প্রকাশ : ০৮ এপ্রিল ২০২২, ০০:০০
আগামীকাল ৯ এপ্রিল শনিবার সারাদেশের ন্যায় চাঁদপুরেও অনুষ্ঠিত হবে সনাতন ধর্মাবলম্বী সম্প্রদায়ের মহাঅষ্টমী স্নানযাত্রা। এদিন পুরাণবাজার হরিসভা মন্দির সংলগ্ন মেঘনা নদীতে মন্ত্রপুতঃ হয়ে স্নান সম্পন্ন করার সকল আয়োজন সস্পন্ন করা হয়েছে বলে অবহিত করেছেন চাঁদপুর জেলা পূজা উদ্যাপন পরিষদের সভাপতি সুভাষ চন্দ্র রায় ও সাধারণ সম্পাদক তমাল কুমার ঘোষ। নেতৃবৃন্দ জানান, গত ২ বছর বৈশ্বিক মহামারি করোনার কারণে সকল প্রকার আচার-অনুষ্ঠান বন্ধ থাকায়, সনাতন ধর্মাবলম্বীদের মহাঅষ্টমী স্নান যাত্রাও বন্ধ ছিল। আনুষ্ঠানিকভাবে কেউ আর স্নানযাত্রায় অংশ নিতে পারেননি। সকলেরই প্রার্থনা ছিল আমরা যেন করোনা থেকে মুক্তি লাভ করতে পারি। এ বছর করোনার প্রাদুর্ভাব কমে যাওয়ায়, আমরা অন্যান্য বছরের ন্যায় পুরাণবাজার হরিসভা মন্দির সংলগ্ন মেঘনা নদীতে স্নানযাত্রার আয়োজন সম্পন্ন করেছি। এদিন ভোরের আলো ফোটার আগেই ব্রহ্ম মহুত্বে ব্রহ্মপুত্র পূজা, গঙ্গাপূজাসহ ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠানের মধ্যে দিয়ে স্নানের স্থানকে পুতপবিত্র করে গড়ে তোলা হবে। পরে শুরু হবে স্নানযাত্রার আনুষ্ঠানিকতা। পূজার আনুষ্ঠানিকতা সম্পন্ন করবেন হরিসভা মন্দির কমপ্লেক্সের অধ্যক্ষ কেদার নাথ চক্রবর্তী। বিষয়টি সম্পর্কে আমরা জেলা প্রশাসন, পুলিশ বিভাগ, পৌরসভার মেয়র, পানি উন্নয়ন বোর্ড, ফায়ার সার্ভিস, বিআইডব্লিউটিএ’র কর্মকর্তাদের অবহিত করেছি এবং নিরাপত্তা বিধানে প্রয়োজনীয় ব্যাবস্থাগ্রহণের জন্যে অনুরোধ জানানো হয়েছে। নেতৃবৃন্দ সনাতন ধর্মাবলম্বী ভক্তবৃন্দকে ধর্মীয় ভাবগাম্ভীর্য বজায় রেখে স্নানযাত্রায় অংশ নেয়ার জন্যে বিনীত আবেদন জানান এবং শান্তিপূর্ণভাবে তা সম্পন্নে সকলের সহযোগিতা কামনা করেন পূজা উদ্যাপন পরিষদের সভাপতি সুভাষ চন্দ্র রায়, সাধারণ সম্পাদক তমাল কুমার ঘোষ। এছাড়াও পূজা পরিষদের বিমল চৌধুরী, গোপাল চন্দ্র সাহা, লিটন সাহা, শিক্ষক কার্তিক সরকার, ডাঃ সহদেব দেবনাথসহ পূজা উদযাপন পরিষদ নেতৃবৃন্দ স্নানের স্থান ঘুরে দেখেন এবং প্রয়োজনীয় ব্যবস্থাগ্রহণে স্নানযাত্রা উদ্যাপন পরিষদ নেতৃবৃন্দকে প্রয়োজনীয় নির্দেশনা প্রদান করেন।
