রবিবার, ০১ জুন, ২০২৫  |   ২৬ °সে
জাতীয়আন্তর্জাতিকরাজনীতিখেলাধুলাবিনোদনঅর্থনীতিশিক্ষাস্বাস্থ্যসারাদেশ ফিচার সম্পাদকীয় অন্যান্য
ব্রেকিং নিউজ
  •   ঢাকা থেকে উড্ডয়নের পরপরই তার্কিশ এয়ারলাইন্সের ইঞ্জিনে আগুন

প্রকাশ : ৩০ মে ২০২৫, ২০:০৯

চাঁদপুরের সাহিত্য চর্চা ও সাহিত্য একাডেমী

কাদের পলাশ
চাঁদপুরের সাহিত্য চর্চা ও সাহিত্য একাডেমী

চাঁদপুরের শিল্প-সাহিত্য তথা সংস্কৃতি চর্চার বর্ণিল ঐতিহ্য রয়েছে। সে ঐতিহ্যকে ধারণ ও লালন করে চলেছে বর্তমান। চাঁদপুরের সাহিত্যের ইতিহাস খুঁজতে গেলে প্রথমেই যে নামটি সামনে চলে আসে তিনি দোনা গাজী। মধ্যযুগের সাহিত্য চর্চায় তাঁর লেখা ‘সয়ফুলমূলক-বদিউজ্জামাল’ গ্রন্থের মাধ্যমে বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে চাঁদপুরের নামকে উজ্জ্বল করে রেখেছেন। মহাকবি আলাওয়ালের আবির্ভাবের পূর্বেই চাঁদপুর তথা দেশের সাহিত্য চর্চায় ব্রত ছিলেন দোনা গাজী। এরপর আরো অনেকের নাম চলে আসবে যাঁরা দেশের শিল্প-সাহিত্যে চাঁদপুরের নাম ঈর্ষার আসনে বসিয়ে গেছেন। এঁদের অনেকেই একুশে পদক, বাংলা একাডেমি পুরস্কারসহ নানা সম্মান ও পুরস্কারে ভূষিত হয়েছেন। স্বাধীনতা পূর্ব ও স্বাধীনতা পরবর্তীতে জাতীয় সাহিত্যে চাঁদপুরের যাঁরা বলিষ্ঠ ভূমিকা রাখতে সক্ষম হয়েছেন তাঁদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছেন : বোরহান উদ্দীন খান জাহাঙ্গীর, নজরুল গবেষক প্রফেসর ড. রফিকুল ইসলাম, বেগম পত্রিকার সম্পাদক নূরজাহান বেগম, মোহাম্মদ আবদুল কুদ্দুস, হীরেন্দ্রনাথ দত্ত (ছদ্ম নাম ইন্দ্রজিৎ), শান্তনু কায়সার, চারণ কবি সামছুল হক মোল্লা, আহমদ জামান চৌধুরী, ফখরুজ্জামান চৌধুরী, মুনতাসীর মামুন, নীলুফার বেগম, কামরুল হাসান শায়ক, শামসুল আরেফিন প্রমুখ। এসব নাম গত শতকের। আঠারো শতকে শিল্প-সাহিত্য চর্চায় যাঁদের অনবদ্য অবদান তাঁদের প্রতি অতল শ্রদ্ধা।

চাঁদপুরের সাহিত্য চর্চার ইতিহাস ছোট্ট করে বলেছি। কিন্তু এবার চাঁদপুরের সাহিত্য চর্চা ও সাহিত্য একাডেমী প্রসঙ্গের অবতারণা করতে চাই। প্রান্তিকে থেকে সাহিত্য চর্চা করা এবং একটি দেশের পরিমণ্ডলে নিজেদের পরিচিত করা নিশ্চয় কঠিন। না হয় বড়ো সুখ্যাতি পেতে রাজধানীতে কেউ যেত না। স্বভাবতই রাজধানীতে যে কোনো পেশাগত জগতে বিচরণের জন্যে ব্যাপৃত পরিসর বিদ্যমান। তেমনি সাহিত্যেও। কিন্তু চাঁদপুরে অবস্থান করে সারাদেশে চাঁদপুরের সাহিত্য চর্চার যে সুনাম ছড়িয়েছে তা তরুণ প্রজন্মের হাত ধরেই। বিগত একযুগে চাঁদপুর থেকে প্রকাশ হয়েছে অর্ধশতাধিক লিটলম্যাগ মানে সাহিত্যের ছোট কাগজ। চাঁদপুরের তরুণ প্রজন্মের প্রায় অর্ধশত লেখক দেশের বিভিন্ন পত্রিকা, ম্যাগাজিন, ছোটকাগজ, ঈদ সংখ্যা, অনলাইন নিউজ পোর্টালে লেখা প্রকাশসহ বই প্রকাশ করেছেন। এমনকি কারো কারো বই প্রকাশের সংখ্যা ত্রিশও ছুঁয়েছে। এটিই স্থানীয় সাহিত্যের উন্মত্ত সময়, আর কবে দেখেছে চাঁদপুর? নানান ধরণের কর্মকাণ্ড করে চাঁদপুরের সাহিত্যাঙ্গনকে সরব রেখেছে এ তরুণ প্রজন্মই। এ তরুণ প্রজন্ম কখনো সাহিত্য একাডেমী চাঁদপুর-এর কাছ থেকে কিছু প্রত্যাশা করেনি। কিন্তু সারাদেশের মধ্যে অন্যতম সাহিত্য প্রতিষ্ঠানটি কিছু করুক এমনটা আমরা চাই।

