প্রকাশ : ০৭ জুন ২০২৪, ০০:০০
দৈনিক চাঁদপুর কণ্ঠ : অন্তরে নিরন্তর
আধুনিক মানুষের জন্যে সংবাদপত্র অপরিহার্য হলেও করোনা অতিমারি এসে সেই সংবাদপত্রের মুদ্রিতরূপকে প্রায় বিলুপ্তির আশঙ্কায় নিয়ে পৌঁছিয়েছিলো। কেউ কেউ প্রথম দিকে না জেনে এ কথা চাউর করেছিলো যে, সংবাদপত্রের মাধ্যমেও করোনা ভাইরাসের বিস্তারণ ঘটে। ফলে অনেক সংবাদপত্রপ্রেমী পরিবারে জীবনের সুরক্ষায় মুদ্রিত খবরের কাগজকে না করে দেওয়া হয়েছিলো। এর পরিণামে সংবাদপত্রসমূহ বিপুল আর্থিক ক্ষতির সম্মুখীন হয়। জনবল কমিয়ে এনেও অনেকের পক্ষে নিজেদের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখা কঠিন হয়ে পড়ে। করোনা অতিমারির সঙ্কটকে জয় করে টিকে থাকা মুদ্রিত পত্রিকার একটি হচ্ছে চাঁদপুর কণ্ঠ, যা মফস্বলে থেকেও সগৌরবে আজ তিরিশ বছর অতিক্রম করেছে। দিন যতই গড়াচ্ছে, সংবাদপত্র মুদ্রিতরূপ থেকে ধীরে ধীরে পাঠকের হাতের মুঠোয় ঢুকে যাচ্ছে এবং প্রায় ঢুকে গেছে বলা যায়। আগে মুদ্রিত খবরের কাগজ হাতে পেতে সকালে সূর্যোদয়ের প্রতীক্ষা করতে হতো। আর এখন রাতগভীরে তরতাজা সংবাদ চলে আসে হাতের মুঠোফোনে। পাঠক পড়তে না চাইলেও নিউজফিডের সতর্কীকরণের কারণে প্রতিটি সংবাদ এখন নজরে আসে। বলা ভালো, নজরে আনতেই হয়। মুদ্রিত সংবাদপত্র একটার বেশি হাতে নিয়ে পড়া সম্ভব না হলেও হাতের মোবাইলে একাধিক সংবাদপত্র ঢুকে যায় তাদের সংবাদণ্ডপণ্য নিয়ে। ফলে মুদ্রিতরূপের সংবাদপত্রের আজ বড়ো আকালের দিন। আকালের এমন দিনকে কৃতিত্ব আর সাহসে মোকাবেলা করে তিরিশ বছরের তরতাজা যুবকে পরিণত হয়েছে চাঁদপুরের প্রথম পূর্ণাঙ্গ দৈনিক পত্রিকা, ‘দৈনিক চাঁদপুর কণ্ঠ’। পাঠক, লেখক এবং উপদেষ্টা হিসেবে এই পত্রিকার সাথে আমার বন্ধন গাঢ় এবং নিবিড়। তিরিশ বছরের যাত্রাপথে পত্রিকাটি পার হয়েছে অসংখ্য চড়াই-উতরাই। একটি সত্য চাঁদপুরে সবাই অকপটে স্বীকার করেন, দৈনিক চাঁদপুর কণ্ঠ হলো চাঁদপুরে সাংবাদিক গড়ে-পিঠে তৈরি করার এক চলমান কারখানা। এখানে কাজ শিখে অনেকেই আজ শুধু চাঁদপুরের স্থানীয় পত্রিকার নয় বরং ঢাকায় জাতীয় সংবাদপত্রের সম্পাদক হিসেবেও নিজের আত্মপ্রকাশ ঘটিয়েছেন।
একটি মানসম্পন্ন যুগোপযোগী সংবাদপত্রের দায়িত্ব কেবল সংবাদকে পণ্য করে বাণিজ্যে লক্ষ্মীর বসতকে নিশ্চিত করা নয়, বরং সমাজে সারস্বত সুন্দরকে বিনির্মাণকল্পে সরস্বতীর সেবায় ব্রতী হওয়াও সংবাদপত্রের পবিত্র দায়িত্ব। সমাজে পাঠক তৈরির পাশাপাশি লেখক তৈরি করাটাও সংবাদপত্রের একটা গুরুদায়িত্ব। একটা বহুল প্রচারিত সংবাদপত্র নানাবিধ উপায়ে লেখক তৈরি করতে পারে। তিরিশ বছর বয়সী দৈনিক চাঁদপুর কণ্ঠ লেখক তৈরির ক্ষেত্রে অত্যন্ত সফল একটি প্রতিষ্ঠান। শুধু যে সংবাদ প্রতিবেদন রচয়িতা তাই নয় বরং নিয়মিত সম্পাদকীয়, উপ-সম্পাদকীয়, চলমান বিষয়ে রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক কলাম লিখিয়েদের জন্যে দৈনিক চাঁদপুর কণ্ঠ একটি বড় ও বিশ্বস্ত মঞ্চ হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেছে। পাশাপাশি পাঠক ফোরামের পাতার মাধ্যমে পাঠককে লেখক বানানোর ক্ষেত্রেও দৈনিক চাঁদপুর কণ্ঠ চাঁদপুরে অগ্রণী ভূমিকা পালন করে চলেছে। যারা নব্য লিখিয়ে, তাদের জন্যে দৈনিক চাঁদপুর কণ্ঠের পাঠক ফোরাম পাতাটি লেখক তৈরির একটি চমৎকার বীজতলা হিসেবে নিজেদেরকে তুলে ধরতে পেরেছে। পাশাপাশি দৈনিক চাঁদপুর কণ্ঠের সাহিত্য পাতা নামের পাতাটি প্রতিষ্ঠিত সাহিত্যিকদের লেখাকে আরো শাণিত করার এক নান্দনিক শিল্পমঞ্চ। পাঠকের সাথে লেখকের সেতুবন্ধ হিসেবে দৈনিক চাঁদপুর কণ্ঠ একটি উৎকৃষ্ট যোগাযোগ মাধ্যম। লেখকের একটি ভালো কবিতা, প্রবন্ধ বা গল্পকে মানুষের দুয়ারে দুয়ারে পৌঁছে দিতে দৈনিক চাঁদপুর কণ্ঠের সাহিত্যপাতা মাতৃস্থানীয়া ভূমিকা পালন করেছে। চাঁদপুর কণ্ঠের একটি অনন্য উদ্যোগ হলো 'বিতর্কায়ন'। এর মাধ্যমে নতুন একটি সাহিত্য শাখার উদ্বোধন ঘটেছে। বিতর্ক শিল্পকে কেন্দ্র করেও যে বিতর্ক-সাহিত্য হতে পারে তা দৈনিক চাঁদপুর কণ্ঠ ‘বিতর্কায়ন’-এর মাধ্যমে দেখিয়ে দিয়েছে। এই প্রকাশনাটি দৈনিক চাঁদপুর কণ্ঠের একান্ত নিজস্ব উদ্ভাবন। 'বিতর্কায়ন' কেবল ক্রোড়পত্রে সীমাবদ্ধ না থেকে বিতর্ক প্রতিযোগিতার নিজস্ব প্রকাশনায় পরিণত হয়েছে। এই 'বিতর্কায়ন' প্রকাশনাই উপহার দিয়েছে 'বিতর্ক সমগ্র' নামে বিতর্কের একটি আকর গ্রন্থকে।
তিরিশ বছরের যাত্রাপথে দৈনিক চাঁদপুর কণ্ঠ কোনো কোনো দিন দ্বিভাষিক পত্রিকা হিসেবেও নিজেকে প্রকাশ করেছে। এতে বাংলায় সংবাদ প্রকাশের পাশাপাশি ইংরেজিতে রচিত প্রবন্ধও প্রকাশিত হয়েছে। এক্ষেত্রেও দৈনিক চাঁদপুর কণ্ঠ অনন্য ও অদ্বিতীয়। 'সওগাত' সম্পাদক নাসিরউদ্দীন তাঁর পত্রিকায় যেমন নারীদের অগ্রাধিকার দিতেন, তেমনি দৈনিক চাঁদপুর কণ্ঠও 'নারীকণ্ঠ' শিরোনামে নারী সাহিত্যিকদের জন্যে আলাদা একটি ক্ষেত্র তৈরি করে দিয়েছে। নারীর ক্ষমতায়ন ও স্মার্ট বাংলাদেশ বিনির্মাণে দৈনিক চাঁদপুর কণ্ঠ তার নাগরিক দায়িত্ব অত্যন্ত সুচারুভাবে পালন করে চলেছে।
জন্মকালে 'দৈনিক চাঁদপুর কণ্ঠ' রাজনৈতিক মতাদর্শের প্রকাশকের হাতে পড়লেও তার যাত্রা যতই সামনে এগিয়ে গেছে ততই সে নিজেকে নিরপেক্ষ রাখার ব্রতে অটল থেকেছে এবং এর ফলে এখনও দৈনিক চাঁদপুর কণ্ঠ সকল মতাদর্শের কাছে, দল-মত নির্বিশেষে গ্রহণযোগ্যতা বজায় রেখেছে। পত্রিকাটির সম্পাদক-প্রকাশক যেমন নিরপেক্ষতা বজায় রাখার প্রশ্নে যত্নশীল, তেমনি প্রধান সম্পাদকও তাঁর সম্পাদকীয় নীতিমালায় কোনো রাজনৈতিক মতাদর্শের দিকে ধাবিত হননি। ফলে এখনো পাঠক এই পত্রিকা পাঠে যে তৃপ্তি পায় তা অসাধারণ।
