প্রকাশ : ০৪ নভেম্বর ২০২৫, ০৯:৩৬
শূন্য পাস শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের প্রতি শূন্যসহিষ্ণুতা

এ বছরের উচ্চ মাধ্যমিক ও সমমানের পরীক্ষায় অকৃতকার্য শিক্ষার্থীর সংখ্যা গতবারের চেয়ে যে হারে বেড়েছে, তার চেয়ে বেশি বেড়েছে শূন্য পাস শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের সংখ্যা। এ বছর অকৃতকার্যের হার ৪১ শতাংশ ছাড়িয়েছে, যা গত বছর ছিল ২০ শতাংশের কিছু বেশি। অন্যদিকে গত বছর ৬৫টি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের কোনো শিক্ষার্থী পাস করতে পারেনি; এ বছর এমন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান প্রায় তিন গুণ ২০২। গত জুলাইয়ে প্রকাশিত এসএসসির ফলেও আমরা দেখেছি, ১৩৪টি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের কোনো শিক্ষার্থী পাস করতে পারেনি, যেখানে পূর্ববর্তী বছর এমন প্রতিষ্ঠান ছিল ৫১টি।
প্রতিবছর শূন্য পাস শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান নিয়ে, বিশেষ করে যখন পাবলিক পরীক্ষা তথা মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষার ফল প্রকাশ হয়, আলোচনা হয়। তখন শিক্ষা বোর্ড এ ব্যাপারে প্রতিকারমূলক ব্যবস্থা গ্রহণের কথা বলে। বাস্তবে সারাবছর এ নিয়ে কতটা কাজ হয়, তা নিয়ে সন্দেহ করার যথেষ্ট কারণ আছে। বিভিন্ন সময়ে শতভাগ ফেল করা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানকে শিক্ষা প্রশাসনের পক্ষ থেকে কারণ দর্শানোর নোটিশ জারির খবর সংবাদমাধ্যমে এসেছে। কিন্তু এর পরের ধাপ সম্পর্কে কিছুই জানা যায়নি। অর্থাৎ চরম এ ব্যর্থতার কারণে কোনো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের এমপিও বাতিল হয়েছে বলে কোনো খবর চোখে পড়েনি। অবশ্য এমপিওভুক্ত নয়, এমন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানেও শূন্য পাস রয়েছে। যেমন ২০২৩ সালেও শিক্ষা প্রশাসন কঠোর বার্তা দিয়েছিল। সংবাদমাধ্যমে এসেছিল, তারা এমপিওভুক্ত প্রতিষ্ঠানের এমপিও বন্ধ করবে। বাস্তবে তেমনটা হয়েছিল কিনা, জানা নেই।
কোনো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শতভাগ শিক্ষার্থী অকৃতকার্য হওয়ার পেছনে বহুবিধ কারণ থাকতে পারে। দুর্বল শিক্ষার্থী ভর্তি একটা কারণ হতে পারে। আবার অবকাঠামোগত ও পারিপার্শ্বিক নানা সমস্যাও এতে ভূমিকা রাখতে পারে। তাই তার সমাধানও একরৈখিক নয়। তবে সেসব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শিক্ষকরা কতটুকু যোগ্য কিংবা যোগ্য হলেও কতটুকু দায়িত্বশীল, সে প্রশ্নও জোরালোভাবে উঠতে পারে। তাই কেবল কারণ দর্শানো নোটিশ দিয়ে সমস্যার সমাধান সম্ভব নয়। সমস্যাগুলো প্রতিষ্ঠানভেদে ভিন্ন হতে পারে। তাই বলে কারণ দর্শানোর নোটিশ দিয়ে তার কোনো ফলোআপ থাকবে না এ কেমন কথা!
