শুক্রবার, ২০ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ৫ আশ্বিন ১৪৩১, ১৬ রবিউল আউয়াল ১৪৪৬  |   ২৯ °সে
আজকের পত্রিকা জাতীয়আন্তর্জাতিকরাজনীতিখেলাধুলাবিনোদনঅর্থনীতিশিক্ষাস্বাস্থ্যসারাদেশ ফিচার সম্পাদকীয়
ব্রেকিং নিউজ
  •   চাঁদপুর শহরের পাঁচ রাস্তার মোড়ে 'আল্লাহু চত্বর'
  •   চাঁদপুর কণ্ঠৈর কলামিস্ট এএসএম শফিকুর রহমানের ইন্তেকাল
  •   নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটের দায়িত্ব পেল সেনাবাহিনী
  •   জুলাই শহীদ স্মৃতি ফাউন্ডেশনে’ প্রধান উপদেষ্টার ১০০ কোটি টাকার অনুদান
  •   মেঘনায় নিখোঁজ দুই ভাইয়ের মরদেহ উদ্ধার

প্রকাশ : ০২ জুন ২০২৪, ০০:০০

চাঁদের মোহনা

মিরন নাজমুল
চাঁদের মোহনা

বাড়ি ছেড়েছিলাম ১৯৯৭ সালে। জীবন যুদ্ধে নামতে সব ছেলেকেই একদিন বাড়ি ছাড়তে হয়। অনেক বেশি পারিবারিক শাসনে বড় হয়েছি। কানে হাত ধরে এক পা তুলে দাঁড়িয়ে থাকার মতো শাস্তি আমার জন্যে ডাল-ভাত ছিলো। আরো বড়ো বড়ো শাস্তি পেতে হতো বড়োভাইয়ের হাতে। এমন সন্ধ্যা খুব কম কেটেছে যে, মাগরিব নামাজের জন্যে মায়ের দৌড়ানি খাইনি।

পারিবারিক নজর আর শাসনের গণ্ডি পেরিয়ে চাঁদপুর শহরে নতুন এসেছি। অভিভাবকহীন কেমন যেনো ফাঁকা ফাঁকা একটা অনুভূতি। পারিবারিক নজরদারি নেই, মা-বাবা, বড়োভাইয়ের শাসন নেই। তবে ছোটবেলা থেকে পাওয়া পারিবারিক অনুশাসন আমাকে সারাটা জীবনই পিছু তাড়া করেছে। সেই বিবেকবোধের কারণে খারাপ হতে, খারাপ কিছু করতে নিজের মধ্যে একটা বাধা অনুভব করেছি সব সময়।

চাঁদপুর তখন খুব ছোট এক শহর। ছবির মতো সুন্দর লাগতো আমার কাছে। ফুরফুরে মন নিয়ে, ফাল্গুনী রাতের ভরা জ্যোৎস্নায় বড় স্টেশনে গিয়ে যে পদ্মা-মেঘনা আর ডাকাতিয়ার মিলন দেখেনি তার জনম বৃথা।

শহরের বিপণীবাগ বাজারের উল্টোতে গলি দিয়ে একটু ভেতরে গেলেই রহিম খাঁর মেস। মেস জীবনে আমাদের মহান কীর্তিকলাপের কথা তুলতে গেলে লেখা বড়ো হয়ে যাবে। সেই গল্প অন্য সময়ের জন্যে তোলা থাকলো।

শহরে বড়ো কোনো স্থাপনা বলতে আমার কাছে চাঁদপুর সরকারি কলেজটাকেই বেশি চোখে পড়তো। সদ্য অনার্সে ভর্তি হয়েছি কলেজে। মেস থেকে বেরিয়ে কুমিল্লা রোডে একটু হেঁটে সামনে আসলেই নাজিরপাড়া রোড। সেই রোডের শুরুতে ডান পাশে মানুষ গড়ার কারিগর চাঁদপুর সরকারি কলেজ গেইট, আর রোডের একটু বামদিকে গিয়ে উল্টো পাশেই ছিলো চাঁদপুরের সংবাদ মাধ্যমের প্রধান দিকপাল চাঁদপুর কণ্ঠের কার্যালয়।

পারিবারিক অনুশাসন থেকে সদ্য বেরিয়ে আসা একটি ছেলের মেসের দরজা থেকে রাস্তায় হাঁটার দূরত্বের পর গন্তব্য হচ্ছে পাশাপাশি থাকা কলেজ এবং পত্রিকা অফিসের মতো গুরুত্বপূর্ণ দুটো প্রতিষ্ঠান, যা মানুষকে আরো মানুষ হতে শেখায়। আমি সেটা পেয়েছিলাম বলে গর্ব অনুভব করি। আমি নিজের পরিবার ছেড়ে নতুন শহরে এসে চাঁদপুর কণ্ঠ পরিবারে প্রবেশ করি। তখন থেকেই শুরু হয় আমার সাংবাদিকতা ও লেখালেখির জীবন।

