বৃহস্পতিবার, ৩১ অক্টোবর, ২০২৪  |   ৩৩ °সে
আজকের পত্রিকা জাতীয়আন্তর্জাতিকরাজনীতিখেলাধুলাবিনোদনঅর্থনীতিশিক্ষাস্বাস্থ্যসারাদেশ ফিচার সম্পাদকীয়
ব্রেকিং নিউজ
  •   চাঁদপুরে রাজনৈতিক মামলায় আসামীদের আটক অভিযান অব্যাহত। যুবলীগ, কৃষকলীগ ও স্বেচ্ছাসেবক লীগের ৫ নেতা-কর্মী আটক
  •   ছেঁড়া তারে প্রাণ গেল যুবকের
  •   চাঁদপুরে গণঅধিকার পরিষদের ৩য় প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী পালন
  •   রাজধানীতে কচুয়ার কৃতী সন্তানদের সংবর্ধনা
  •   সম্প্রীতির চমৎকার নিদর্শন আমাদের বাংলাদেশ --------------জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ মোহসীন উদ্দিন

প্রকাশ : ৩১ অক্টোবর ২০২৪, ১০:২৪

প্রাকৃতিক ভারসাম্য রক্ষাকারী ও পরম বন্ধু তালগাছ

মোঃ কায়ছার আলী
প্রাকৃতিক ভারসাম্য রক্ষাকারী ও পরম বন্ধু তালগাছ

‘ঘুমাইয়া কাজা করেছি ফজর, তখনো জাগিনি যখন যোহর, হেলা ও খেলায় কেটেছে আসর, মাগরিবের আজ শুনি আজান। জামাত শামিল হওরে এশাতে, এখনো জমাতে আছে স্থান।’ কী সুন্দর চমৎকার উপমা দিয়ে আমাদের প্রিয় জাতীয় কবি চিরকাল অলসতাকে ঠেলে দিয়ে এখনো সময় শেষ হয়ে যায় নি বলে চেতনা ও জাগরণের সম্ভাবনার জয়গান গেয়েছেন। বৃক্ষরোপণ (লালন পালনসহ) সবচেয়ে বড়ো সামাজিক বিপ্লব, মহৎ কর্ম ও সদকায়ে জারিয়াহ। বৃক্ষহীন স্থানই মরুভূমি, যেখানে বৃষ্টিপাত হয় না।সাম্প্রতিক সময়ে গাছপালা নিধনে দাবদাহে পুড়ছে সোনার বাংলা। কাঠফাটা রোদ, ভ্যাপসা গরম এবং সীমাহীন লোডশেডিংয়ে পশুপাখি, উদ্ভিদ, প্রাণী সবারই হাঁসফাঁস অবস্থা। ভয়ংকরভাবে বিপর্যস্ত আমাদের জনজীবন। কালো মানুষের কালো থাবায় সাদা মনের মানুষেরা কি বারবার হেরে যাবে?সাদামনের অধিকারীরা বা ভাল মানুষেরা কেবলমাত্র ভাল কাজ করে আত্মতৃপ্তি পান। বিনিময়ে কী পেলেন বা না পেলেন সেটার তোয়াক্কা করেন না।

সারাদেশে অনন্য রেকর্ড স্থাপনকারী ৭১ বছরের মুরুব্বি ইমাম ও পল্লি চিকিৎসক খোরশেদ আলীকে দেখতে গিয়েছিলাম ঠাকুরগাঁও সদর উপজেলার চিলারং ইউনিয়নের অন্তর্ভুক্ত পাহাড়ভাংগা গ্রামে। তালগাছ প্রেমী বা পাগল এই মহান মানুষটি নিজের পৈত্রিক পাঁচ বিঘা জমি বিক্রি করে অনেক দূরে গিয়ে তালের বীজ সংগ্রহ করে বিভিন্ন উপজেলা, বিভিন্ন স্থানের সড়কে ইতোমধ্যে ৫২ হাজার ৩০০ টি তালের বীজ স্বহস্তে গভীর রাতে নিদ্রাহীন থেকে রোপণ করে পরিচর্যা করছেন। কেন রাত ১২ টা থেকে ৩ টা পর্যন্ত সেগুলো লাগান তা জানতে চাইলে তিনি বলেন, "নানা বয়সী কিছু দুষ্টু প্রকৃতির মানুষ তালের আঁটিগুলো খেয়ে ফেলে এবং গাছগুলো উপড়ে দেয়।" তাঁর অদম্য ইচ্ছে হলো এক লক্ষ তালের চারা রোপণ করে বিশ্বের বুকে এক সোনালি ইতিহাসের গৌরব অর্জন করা। প্রকৃত পরিবেশ বন্ধু এই মহান লোকটিকে জানাই গভীর শ্রদ্ধা, বুক ভরা উজাড় করা ভালবাসা। তাঁর আবেগের মধ্যে মিশে আছে প্রকৃতি ও মানুষের প্রতি গভীর মায়া, মমতা।

