বুধবার, ২৩ জুলাই, ২০২৫  |   ৩৬ °সে
জাতীয়আন্তর্জাতিকরাজনীতিখেলাধুলাবিনোদনঅর্থনীতিশিক্ষাস্বাস্থ্যসারাদেশ ফিচার সম্পাদকীয় অন্যান্য

প্রকাশ : ২২ জুলাই ২০২৫, ২৩:০৮

ছেলের খোঁজে রুদ্ধশ্বাস ৪ ঘণ্টা

অনলাইন ডেস্ক
ছেলের খোঁজে রুদ্ধশ্বাস ৪ ঘণ্টা

আগের রাত থেকে আমার স্ত্রীর জ্বর। তাই পরদিন ছেলেকে (সায়ের মাহবুব) আমিই স্কুলে নামিয়ে দিয়ে এসেছি। দুপুরে আমার কাছে একটি ফোন আসে। জানতে পারি, মাইলস্টোন স্কুলের মধ্যে বিমানের কী যেন একটা ভেঙে পড়েছে। অফিসের কাজে আমি তখন বনানী। স্কুলের একজনকে ফোন করলাম, তিনি তখন বাইরে ছিলেন, সঠিক তথ্য দিতে পারলেন না। এরপর জানতে পারলাম, স্কুলের মধ্যে বিমান বিধ্বস্ত হয়েছে। মাইলস্টোনের ঠিক সেই শাখায়, যে শাখার ইংরেজি ভার্সনে ক্লাস এইটে পড়ে সায়ের। দ্রুত মোটরসাইকেল নিয়ে রওনা হয়ে গেলাম।

দিয়াবাড়ি মোড়ের কাছে গিয়ে দেখি অনেক মানুষ। মোটরসাইকেল নিয়েও যেতে পারছি না। একটা গলির মধ্যে ঢুকে মোটরসাইকেলটা সেখানে ফেলে রেখেই হেঁটে চলে এলাম স্কুলের কাছে। কিন্তু এত মানুষ! কিছুতেই ভেতরে যেতে পারছি না। অভিভাবকদেরও ভেতরে যেতে দিচ্ছে না। অভিভাবক পরিচয়ের বাইরেও আমার আরেকটা পরিচয় আছে, আমি একজন সাংবাদিক। নিজের পরিচয়পত্রটি দেখিয়ে সেনাবাহিনীর অনুমতি নিয়ে ভেতরে ঢুকলাম।

চারদিকে মানুষের ছোটাছুটি। ফায়ার সার্ভিস, সেনাবাহিনীর পাশাপাশি স্কুলের ছেলেরাও উদ্ধারকাজ করছে। দেখলাম, আমার ছেলের ক্লাসরুমের নিচেই বিমানটা বিধ্বস্ত হয়েছে। দোতলায় সায়েরের ক্লাসরুম কালো ধোঁয়ায় আচ্ছন্ন, আগুনের কুণ্ডলীও দেখা যাচ্ছে। তখনই ধরে নিলাম, আমার ছেলেও হয়তো নেই। উদ্ধারকারীরা একের পর এক মৃত, পোড়া শিক্ষার্থীদের বের করে আনছে আর আমি শুধু ভাবছি এই বুঝি আমার সায়েরকে দেখতে পাব। এ যে কী দীর্ঘ অপেক্ষা, একজন বাবাই শুধু সেটা উপলব্ধি করতে পারবেন। ছোট পোড়া শরীরগুলোকে প্যাকেটে করে আনা হচ্ছে, আর আমি ভাবছি এরা আমার একেকটা সায়ের। আমার চোখে পানি। স্ত্রী অসুস্থ বলে এতক্ষণ খবরটি জানাইনি। এবার ফোন করলাম, অবস্থা জানালাম। ওর চিৎকার আমাকে আরও অসহায় করে তুলল। মাঠের মধ্যে ঘিরে রাখা একটি জায়গায় হেলিকপ্টার নেমেছে, তাতে কোনো কোনো শিক্ষার্থীকে তোলা হচ্ছে। আমার শুধু মনে হচ্ছে এটাই আমার সায়ের। গলা শুকিয়ে কাঠ হয়ে গেছে। অনেকে পানি এনে দিচ্ছে, খাচ্ছি, কিন্তু পিপাসা মিটছে না। এত পিপাসা জীবনে আর কখনো লাগেনি। খালি মনে হচ্ছে, ছেলেটা না জানি কতটা পানির তেষ্টায় ছটফট করেছে।

‘পাওয়া গেছে?’ ততক্ষণে খবর ছড়িয়ে পড়েছে। ভাইবোন, আত্মীয়স্বজনের কাছ থেকে একের পর এক ফোন। তাঁদের একটাই প্রশ্ন, ‘পাওয়া গেছে?’ আমি নিরুত্তর। কখনো শুধু বলেছি, না। মাথার মধ্যে কত কথা যে ঘুরছে। দুই সন্তানের মধ্যে সায়ের ছোট। ওকে নিয়ে একের পর এক স্মৃতি আমার চোখের সামনে আসছে। মায়ের জ্বর থাকায় ছেলেটা আজ সকালে নাশতা পর্যন্ত খেতে পারেনি। স্কুলে নামিয়ে দেওয়ার আগে হোটেল থেকে নাশতা কিনে দিলাম। দুপুরের টিফিন আনতে পারেনি বলে আলাদা করে ১০০ টাকা হাতে দিলাম। ছেলে আমাকে বলল, ‘এত লাগবে না। তুমি ৪৫ টাকা দাও।’ জোর করেও বেশি টাকা দিতে পারলাম না।

