বৃহস্পতিবার, ১৮ সেপ্টেম্বর, ২০২৫  |   ২৯ °সে
জাতীয়আন্তর্জাতিকরাজনীতিখেলাধুলাবিনোদনঅর্থনীতিশিক্ষাস্বাস্থ্যসারাদেশ ফিচার সম্পাদকীয় অন্যান্য

প্রকাশ : ১৮ সেপ্টেম্বর ২০২৫, ০৮:৩২

সৌদি আরবে শতবর্ষী আল-দাকাল দুর্গে ফিরেছে গৌরবের ঐতিহ্য

মোহাম্মদ সানাউল হক
সৌদি আরবে শতবর্ষী আল-দাকাল দুর্গে ফিরেছে গৌরবের ঐতিহ্য

আবহা সৌদি আরবের আছির প্রদেশের রাজধানী। এটি সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে ২,২৭০ মিটার (৭,৪৫০ ফুট) উপরে দক্ষিণ-পশ্চিম সৌদি আরবের আছির পর্বতমালায় (আছির জাতীয় উদ্যানের) নিকটে অবস্থিত। শহরটির অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন আল-দাকাল দুর্গ সংস্কারের পর আবারও সংস্কৃতি অঙ্গনে তার গৌরবময় স্থান পুনরুদ্ধার করেছে। এ প্রকল্পটি সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের অন্তর্গত হেরিটেজ কমিশন বাস্তবায়ন করেছে।

কর্তৃপক্ষের উদ্যোগে দুর্গটির দীর্ঘদিনের অবহেলা ও ক্ষয়ক্ষতির চিহ্ন মুছে ফেলা হয়েছে এবং এর মূল স্থাপত্য ও ঐতিহাসিক বৈশিষ্ট্যগুলোকে নতুন করে পুনঃস্থাপন করা হয়েছে। এ কাজের ফলে দুর্গটি শুধু প্রাচীন ঐতিহ্যের নিদর্শন হিসেবেই নয়, বরং আছির অঞ্চলের সাংস্কৃতিক পরিচয়ের অংশ হিসেবেও নতুন মর্যাদা অর্জন করেছে। ইতিহাস ও স্থাপত্যের সংরক্ষণমূলক এই প্রচেষ্টা পর্যটক, গবেষক এবং ঐতিহ্যপ্রেমীদের কাছে দুর্গটিকে আরও আকর্ষণীয় করে তুলেছে। এর মাধ্যমে নতুন প্রজন্মও তাদের অতীত ইতিহাস ও শেকড়ের সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে পরিচিত হওয়ার সুযোগ পাচ্ছে।

অন্যদিকে, দুর্গটির অবস্থান আবহা শহরে হওয়ায় এর গুরুত্ব আরও বেড়েছে। পাহাড়ি প্রাকৃতিক সৌন্দর্য, সবুজে ঘেরা পরিবেশ এবং শীতল ও মনোরম জলবায়ুর জন্যে আবহা শহর সৌদি আরবের মানুষের কাছে বহু আগে থেকেই জনপ্রিয় একটি পর্যটন কেন্দ্র। গ্রীষ্মকালে দেশের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে মানুষ এখানে ছুটে আসে শীতল আবহাওয়া উপভোগ করতে। এখন দুর্গটির পুনঃস্থাপনের ফলে আবহার এই পর্যটন কেন্দ্রিক আকর্ষণ আরও বহুগুণ বৃদ্ধি পেয়েছে এবং দেশি-বিদেশি ভ্রমণকারীদের জন্যে এটি এক অনন্য সাংস্কৃতিক ও ঐতিহাসিক গন্তব্যে পরিণত হয়েছে।