তখন চাঁদপুর কণ্ঠের ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক কাজী শাহাদাত ভাইকে আমি নতুন অভিভাবক হিসেবে পেয়েছিলাম। তাঁর সম্পাদনা জীবনের শুরুর দিকটি আমি দেখেছি, সেটা আমার সৌভাগ্য বলতে পারি। তাঁর কাজের প্রতি সে কী একাগ্রতা, দায়িত্বশীলতা! হাতে ধরে তিনি আমাদের বাংলা বানান থেকে শুরু করে সম্পাদনার কাজ শিখিয়েছেন।

আমি যখন পত্রিকাটির সাথে সম্পৃক্ত হই, তখন চাঁদপুর কণ্ঠ সাপ্তাহিক পত্রিকা ছিলো, বের হতো লেটার প্রেস থেকে। সেই সময়টা মূলত শুধু চাঁদপুর নয়, বরং সারা বাংলাদেশেই লেটার প্রেস থেকে বেরিয়ে আধুনিক অফসেট প্রেসে পত্রিকা প্রিন্ট হওয়ার সন্ধিক্ষণ ছিলো। এর মধ্যে এক বছর পরে ১৯৯৮ সালে সারাদেশে প্রবল বন্যা হলো। চাঁদপুর শহরের প্রধান রাস্তাঘাটে পানির গড়াগড়ি। আমার যেটুকু মনে আছে, সে সময় চাঁদপুর কণ্ঠ অফিসও বন্যার কবল থেকে রেহাই পায়নি। এতো সব প্রতিকূলতাকে সামলে নিয়ে কাজী শাহাদাত ভাই পুরো চাঁদপুর কণ্ঠ পরিবারকে সাথে নিয়ে নিয়মিত পত্রিকা বের করেছেন।

এর মধ্যে পত্রিকা অফিস নতুন জায়গা পরিবর্তন করেছে। অফসেট প্রেসে পত্রিকা বের হওয়া শুরু হয়েছে। ভোর রাতে পত্রিকা প্রিন্ট হলে অনেক সময় হাতাহাতি করে পত্রিকা ভাঁজ করা হতো পত্রিকা বিলি করার জন্যে। মাঝে মধ্যে সে কাজে আমিও অংশীদার হয়েছি। নতুন পত্রিকার গায়ে নিজের লেখাটা দেখতাম। সদ্য ছাপানো পত্রিকা, নাকে প্রেসের কালির ঘ্রাণ পেতাম।

১৯৯৮ ও ১৯৯৯ সাল চাঁদপুরের সাংবাদিকতার ইতিহাসে একটি মাইলফলক। বিশেষ করে ১৯৯৯ সালের জানুয়ারি মাস। এই মাসেই চাঁদপুর কণ্ঠ চাঁদপুরের প্রথম দৈনিক পত্রিকা হিসেবে আনুষ্ঠানিকভাবে আত্মপ্রকাশ করে। সাপ্তাহিক থেকে দৈনিকে রূপান্তর মানে প্রায় এক সপ্তাহের পত্রিকার কাজের সমান একদিনে এসে জমা হতো। তখন বড়ো অফিসের প্রয়োজন ছিলো। এর মধ্যে পত্রিকা অফিস রেলওয়ে হকার্স মার্কেট থেকে স্থানান্তরিত হয়ে গুয়াখোলা চলে এলো। সুন্দর বিল্ডিংয়ে নতুন বড়ো অফিস। প্রতি সন্ধ্যা থেকে মাঝ রাত পর্যন্ত কাজের চাপ। তিনটি কম্পিউটারে কাজ হতো। পুরো টিম নিয়ে কাজী শাহাদাত ভাই কাজ সামাল দিতেন।

সন্ধ্যারাতে চাঁদপুরের বিশেষ ব্যক্তিবর্গ, কবি-লেখক, সংস্কৃতিকর্মীগণ অফিসে আসতেন। কাজের ফাঁকে তাদের সাথে দারুণ আড্ডা হতো। আমাদের অফিস স্টাফ হেলাল বুট, পিঁয়াজু দিয়ে মুড়ি বানাতো। সেই স্বাদ এখনও আমি খুঁজে বেড়াই।

