প্রকাশ : ০২ নভেম্বর ২০২১, ০০:০০
হাজীগঞ্জে আওয়ামী লীগের তৃণমূলের বর্ধিত সভা
ইউপি চেয়ারম্যান পদে নিয়ম বহির্ভূত মনোনয়ন তালিকা প্রস্তুত নিয়ে ক্ষোভ!
আসন্ন ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনকে সামনে রেখে হাজীগঞ্জ উপজেলার ১১টি ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের বর্ধিত সভা ইতোমধ্যে সম্পন্ন হয়েছে। সভায় দলীয় নিয়ম অনুযায়ী প্রস্তাবক ও সমর্থকদের প্রাধান্য না দিয়ে সরাসরি প্রার্থীদের উপস্থিতিতে তালিকা প্রণয়ন করায় ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন আওয়ামী লীগের তৃণমূলের নেতা-কর্মীরা। এ ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশ ঘটে উপজেলার ১নং রাজারগাঁও ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের বর্ধিত সভায়।
|আরো খবর
এ সভার শুরুতে ক্ষোভ প্রকাশ করে বক্তব্য রাখেন হাজীগঞ্জ উপজেলা আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক হাজী জসিম উদ্দিন। তিনি তার বক্তব্যে বলেন, আমাদের উপজেলা আওয়ামী লীগের নেতৃবৃন্দ ইতোমধ্যে অনেক ইউনিয়নে আওয়ামী লীগের বর্ধিত সভা করেছেন। উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক তাদের মনগড়া ও একপেশে প্রভাব বিস্তার করে দায়সারাভাবে এসব সভা শেষ করেছেন। আমাদের এমপি মহোদয় হাজীগঞ্জ-শাহরাস্তি আসনের গণমানুষের নেতা। তিনি ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের ১নং সেক্টর কমান্ডার এবং সাবেক সফল স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী। আমাদের প্রিয় নেতা মেজর (অবঃ) রফিকুল ইসলাম এমপি স্যারের সাথে গত কদিন যে তৃণমূলের বর্ধিত সভা হয়েছে, সে বিষয়ে আলোচনা করেছি। তিনি বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়েদুল কাদেরসহ চট্টগ্রাম বিভাগের যারা আছেন প্রত্যেকের সাথে আলাপ করেছেন। তাদের সাথে আলাপ করার পর যে বিষয়টি জানতে পেরেছি, প্রার্থীদের থেকেই প্রথমে প্রকাশ্যে সম্মতি নেয়ার বিষয়টি নিয়মের মধ্যে পড়ে না। যেমন আমাদের উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক কিছুক্ষণ আগেই বলেছেন, আপনারা যারা প্রার্থী তারা হাত তুলবেন। এটা আসলে কোনো নিয়মের মধ্যে পড়ে না। আমি বুঝতে পেরেছি, এ ম্যাসেজগুলো আসার পরে আমরা যে ইউনিয়নগুলোতে তৃণমূল সভা করেছি একটিও সুষ্ঠুভাবে সম্পন্ন হয় নি। সিস্টেম হলো, বর্ধিত সভায় যারা প্রার্থী তারা ১ থেকে ৫০ হতে পারে কিংবা ৭০ জনও হতে পারে। তাদের প্রস্তাবকারী ও সমর্থনকারী রাখবেন। তাদের নাম অন্তর্ভুক্ত হবে সিরিয়াল অনুযায়ী। এখানে নেতৃবৃন্দ আছেন, সিরিয়াল অনুযায়ী তাদের নাম অন্তর্ভুক্ত হবে। অথচ বাস্তবে আমরা দেখছি, যাদের এলাকায় জনপ্রিয়তা নেই, একজন সমর্থনকারীও নেই তারা দাঁড়িয়ে নিজেদের চেয়ারম্যান প্রার্থী হিসেবে ঘোষণা দিচ্ছেন। এটা বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের গঠনতন্ত্রে নেই। অতএব আমি বলবো, অতীতেরগুলো বাদ দিয়ে আজকের পর থেকে গঠনতন্ত্র অনুযায়ী এখানে যারা প্রার্থী হবেন তাদের প্রস্তাবকারী এবং সমর্থনকারীর নাম উপস্থাপন করবেন, এটা আওয়ামী লীগের গঠনতন্ত্রে নির্দেশনা দেয়া আছে।
এ বক্তব্যের পরপরই চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিয়ে হাজীগঞ্জ উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক গাজী মাঈনুদ্দিন গঠনতন্ত্রের ব্যাখ্যা দেয়ার জন্যে হাজীগঞ্জ পৌর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক সৈয়দ আহম্মেদ খসরুকে বলেন।