বিশ্বকবির মতে "ন্যায়, নীতি ও সত্যতে অটল থাকার দৃশ্যমান বড্ড তালগাছ আত্মপ্রত্যয়ী ও আত্মনির্ভরশীলতার প্রতীক।'' কেননা তালগাছ একপায়ে দাঁড়িয়ে, আবার সবগাছ ছাড়িয়ে, আকাশে উঁকি মারে।কবি রজনীকান্ত সেনের মতে "ঝুলন্ত তালগাছে শক্ত বাসা বুননে বাবুই পাখি পরিশ্রমী, প্রকৌশলী ও আত্মমর্যাদার আরেক প্রতিচ্ছবি।'' শিশু মননের আলোড়িত ছড়া খান মুহাম্মদ মইনুদ্দীনের "ঐ দেখা যায় তালগাছ, ঐ আমাদের গাঁ...’।

দৃশ্যমান উঁচু তালগাছ যেন আবহমানকালের গ্রাম বাংলার পরিচয়ের সাক্ষ্য দেয়। তর্ক-বিতর্ক ও কথায় আমরা বলে থাকি "বিচার মানি কিন্তু তালগাছটি আমার।'' যাকে সহজভাবে জোর করে জিতে যাওয়া বলে। বহুমাত্রিকভাবে তালগাছ আমাদের বাংলা সাহিত্যে বিদ্যমান। বর্তমানে প্রাকৃতিক দুর্যোগ (বজ্রপাত) সারাবিশ্বে এক আতঙ্কের নাম। পরিবেশ বিশেষজ্ঞদের মতামত হলো,"তালগাছ, সুপারী গাছ এবং নারিকেল গাছ ঝড়, তুফান, টর্নেডো, প্রবল হাওয়া প্রতিরোধে, মাটির ক্ষয়রোধে সহায়তার পাশাপাশি আমাদের পরিবেশকে রক্ষা করে। এছাড়াও ভূমিধস, ভূমিক্ষয়, ভূ-গর্ভস্থ পানির মজুদ বৃদ্ধি ও মাটির উর্বরতা রক্ষায় তালগাছের গুরুত্ব ও প্রয়োজনীয়তা অপরিসীম। তালগাছের আকর্ষণে বাড়ে মেঘের ঘনঘটা, ঘটে বৃষ্টিপাতও। তালগাছ রোপণে প্রথমেই তা মাটির নিচে প্রবেশ করে। এর ফলে গাছটি ঝড়ে হেলে পড়ে না কিংবা ভেঙ্গে পড়ে না। সবচেয়ে আনন্দদায়ক খবরটি হলো, বজ্রপাত (বিদ্যুৎ স্পর্শ )-এর থাবা থেকে মানুষ, পশুপাখি সহ জীববৈচিত্র্য রক্ষায় এই গাছ আমাদের অকৃত্রিম ও পরীক্ষিত বন্ধু। তালগাছ ৯০- ১০০ ফুট উঁচু হওয়ায় এবং বাঁকলে পুরু কার্বনের স্তর থাকায় আকাশের বিজলী গাছ হতে তা সরাসরি মাটিতে চলে যায়। বেশি বেশি তালগাছ থাকলে গ্রামীণ জনপদের কৃষক, শ্রমিক, জেলে ও মেহনতি ইত্যাদি মানুষ মহাবিপদ থেকে রক্ষা পাবে। বজ্রপাত বাংলাদেশে জাতীয় দুর্যোগ হিসেবে পরিচিত। প্রতি বছর এই বজ্রপাতে আকস্মিক মৃত্যু, মৃত্যুর ঝুঁকি ও সংখ্যা জ্যামিতিক হারে বেড়েই চলেছে।