এবারের এইচএসসি পরীক্ষায় শতভাগ অকৃতকার্য শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের তালিকায় এমন প্রতিষ্ঠানও আছে, যেখান থেকে একজন শিক্ষার্থীও পরীক্ষা দেয়নি; পরীক্ষা না দিলে তো পাস-ফেলের প্রশ্নই নেই। সে জন্য প্রতিষ্ঠানগুলোর বাস্তবতা আগে দেখতে হবে। আন্তঃশিক্ষা বোর্ড সমন্বয় কমিটির সভাপতি ও ঢাকা শিক্ষা বোর্ড চেয়ারম্যান খন্দকার এহসানুল কবির যথার্থই বলেছেন, শূন্য পাস করা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোর বিষয়ে তারা ‘কেস টু কেস’ ভিত্তিতে সিদ্ধান্ত নেবেন।
আমরা দেখেছি, এ বছর প্রথমবারের মতো ঢাকা শিক্ষা বোর্ড এসএসসিতে অনুপস্থিত শিক্ষার্থীর কারণ অনুসন্ধানের চেষ্টা করেছে। সেখানে তারা শিক্ষার্থীর বিয়ে হয়ে যাওয়া, অর্থনৈতিক অবস্থাসহ পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করতে না পারার বেশ কিছু কারণ পেয়েছেন। এভাবে অকৃতকার্য প্রতিষ্ঠানভিত্তিক বাস্তব তথ্য পেলে কারণ বের করা সহজ হবে।
কিন্তু কিছু ক্ষেত্রে শতভাগ শিক্ষার্থী ফেল করার পেছনের কারণটা চোখ বন্ধ করেই বলা যায়। আমরা জানি, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান অনুমোদনের ক্ষেত্রে যেমন মৌলিক কিছু শর্ত থাকে, তেমনি এমপিওভুক্ত করার ক্ষেত্রেও অনেক কিছু দেখা হয়। প্রতিষ্ঠান অনুমোদনের ক্ষেত্রে দেখা হয়, আশপাশে কোনো প্রতিষ্ঠান আছে কিনা; সেখানকার জনসংখ্যা কত। ক্যাচমেন্ট এরিয়া তথা এলাকার ভৌগোলিক অবস্থানও এখানে গুরুত্বপূর্ণ। অনুরূপ এমপিওভুক্ত হতে গেলে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থী-শিক্ষক অনুপাত, পরীক্ষায় শিক্ষার্থীর ফল কেমন ইত্যাদি দেখা হয়। এসব নিয়মানুযায়ী শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান অনুমোদন ও এমপিওভুক্তি নিশ্চিত হলে হয়তো শতভাগ ফেল করা প্রতিষ্ঠান এত বাড়ত না।
শিক্ষার্থীদের অকৃতকার্য হওয়ার পেছনে যেমন শিক্ষার্থীর দায় আছে, তেমনি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, শিক্ষক ও অভিভাবকের দায়ও কম নয়। একই সঙ্গে শিক্ষা প্রশাসনের মনিটরিংয়ের বিষয়ও উপেক্ষা করা যাবে না। শিক্ষকদের মূল্যায়ন ও তাদের প্রশিক্ষণের সঙ্গে দুর্বল শিক্ষার্থীদের জন্য রেমেডিয়াল ক্লাস এবং অতিরিক্ত শ্রেণি কার্যক্রমের প্রয়োজন হতে পারে। এ ক্ষেত্রে অভিভাবক ও কমিউনিটিকেও সম্পৃক্ত করা যায়। শতভাগ ফেল করা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ক্ষেত্রে সমন্বিত পদক্ষেপ জরুরি।
এবারের এইচএসসি ও সমমানের ফলে অকৃতকার্যের হার দুই দশকের মধ্যে সর্বোচ্চ, বলা হচ্ছে। এর কারণ হিসেবে শিক্ষা প্রশাসন বলেছে, আগে যেভাবে খাতা মূল্যায়নে শিক্ষকদের ‘উদার’ হওয়ার অলিখিত নির্দেশনা ছিল, এবার তা দেওয়া হয়নি। এই বাস্তবতায় শিক্ষক-শিক্ষার্থী ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের জন্য বড় বার্তা আছে। তার মানে, শিক্ষার্থীদের অবশ্যই পড়াশোনার বিষয়ে ‘সিরিয়াস’ হতে হবে। যে শিক্ষার্থী ১০ বছর পড়াশোনা করে এসেছে, তার একটা মৌলিক জ্ঞান আছে, যার মাধ্যমে এইচএসসি ও সমমানের শিক্ষায় তার পাস করার মতো ন্যূনতম নম্বর পাওয়ারই কথা। তবে এটাও ঠিক, শিক্ষায় মূল্যায়ন মানে কেবল পরীক্ষা নয়; নানাভাবেই তা হতে পারে। সে বিকল্প বিষয়গুলোও ভাবার সময় এসেছে।
বাস্তবতা যাই হোক, শিক্ষা প্রশাসনের লক্ষ্য হতে হবে শূন্য পাস করা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের সংখ্যা শূন্যে নামিয়ে আনা। এর বিরুদ্ধে শূন্যসহিষ্ণুতা প্রদর্শন জরুরি। যে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের কর্তৃপক্ষ বা শিক্ষকরা শিক্ষার্থীদের গড়ে তোলার ব্যাপারে ধারাবাহিক ব্যর্থতার পরিচয় দিচ্ছেন; এমপিওভুক্ত হয়ে থাকলে প্রয়োজনে তাদের এমপিও বন্ধ করা যেতে পারে। এমপিওভুক্ত নয়, এমন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানও শাস্তির আওতায় আসতে পারে। তবে এ ব্যর্থতা থেকে বেরিয়ে আসতে সম্ভাব্য সব রকম সরকারি সমর্থন দিতে হবে সংশ্লিষ্ট শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানকে। তারপরও প্রত্যাশিত সাফল্য পেতে ব্যর্থ হলে ওই শাস্তিমূলক পদক্ষেপ গ্রহণের প্রশ্ন আসতে পারে।








