প্রকাশ : ১৮ ফেব্রুয়ারি ২০২৫, ১১:৩৯
‘রাঙ্গামাটির রঙে চোখ জুড়ালো’

শেষ পর্ব
বিদায় রাঙ্গামাটি
রোববার (৯ ফেব্রুয়ারি ২০২৫) বিকেলে রাঙ্গামাটির জেলা প্রশাসক হাবিব উল্লাহ মারুফ শাহরাস্তি প্রেসক্লাবের আনন্দ ভ্রমণে অংশগ্রহণকারীদের নিকট থেকে বিদায় নেবার পর রাঙ্গামাটি জেলা শহর থেকে প্রায় শতজনের বিদায় নেবার তড়িঘড়ি শুরু হয়ে যায়। কিন্তু সুদৃশ্য রাঙ্গামাটি সার্কিট হাউজে বিভিন্ন অ্যাঙ্গেলে ছবি তোলার খায়েস অনেকের মধ্যেই দেখা যায়। সংলগ্ন হেলিপ্যাডে গিয়েও ছবি তুলেছেন কেউ কেউ। শিশুরা হেলিপ্যাডে গিয়ে সে কী আনন্দ উদযাপনই না করলো! এরই মধ্যে মসজিদ থেকে আসরের আজান কানে ভেসে আসছিলো। অনেকে আসরের নামাজটা পড়েই তবে শাহরাস্তির উদ্দেশ্যে রওনা দিতে চাইলেন। সভাপতি কাজল বারবার বলছিলেন, আমরা সন্ধ্যার পূর্বেই ঝুঁকিপূর্ণ পাহাড়ি পথ পেরুতে পারবো ইনশাআল্লাহ। কাজেই নামাজ পড়ে নেয়াটাই উত্তম।
বাসে উঠার আগে সার্কিট হাউজকে ব্যাকগ্রাউন্ডে রেখে সর্বশেষ তোলা হলো গ্রুপ ছবি। বাস ছাড়তে ছাড়তে বিকেল প্রায় পাঁচটা বেজে গেলো।
মাগরিবের বিরতি ও সভাপতির স্ত্রীর 'ওক্কা'মাগরিবের নামাজের আজান হওয়ায় রাঙ্গামাটি জেলার প্রান্তিক এলাকায় বিরাট এক মাদ্রাসার মসজিদে নামাজ পড়তে বাস দুটি থামানো হলো। নামাজ পড়াশেষে সাথে সাথে বাস ছেড়ে দেবে এটাই ছিলো নারী ভ্রমণকারীদের প্রত্যাশা। কিন্তু দেরি হচ্ছিলো। কারণ কেউ কেউ নিকটবর্তী দোকানে গিয়ে চা ও ধূমপান করছিলেন। এ সময় সভাপতির স্ত্রী মরিয়ম আক্তার রিনা স্বগতোক্তি করলেন, এমন অভ্যাসের লোকজনকে 'ওক্কা' (হুক্কা) কিনে নেয়াই ভালো, যারা বাসাবাড়িতে ইচ্ছেমত 'ওক্কা'র পাইপে সুখটান দিতে পারবে। তার এমন কথায় উৎকর্ণ লেখকসহ আরো ক'জনকে হাসতে দেখা যায়।