এ সময় সৈয়দ আহম্মেদ খসরু বলেন, আজকের হাউজে একটু আগে আলহাজ¦ জসিম উদ্দিন সাহেব যে ব্যাখ্যাটি দিয়েছেন তার প্রেক্ষিতে উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক আমাকে এর ব্যাখ্যা দেয়ার জন্যে বলেছেন। আমি উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি এবং সাধারণ সম্পাদকের জ্ঞাতার্থে বলতে চাই, বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ যে নিয়মতান্ত্রিক সংগঠন, সে সংগঠনের এ জাতীয় বর্ধিত সভায় প্রার্থী মনোনয়নের ক্ষেত্রে সিস্টেম হলো, প্রথমে ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের কার্যনির্বাহী কমিটির সদস্যরা হচ্ছেন সকল ক্ষমতার উৎস। এ ইউনিয়নের ৯টি ওয়ার্ডের সভাপতি সাধারণ সম্পাদকের বাইরে সভা হয় না। এ সভ্যগণের মধ্যে দেখে তারা তাদের ইউনিয়নে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের নৌকা প্রতীকের মনোনয়ন প্রত্যাশীদের প্রস্তাব এবং সমর্থন করবেন। প্রস্তাব এবং সমর্থনের পরে নামের সিরিয়াল করা হবে। বাংলাদেশের নাম হলো গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার অর্থাৎ জনগণের সরকার জনগণ নির্বাচিত করবে। বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ জনগণের দল। জনগণের বাইরে না। প্রস্তাব ও সমর্থনের নামের পরে যদি কারো প্রার্থী হওয়ার আগ্রহ থাকে এবং সে যদি নিজে তার পরিচয় তুলে ধরে প্রার্থী হওয়ার কথা জানান দেন, সেটাও মৌলিক অধিকার রক্ষা করে তালিকাভুক্ত করা যেতে পারে। কিন্তু আগে যাদের সমর্থনকারীর নাম আসবে, তারপর প্রস্তাবকারীর নাম আসবে, তাদের নাম লিখতে হবে। হাজীগঞ্জ পৌর আওয়ামী লীগের বর্ধিত সভা একই নিয়মে করা হয়েছে। সর্বশেষ যে সকল প্রার্থীর প্রস্তাবকারী এবং সমর্থনকারী ছিল না, তাদের নামও আমি পাঠিয়েছি। এ ইউনিয়নে যারা ইউনিয়ন কমিটির কার্যনির্বাহী কমিটির সদস্য এবং ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের সভাপতি এবং সাধারণ সম্পাদক তারাই এই দ-মু-ের মালিক। তাদের প্রস্তাব এবং সমর্থনে প্রার্থীদের নাম নির্ধারণ করাই গঠনতন্ত্রের নিয়ম।
এদিকে চাঁদপুর জেলার অন্যান্য উপজেলায় ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের বর্ধিত সভায় দলীয় গঠনতন্ত্র মেনে এবং কেন্দ্রীয় দপ্তর সম্পাদকের নির্দেশক্রমে প্রত্যেক ইউনিয়নে প্রস্তাবক এবং সমর্থকদের সমর্থনের নামসহ প্রার্থীর নাম সিরিয়াল অনুযায়ী ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের দলীয় প্যাডে লিখে ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সভাপতি এবং সাধারণ সম্পাদকের হাতে তুলে দেন।
গত ২৪ অক্টোবর রোববার থেকে হাজীগঞ্জ উপজেলার ১২টি ইউনিয়নের মধ্যে ১১টি ইউনিয়নে আওয়ামী লীগের বর্ধিত সভার কার্যক্রম চলছে। বিচ্ছিন্ন ঘটনার মধ্য দিয়ে ৯টি ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের বর্ধিত সভা শেষ হয়।
বাকি ৩টির মধ্যে ৫নং হাজীগঞ্জ সদর ও ৮নং হাটিলা পূর্ব ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের বর্ধিত সভা চট্টগ্রাম বিভাগীয় কমিশনার এবং ধর্ম প্রতিমন্ত্রীর আগমনকে কেন্দ্র করে স্থগিত করা হয়। এদিকে ৬নং বড়কুল পূর্ব ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের বর্ধিত সভা শুরু হওয়ার আগেই স্থানীয় মুক্তিযোদ্ধা এবং বিক্ষুব্ধ নেতা-কর্মীদের তোপের মুখে সভাটি স্থগিত করেন উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি আলহাজ¦ হেলাল উদ্দিন মিয়াজী এবং সাধারণ সম্পাদক গাজী মাঈনুদ্দিন।