শ্রদ্ধার সাথে স্মরণ করছি সাহিত্য একাডেমী চাঁদপুর-এর প্রতিষ্ঠাতা চাঁদপুরের প্রাক্তন জেলা প্রশাসক এসএম শামসুল আলম মহোদয়কে। তাঁর প্রতি অসীম কৃতজ্ঞতা। এমন একজন সাহিত্যপ্রেমী মানুষের কাছে আমাদের অনেক ঋণ। ৪০ বছর আগে প্রতিষ্ঠা হওয়া সাহিত্য একাডেমী নিয়ে আজ তরুণ প্রজন্মের লেখকরা উচ্চাভিলাষী। তারা চায়, সাহিত্য একাডেমী হোক চাঁদপুরের আগামী সাহিত্য চর্চার বাতিঘর। এখান থেকে আলো ছড়িয়ে পড়ুক পুরো জেলায় তথা সারা দেশে। কারণ এমন সাহিত্য প্রতিষ্ঠান দেশে আর কোথাও নেই। সাহিত্য একাডেমী, চাঁদপুর হতে পারে সারাদেশে আইকনিক নাম।

সাহিত্য একাডেমী, চাঁদপুর ১৯৮৬ সালে প্রতিষ্ঠার পর এর কার্যক্রম নিয়ে অনেক কথা শুনেছি। শোনা হয়েছে। দখল বা পুনরুদ্ধারের গল্পও শোনা হয়েছে। সবশেষ ২০১৩ সালে ১৪১ সদস্যের তালিকা ধরে এক তৃতীয়াংশ সদস্যের উপস্থিতিতে হ্যাঁ/না-এর মাধ্যমে কমিটি হয়েছিলো। সেই ১৪১ সদস্য নিয়ে নানা বির্তকও আমরা শুনেছি।

আরো একটু পূর্বে যেতে চাই। ২০০৪ সাল। সাহিত্য একাডেমি চাঁদপুর-এর সভাপতি এবং জেলা প্রশাসক আবদুর রব হাওলাদার ও সদস্য সচিব সদর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা কোংখাম নীলমনি সিংহ ২০০৪ সালে প্রথমে ১০ টাকা চাঁদা নিয়ে সদস্য ফরম বিক্রি করার উদ্যোগ নেন। কিন্তু এরপর আর কোনো মিটিং হয়নি। হলেও এমন কোনো নথি সাহিত্য একাডেমীতে সংরক্ষিত নেই বলে জানা গেছে। অবশেষে ১ মে ২০১০ সালের নির্বাহী পরিষদের সভায় সাহিত্য একাডেমীর মহাপরিচালক ও সদর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা শাহীনুর শাহিন খান জানান, ১০ টাকায় সদস্য ফরম বিক্রির ১৯৫৭ জনের নামের তালিকা পাওয়া যায়। চূড়ান্ত ১৮শ' জনের নামের রেজিস্ট্রার নষ্ট হয়ে যায়। ফলে ২ মে ২০১০ পরবর্তী সভায় কেউ সদস্য হতে চাইলে নতুন করে আবেদন এবং পুরানোদের নবায়নের সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়।

