প্রকাশ : ২১ ডিসেম্বর ২০২১, ০০:০০
সমুদ্র অর্থনীতির অপার সম্ভাবনা তুলে ধরতে এবং সমুদ্র দূষণ ও সমুদ্র সম্পদ সংরক্ষণে সচেতনতা তৈরির লক্ষ্যে বাংলাদেশ ওশানোগ্রাফিক রিসার্চ ইনস্টিটিউট (বিওআরআই) কর্মশালার আয়োজন করে।
সমুদ্র দূষণ রুখতে পর্যটক, ব্যবসায়ী ও সমুদ্র সংশ্লিষ্টদের মাঝে সচেতনতা তৈরি করা অপরিহার্য। আর এ সচেতনতা তৈরিতে শিগগিরই একটি সমুদ্র সাক্ষরতা অভিযান পরিচালনা জরুরি বলে মত দিয়েছেন (বিওআরআই)-এর মহাপরিচালক (ডিজি) সাঈদ মাহমুদ বেলাল হায়দার। মঙ্গলবার (১৪ ডিসেম্বর) কক্সবাজারে অবস্থিত বিওআরআই’র হলরুমে ‘ব্লু-ইকোনমি, মেরিন ইকোলজি এন্ড কনজারভেশন : বাংলাদেশ পার্সপেকটিভ’ শীর্ষক কর্মশালায় তিনি এ মতামত ব্যক্ত করেন। দিনব্যাপী এ কর্মশালায় বিভিন্ন গণমাধ্যমের ৪০ জন সাংবাদিক অংশ নেন।
বিওআরআই’র মহাপরিচালক বলেন, ‘সমুদ্র এমন একটি জায়গা যেখানে আসলে আমাদের মন আন্দোলিত হয়, সতেজ হয়ে পড়ে। দুঃখ-বেদনা, ক্লান্তি ভুলে আমরা প্রশান্তি অনুভব করি। এ সময় মানুষ যে কোনো জটিল বিষয়ে সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে সক্ষম হয়। তাই মানুষ বারবার সমুদ্রের কাছে ছুটে আসে। কিন্তু আমাদের অজান্তেই আমরা সমুদ্রের ক্ষতি করি। সমুদ্র সম্পদ ধ্বংস করি। নানাভাবে আমরা এটি করে থাকি। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি ক্ষতি করে প্লাস্টিকসহ অপচনশীল বস্তু। এসব বস্তু সমুদ্রকে দূষিত করে। একটি প্লাস্টিক বা পলিথিন প্রায় ৫০ বছর অপচনশীল থাকে। এ সময় এগুলো সমুদ্রের পানি দূষণ ও প্রাণীর ক্ষতি করে। এক সময় এসব প্লাস্টিক ভেঙ্গে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র টুকরায় পরিণত হয়। এগুলো পানির সাথে মাছের পেটে ও কানকোয়ায় প্রবেশ করে। প্লাস্টিক মানবদেহে প্রবেশ করে ক্যান্সারসহ বিভিন্ন জটিল রোগ সৃষ্টি করে। একই সাথে এসব প্লাস্টিকের ক্ষুদ্র টুকরা ফাইটোপ্লাংকটন, সিওইড, কোরালসহ অন্যান্য সামুদ্রিক স্পেসিস ও প্রাণের জীবনধারণে বাধা সৃষ্টি করে। সমুদ্রকে রক্ষার জন্য প্লাস্টিকের ব্যবহার রোধ এবং অন্যান্য ক্ষতির বিষয়ে সচেতনতা সৃষ্টি করতে হবে। তাই পর্যটক, ব্যবসায়ী ও সমুদ্র সংশ্লিষ্ট সকলকে সচেতনতা ক্যাম্পেইনের আওতায় এনে একটি সমুদ্র সাক্ষরতা অভিযান পরিচালনা জরুরি।’