এর মধ্যে সম্ভবত বেলা সাড়ে তিনটার দিকে একজন শিক্ষকের সঙ্গে কথা হলো। তিনি জানালেন, সায়ের সম্ভবত ভালো আছে। ওর গায়ে একটু আগুন লেগেছে। আপনারা আশপাশের হাসপাতালে খোঁজেন। ততক্ষণে বাইরে আমার স্ত্রী, দুই ভাই ও স্বজনরা এসে জড়ো হয়েছে। বিকেল পৌনে চারটার দিকে স্কুল এলাকা থেকে বের হয়ে এলাম। আশপাশের হাসপাতালগুলোতে খোঁজ নিতে হবে। কিন্তু রাস্তায় শুধু মানুষ আর মানুষ, একটাও রিকশা নেই। তার ওপর স্ত্রী নিজেও অসুস্থ। কোনো রকমে হেঁটে উত্তরা সেক্টর ১৩-এর জমজম টাওয়ার পর্যন্ত এলাম। এরপর একটা রিকশা পেলাম। কিন্তু তারপরও আমি যেতে পারলাম না। কারণ, আমাদের মতো আরেকজন মা তাঁর সন্তানকে খুঁজছে। আমার স্ত্রী তাঁকে রিকশায় তুলে নিয়ে উত্তরা আধুনিক মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের দিকে চলে গেল। আমিও সেদিকে হাঁটতে থাকলাম। ৩০-৪০ মিনিট খুঁজেও ওই হাসপাতালে ছেলেকে পাওয়া গেল না। হাসপাতালের উল্টো দিকে আই হসপিটালের সামনে আমার স্ত্রী আর এক বন্ধুকে দাঁড় করিয়ে রেখে আরেকজনের মোটরসাইকেলে চেপে

মনসুর আলী হাসপাতালের দিকে রওনা দিলাম। অর্ধেক পথ যেতেই আমার বন্ধুর ফোন,

‘ছেলেকে পাওয়া গেছে।’ ঘড়িতে তখন প্রায় পাঁচটার মতো বাজে।

স্কুলঘরে বিমানটি যখন আছড়ে পড়ে, সায়ের তখন ক্লাসরুমেই ছিল। লম্বা দোতলা ভবনের মাঝবরাবর সিঁড়ি। দুই দিকে ছয়টি করে ১২টি রুম। দোতলার উত্তর পাশে ৫ নম্বর কক্ষে আমার ছেলে ছিল। নিচতলায় বিমান ঢুকে পড়ার পর ওদের ১ ও ২ নম্বর রুমের কারও পোশাক, কারও চুল পুড়েছে। পাশের ঘরেও কয়েকজন মারা গেছে। ওই সময় সায়েরদের ক্লাসরুমে সাঈদ নামের একজন শিক্ষকও ছিলেন। শিক্ষার্থীদের সঙ্গে নিয়ে তিনি পেছন দিকের গ্রিলের একটা অংশ ভেঙে ফেলেন। ওই গ্রিলের মধ্যেই নাকি একটা ছোট্ট দরজার মতো আছে, হয়তো এ ধরনের কোনো জরুরি অবস্থার কথা ভেবেই বানানো হয়েছিল। তবে নিরাপত্তার কারণে সেটা তালা দেওয়া থাকত। সায়েরদের নিয়ে সেই তালাই ভেঙেছিলেন শিক্ষক। তারপর ওই শিক্ষকের সহযোগিতায় ছাত্ররা এক এক করে দোতলা থেকে একটি আমগাছ বেয়ে নিচে নেমে আসে। নিরাপত্তার কথা ভেবে তাদের পাশের ক্যানটিনে রাখা হয়। সেখান থেকে সায়ের আমাদের ফোন করার চেষ্টা করেছিল, কিন্তু নেটওয়ার্ক-জটিলতায় পায়নি।

চারটার পর ওদের সেখান থেকে বের হতে দেয়। ছেলে বাইরে বেরিয়ে বাসার দিকে আসতে থাকে। একটি অচেনা লোক বাড়ির পথে যেতে ওকে সাহায্য করে। সায়েরকে নিয়ে হেঁটে হেঁটে মেডিকেলের পথেই আসছিলেন অচেনা সেই ব্যক্তি। তখনই হঠাৎ ছেলের ওপর ওর মায়ের চোখ পড়ে। দৌড়ে ছেলেকে বুকে টেনে নিয়েছে ও। বন্ধুর ফোন পেয়ে আমিও সেখানে চলে এলাম। ছেলেকে জড়িয়ে ধরে মনে হলো, এর চেয়ে শান্তির জায়গা আর হয় না। তবে যেসব মা-বাবার বুক খালি হলো, যাঁদের সন্তানেরা এখনো হাসপাতালে, তাঁদের কথা ভেবে বুকটা কেঁপে ওঠে। চোখ থেকে অঝোরে পানি ঝরে।

লেখক: সেলিম জাহিদ, প্রথম আলোর বিশেষ প্রতিনিধি

  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়