৮ নভেম্বর ২০১০ তারিখের সভায় ৩৬ জন সদস্য নবায়ন করেছেন বলে অবগত করা হয়। ১৯ডিসেম্বর ২০১০ তারিখের সভায় জানানো হয়, নবায়নকৃত সদস্য সংখ্যা মোট ৫০ জন। ০১ ফেব্রুয়ারি ২০১১ তারিখের সভায় ৭৫ জনের নবায়নের বিষয়টি অবগত করা হয়। ২১জানুয়ারি ২০১৩ সালের সভায় নতুন সদস্য ও আজীবন সদস্য পদে অন্তর্ভুক্তির জন্যে সিদ্ধান্ত গৃহীত হয় এবং ১৪১ সদস্যকে অনুমোদন করে এই তালিকার আলোকে কমিটি গঠন করা হয়। এতে প্রতীয়মান হয় যে, যারা ১০টাকার ফরম কিনে সদস্য দাবি করছে তাদের মূলত প্রাথমিক সদস্যই করা হয়নি। ২০১৩ সালের পর ২০২২ সালে সাবেক ডিসি অঞ্জনা খান মজলিশ তিন মাসের জন্যে একটি এডহক কমিটি গঠন করে দিয়ে তাঁর দায়িত্ব শেষ করেন। ২০২৪ সালে এসে সাবেক জেলা প্রশাসক মো. কামরুল হাসান আবারো একটি এডহক কমিটি গঠন করেন। দুটি এডহক কমিটিতেই আমি একজন সদস্য হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছি। ২০২৪ সালের এডহক কমিটি একাডেমীর বেশ কিছু গুরুত্বপূণ কার্য সম্পাদন করেন। এর মধ্যে ১২বছর পর নতুন সদস্য অন্তর্ভুক্তির জন্যে বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ। পুরানো নথিপত্র তল্লাশি ও রিচার্চ করে প্রতিষ্ঠাকালীন সদস্য, কার্যনির্বাহী সদস্য শনাক্ত করা হয়।

নতুন সদস্য অন্তর্ভুক্তির জন্যে বিজ্ঞপ্তি প্রকাশের পর চাঁদপুরের প্রায় সব লেখক সদস্য হওয়ার জন্যে আবেদন করেন। যদিও অভিমানে কয়েকজন প্রকৃত লেখক আবেদন করেননি। অথবা কেউ কেউ গুরুত্ব দেননি। যা হোক ২০২৪ সালের এডহক কমিটি সভাপতির নির্দেশনা মোতাবেক সকল কার্যসম্পাদন করে প্রতিবেদন জমা দেয়ার পর তিনি একটি নির্বাচন কমিশন গঠন করে দেন। সে কমিশন ১৫ সেপ্টেম্বর ২০২৪ তারিখের মধ্যে নির্বাচন সম্পন্ন করে প্রতিবেদন জমা দেয়ার নির্দেশ দেন। এ নিয়ে সাহিত্যাঙ্গনে দেখা দেয় প্রাণচাঞ্চল্য। শুরু হয় ভোটের হিসেব-নিকেশ। যদিও ০৫ আগস্ট ২০২৪ সালে দেশের পট পরিবর্তনের কারণে সবকিছু থমকে যায়।

তারপর বর্তমান জেলা প্রশাসক ও সাহিত্য একাডেমির সভাপতি মো. মোহসীন উদ্দিন গত ১৭ মার্চ ২০২৫ তারিখে ১২০ সদস্যের একটি খসড়া তালিকা প্রকাশ করে নোটিস জারি করেন। সে নোটিসে উল্লেখ করা হয়, দীর্ঘদিন একাডেমীর কার্যকরী পরিষদ না থাকায় সদস্য তালিকাসহ বিভিন্ন নথিপত্র পাওয়া যায়নি। ফলে একাডেমীর সাধারণ সদস্যদের সঠিক তালিকা তৈরি করা সম্ভব হয়নি। একাডেমীতে বর্তমানে সংরক্ষিত বিভিন্ন নথিপত্র পর্যালোচনা করে সাধারণ সদস্যদের একটি খসড়া তালিকা করা হয়েছে। খসড়া তালিকায় অনেকের নাম বাদ যেতে পারে। পূর্বে সাহিত্য একাডেমীর সদস্য ছিলেন কিন্তু নিম্নবর্ণিত খসড়া তালিকায় নাম নেই, এমন কেউ থাকলে তাঁকে যথাযথ প্রমাণ সংযুক্ত পূর্বক ০৫ এপ্রিল ২০২৫ খ্রি. তারিখের মধ্যে সভাপতি, সাহিত্য একাডেমী ও জেলা প্রশাসক, চাঁদপুর বরাবরে আবেদন করার জন্যে অনুরোধ জানা হয়েছে। সেখানে উল্লেখ করা হয়, প্রতিষ্ঠাতা সদস্য, গঠনতন্ত্র উপ-পরিষদ সদস্য, আজীবন সদস্য, নির্বাহী পরিষদের সদস্য, সাধারণ সদস্যের সমন্বিত তালিকা (খসড়া ভোটার তালিকা) সাহিত্য একাডেমী, চাঁদপুর-এর গঠনতন্ত্র ১৪-এর ‘ক’ ধারা মোতাবেক প্রকাশ করা হলো।