তিনি বলেন, সমুদ্রকে অবহেলা করলে চলবে না। এতে রয়েছে অর্থনীতির অপার সম্ভাবনা। আগামী এক দশকের কাছাকাছি সময়ের মধ্যে স্থল সম্পদের ঘাটতি দেখা দিবে। তাই সমুদ্র সম্পদকে কাজে লাগাতে এখনই পদক্ষেপ নিতে হবে। আমাদের যে সমুদ্রসীমা রয়েছে তা বিশ্বের অন্যতম সমৃদ্ধ সমুদ্র অঞ্চল। কিন্তু সেখানে যা আছে তার ৯৫ শতাংশই আমাদের অজানা। সমুদ্রতীর থেকে মাত্র ১০-১২ কিলোমিটার পর্যন্ত আমাদের জেলেরা মাছ ধরতে যায়। আবার মাত্র ৩০-৪০ ফুট গভীর পর্যন্ত গিয়ে তারা মাছ ধরে। এর বাইরে বিশাল যে সমুদ্র রয়েছে সেগুলোতে বিশ্বের অনেক দামি বেশ কিছু মাছ রয়েছে। তবে দুর্ভাগ্যজনকভাবে সেখানে যাওয়ার সক্ষমতা এখনো আমাদের হয়নি। টুনা মাছ ধরার জন্য দেশের ১৯ টি শিপিং জাহাজকে অনুমোদন দিলেও এখনো একটি জাহাজও টুনা ধরতে যায়নি। অথচ সবচেয়ে পরিণত আকারের টুনা আমাদের জলরাশিতে পাওয়া যায়। চীনসহ দূরবর্তী অনেক দেশের জাহাজ মূল্যবান এই মাছ ধরতে হাজার মাইল পাড়ি দিয়ে এখানে আসে কিন্তু আমরা পারি না। আমরা অক্সিজেনের জন্য গাছ লাগাই, কিন্তু আমরা জানি না সামুদ্রিক শৈবাল ফাইটোপ্লাংকটন ৭০ শতাংশের বেশি (৭০-৭৬ শতাংশ) অক্সিজেন সরবরাহ করে। একই সাথে কার্বন ডাই-অক্সাইড শোষণ করে।’
এই সমুদ্র বিজ্ঞানী আরো বলেন, ‘২০১৫ সালে আইন প্রণয়ন এবং ২০১৮ সালে সমুদ্র গবেষণা ইনস্টিটিউট প্রতিষ্ঠার পর থেকে আমরা মাত্র ৩টি বছর অতিক্রম করেছি। নানান সীমাবদ্ধতা নিয়েও আমরা চেষ্টা করে যাচ্ছি গবেষণা করতে। গবেষণার জন্য আমাদের বিশেষায়িত জাহাজ নেই। আমাদের পর্যাপ্ত জনবল নেই। আর তেল-গ্যাসের মতো সমুদ্রের গভীরে থাকা খনিজ পদার্থ নিয়ে গবেষণার প্রযুক্তিও নেই। তবে আমরা আশাবাদী, খুব দ্রুতই এসব সীমাবদ্ধতা কাটিয়ে অপার সম্ভাবনার সমুদ্র সম্পদকে কাজে লাগাতে দেশকে ভালো কিছু উপহার দিতে পারবো।’
কর্মশালায় আরও বক্তব্য রাখেন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের সমুদ্রবিজ্ঞান বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ মুসলেম উদ্দীন মুন্না, পরিবেশবাদী সংগঠন ‘সেভ আওয়ার সি’-এর মহাসচিব মুহাম্মদ আনোয়ারুল হক।
এছাড়া প্রশিক্ষক হিসেবে প্রেজেন্টেশন উপস্থাপন করেন বিওআরআইয়ের ৬টি বিভাগের বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা। প্রেজেন্টেশনে তারা বিভিন্ন বিষয়ে তাদের উদ্ভাবন ও গবেষণা কার্যক্রমের অগ্রগতি তুলে ধরেন। তারা বলেন, ‘বঙ্গোপসাগরের বালুতে পাওয়া গেছে বিশ্বের অন্যতম দামি খনিজ পদার্থ ইউরেনিয়াম। এটি সাধারণ মাত্রার চেয়েও বেশি পরিমাণে আছে। যেটি আন্তর্জাতিক মাত্রার চেয়েও বেশি। প্রযুক্তি হাতে পেলে খুব সহজেই এই মূল্যবান খনিজ আহরণ করা সম্ভব হবে। এছাড়াও বেশ কিছু সামুদ্রিক স্পেসিস যেগুলো চাষ করা সম্ভব তা আমরা উদ্ভাবন করতে পেরেছি। এগুলো বেসরকারি উৎপাদনকারীদের দেয়া হবে। আরও কিছু গবেষণা চলছে, যার ফলাফল শিগগিরই পাওয়া যাবে।’
কর্মশালা শেষে সাংবাদিকদের হাতে সনদ তুলে দেন বিওআরআই-এর ডিজি সাঈদ মাহমুদ বেলাল হায়দর।