প্রতিবছরই চৈত্রমাসের মহাষ্টমী তিথিতে পাপ মোচনের নিমিত্তে সনাতন ধর্মাবলম্বী সকল বয়সের নারী-পুরুষ গঙ্গাস্নান করেন মন্ত্রপুত হয়ে। তাদের বিশ্বাস, এই স্নানের মধ্য দিয়ে জানা অজানা সকল পাপ থেকে তারা মুক্তি লাভ করবেন। ৮ এপ্রিল শুক্রবার রাত ৯টা থেকে মহাষ্টমী তিথি শুরু হয়ে আগামীকাল ৯ এপ্রিল শনিবার রাত ৯টা পর্যন্ত তা বলবৎ থাকবে বলে জানা যায়। তাই শনিবারেই স্নান যাত্রা সম্পন্ন করার দিন হিসেবে নির্ঘন্ট করা হয়। মূলত দেশের লাঙ্গলবন্দেই স্নানযাত্রা হয়ে থাকে ব্যাপকভাবে। কিন্তু সময় ও দূরত্বের কথা চিন্তা করে অনেকেই নদী বা খালের জলে স্নান সম্পন্ন করে থাকেন মনের ভক্তি আর বিশ্বাস নিয়ে।
জানা যায়, কোনো এক দূর অতীতে জমদগ্নি মহামুনির রেনুকা নামে এক রাজবংশীয় পরমা সুন্দরী স্ত্রী ছিল। তাদের ছিল ৫ পুত্র। সর্ব কনিষ্ঠ পুত্রের নাম ছিল পরশুরাম। ঘটনাক্রমে মার্তিকাবর্ত দেশের রাজাকে সস্ত্রীক জলবিহার করতে দেখে আশ্রমবাসিনী রেনুকা কামস্পৃহ হয়ে পড়েন এবং নিজের পূর্ব রাজকীয় জীবন সম্পর্কে স্মৃতিভ্রষ্ট হন। মুনি স্ত্রীর এই আসক্তি দেখে ক্রোধান্বিত হয়ে পাঁচ পুত্রকে তাদের মাতাকে হত্যার নির্দেশ দেন। কিন্তু কোনো পুত্রই মাতৃহত্যার মতো নিষ্ঠুর কাজ করতে রাজি হলেন না। তখন মুনি তার প্রিয় পুত্র পরশুরামকে আদেশ দিলে পরশুরাম এক কুঠারের আঘাতে মাকে হত্যা করেন। মাকে হত্যা করে পরশুরাম পরম পাপী হিসেবে চিহ্নিত হন। পাপের শাস্তি হিসেবে কুঠারটি তার হাতে আটকে থাকে। শত চেষ্টা করেও তা থেকে তিনি মুক্ত হতে পারলেন না। তখন পিতা তাকে বিভিন্ন তীর্থস্থানে গিয়ে পাপমুক্ত হতে বলেন। মাতৃহত্যার ভয়াবহ পাপের অনুশোচনা নিয়ে একের পর এক তীর্থ ঘুরতে থাকেন। দেবতা ব্রহ্মপুত্র তখন হিমালয়ের বুকে হ্রদরূপে লুকিয়ে ছিলেন। দৈবক্রমে পরশুরাম ব্রহ্মপুত্রের মাহাত্ম্যের কথা জানতে পারেন। তিনি খুঁজে পেলেন হিমালয়ে লুক্কায়িত ব্রহ্মপুত্র হ্রদ এবং প্রার্থনা জানালেন যেন এর পবিত্র জলে তার পাপমুক্ত হয়। তিনি হ্রদের জলে ঝাঁপ দেয়ার সঙ্গে সঙ্গে হাতে আটকে থাকা কুঠারখানা খসে পড়ে। এভাবে তিনি মাতৃহত্যার প্রায়শ্চিত্ত থেকে মুক্তি পান। ব্রহ্মপুত্রের এই অলৌকিক শক্তিসম্পন্ন পাপহরণকারী জল যাতে সাধারণ মানুষের উপকারে আসে এ উদ্দেশ্যে পরশুরাম সেই জলধারাকে সমতল ভূমিতে নিয়ে আসার অভিপ্রায় ব্যক্ত করেন।
তিনি কুঠারখানা লাঙ্গলের ফলকে বেঁধে সেই ফলক দিয়ে নালা সৃষ্টি করে ব্রহ্মপুত্রের পবিত্র জলধারাকে সমতল ভূমিতে নিয়ে আসেন। দীর্ঘ সময় ও পথ পরিক্রমায় পাহাড়-পর্বত পেরিয়ে তিনি ব্রহ্মপুত্রের জলধারাকে বিভিন্ন জনপদ ঘুরিয়ে অবশেষে বর্তমান লাঙ্গলবন্দে এসে ক্লান্ত হয়ে থেমে যান এবং লাঙ্গল চষা বন্ধ করে দেন। তার লাঙ্গলের ফলকে তৈরি পথ ধরে ব্রহ্মপুত্র প্রবাহিত হতে থাকে। সেই থেকে লাঙ্গলবন্দ হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের কাছে পুণ্যস্থান বা তীর্থস্থানে পরিণত হয়।