এ নোটিসের প্রেক্ষিতে বেশ কয়েকজন প্রমাণসহ আবেদন করেন। তাদের ৬জনকে ইতোমধ্যে সদস্য করে চূড়ান্ত তালিকা প্রকাশ করা হয়।

তারপর গত ১০ মে ২০২৫ তারিখে সাধারণ সভা হবে মর্মে নোটিস জারি করেন সভাপতি মো. মোহসীন উদ্দিন। যদিও সেদিন সভাটি হয়নি। পরে ১৬ মে ২০২৫ তারিখ শনিবার দুপুর ২টায় জেলা প্রশাসকের সম্মেলন কক্ষে সভা অনুষ্ঠিত হয়। সে সভায় ৮৩জন সদস্য উপস্থিত হন। এদের অন্তত ৯০ভাগ সদস্য ওই দিনই কমিটি গঠন প্রক্রিয়া সম্পন্ন করতে লিখিতভাবে মত প্রকাশ করেন। যদিও গুটিকয়েক সদস্যের পক্ষ নিয়ে জেলা প্রশাসক মো. মোহসীন উদ্দিন আগামী ১৫দিনের মধ্যে নির্বাচন হবে মর্মে অনুষ্ঠিত সভায় সিদ্ধান্ত জানিয়ে সভা শেষ করেন। সে মোতাবেক শনিবার (৩১ মে ২০২৫) শনিবার ভোট গ্রহণ অনুষ্ঠিত হচ্ছে।

এসব কথা তো একেবারে সাদামাটা কথা। তবে কেন এমন বড় করে ফিরিস্তি লেখা? এবার আসছি সে বিষয়ে।

১৬ মে সাধারণ সভা হওয়ার পূর্বে কিছু অর্বাচীন সাহিত্য একাডেমীর সদস্য না হয়েও অন্যায্য ও অবৈধ দাবি দাওয়া তুলে ধরেন। জেলা প্রশাসক তথা সাহিত্য একাডেমীর সভাপতির ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন তোলেন ওসব ভদ্র (?) মানুষেরা। তাদের দাবি হচ্ছে, নতুন সদস্য অন্তর্ভুক্ত করে নির্বাচন দেয়া। অথচ নতুন সদস্য হতে হলে গঠনতন্ত্র মোতাবেক কিছু প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে যেতে হয়। নিয়ম না মেনে কাউকে সদস্য করা নিশ্চয় অনিয়ম। অনেক অথর্ব বলছে, অনেক সিনিয়র বাদ পড়েছেন। ওই বেকুবরা একবারও সভাপতি কর্তৃক প্রকাশিত খসড়া সদস্য তালিকার নোটিসটি পড়েনি। সেখানে বলা হয়েছে, কেউ যদি বাদ পড়ে থাকেন প্রমাণসহ আবেদন করুন। যারা আবেদন করেননি তাদের পক্ষ নিয়ে যারা কথা বলছে, তাদের কী বলে সম্বোধন করা যায়, তা আমার বোধগম্য নয়। কারণ যাদেরকে সুযোগে ঢুঁ মেরে সদস্য করা হয়েছিলো, তারা কেউই সাহিত্যিক নয়। এমনকি তাদের কাছে পূর্বে সদস্য ছিলো তার কোনো প্রমাণপত্র নেই। সুতরাং এসব নিয়ে যারা ঘোলা পানিতে মাছ শিকার করছে চাচ্ছে তারা বাতেল মালের অংশ।

এবার আসি, যারা সদস্য আছেন, এদের সদস্য পদ নিয়ে প্রশ্ন থাকার কথা নয়। কিন্তু প্রশ্ন যেহেতু তুলেছে ওসব অর্বাচীনরা, তাহলে বলা প্রয়োজন, কেউ যদি ত্রিশ বছর আগে সদস্য হয়ে থাকেন আর তিনি যদি কোনো দেশবিরোধী কার্যকলাপ বা অপরাধ করে থাকেন এবং অপরাধীও হন, তাহলে তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে পারে কার্যনির্বাহী পরিষদ। যেহেতু সাহিত্য একাডেমির কার্যনির্বাহী পরিষদ নেই, কারো সদস্য খারিজ বা স্থগিত রাখার অধিকার কারো আছে? নিশ্চয় নাই। তাহলে এ নিয়ে প্রশ্ন তোলা বাতুলতা নয় কি?

  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়