মাঝ রাতের পরে কাজের চাপ একটু কমলে পাশের চাঁদপুর হোটেলে গ্রুপ বেঁধে চলে যেতাম। রাতে গরম পরোটা, ডিম ভাজি, সবজি, মাংস কতো যে স্বাদ করে খেতাম! এভাবে ফজরের আগ পর্যন্ত কেটে যেতো পত্রিকা অফিসে। পত্রিকার পেস্টিং শেষ হবার পরে প্রেসের উদ্দেশ্যে পাঠিয়ে তারপর অফিস বন্ধ করাতেন কাজী শাহাদাত ভাই।

বর্তমান সময় সাংবাদিকতার ধরণ, প্রকৃতিতে অনেক পরিবর্তন দেখি। পরিবর্তন এসেছে সংবাদ মাধ্যমের প্রকাশনায়। প্রিন্ট পত্রিকার জায়গায় এখন অনলাইন পত্রিকার দিন। মানুষ মুঠোফোনে বা মনিটরে সংবাদ দেখেন বেশি। যখন ঘটনা, তখন সংবাদের দিন এখন। এই প্রতিযোগিতার জন্যে তথ্যবিভ্রাট হয়। অনেক আজগুবি তথ্যও ঢুকে পড়ে সংবাদে।

আর আমি যে সময়ের কথা বলছি, সেই সময় মানুষ সংবাদের পাতায় খবর খুঁজতো। সাথে সাথে সঠিক খবর পাবার অন্য কোনো মাধ্যম না থাকায় মানুষ প্রতি সকালে প্রবল আগ্রহে সংবাদপত্র খুঁজতো। গণমাধ্যমকর্মীরা রাত জেগে পাঠকের জন্যে অনেক যত্ন করে সংবাদ ছাপাতো পত্রিকায়। যাতে আগের দিনের সংবাদগুলো সকাল সকাল পাঠক জানতে পারেন। রাতের মধ্যে কোনো ঘটনা ঘটলে সেটার সর্বশেষ আপডেট দিয়ে পত্রিকা ছাপানো হতো।

চাঁদপুর কণ্ঠ যখন প্রথম দৈনিক হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে, তখন মূল পরিবারে আমরা ২৪ জন ছিলামণ্ড-সম্পাদকম-লীর সভাপতি ফ্লাঃ লেঃ (অবঃ) এস. এ সুলতান টিটু, প্রতিষ্ঠাতা সম্পাদক অ্যাডভোকেট ইকবাল-বিন-বাশার ভাই, প্রধান সম্পাদক কাজী শাহাদাত ভাইসহ অ্যাডঃ শাহ্ মোঃ ওবায়েদুল্যা ভাই, এম. এম. এ. বাতেন ভাই, আলম পলাশ ভাই, গিয়াস উদ্দিন মিলন ভাই, মাহবুবুর রহমান সুমন ভাই, নজরুল ইসলাম স্বপন ভাই, রাশেদ শাহরিয়ার পলাশ ভাই, রোকনুজ্জান রোকন ভাই, আব্দুল গনি ভাই, শাহ্ মোঃ সেলিম ভাই, খালিদ সোহেল, নুর আহমেদ নুরু ভাই, মহিউদ্দিন সরকার, আবু সাঈদ কাউসার, আমি নাজমুস শাহরিয়ার মিরন, শাহআলম মল্লিক ভাই, নজরুল ইসলাম, টিএম দেলোয়ার ভাই, শফি মাহমুদ, বোরহান ও হেলাল গাজী।

এরপর যতো সময় গড়িয়েছে, আমরা এই পরিবার থেকে বাস্তবতার টানে বিচ্ছিন্ন হয়ে চলে যেতে হয়েছে যার যার গন্তব্যে। তবুও আমার কল্পনায় কেবলই মনে হয়, আমাদের সেই সময়টাই ছিলো দৈনিক চাঁদপুর কণ্ঠের স্বর্ণযুগ।

চাঁদপুর কণ্ঠ ছেড়ে চলে আসলেও মনের মধ্যে লালন করেছি আমার জীবনের সেই সুন্দর ও হিরন্ময় অধ্যায়। চাঁদপুর কণ্ঠও আমাকে মনে রেখেছে। আর সে জন্যেই শ্রদ্ধাভাজন কাজী শাহাদাত ভাই আমাকে লিখতে বলেছেন। আর আমিও ২ যুগ আগের স্মৃতির ঝাঁপি খুলে লেখার জন্যে মন থেকেই একটি নিবিড় টান অনুভব করলাম। সেই টান ভালোবাসার, আমার ফেলে আসা সোনালি অতীতের।

লেখক : স্পেন প্রবাসী।

  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়