প্রকাশ : ২৫ জুন ২০২২, ০০:০০
স্বপ্নের পদ্মা সেতু : অসাধ্যকে সাধন করার মহাকাব্য
স্বপ্নের পদ্মা সেতু শুধুমাত্র সেতুর সংজ্ঞায় আজ আর আবদ্ধ নেই। এর আবেগ সেতুকে ছাড়িয়ে গেছে অনেক আগেই। এর সাথে জড়িয়ে আছে বিশ্ব প্রপঞ্চে বাঙালির মান-মর্যাদা, গৌরব ও সক্ষমতা। বিশ্ব মোড়লের চক্রান্তের অংশ হয়ে বিশ্ব ব্যাংক পদ্মা সেতুতে অর্থায়নে অপারগতা প্রকাশ করলে দেশের তাবৎ বড় বড় তথাকথিত পণ্ডিত ব্যক্তি মোটা কণ্ঠে বিবৃতি দিয়েছিলেন, যার সারমর্ম দাঁড়ায়, বাংলাদেশের একার পক্ষে পদ্মা সেতু বানানোর চিন্তা আর বাতাসে দুর্গ গড়ে তোলা একই ধরনের হাস্যকর প্রচেষ্টা। কিন্তু সময় যত গড়িয়ে গেছে, যত কাজ এগিয়ে গেছে, ততই বুঝে গেছে বিশ্ব, বাংলাদেশ স্বপ্নের পদ্মা সেতু বাস্তবে বানিয়ে অসাধ্যকে সাধন করেছে। বিরোধীরা হাজারো গুজব ছড়িয়ে পদ্মা সেতুর নির্মাণকে থামিয়ে দিতে চাইলেও, দেশের জনগণ তাতে কান দেয়নি। কল্লা গুজব থেকে শুরু করে হেন কোনো গুজব নেই যা তারা রটায়নি পদ্মা সেতুর নির্মাণ কাজ পণ্ড করতে। কিন্তু হিমালয়ের মতো অটল দৃঢ়তায় মুজিবকন্যা শেখ হাসিনা জয় করেছেন সকল বিঘ্নকে। দৃঢ় নেতৃত্বে দেখিয়ে দিয়েছেন পৃথিবীকে, বাঙালির প্রত্যয়ের কাছে কোনো কিছুই অজেয় নয়।
|আরো খবর
রামণ্ডরাবণের পৌরাণিক যুদ্ধে সমুদ্রের ওপর সেতু নির্মাণের দক্ষযজ্ঞের বর্ণনা আছে। দেব-নর-বানরের যৌথ শক্তিতে রাবণকে বধ করার জন্যে একশ’ আটটা নীল পদ্ম দিয়ে শক্তির আরাধনা সমাপ্ত করলে অতঃপর সেতু নির্মাণ সম্ভব হয়। সমুদ্র না হলেও পদ্মা নদী বাঙালির কাছে সমুদ্রের মতো আবহ সঞ্চারী। মানুষের দ্বারা এর বুকে সেতু নির্মাণ তাই সকল পৌরাণিক কাহিনীকেও হার মানায়। অটল হিমাদ্রীসম মুজিব-তনয়ার প্রজ্ঞায় আজ বাংলাদেশ নির্মাণ করেছে এমন এক সেতু যা বিশ্বে তৈরি করেছে বিস্ময়। দক্ষিণ আমেরিকার আমাজনের পরে পদ্মাই দ্বিতীয় সর্বোচ্চ খরস্রোতা নদী। প্রতি সেকেন্ডে এই নদী এক লাখ চল্লিশ হাজার কিউবিক মিটার আয়তনের পানি বহন করে। এমন নদীর ওপর তাই অতীতে সেতু বাঁধার কোনো কল্পনাই করেনি মানুষ। পদ্মাকে বাগে আনতে হলে নদী শাসন ছিল অতীব জরুরি। প্রায় চৌদ্দ কিলোমিটার নদী শাসনে ব্যয় হয়েছে নয় হাজার চৌদ্দ কোটি টাকার অধিক। সবচেয়ে অধিক শক্তিশালী ক্রেন ব্যবহার করে একশ’ কুড়ি থেকে একশ’ ত্রিশ মিটার গভীরে পাইলিং করে পিলারকে থিতু করা চাট্টিখানি কথা নয়। ইতোমধ্যেই পদ্মা সেতু সংশ্লিষ্ট বেশ ক’টি ঘটনা গিনেজ বুকে স্থান করে নেয়ার যোগ্যতা তৈরি হয়েছে। একই সাথে সেতুতে যান চলাচলে কংক্রিটের ব্যবহার ও রেল চলাচলের স্টিলের ব্যবহার আর কোনো সেতুতে নেই। ওপর দিয়ে গাড়ি আর নিচ দিয়ে রেল চলাচলের ব্যবস্থা রেখে পদ্মা সেতুর নির্মাণ ব্যয় প্রায় দশ মিলিয়ন ডলার কমানো হয়েছে। মৃদু সর্পিল বাঁকে নির্মিত পদ্মা সেতুর ভূমিকম্পঘাতসহতা রিখটার স্কেলে নয়ের অধিক, যা অনেকটাই নিরাপদ। সবচেয়ে ভারী ওজনের বিয়ারিং, প্রায় সাড়ে তিন হাজার কিলোজুল সম্পন্ন বৈদ্যুতিক হ্যামারের ব্যবহার একে দান করেছে পৌরাণিক মাত্রা।
পদ্মা সেতু নির্মাণের বৈজ্ঞানিক তত্ত্ব পৃথিবীর অনেক দেশে সেতু নির্মাণে কাজে লাগানো যাবে। আমাদের প্রকৌশলীরা একবাক্যে স্বীকার করে নিয়েছেন, পদ্মা সেতুর অভিজ্ঞতা আমাদের পরবর্তী নির্মাণ প্রক্রিয়াকে যেমন সহজ করে তুলবে, তেমনি বিপুল পরিমাণ অর্থ বিদেশি পরামর্শকদের দেয়া থেকে সাশ্রয় করা যাবে। একটি পদ্মা সেতু আমাদের যেমন সাহস বাড়িয়ে দিয়েছে, তেমনি আগামীতে আমাদের অর্জনের আকাঙ্ক্ষাকে দীপ্তিমান করে তুলেছে।
যিনি না হলে স্বপ্নের পদ্মা সেতু নদীর গর্ভ হতে মাথা তুলে দাঁড়াত না, তিনি হলেন আমাদের আধুনিক বাংলাদেশের নির্মাতা মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। পদ্মা সেতুর সাথে সাথে তিনিও আমাদের সোনালি ইতিহাসের অবিচ্ছেদ্য অংশ হয়ে গেলেন। আজ স্বপ্নের পদ্মা সেতুর উদ্বোধনী দিনে আমরা এ সেতুর দীর্ঘ স্থায়িত্ব কামনা করি এবং প্রকৃত জনকল্যাণ সাধিত হবে বলে বিশ্বাস করি। পদ্মার দক্ষিণ তীরের একুশটি জেলা উন্নয়নের ছোঁয়ায় আমূল পাল্টে যাবে বলে আমরা স্বপ্ন দেখি।
জয় বাংলা। পদ্মা সেতু দীর্ঘস্থায়ী হোক।