প্রকাশ : ২৯ জুলাই ২০২৫, ০৯:০২
বাংলাদেশের গ্রামীণ প্রাথমিক বিদ্যালয়ে বাংলা ও ইংরেজি ভাষা শিক্ষার অন্তরায়

বাংলাদেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলের প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলোতে শিশুদের শিক্ষা জীবন শুরু হয় সীমিত সুযোগ, দুর্বল কাঠামো এবং অনুপ্রেরণার অভাবে। এই সংকট সবচেয়ে প্রকট আকারে দেখা যায় ভাষা শিক্ষার ক্ষেত্রে। বাংলা ও ইংরেজিÑদুটি ভাষাই শিশুর জ্ঞান, চিন্তা ও আত্মপ্রকাশের প্রধান বাহন। অথচ বাস্তবে দেখা যায়, ছাত্র-ছাত্রীরা একটানা ১২/১৩ বছর বিদ্যালয়ে ভাষা শিক্ষার অন্তর্ভুক্ত থাকলেও তারা দুটির একটিতেও স্বচ্ছভাবে পড়তে, লিখতে বা বলতে পারে না। এই ব্যর্থতা শুধু শিক্ষার্থীর নয়, বরং পুরো শিক্ষা ব্যবস্থার, বিশেষ করে প্রাথমিক পর্যায়ে ভাষা শিক্ষাকে অবহেলার ফল।
প্রাথমিক স্তর ভাষা শিক্ষার ভিত্তি রচনা করে। এই স্তরেই শিশুকে শেখাতে হয় বর্ণমালা, ধ্বনি ও উচ্চারণ, শব্দ গঠন, বানান, বাক্য নির্মাণ ও অনুশীলনের মাধ্যমে আত্মপ্রকাশের মৌলিক কৌশল। কিন্তু বাংলাদেশের গ্রামীণ বিদ্যালয়গুলোর অধিকাংশে শিক্ষকরা এই ধাপে ধাপে শেখানোর রীতি মানেন না। পাঠদান হয় একঘেয়ে ও অনুৎসাহজনকভাবে। শিক্ষকেরা অনেক সময় ক্লাসে এসে বই পড়ে চলে যান, কোনও ব্যাখ্যা দেন না, উচ্চারণ শেখান না, অনুশীলনে উৎসাহিত করেন না। এর ফলে শিশুরা শেখার প্রতি আগ্রহ হারিয়ে ফেলে, এবং ভাষাকে ভয় পেতে শুরু করে।
এই অবস্থার পেছনে শিক্ষকদের পেশাগত প্রশিক্ষণ ও সচেতনতাও বড় ভূমিকা রাখে। অনেক শিক্ষক নিজেরাই ভাষা শিক্ষার মৌলিক নিয়ম জানেন না বা জানলেও তা যথাযথভাবে ব্যবহার করেন না। বিশেষ করে ইংরেজি বিষয়ে অনেক শিক্ষক ভুল উচ্চারণে পাঠদান করেন, ভুল ব্যাকরণ শেখান। আবার কিছু স্কুলে নির্দিষ্ট ইংরেজি শিক্ষক না থাকায় বাংলা শিক্ষকই ইংরেজি ক্লাস করান, যার ফলে ভাষার কাঠামোগত গভীরতা হারিয়ে যায়।
শুধু শিক্ষকই নয়, শিক্ষাব্যবস্থার কাঠামোতেও রয়েছে ভাষা শিক্ষার প্রতি অবজ্ঞা। বর্তমান পাঠ্যক্রম মুখস্থনির্ভর, পরীক্ষাকেন্দ্রিক। ছাত্রছাত্রীরা শুধু সিলেবাস শেষ করতে ব্যস্ত থাকে, শেখার আনন্দ ও অভিজ্ঞতা অর্জনের সুযোগ পায় না। প্রশ্নোত্তর মুখস্থ করে তারা ক্লাসে পাস করলেও বাস্তব জীবনে একটি সঠিক বাক্য গঠন করতে পারে না। ফলে বাংলা বা ইংরেজি কোনো ভাষাতেই তারা সাবলীল হতে পারে না।
এতসব সীমাবদ্ধতার সঙ্গে যুক্ত হয়েছে অভিভাবকদের অজ্ঞতা ও অসচেতনতা। গ্রামীণ এলাকার অনেক মা-বাবা নিজেরাই অশিক্ষিত বা অর্ধশিক্ষিত। ফলে তারা শিশুদের পড়াশোনায় সহায়তা করতে পারেন না। শিশুদের প্রতি উৎসাহ জোগানো, ভাষা শিক্ষায় অনুশীলনের গুরুত্ব বোঝানোÑএসবও অধিকাংশ পরিবারে অনুপস্থিত। এমন পরিস্থিতিতে শিশুর শেখার একমাত্র ভরসা হয়ে ওঠে বিদ্যালয়, কিন্তু সেখানে যদি দায়িত্ববান ও উৎসাহী শিক্ষক না থাকে, তাহলে শিশুটি চিরতরে ভাষাগত দুর্বলতার শিকার হয়ে পড়ে।