কিং খালিদ বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষক ড. গাইথান গ্রেস এবং অন্যান্য গবেষকের মতে, আছির অঞ্চলে অবস্থিত এই দুর্গটির ইতিহাস বেশ পুরনো। তাঁদের গবেষণায় জানা যায় যে, দুর্গটির নির্মাণকাল প্রায় ১১০ বছর আগে, অর্থাৎ হিজরি ১৩৩৪ সালে। সময়ের হিসেবে এটি খ্রিস্টাব্দ ১৯১৬ সালের কাছাকাছি সময়ে নির্মিত হয়। এর ফলে ধারণা করা যায়, দুর্গটি প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময়কালেই প্রতিষ্ঠিত হয়েছিলো, যা ঐ অঞ্চলের রাজনৈতিক ও সামাজিক প্রেক্ষাপটে একটি গুরুত্বপূর্ণ দৃষ্টান্ত বহন করে।

এই দুর্গের বয়স শত বছরেরও বেশি হওয়ায় এটি এখন আছির অঞ্চলের একটি গুরুত্বপূর্ণ ঐতিহাসিক নিদর্শনে পরিণত হয়েছে। গবেষকদের মতে, দুর্গটির স্থাপত্যশৈলী সেই সময়কার স্থানীয় ঐতিহ্য ও নিরাপত্তা ব্যবস্থার প্রতিফলন। স্থানীয় জনগণ ও শাসকদের প্রয়োজন মেটাতে নির্মিত এই স্থাপনা শুধু প্রতিরক্ষা ব্যবস্থার অংশই ছিলো না, বরং সমাজের কেন্দ্রীয় কার্যক্রমের সাথেও সম্পৃক্ত ছিলো। এভাবে দুর্গটির নির্মাণকাল, উদ্দেশ্য এবং স্থাপত্যশৈলী, ইতিহাস ও ঐতিহ্যের ধারাবাহিকতায় বিশেষ তাৎপর্য বহন করে।

সাম্প্রতিক পুনরুদ্ধার ও সংরক্ষণ কার্যক্রমের সময় দুর্গের ক্ষতিগ্রস্ত অংশসমূহ স্থানীয় প্রাকৃতিক পাথর দিয়ে সতর্কতার সাথে পুনর্নির্মাণ করা হয়েছে, যাতে এর প্রাচীন স্থাপত্যশৈলী অবিকৃত থাকে। অভ্যন্তরীণ করিডোর ও কক্ষসমূহ পরিষ্কার করে নান্দনিকভাবে পুনর্বিন্যাস করা হয়েছে। ফলে দর্শনার্থীরা আসির অঞ্চলের সমৃদ্ধ ঐতিহ্য ও ইতিহাসের অনন্য স্বাদ উপভোগ করতে পারেন।

ড. মাহফুজ আল-জাহরানি তাঁর গবেষণা ‘দ্য ফোর্টিফিকেশন্স অফ দ্য সিটি অফ আভা’ (২০০৬) গ্রন্থে উল্লেখ করেছেন, ‘আল-দাকাল’ নামটি শুদ্ধ আরবি শব্দ থেকে এসেছে, যার অর্থ উচ্চতা বা উঁচু স্থান। এটি পালতোলা নৌকার কেন্দ্রীয় মাস্তুলের প্রতীক হিসেবেও ব্যবহৃত হয়, যা দুর্গটির উঁচু অবস্থানকে ইঙ্গিত করে।

পাহাড়ি পাথুরে ভিত্তির ওপর নির্মিত দুর্গটি পার্বত্য ভূপ্রকৃতির সাথে সামঞ্জস্য রেখে প্রাচীন স্থাপত্যরীতি অনুসরণ করে তৈরি করা হয়েছে। এর আয়তাকার বিন্যাস প্রায় ৪৩.৬ মিটার লম্বা ও ১৬ মিটার চওড়া, যার উত্তর অংশটি অর্ধবৃত্তাকার। এটির উত্তর ও পশ্চিম প্রান্তের প্রাকৃতিক ঢালগুলোকে দুর্গের প্রতিরক্ষার অংশ হিসেবে কাজে লাগানো হয়েছে।

দুর্গের মূল কাঠামো তিনটি ভাগে বিভক্ত : কমান্ড সেন্টার, সৈন্যদের আবাসন এবং একটি সেবামূলক অংশ। একটি কেন্দ্রীয় প্রাঙ্গণ দুর্গটিকে পূর্ব ও পশ্চিম শাখায় ভাগ করেছে। এর অন্যতম আকর্ষণ হলো একটি বৃহৎ পাথরের চুলা, যেখানে সৈন্যরা রুটি তৈরি করতো। এর মুখ প্রায় দুই মিটার চওড়া এবং এর চিমনি ১১০ সেন্টিমিটার উঁচু।