যানজটের কষ্ট ও ড্রাইভার হোটেলে বিরতিশুক্রবার (৭ ফেব্রুয়ারি ২০২৫) সকালে শাহরাস্তি প্রেসক্লাবের আনন্দ ভ্রমণে অংশগ্রহণকারীদের দুটি বাস জুমার নামাজের পর ভাটিয়ারী থেকে রওনা দিয়ে মেঘমুক্ত আকাশে রোদের ঝিকিমিকিতে জিগজাগ পাহাড়ি সড়ক পাড়ি দিতে দিতে আনন্দ বিচ্ছুরণে সকলকে বারবার আন্দোলিত করে চলছিলো। তখন মনে হয়েছে, দিনে ভ্রমণ করার কারণেই পথের সৌন্দর্য তথা পথিমধ্যের নজরকাড়া দৃশ্যাবলি উপভোগ করা যাচ্ছে, অন্যথায় সেটা সম্ভব হতো না। কাজেই ঘুম নষ্ট করে রাতের অন্ধকারে দীর্ঘপথ পাড়ি দেবার পরিবর্তে দিনের আলোতে ভ্রমণ-গন্তব্যে পৌঁছার সিদ্ধান্ত যথার্থ হয়েছে। কিন্তু ফেরার দিন রোববার (৯ ফেব্রুয়ারি ২০২৫) মাগরিব-পরবর্তী সময়টা চট্টগ্রাম শহরের অসহনীয় যানজটের কারণে ভ্রমণকারীদের নিকট বিরক্তিকর মনে হয়েছে। প্রাকৃতিক প্রয়োজন মেটাবার তাগিদে একটা বিরতির অনিবার্যতা দেখা দিলো। সেটি পূরণে ড্রাইভার এমন একটি পাম্পে যাত্রা বিরতি দিলেন, যেখানে টয়লেটের ওপরে ড্রাইভারদের হোটেলের আলোকোজ্জ্বল সাইনবোর্ড ঝুলছিলো। সভাপতি কাজল সে ছবিটি ধারণ করে বিনোদন অনুভব করলেন। এর জবাবে নিকটবর্তী স্থানে দাঁড়ানো এক লোক বললেন, হোটেল একটু সামনে, আপনারা খাবার খেতে চাইলে যেতে পারেন। প্রচারের সুবিধার্থে টয়লেটে লাগানো হয়েছে হোটেলের সাইনবোর্ড। তার এটা খোঁড়া যুক্তি। কেননা এমনভাবে সাঁটানো সাইনবোর্ড অন্যত্র দেখা যায় না বললেই চলে।
নৈশভোজের বিরতিতে কুমিল্লার মায়ামি-২ রেস্তোরাঁয়সভাপতি কাজল সুন্দর পরিবেশে নৈশভোজের ইচ্ছা পোষণ করলেন। আমি (লেখক) তাঁকে ৩১ জানুয়ারিতে সনাক-টিআইবির আনন্দ ভ্রমণের ভালো অভিজ্ঞতার আলোকে কুমিল্লার আলেখার চরের নিকটবর্তী মায়ামী-২ রেস্তোরাঁয় সেটি আয়োজনে টিআইবি, চাঁদপুরের রাজন চন্দ্র দে'র সাথে কথা বলতে বলি। কেননা রাজনের ছাত্র ফুল মিয়া এই রেস্তোরাঁর অন্যতম পার্টনার। সুন্দর পরিবেশে খাওয়া যাবে এবং মূল্যও সাশ্রয়ী হবে। সভাপতি কাজল কথা রাখলেন। রাজনের আন্তরিক সহযোগিতায় চমৎকার সুন্দর পরিবেশে রাত ১১টার পর হাইওয়ে রেস্তোরাঁ মায়ামী-২-এর চাইনিজ খাবারের কক্ষে একসঙ্গে শতজন আপ্যায়িত হলেন সুস্বাদু নৈশভোজে। শুধু কি তা-ই?