অনেক উপাকারী তালগাছের কাণ্ড, বাকল ও লতাপাতা। তালের কাঠ খুব শক্ত, মজবুত ও টেকসই। ঘরের খুঁটি, আসবাবপত্র, বিভিন্ন গৃহস্থালী সামগ্রী ও আদি যানবাহন নৌকা তৈরিতে তালকাঠ অনন্য। লোকজ চিকিৎসায় তালের ব্যবহার প্রচুর। মানব শরীরের কোষের ক্ষয়রোধ করে এবং তারুণ্য ধরে রাখে তাল। এক কথায় পুরো তালগাছটিই হরেকরকম কাজে ব্যবহার হয়। কোনো অংশই অপ্রয়োজনীয় নয়। পরিপক্ক একটা তালগাছ দিয়ে কমপক্ষে পাঁচ হাজার টাকা আয় করা সম্ভব। পরোপকারী বৃক্ষ তালগাছ শাখা প্রশাখাহীন একবীজপত্রী উদ্ভিদ। স্ত্রী ও পুরুষ উভয় গাছেই ফুল হয়। ১২-১৩ বছর হলেই স্ত্রী গাছে ফল আসে। প্রচুর ভিটামিন ও পুষ্টিমান সমৃদ্ধ কাঁচা ও পাকা তাল সুস্বাদু ও মিষ্টি। একটানা ৯০-১২০ দিন পর্যন্ত ২৪ ঘন্টায় ১২-১৫ কেজি রস দেয়। পাঁচ কেজি রস থেকে এক কেজি গুড় তৈরি হয়।তালগাছ ১৪০-১৫০ বছর পর্যন্ত বাঁচে।

ভাল কাজে পুরস্কার ও মন্দ কাজে তিরস্কার সবারই করা উচিত। আজ দেশের আনাচে কানাচে কিছু মহৎপ্রাণ ব্যক্তি, সংগঠন স্বউদ্যোগে যেভাবে তালগাছ বা অন্যগাছ লাগাচ্ছেন সে কাজগুলোকে সরকারের স্বীকৃতি দিয়ে তাদের পুরস্কৃত করা উচিত। ছোট্ট আয়তনের এই দেশে সুষ্ঠু মহাপরিকল্পনার মাধ্যমে সর্বত্র বিশেষ করে গ্রামীণ ও উপকূলীয় অঞ্চলে তালগাছ লাগিয়ে বজ্রপাতে প্রাণহানি কমানো সম্ভব। বিদ্যুৎস্পর্শ থেকে জীবন রক্ষায় উঁচু তালগাছের বিকল্প নেই। প্রতিটি সমস্যার সমাধান যুক্তিসঙ্গত ভাবে বা মাঝে মাঝে অলৌকিকভাবে হয়ে থাকে। সরকারের আর্থিক প্রণোদনা ও পৃষ্ঠপোষকতা দিয়ে যে কোনো সফলতা দ্রুত করা অসম্ভব নয়। তালগাছের সারি সারি নান্দনিক সৌন্দর্যরূপ দেখতে যেমন সুন্দর, ঠিক তেমনি রয়েছে এর বিভিন্নরকম উপকারিতা। অকাল মৃত্যু থেকে দেশবাসী তালগাছের ছোঁয়ায় শুধু রক্ষাই পাবে না, সবুজ বেষ্টনীতে গড়ে উঠবে আমাদের গ্রাম বাংলার প্রতিটি গ্রামের কৃষি, অকৃষি ভূমি। একজন পরিবেশ সচেতন নাগরিক হিসেবে আমার মতো সবাই এই অনিন্দ্যসুন্দর দৃশ্য উপভোগ করতে চায়।

লেখক : শিক্ষক, প্রাবন্ধিক ও কলামিস্ট; সদস্য, দিনাজপুর কলামিস্ট অ্যাসোসিয়েশন, দিনাজপুর । ০১৮১৮-২৩০৯৭০

  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়