দুর্গটির ভেতরে একটি সিল করা শস্যভাণ্ডার রয়েছে, যা সেই সময়কার মানুষের জীবনযাত্রা ও খাদ্যসংরক্ষণ পদ্ধতির নিদর্শন বহন করে। এই ভাণ্ডারটি পাথরের নিরোধক ব্যবহার করে নির্মাণ করা হয়েছিল, যাতে ভেতরের শস্য দীর্ঘদিন ভালো থাকে এবং আর্দ্রতা কিংবা বাহ্যিক পরিবেশজনিত কোনো ক্ষতি না করতে পারে। পাশাপাশি কীটপতঙ্গ থেকে রক্ষার জন্যেও বিশেষ ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছিল, যা প্রমাণ করে স্থানীয়রা কতটা সচেতনভাবে খাদ্য মজুত রাখার কৌশল জানতো। এই সংরক্ষণ ব্যবস্থা কেবল তাদের দৈনন্দিন চাহিদাই পূরণ করেনি, বরং দুর্যোগকালীন সময়ে টিকে থাকার জন্যেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছিল।

এছাড়া দুর্গে স্থানীয় সংস্কৃতি ও খাদ্যাভ্যাসের প্রতিফলন ঘটানো একটি বিশেষ জায়গারও ব্যবস্থা ছিলো। এখানে আছির অঞ্চলের ঐতিহ্যবাহী খাবার ‘হানীথ’ প্রস্তুতের জন্যে আলাদা একটি স্থান নির্ধারিত ছিলো। সাধারণত এটি মাংসকে বিশেষ ভঙ্গিতে মাটির নিচে বা ওভেনে ধীরে ধীরে রান্না করার মাধ্যমে প্রস্তুত করা হয়, যা অঞ্চলের অতিথিপরায়ণতা ও সামাজিক বন্ধনের প্রতীক হিসেবে বিবেচিত হয়। দুর্গের অভ্যন্তরে এই রান্নার জায়গা থাকার মাধ্যমে বোঝা যায়, শুধু নিরাপত্তাই নয়, বরং মানুষের সামাজিক ও সাংস্কৃতিক চাহিদাও এখানে সমান গুরুত্ব পেয়েছিল।

স্থানীয় কারিগররা দুর্গটি গ্রানাইট পাথর ব্যবহার করে নির্মাণ করেছেন, যা ক্ষয়রোধী হিসেবে পরিচিত। ছাদের জন্যে জুনিপার কাঠ ব্যবহার করা হয়েছে, যা মাটি, আখশলাকা (শোহাত) এবং লাল সাগর থেকে আমদানি করা প্লাস্টার দিয়ে সম্পূর্ণ করা হয়েছে। বহির্মুখে জলরোধী এবং শৈল্পিক প্লাস্টার প্রলেপ দেওয়া হয়েছে।

ছাদ নির্মাণের পদ্ধতিতে সমান্তরালভাবে জুনিপার কাঠের গুঁড়ি বসানো হয়েছে, এর উপর আখশলাকা এবং পলিমাটি-খড়ের মিশ্রণ দিয়ে স্তর তৈরি করে বৃষ্টির পানি থেকে রক্ষা নিশ্চিত করা হয়েছে।

দুর্গটি শীঘ্রই সর্বসাধারণের জন্যে উন্মুক্ত করার পরিকল্পনা রয়েছে, যা আভা শহরের সাংস্কৃতিক সৌন্দর্যকে আরও সমৃদ্ধ করবে এবং আসির অঞ্চলের প্রত্নতাত্ত্বিক ঐতিহ্য সম্পর্কে সচেতনতা বাড়াবে।

মোহাম্মদ সানাউল হক : +৯৬৬০৫৭৬৩২৮৫৫০।

  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়