সমাপনী অনুষ্ঠান ও র্যাফেল ড্রমায়ামী-২ রেস্তোরাঁয় নৈশভোজশেষে আবদার করা হলো, তাদের শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত কনফারেন্স রুমটা যেনো ব্যবহার করতে দেয়া হয়। মায়ামী-২ কর্তৃপক্ষ সানন্দে তাতে রাজি হলো। সেখানে রাত ১২টার পর আয়োজন করা হলো আনন্দ ভ্রমণের সমাপনী অনুষ্ঠান ও র্যাফেল ড্র। সরাসরি সম্প্রচারের দায়িত্ব দেয়া হলো ইত্তেফাকের জসিম উদ্দিনকে, ছবি তোলার দায়িত্ব দেয়া হলো বিএম নয়নকে, আর সঞ্চালনার দায়িত্ব দেয়া হলো যুগান্তরের ফয়সালকে। এই পর্বটি সুন্দরভাবে সম্পন্ন করতে সহ-সভাপতি সজল পালসহ অন্যদের সহযোগিতা ছিলো হৃদ্যতাপূর্ণ। প্রথমে প্রেসক্লাবের পক্ষ থেকে আনন্দ ভ্রমণে অংশগ্রহণকারী সকল সদস্যকে স্মৃতিচিহ্ন হিসেবে ক্লাবের লোগো ও আনন্দ ভ্রমণ লেখা খচিত মগ এবং চাবির রিং উপহার দেয়া হয়। সদস্যদের স্ত্রীরা এই উপহার গ্রহণ করেন। উপহার প্রদানের পূর্বে ক্লাব সভাপতি ও সেক্রেটারী এবং লেখক বক্তব্য রাখেন।
সবশেষে ছিলো আকর্ষণীয় র্যাফেল ড্র। দশটি পুরস্কারের এই ড্রতে মহিউদ্দিন মাইনু জিতলেন প্রথম পুরস্কার। এতে কাপ্তাই হ্রদে উপজাতিদের মার্কেটে তার হারিয়ে যাওয়ার কষ্টটা পুরোপুরিই ঘুচেছে।
রোববারের পরিবর্তে সোমবারে শাহরাস্তিতে
রাত ১টার পর কুমিল্লা থেকে রওনা হয়ে রাত ৩টার পর শাহরাস্তিতে নিরাপদে পৌঁছেন শাহরাস্তি প্রেসক্লাবের আনন্দ ভ্রমণে অংশগ্রহণকারী প্রত্যেকে। বাসের লোকদের সাথে কথা ছিলো, শুক্রবার যাবে ও রোববার ফিরবে। সেই ফেরাটা সোমবার গড়ানোর কারণে বাসের ড্রাইভার-কন্ডাক্টর-হেলপারদের একটু গুণগুণানি ছিলো। কিন্তু সভাপতি কাজলের বাকচাতুর্যে সেটা নিরসন হয়েছে হাসিখুশিভাবেই। নেতা আসলে এমনই হতে হয়--কাউকে কথা দিয়ে খুশি করতে হয়, কাউকে দিতে হয় বকশিস, কাউকে পিঠ চাপড়িয়ে দিতে হয় প্রসন্নতা।
ছোটবোনের বাসায় দুবার রাতযাপনের সুযোগ
'সে আমার ছোটবোন, বড়ো আদরের ছোটবোন'-- উপমহাদেশের কালজয়ী কণ্ঠশিল্পী মান্না দে'র এই গানটি আমার ভীষণ প্রিয়। কিন্তু সে গানের আলোকে বৈবাহিক সূত্রে শাহরাস্তির স্থায়ী বাসিন্দা আমার ছয় বোনের মধ্যে সবচে' ছোটবোন রাজিয়া বেগম শাহ্জাদী (সাজু)-এর প্রতি দায়িত্ব পালন করি না। বৈশ্বিক মহামারী করোনাকালে ২০২০ সালের ৩১ জুলাই তারিখে চাঁদপুর সরকারি জেনারেল হাসপাতালের সম্মুখস্থ সড়কে অ্যাম্বুলেন্সের ভেতরে ঢাকায় নেয়ার প্রাক্কালে সাজুর স্বামী কবিরুল ইসলাম মজুমদার (কবির স্যার নামে বহুল পরিচিত) আমার চোখের সামনে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করার পরও বোনের আকুতি সত্ত্বেও তাদের গ্রামের বাড়ি মালরাতে যাইনি। তবে দাফন কাফনের দায়িত্ব ইসলামী আন্দোলনের জেলা সভাপতি শেখ মুহাম্মদ জয়নাল আবেদীনের ওপর দিয়েই যেনো দায়মুক্তি খুঁজেছিলাম।
