প্রকাশ : ২৩ জানুয়ারি ২০২৪, ০০:০০
আধুনিক শিক্ষা, প্রযুক্তি ও অনুশীলন
মানবমস্তিষ্ক বড়ই জটিল। এই মস্তিষ্ক ব্যবহার করে মানুষ চাঁদে গেছে, পিরামিড তৈরি করেছে, জটিল রোগের প্রতিষেধক তৈরি করেছে। আবার এই মস্তিষ্কই পাঁচ থেকে ছয় মিনিট পরপর ফেসবুকে ঢুঁ মারতে বলছে। বর্তমান সময়ে গুগলে বাংলায় ‘মনোযোগ’ শব্দটি লিখলে বেশ কয়েকটি সাজেশন চলে আসে। সেগুলি হলো, ‘মনোযোগ ধরে রাখার উপায়, মনোযোগী হওয়ার উপায় ও মনোযোগ দিয়ে পড়ার উপায়’। বুঝতেই পারছেন বর্তমান যুগে মনোযোগ-বিয়োগ নিয়ে সবার উদ্বিগ্নতা হাজার গুণ বেড়ে গেছে।
আসুন একটু গভীরভাবে নিজেকে বিশ্লেষণ করি, একটা বই বা যে-কোনো প্রতিবেদনের অনেকগুলো পাতা একনাগাড়ে কবে শেষ করেছি? লিখতে গিয়েও একই অবস্থা। কয়েক লাইন লেখার পরই থেমে যেতে হচ্ছে। ভাবতে গেলেও তা-ই। ভাবনাগুলো দীর্ঘ ও গভীর হওয়ার আগেই অন্য ভাবনা এসে জায়গা করে নিচ্ছে। হারিয়ে যাচ্ছে আগেরটি। হয়তো আপনি পারছেন। কিন্তু অনেকেই পারছেন না।
সামগ্রিকভাবে আমাদের মনঃসংযোগ কমতে শুরু করেছে। মাইক্রোসফটের অর্থায়নে পরিচালিত এক গবেষণায় দেখা গেছে, ২০০০ সালে এক জন মানুষ কোনো বিষয়ে একটানা গড়ে ১২ সেকেন্ড মনঃসংযোগ করতে পারতেন। ২০১৫ সালে এসে দাঁড়িয়েছে মাত্র ৮ সেকেন্ডে। ইউনিভার্সিটি অব ক্যালিফোর্নিয়ার বিজ্ঞানীরা দেখতে পেয়েছেন, কাজের জায়গাতে কোনোভাবেই কর্মীরা একটানা ৭৫ সেকেন্ডের বেশি কম্পিউটারের একই স্ক্রিনে মনঃসংযোগ করতে পারছে না। কোনো কিছু টাইপ করতে গিয়ে এক ওয়েবসাইট থেকে কিছুক্ষণ পরই আরেক ওয়েবসাইটে চলে যাচ্ছেন। মুঠোফোন আর সামাজিক যোগাযোগের বিভিন্ন মাধ্যমের অতি ব্যবহার এর প্রধান কারণ বলে মনে করা হচ্ছে। সাম্প্রতিক এক আমেরিকান গবেষণায় দেখা গেছে, দৈনিক গড়ে চার ঘণ্টা এক জন মানুষ মুঠোফোনে চোখ রাখছেন। সকালে ঘুম থেকে উঠে, ঘুমোতে যাওয়ার আগে, এমনকি ঘুম থেকে জেগে মধ্যরাতে ফোনে চোখ পড়ছে। দৈনিক গড়ে ৮৫ বার এক জন মানুষ মুঠোফোনের সংস্পর্শে আসছেন।
বর্তমান যুগে ছোট, বড়, বৃদ্ধ সকলের মধ্যে সাংঘাতিক এক মানসিক প্রতিযোগিতা বিদ্যমান। প্রতিদিন নিত্যনতুন কৌশল বের হচ্ছে প্রযুক্তির কল্যাণে। এ বলছে আমায় দেখো, ও বলছে আমাকে। এ বলছে আমারটা শোনো, ও বলছে আমারটা না শুনলে পিছিয়ে গেলে, সমাজে তোমার আর কোনো মানই রইল না। বিজ্ঞান, বাণিজ্য ও বিপণনের কত শাখা গড়ে উঠেছে এই মনোযোগকে কেন্দ্র করে। মনোযোগের