ভাষা শেখার প্রক্রিয়ায় পরিবেশ ও উপকরণের ভূমিকা অনস্বীকার্য। কিন্তু গ্রামীণ বিদ্যালয়গুলোতে নেই চিত্রসহ বই, নেই অডিও-ভিজ্যুয়াল উপকরণ, নেই ছড়া বা গল্পভিত্তিক শিক্ষার ব্যবস্থা। শিশুদের শেখার জন্য যে আনন্দময় পরিবেশ দরকার, তা এই বিদ্যালয়গুলোতে দুর্লভ। শহরের তুলনায় গ্রামে মাল্টিমিডিয়া ক্লাসরুমও খুব কম এবং যেগুলো আছে, সেগুলোর কার্যকারিতা প্রশ্নবিদ্ধ। শিক্ষকরা প্রযুক্তি ব্যবহারে অভ্যস্ত না হওয়ায় সেগুলোর ব্যবহারও সীমিত থেকে যায়।
তবুও, পরিবর্তনের আশা আছে। যদি প্রাথমিক স্তর থেকেই শিশুদের ভাষা শিক্ষাকে গুরুত্ব দিয়ে শেখানো হয়Ñপ্রথমে বর্ণ, তারপর ধ্বনি, ধাপে ধাপে শব্দ ও বাক্যÑতাহলে শিশুরা নিজেদের ভাষাগত দুর্বলতা কাটিয়ে উঠতে পারে। শিশুকে ছোট ছড়া পড়ানো, গল্প বলানো, উচ্চারণ করানো, তাদের প্রশ্ন করতে উৎসাহ দেওয়া এবং শ্রুতিধ্বনির অনুশীলনে যুক্ত করাÑএসবই হতে পারে কার্যকর পন্থা। এভাবে একটি শিশু প্রাক-প্রাথমিক স্তরেই নিজে নিজে বাংলা-ইংরেজি পড়তে ও বুঝতে সক্ষম হতে পারে।
এর জন্য প্রয়োজন নীতিগত উদ্যোগ। প্রতিটি বিদ্যালয়ে দক্ষ ভাষা শিক্ষক নিশ্চিত করতে হবে। শিক্ষকদের নিয়মিত প্রশিক্ষণ, ক্লাস পর্যবেক্ষণ ও প্রণোদনার ব্যবস্থা করতে হবে। শিশুদের শেখার ফলাফল নিয়মিতভাবে যাচাই করতে হবে। পাঠ্যপুস্তকে আরও বেশি গল্প, ছড়া, রঙিন ছবি ও বাস্তবভিত্তিক অনুশীলন যুক্ত করতে হবে। পাশাপাশি, প্রতিটি বিদ্যালয়ে ভাষা সহায়ক উপকরণ যেমন শব্দ কার্ড, পোস্টার, শ্রুতিধ্বনি রেকর্ড, প্রজেক্টর ইত্যাদি সরবরাহ করতে হবে। প্রযুক্তি ও পঠন-উপকরণের এই যুগে ভাষা শিক্ষার এমন অনাদর মেনে নেওয়া যায় না।
এই সংস্কারে অভিভাবকদের ভূমিকাও অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। তাদের সচেতন করতে হবে যে শিশুরা কেবল পরীক্ষায় পাস করলেই যথেষ্ট নয়, তাদের ভাষাগত সক্ষমতা অর্জন করাও জরুরি। বাড়িতে তারা যেন প্রতিদিন কিছুক্ষণ শিশুর সঙ্গে গল্প পড়েন, উচ্চারণ শেখান বা একসঙ্গে ইংরেজি-বাংলা বাক্য অনুশীলন করেন। এতে শিশুর শেখা হবে আনন্দের, শেখার প্রতি আগ্রহ জন্মাবে।
বাংলাদেশের সংবিধানেই বলা হয়েছে, ‘সবার জন্য শিক্ষা নিশ্চিত করা রাষ্ট্রের দায়িত্ব’। সেই শিক্ষা তখনই সফল হবে, যখন প্রতিটি শিশুর ভাষাগত ভিত্তি মজবুত হবে। ভাষা শুধু পরীক্ষায় নম্বর পাওয়ার হাতিয়ার নয়, এটি চিন্তার প্রকাশ, আত্মমর্যাদার উপাদান এবং বিশ্বদর্শনের বাহন। একজন শিশু যদি নিজের মনের কথা বলতে না পারে, অনুভূতি প্রকাশ করতে না পারে তবে তার শিক্ষা অসম্পূর্ণই থেকে যাবে।
এই বাস্তবতা সামনে রেখে আমাদের একটি সচেতন, মানবিক ও অন্তর্ভুক্তিমূলক ভাষা শিক্ষার রূপরেখা প্রণয়ন করতে হবে। শহর-গ্রামের বৈষম্য দূর করে প্রত্যন্ত অঞ্চলের শিশুদের মধ্যেও ভাষা শেখার আলো পৌঁছে দিতে হবে। প্রাথমিক শিক্ষাকে বানাতে হবে ভাষাভিত্তিক, চিন্তামূলক ও আনন্দময়। শিশুদের মুখে ফুটুক বাংলার সৌন্দর্য, ইংরেজির আত্মবিশ্বাস। ভাষা হোক তাদের ভবিষ্যতের সেতুবন্ধন।
বাংলাদেশের প্রতিটি শিশুই সম্ভাবনাময়। তাদের সেই সম্ভাবনা পূর্ণতা পাক ভাষাশিক্ষার মাধ্যমে এটাই হোক আমাদের শিক্ষা-দর্শনের প্রধান লক্ষ্য।