দুদশকেরও বেশি সময় ধরে সাজু আছে তাঁর কর্মস্থল ও স্বামীর ঠিকানা শাহরাস্তিতে। আমি তাঁর বাসায় সকালে গিয়ে সন্ধ্যায় এসেছি কয়েকবার, কিন্তু সপরিবারে রাতযাপন করিনি। শাহরাস্তি প্রেসক্লাবের আনন্দ ভ্রমণে অংশগ্রহণের প্রয়োজনে দুরাত (বৃহস্পতি ও সোমবার) থাকতে হয়েছে সাজুর বাসায়। ভাইকে পেয়ে সহোদরা বোন কতো কী যে করতে পারে, সেটার নজির রাখলো আদরের ছোটবোন সাজু। বিমুগ্ধতায় ভরে গেছে মনপ্রাণ। এরচে' বেশি কিছু লিখলে আত্যন্তিকতার দোষে দোষী হয়ে যেতে পারি। তবে কৃতজ্ঞ শাহরাস্তি প্রেসক্লাবের সদস্যগণের প্রতি, যাঁরা তাঁদের অতিথি হিসেবে আমার পরিবারের সদস্যগণকে তাঁদের ভ্রমণসঙ্গী করেছেন এবং সে সুবাদে ছোটবোনের বাসায় দুরাত যাপনের বিরল সুযোগ করে দিয়েছেন। সত্যি কথা বলতে কী, রাঙ্গামাটির চেয়ে শাহরাস্তির সাবেক ইউএনও, রাঙ্গামাটির বর্তমান জেলা প্রশাসক হাবিব উল্লাহ মারুফই ছিলেন মূল আকর্ষণ। তিনি আমাকে যে সম্মান দেখিয়েছেন, সেটা ছিলো আশাব্যঞ্জক। তাঁর মতো সৃষ্টিশীল ও উদ্ভাবনী চিন্তা-চেতনার মানুষ দেশের প্রয়োজনে সরকারের অনেক উঁচু স্থানে যেতে সক্ষম হোক--নিরন্তর সে কামনাই করি।
কাজল-জামালের কথাতেই ভ্রমণ কাহিনীতে ফেরাজামাল হোসেন শাহরাস্তি প্রেসক্লাবের অর্থ দম্পাদক। উপজেলা পরিষদের সামনেই তাঁর পিতার যতো স্থাপনা। তাঁদের একটি কক্ষে চলছে শাহরাস্তি প্রেসক্লাবের দাপ্তরিক কার্যক্রম। সামান্য দূরেই তাঁর বাসা। সভাপতি কাজলের অনেক প্রিয়ভাজন ও স্নেহভাজন এই জামাল। তিনি একসময় চাঁদপুর কণ্ঠে কাজ করতেন। সে হিসেবে আমার সাবেক সহকর্মী। রাঙ্গামাটি ভ্রমণকালে জামাল বিভিন্নভাবে আমাকে ভ্রমণ কাহিনী লিখার ব্যাপারে উদ্বুদ্ধ করেছেন। সভাপতি কাজল এ ক্ষেত্রে ছিলেন কৌশলী। তিনি শুক্রবার পলওয়েল পার্কে 'লাভ পয়েন্টে' গিয়ে 'ভালোবাসার শোকগাথা' শিরোনামের বিল বোর্ডের ছবি তোলার তাগিদ দিয়ে আস্তে করে বললেন, ভাই! আপনি তো আমাদের ভ্রমণ নিয়ে একটা লেখা লিখবেন, সেজন্যে এই ছবিটি তুলে রাখুন। কাজে লাগবে।আমার আর বুঝতে বাকি থাকলো না, ভ্রমণশেষে আমাকে কোন্ কাজটি করতে হবে।
বস্তুত সে কাজটি সম্পন্ন করলাম ষোলআনা সন্তুষ্টির প্রেক্ষিতে। অসুস্থতা ও দুদিনের ব্যবধানে কুষ্টিয়া ভ্রমণের কষ্টও তাতে বাধ সাধেনি।
বলা দরকার, বিগত ক'বছরে ভারতের ত্রিপুরা, দার্জিলিং ও কাশ্মীরসহ দেশের অনেক আকর্ষণীয় স্পটে ভ্রমণ করেও লিখিনি ভ্রমণ কাহিনী। কেনো লিখিনি বা লিখতে পারিনি সেটার ব্যাখ্যা না দিয়ে ছোট্ট কথার জবাব হচ্ছে, আল্লাহ আমাকে তখন লেখার মানসিক সামর্থ্য দেন নি। এবার দিয়েছেন, তাই অশেষ শোকরিয়া। (সমাপ্ত)