান্ডিং ফেস্টিভ্যাল ২০১৭ উপলক্ষে একত্রিশ প্রকার ইলিশ রেসিপি দিয়ে বুফে খাবার পরিবেশন করা হয়। এতে বাঙালির চিরাচরিত স্বভাব খাবার নষ্ট করার বিষয়টি বেশ দৃষ্টিকটু ছিলো। যে যা খেতে পারবে না তা-ও নিয়ে প্লেট ভর্তি করে ফেলেছিলো। ফলে খাবার নষ্ট হয়েছে বেশি এবং শেষদিকে যারা খেতে বসেছেন তাদের খাবার আনুপাতিক হারে কম পড়ে যায়। অথচ শুরুর দিকে এক এক জন সাত-আট টুকরা ইলিশ নিয়ে বসেছিলেন এবং তার অর্ধেকই এঁটো করে ফেলেছেন না খেতে পেরে। স্মোকড ইলিশ, দই ইলিশ, পাইনাপেল ইলিশ, অরেঞ্জ ইলিশ, ইলিশ ভিন্দুলি, মটরশুঁটি ইলিশ এরকম সব লোভনীয় পদ ছিলো ডিনারে। 'পুষ্পগুচ্ছ' হলে ঢুকতেই চেয়ার নিয়ে বসেছিলো তমাল দা আর মোর্শেদের দল, যারা আমন্ত্রণ কার্ড দেখে দেখে অতিথিদের হাতে তুলে দিচ্ছিলেন একটা করে স্যুভেনির ব্যাগ। পাটের আঁশ দিয়ে তৈরি সুদৃশ্য এ ব্যাগের ভেতর ছিলো ফেস্টিভ্যালের টি শার্ট, চেস্ট কার্ড, লেপেল পিন, ইলিশ রেসিপি বই ইত্যাদি। স্যুভেনিরের ব্যাগে এক পাশে ছিলো জেলা ব্র্যান্ডিং লোগো ও ট্যাগ লাইন এবং অন্য পাশে ছিলো আমার লেখা জেলা ব্র্যান্ডিং প্রকাশনায় স্থান পাওয়া একটা ছড়া 'ইলিশের বাড়ি চাঁদপুর। ' যদিও এতে রচয়িতার নাম নেই, তবুও ছড়াটির সাহায্যে জেলা ব্র্যান্ডিং-এর মূল বিষয় ইলিশকে বেশ ভালোভাবেই সবার কাছে পৌঁছে দেওয়া গেছে। রচয়িতা হিসেবে একটা সান্ত্বনা আমার ছিলো। এ অনুষ্ঠানের বেশ কিছুদিন পরে, তমাল কুমার ঘোষ দাদা আমাকে জানালেন, পশ্চিমবঙ্গে বসবাসরত তাঁর ভাতিজি এই ব্যাগ পেয়ে তাঁকে অনুযোগ করেছেন, কেন এতো সুন্দর একটা ছড়ার ছড়াকারের নাম স্যুভেনিরের ব্যাগে দেয়া হোলো না। দেখলাম, তমালদাও বেশ অনুতাপে দগ্ধ হচ্ছিলেন।

বসুন্ধরা কনভেনশন হলের মুক্ত প্রাঙ্গণে চাঁদপুরের ইলিশের স্টল দেওয়া হয়েছিলো। যে যে চায় সে সে যেন কিনে নিয়ে যতে পারে চাঁদপুরের ইলিশ। এটাও ছিলো ব্র্যান্ডিংয়ের একটা অংশ। কিন্তু এই স্টল নিয়ে একটা ভুল বোঝাবুঝি হয়। অনুষ্ঠান ছিলো চাঁদপুর জেলা ব্র্যান্ডিং আর ওখানে বিক্রি হচ্ছিল বার্মার ইলিশ, যা চাঁদপুর মাছের আড়তে পাওয়া যায়। বিক্রেতা বলে দিচ্ছিলেন, এগুলো বার্মার ইলিশ। তার ভাষ্যে এর ব্যাখ্যা ছিলো এমন, ও সময় চাঁদপুরের ইলিশ ধরা পড়ছিলো কম। আর বার্মার ইলিশকে স্বাদের কারণে চাঁদপুরের বলে চালিয়ে দেওয়ার জো নেই। তাই তারা বার্মার ইলিশ বলেই তা বিক্রি করেছেন। জেলা ব্র্যান্ডিংয়ের লোগো নির্মাতা চিত্রশিল্পী হাশেম খান নিজেই লোগোর ট্যাগ লাইনে লিখেছিলেন 'ইলিশের বাড়ি চাঁদপুর, Chandpur The City Of Hilsha.' কিন্তু তাঁর কোনো এক বক্তব্যে তিনি তা ভুলে গিয়ে বাড়িকে ইংরেজিতে ঈরঃু কেন বলা হলো তা নিয়ে অস্পষ্টতার কথা বললেন। এ কথা শুনে জেলা প্রশাসক মহোদয় আমাকে বললেন, পীযূষ, পড়লাম তো বেকায়দায়। দেখেন, কী করা যায়। আমি তথ্যপ্রমাণ ঘেঁটে এর একটা যুক্তি দাঁড় করালাম। তারা দল বেঁধে সমুদ্র হতে আসে বলেই চাঁদপুর সিটি অব হিলশা আর এককভাবে মা ইলিশকে ধরলে বলতে হয় চাঁদপুরে তার বাড়ি। যেহেতু ইলিশের ক্ষেত্রে দুটোই সত্য, তাই এক্ষেত্রে ইলিশের বাড়ি চাঁদপুর এবং Chandpur The City Of Hilsha. কথায় কোনো বিরোধ নেই। ব্যাখ্যাটা ট্যাগলাইনকে শক্তি দিলো যথাপ্রত্যাশায়। ফলে আর অস্পষ্টতা রইলো না।