গত ২৪ অক্টোবর রোববার শুরু হওয়া ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের বর্ধিত সভায় শুরু থেকে দলীয় বিশৃঙ্খলা এড়ানোর কারণ দেখিয়ে হাজীগঞ্জ উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক গাজী মাঈনুদ্দিন ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান পদে প্রার্থীদের সরাসরি হাত তুলে প্রার্থিতা জানান দেয়ার নির্দেশ দেন। এ নিয়ে শুরু থেকে হাজীগঞ্জ পৌর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক সৈয়দ আহম্মদ খসরু এবং হাজীগঞ্জ উপজেলা আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক ও জেলা পরিষদের প্যানেল চেয়ারম্যান হাজী জসিম উদ্দিন বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের গঠনতন্ত্র এবং কেন্দ্রীয় আওয়ামী লীগের নির্দেশনা মেনে বর্ধিত সভা পরিচালনা এবং প্রস্তাবক ও সমর্থকদের মাধ্যমে প্রার্থীদের নামের তালিকা প্রণয়ন করার কথা বলে আসছেন।
এ নিয়ে ৭নং বড়কুল পশ্চিম, ৩নং কালচোঁ, ৯নং গন্ধর্ব্যপুর, ১০নং গন্ধর্ব্যপুর, ২নং বাকিলা, ১নং রাজারগাঁও ও ৪নং কালচোঁ ইউনিয়নে বর্ধিত সভায় নেতা-কর্মী এবং প্রার্থীরা সভার শুরুতে দাবি উত্থাপন করলেও তা বিশৃঙ্খলার কারণ দেখিয়ে এড়িয়ে যান উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি হেলাল উদ্দিন মিয়াজী এবং সাধারণ সম্পাদক গাজী মাঈনুদ্দিন।
প্রস্তাবক এবং সমর্থকদের মাধ্যমে প্রার্থীদের নাম তালিকাভুক্ত না করার কারণে ২নং বাকিলা ও ৪নং কালচোঁ দক্ষিণ ইউনিয়নে বর্ধিত সভার মধ্যে হট্টগোল সৃষ্টি হলে প্রার্থীদের নাম ঘোষণা না করেই সভাস্থল ত্যাগ করেন নেতৃবৃন্দ। এদিকে ৪নং কালচোঁ ইউনিয়নে প্রার্থীদের নাম ঘোষণা না করে উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি এবং সাধারণ সম্পাদকের সভাস্থল ত্যাগ করার প্রতিবাদে তিন প্রার্থীর সমর্থকরা হাজীগঞ্জ পৌরসভাধীন বলাখাল বাজারে চাঁদপুর-কুমিল্লা আঞ্চলিক মহাসড়ক পৌনে ১ ঘন্টা অবরোধ করে রাখেন। এরপর হাজীগঞ্জ থানার অফিসার ইনচার্জ মোঃ হারুনুর রশিদকে উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদকের ইচ্ছা ও পছন্দ অনুযায়ী গঠনতন্ত্র বহির্ভূত তালিকা না পাঠানোর বিষয়টি নিশ্চিত করার পর অবরোধ তুলে নেয় নেতা-কর্মীরা।
এই প্রতিবেদক তৃণমূলের নেতা-কর্মীদের সাথে এ বিষয়ে জানতে চাইলে কর্মীরা ক্ষোভের সাথে বলেন, উপজেলা আওয়ামী লীগের শীর্ষ এক ব্যক্তি প্রতিটি ইউনিয়নে তার ব্যক্তিগত কিছু লোকজন থেকে অবৈধভাবে অর্থ ও বাণিজ্যের মাধ্যমে ২ বছর পূর্বের করা ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের বিতর্কিত সম্মেলনের মাধ্যমে সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক ঘোষণা করলেও কমিটি পুনর্গঠন করেননি এবং ইউনিয়ন কমিটিগুলো উপজেলা আওয়ামী লীগ অনুমোদন দেয়নি। তৃণমূলের বর্ধিত সভাকে কেন্দ্র করে উপজেলা আওয়ামী লীগের শীর্ষ ক’জন নেতা ও ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সভাপতি, সাধারণ সম্পাদক অর্থ ও বাণিজ্যের মাধ্যমে সংগঠন বহির্ভূত বিএনপি-জামাত-জাতীয় পার্টি থেকে কমিটি অনুমোদন দেয়ার কাজে লিপ্ত রয়েছে। এসব কমিটির বিতর্কিত ব্যক্তিদের কাছ থেকে টাকা নিয়ে মনোনয়ন তালিকায় নাম অন্তর্ভুক্ত করছে।
তারা আরো বলেন, এক ব্যক্তি অসাংগঠনিক ও শিষ্টাচার বহির্ভূতভাবে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের নাম বিক্রি করে অর্থ ও বাণিজ্যের মাধ্যমে আঙ্গুল ফুলে কলাগাছ বনে যাচ্ছেন। অপরদিকে দলকে ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে নিয়ে যাচ্ছেন। তৃণমূলের নেতা-কর্মীরা এ বিষয়ে জেলা আওয়ামী লীগ এবং বিভাগীয় আওয়ামী লীগের দায়িত্বপ্রাপ্ত নেতৃবৃন্দ ও কেন্দ্রীয় আওয়ামী লীগের নেতৃবৃন্দসহ সর্বোপরি প্রধানমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনার জরুরি হস্তক্ষেপ কামনা করেছেন।
তারা আরও দাবি করেছেন, উপজেলা আওয়ামী লীগের নির্দিষ্ট ক’নেতা উপস্থিত থেকে তাদের প্রভাবে ও নির্দেশে সংবিধান বহির্ভূত যে তৃণমূলের সভাগুলো করেছেন তা বাতিল করে পুনরায় গঠনতন্ত্র মোতাবেক প্রতিটি ইউনিয়নে তৃণমূলের বর্ধিত সভাগুলো আয়োজন করা হোক।