বাজারমূল্য অনেক। ভার্চ্যুয়াল দুনিয়ায় আমি, আপনি অধিকাংশই আমরা এখন বিনামূল্যের শ্রমিক। আমাদের অতি মূল্যবান মনঃসংযোগ অন্যকে দিচ্ছি। ঘণ্টার পর ঘণ্টা ফেসবুকে রিলস বা ইউটিউবের কনটেন্ট দেখে অন্যকে ধনী করছি। বিনামূল্যের শ্রমঘণ্টার আকার আমাদের জীবনে চক্রকারে বৃদ্ধি পাচ্ছে। নিজের সৃজনশীলতা বৃদ্ধির জন্য একান্ত মনঃসংযোগ দিয়ে কোনো কিছু অনুধাবন ও পড়ার জন্য যে সময় দেওয়া দরকার, তা কোনোভাবেই দেওয়া সম্ভব হচ্ছে না, যা একটি জাতিকে পিছিয়ে দেওয়ার জন্য যথেষ্ট।
কোনো সভা, সেমিনার বা বক্তৃতায় গিয়ে একটি বিষয় গভীরভাবে অবলোকন করি যে, সামনের চেয়ারে বসে বক্তব্য না শুনে অনেকেই নিবিষ্ট মনে মোবাইল স্ক্রল করে চলেছে। অতি উচ্চ পর্যায়ের সভা, সেমিনার যেখানে একাধিক মন্ত্রী উপস্থিত আছেন এবং কোনো গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে প্রেজেন্টেশন চলছে, এমন অবস্থাতেও আমি প্রেজেন্টেশনের দিকে মনোযোগ না দিয়ে অনেককে মোবাইল ফোন স্ক্রল করতে দেখেছি। বাস্তবে মনঃসংযোগের এমন বেহাল দশা দেখে আমার প্রায়ই মনে হয়, এই মানুষগুলো যদি তাদের ছাত্রজীবনে শিক্ষা গ্রহণের সময় এমন অমনোযোগী থাকতেন, তাহলে তারা আজকের এই অবস্থানে পৌঁছাতে পারতেন কি?
সন্ধ্যায় নিজ সন্তানদেরকে পড়তে বলে নিজে দেদার মোবাইলে স্ক্রল করে চলেছি। এমন পরিবেশে সন্তানেরা পড়াকে বেশি গুরুত্ব দেবে কীভাবে? কারণ সন্তানেরা শেখে তাদের পরিবার থেকে। পিতা-মাতার মোবাইল স্ক্রল-প্রীতি সন্তানের জীবনদর্শনে শিক্ষার চেয়ে ভার্চ্যুয়াল দুনিয়াকে গুরুত্ববহ করে তুলছে। একই অবস্থা পরিলক্ষিত হয় পরীক্ষায় প্রত্যবেক্ষকের দায়িত্বপ্রাপ্ত শিক্ষকদের মধ্যে। তারা পরীক্ষার হলে শিক্ষার্থীদেরকে মোবাইল নিয়ে ঢুকতে দেন না; কিন্তু পরীক্ষা চলাকালীন তিন ঘণ্টা সময়ের বেশির ভাগ সময় নিজেদের মোবাইলে ভার্চ্যুয়াল দুনিয়ায় বিভোর হয়ে থাকেন। এই অবস্থার পরিবর্তন ছোট থেকে নয়, শুরু করতে হবে বড়দের মধ্য থেকে। আমার সন্তানেরা যখন আমার হাতে অবসর সময়ে বই দেখবে, তখন তারা বই পড়তে অভ্যস্ত হবে বা অবসর সময়ে বই পড়াটা স্বাভাবিক বলে ধরে নেবে। আমি দ্ব্যর্থহীন কণ্ঠে ঘোষণা করতে পারি, বই পড়া ছাড়া সুনাগরিক গড়া সম্ভব নয়। কারণ বই হলো ইতিবাচক ও চিন্তাশীল মানুষের একাগ্র চিত্তের ভাবনাগুচ্ছের নির্যাস, যা পাঠকের জীবনকে সুগন্ধময় ও সুশোভিত করে। কেবল বই পড়লেই