জেলা ব্র্যান্ডিং ফেস্টিভ্যাল উপলক্ষে আমার রোগীপত্র দেখা শিকেয় উঠলো। এর বিভিন্ন পর্যায়ে প্রস্তুতি সভা ও কাজকর্ম সম্পন্ন করতে গিয়ে আমার চেম্বারে প্রত্যাশিত উপস্থিতি বজায় রাখতে পারিনি। ফলে রোগীরা অসন্তুষ্ট হয়েছে এ কথা নির্দ্বিধায় বলা যায়। উপার্জনও এর ফলে কমে এসেছিলো। কিন্তু মন যেখানে উজাড় করে দিয়েছি উৎসাহ আর প্রেমে, সেখানে পেশা কি আর বাধা হয়ে দাঁড়াতে পারে? কোনো কোনো সময় দুপুর বারোটায়ও ডাক পড়েছে মিটিংয়ের কিংবা জরুরি কোনো কাজ করে দেওয়ার। অথচ সকাল এগারোটা হতে দুপুর দুটো হলো আমার চেম্বার প্র্যাকটিসের মূল সময়। চরের রোগীগুলো এসে বসে থাকতে পারতো না। তাদের ট্রলার সময়মত ছেড়ে দিতো। এ কারণে বেশ ভালো রকমের রোগী আমি হারাই, যা আমার পরবর্তী সময়ে প্রভাব ফেলে। কেউ কেউ আবার দূর থেকে মনে করতো, আমি বুঝি এ কাজের বদৌলতে আঙ্গুল ফুলে কলাগাছ হয়ে যাচ্ছি। আহারে! মূর্খ মানুষের চিন্তার দীনতা কতো প্রকট !

একবার ডিসি অফিস থেকে জেলা ব্র্যান্ডিং ফেস্টিভ্যালের মিটিং শেষে বের হয়ে বেদেনির দলের খপ্পরে পড়ি। তারা আমাকে একা পেয়ে ইনিয়ে বিনিয়ে অসুস্থ বাচ্চার চিকিৎসার সাহায্য চায়। আমি দয়ার্দ্র হয়ে পকেটে হাত দেই। পাঁচশো টাকা নোট ভাঙতি ছিলো না। ওটা হাতে দিয়ে বললাম, আমাকে তিনশ টাকা ফেরত দাও, তুমি দুশো টাকা রাখো তোমার বাচ্চার চিকিৎসার জন্যে। হায়! আমি কাকে কী বললাম! আস্ত পাঁচশো টাকার নোটটা পেয়ে সে আর দাঁড়ালো না। আমার একটা ভালো শিক্ষা হলো। বেদেনির দলকে আর ভবিষ্যতে করুণা দেখানো যাবে না। কড়কড়ে পাঁচশো টাকার নোট গচ্চা দিয়ে আমার মন ভালো ছিলো না অনেকক্ষণ।

জেলা ব্র্যান্ডিং ফেস্টিভ্যাল ২০১৭ উদযাপন শেষে জেলা ব্র্যান্ডিং মিউজিয়াম স্থাপন করাটা জরুরি হয়ে পড়েছিলো। জেলা প্রশাসন, চাঁদপুর কর্তৃক জেলা কালেক্টরেট ভবনে একটা মাঝারি আকারের কক্ষে বাংলাদেশের প্রথম জেলা ব্র্যান্ডিং মিউজিয়াম প্রতিষ্ঠা করা হলো। এতে ব্র্যান্ডিং ফেস্টিভ্যালের লোগোর রেপ্লিকা থেকে শুরু করে সকল প্রকাশনা, সংবাদ প্রকাশকারী পত্রিকা, স্যুভেনিরসমূহ, জেলা ব্র্যান্ডিং লোগো সম্বলিত মগ ও ইলিশ রেসিপি বুক, বিশেষ সংখ্যার লিটল ম্যাগ এসবই স্থান পায়। যেদিন এই ব্র্যান্ডিং মিউজিয়াম উদ্বোধন হলো সেদিন বেশ গর্ব বোধ হয়েছিল। আমরা হলাম জেলা ব্র্যান্ডিং মিউজিয়ামের পথিকৃৎ।

  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়