দৈনিক চাঁদপুর কণ্ঠ কেবল একটি সংবাদ মাধ্যম তা নয়, বরং এটি একটি জীবন্ত আর্কাইভ। নিজস্ব ওয়েবসাইটে প্রকাশিত লেখাগুলো বছরের পর বছর জেগে থাকে অতন্দ্র প্রহরীর মতো। তিরিশ বছরের পথ পরিক্রমায় দৈনিক চাঁদপুর কণ্ঠ গর্ববোধ করে বলতে পারবে, তারা জাতীয় রবীন্দ্র সংগীত সম্মেলন আয়োজনে মুখ্য ভূমিকা পালন করেছে। জেলা ব্র্যান্ডিং, জেলা কমিউনিটি পুলিশিং ইত্যাদি সকল সম্ভাবনাময় কর্মযজ্ঞের সাথে তারা সক্রিয় ছিলো। বিতর্ককে তৃণমূল পর্যায়ে চাঁদপুর জেলাব্যাপী জনপ্রিয় করে তোলার ক্ষেত্রেও চাঁদপুর কণ্ঠ অনন্য ও অদ্বিতীয়।
সাদাকালো এবং রঙিন এই দুরকম বর্ণের সমন্বয়ে বর্তমান সময়ে প্রকাশিত দৈনিক চাঁদপুর কণ্ঠ নিজেদেরকে সবসময় পাঠকের পত্রিকা বলে প্রতিষ্ঠিত করতে পেরেছে । তাই পাঠকের রুচির বিপরীতে গিয়ে কখনো এই পত্রিকাটিকে দাঁড়াতে দেখা যায়নি। এই পত্রিকাটি অসাম্প্রদায়িক চেতনাকে সর্বতোভাবে লালন করে। ঈদের সময় যেমন ঈদ সংখ্যার আয়োজন থাকে, তেমনি শারদীয়া দুর্গা পূজায় বিশেষ সংখ্যা প্রকাশেও দৈনিক চাঁদপুর কণ্ঠের জুড়ি নেই। বুদ্ধ পূর্ণিমায় বিশেষ উপ-সম্পাদকীয় কিংবা বড়দিনের সংবাদ পরিবেশনেও দৈনিক চাঁদপুর কণ্ঠ কখনো কোনো প্রকার বৈষম্যের অবতারণা করেনি।
তিরিশ বছরের দৈনিক চাঁদপুর কণ্ঠ আজ অনেকটাই প্রাজ্ঞ ও পরিণত। হলুদ সাংবাদিকতা বলতে যা বুঝায় তা থেকে পত্রিকাটি অনেকখানিই দূরে। কারো প্রতি কোনো অনুরাগ-বিরাগের বশবর্তী না হয়ে দৈনিক চাঁদপুর কণ্ঠ সর্বদা বস্তুনিষ্ঠ থেকেছে বলেই আজও তার জেলাব্যাপী জয়-জয়কার।
একজন লেখক হিসেবে দৈনিক চাঁদপুর কণ্ঠ আমাকে তাগিদ দিয়ে অনেক লেখা বের করে এনেছে। পত্রিকা চালাতে হলে লিখতে পারে এমন ব্যক্তিদের পেছনে লেগে থাকতে হয়। চাঁদপুর কণ্ঠও তার ব্যতিক্রম নয়। যদিও ফরমায়েশি লেখার সাহিত্যমান প্রশ্নবিদ্ধ, তবুও লেখক সৃষ্টি ও লেখককে প্রণোদনা দিতে চাঁদপুর কণ্ঠ কখনো পিছপা হয়নি। চাঁদপুর কণ্ঠের সাথে আমার সময় যাপন সব সময় আনন্দদায়ক ছিলো। যদিও পত্র শব্দটি বৃহদার্থে এবং পত্রিকা কথাটি ক্ষুদ্রার্থে হয়, তবু দৈনিক চাঁদপুর কণ্ঠের ক্ষেত্রে পত্রিকা বিশেষণটি সর্বতোভাবেই প্রযোজ্য। সময়ের সাথে সাথে পত্রিকার দাম যেমন তিন টাকা থেকে বেড়ে পাঁচ টাকা হয়েছে, তেমনি পত্রিকা চালানোর ব্যয়ও বৃদ্ধি পেয়েছে। এতো সঙ্কটেও দৈনিক চাঁদপুর কণ্ঠ তার নীতি হতে বিন্দুমাত্র বিচ্যুত হয়নি। তিরিশ বছর পরে এসে যে দীর্ঘশ্বাসে চাঁদপুর কণ্ঠের প্রতি একটা অতৃপ্তি জেগে উঠে, তা হলো পত্রিকাটির নিজস্ব কোনো ভবন হয়ে না ওঠা। অথচ জেলার প্রথম ও সর্ববহুল প্রচারিত পত্রিকাটি চাইলেই গত তিরিশ বছরে ভবন হয়ে ওঠা অসম্ভব ছিলো না মোটেই। আমি আশা করি আগামী পঞ্চাশ বছর পূর্তি বা সুবর্ণ জয়ন্তী তার নিজ ভবনেই হবে। সে আশায় দীপ জ্বেলে যাই অন্তরে-অন্দরে নিরন্তর, অক্ষরে-অভিজ্ঞানে। জয় বাংলা।
লেখক : সব্যসাচী লেখক; উপদেষ্টা, দৈনিক চাঁদপুর কণ্ঠ।