মানবমস্তিষ্কের বয়স মানুষের স্বাভাবিক বয়সের চেয়ে অনেকগুণ বৃদ্ধি পায়। ফলে সেই মানুষগুলি সমাজ ও পৃথিবীর জন্য ভার না হয়ে মানবসম্পদ হয়ে ওঠে। বই পড়ার অভ্যাস গড়ে ওঠে শিশুকাল থেকে। পাঠ্যবইসহ গল্প-উপন্যাস, সায়েন্স ফিকশন, বিজ্ঞান ও গণিতভিত্তিক যে-কোনো বই-ই মনোযোগ দিয়ে পড়ার জন্য অনুকূল পরিবেশ তৈরি করতে হবে। এজন্য প্রতিটি পরিবারে গড়ে তুলতে হবে সর্বোপরিসরে ছোট আকারের পাঠাগার। পরিবার ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান পর্যায়ে অনুশীলন করতে হবে সফলতার সঠিক জীবনবোধ। বই পড়ার অভ্যাস গড়ে তুলতে পারলেই মানুষকে জাগিয়ে তোলা সম্ভব। সে নিজেই হতে পারে জ্ঞানের বিশ্বকোষ। এভাবেই গড়ে উঠবে জাতি, সমৃদ্ধ হবে দেশ। সফলতার সুষমায় উদ্ভাসিত হবে প্রতিটি জীবন ও পরিবার।
আগামীর জ্ঞানভিত্তিক অর্থনীতিতে জায়গা করে নিতে হলে মনোযোগ ধরে রাখাটা অত্যন্ত জরুরি। মনঃসংযোগ বাড়ানোর বিভিন্ন উপায় নিয়ে অনেক গবেষণা হচ্ছে। বলা হচ্ছে, কাজের সময় মনঃসংযোগ নষ্ট করে, এমন জিনিস, যেমন মুঠোফোন দূরে সরিয়ে রাখা উচিত। একসঙ্গে একাধিক নয়, একটি কাজ করতে হবে। নিয়মিত শরীরচর্চা এবং প্রকৃতির সঙ্গে যোগাযোগও মনঃসংযোগ বাড়াতে সাহায্য করে।
আরেকটি বিষয় আমরা ভুলতে বসেছি, তা হলো সূর্যের আলোর উপকারিতা। ধনী, দরিদ্র সবাই আমরা এখন সূর্যের আলোকে ভয় পাই। কেউই সূর্যের আলো গায়ে মাখতে স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করি না। তাই হয়তো আমাদের দেশে প্রায় ৮০ শতাংশ মানুষ ভিটামিন ডি-এর স্বল্পতায় ভুগছে। আমাদের মতো সূর্যকিরণময় দেশেও আজকাল নাকি ভিটামিন ডি-এর ক্যাপসুল খেয়ে ভিটামিন ডি-এর ঘাটতি পূরণ করতে হয়। অথচ ভিটামিন ডি-এর স্বল্পতা আমাদের মাদকাসক্তির প্রবণতা থেকে শুরু করে ক্যানসার, হূদেরাগ, লিভার, জয়েন্টে ব্যথা, স্থুলতা, হতাশা, অমনোযোগিতা এবং ঠান্ডা লাগার জন্য দায়ী। এত কিছু জেনেও আমরা সূর্যের আলোবিমুখ। কোনোভাবেই সূর্যের আলো শরীরে পড়তে দিতে চাই না।
সবার জন্য মনোযোগ বাড়ানোর কৌশল জানা ও অনুশীলন একান্ত কাম্য। ভার্চ্যুয়াল ভাবনার এই যুগে মনঃসংযোগে যারা এগিয়ে আছে, তারাই সাফল্য পাবে। মনঃসংযোগ বাড়াতে পারলেই একাগ্র চিত্তে পড়া সম্ভব। অনুশীলনেও চাই নিবিষ্ট মন। এভাবেই শিক্ষা রূপ নেবে সফলতায়।
লেখক : উপাচার্য, চাঁদপুর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়।