রবিবার, ০১ জুন, ২০২৫  |   ২৮ °সে
জাতীয়আন্তর্জাতিকরাজনীতিখেলাধুলাবিনোদনঅর্থনীতিশিক্ষাস্বাস্থ্যসারাদেশ ফিচার সম্পাদকীয় অন্যান্য
ব্রেকিং নিউজ
  •   ঢাকা থেকে উড্ডয়নের পরপরই তার্কিশ এয়ারলাইন্সের ইঞ্জিনে আগুন

প্রকাশ : ৩১ মে ২০২৫, ০৭:৫৭

আব্বাকে লেখা চিঠি

খান-ই-আজম
আব্বাকে লেখা চিঠি

দেবিদ্বার, কুমিল্লা পরম শ্রদ্ধাভাজন আব্বা, ১০/০১/১৯৮১খ্রি.।

আমার সশ্রদ্ধ সালাম নিবেদন করছি আপনার পবিত্র চরণযুগলে। বেশ লম্বা একটা সময় কালের গর্ভে বিলীন হতে চললো আম্মা, দাদু ও আপনার পরম স্নেহ ও আদরে সিক্ত হবার দুর্লভ সুযোগ থেকে আমি বঞ্চিত। মায়ের হাতের রান্না আমার প্রিয় খাবারগুলো খেয়ে রসনা তৃপ্ত করার অদম্য ইচ্ছে আমায় ঘন ঘন বাড়ি যেতে হাতছানি দেয়। একদিকে নতুন কর্মস্থল অন্যদিকে পথের দূরত্ব সর্বোপরি অফিস থেকে ছুটি পাওয়ার বিড়ম্বনা সবকিছু মিলিয়ে বাড়ি যাবার সুযোগ করা খুব একটা সহজসাধ্য নয়। তবুও আমার মনটা পড়ে থাকে ডাকাতিয়া নদীর কোলঘেঁষা ছায়াসুনিবিড় ছোটসুন্দর গ্রামে। আজ বার বার কেবলই মনে পড়ে কৈশোরে পড়া বিশ্বকবি রবি ঠাকুরের পোস্ট মাস্টার গল্পের কথা। আমি যেনো আজ পোস্ট মাস্টারেরই এক নতুন সংস্করণ।

কুমিল্লা জেলার দেবিদ্বার থানার পুলিশ স্টেশন আর আমাদের ব্যাংক শাখা এ দুটি প্রতিষ্ঠান রাস্তার দুপাশে মুখোমুখি দুটি ভবনে অবস্থিত। রিয়াজউদ্দিন পাইলট হাই স্কুল, সাব-পোস্ট অফিস, ডাক বাংলো, খেলার মাঠ, বাজার এসব প্রতিষ্ঠানগুলো আমাদের ব্যাংক শাখার সন্নিকট। সার্কেল অফিসারের কার্যালয়, সোনালী ব্যাংক শাখা, ক্যাপ্টেন সুজাত আলী ডিগ্রি কলেজ ও নতুন বাজার আমাদের কার্যালয়ের অনতিদূরে। বিকেলে অফিস ছুটির পর প্রায়শ মরা নদীর পাড়ে ডাকবাংলোর পাশের আমতলা কিংবা ফিসারী ক্যাম্পাসে গিয়ে সদ্য পরিচিত বন্ধুদের সনে আড্ডায় মেতে উঠি। সন্ধ্যার পর ঘরে ফিরে ভীষণ একাকীত্ব বোধ করি।

ভাই-বোনেদের সনে কারণে-অকারণে খুনসুঁটি, লুডু, ক্যারম ও চোরপুলিশ খেলার মাঝে চাল-ডাল-কড়ই ভাজা খাওয়ার মতো বিষয়গুলো আমায় নস্টালজিক করে তোলে। তখনই আমার মনটা ঝড়ের আঘাতে ডানাভাঙ্গা পাখির মতো ছটফট করে। সাধ তখন অসাধ্যের শেকলে বন্দী হয়ে যায়।

আব্বা আপনি একবার এসে এ স্থানটি ঘুরে গেলে খুব ভালো হতো। আমার বন্ধু কাজী নূরের আব্বা ব্রাহ্মণবাড়িয়ার নবীনগর থেকে মাঝে মধ্যে এসে দু একদিন এখানে থেকে যান। খালুজানের সাথে অনেক গল্প করার অবকাশ মেলে। তিনিও আপনার সময়বয়সী হবেন বলে আমার ধারণা। আমাদের শাখার ম্যানেজার স্যার অত্যন্ত সজ্জন ব্যক্তি। ব্যাংকের চাকুরিতে প্রবেশের আগে তিনি কুমিল্লা কলেজের অর্থনীতির শিক্ষক ছিলেন। তিনি আমায় যথেষ্ট স্নেহের চোখে দেখেন। আমাদের শাখার বয়োজ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা-কর্মচারীগণ এটি খুব সহজভাবে নেন বলে আমার মনে হয় না। তবুও সবার প্রতি সম্মানবোধ অক্ষুন্ন রেখে চলার চেষ্টা করি। এক্ষেত্রে আম্মাও আপনার দেয়া উপদেশগুলো নিয়ামক শক্তি হিসেবে কাজ করে।

এখানকার মানুষগুলো খুবই সহজ সরল। শিক্ষার দিক থেকে যথেষ্ট পিছিয়ে। আর্থসামাজিক অবস্থার নিরিখেও সিংহভাগ লোক অসচ্ছল। গ্রামের সাদামাটা মানুষগুলোর সারল্য হৃদয় কাড়ে। আমার মতো একজন সাধারণ কর্মচারীকেও তাঁরা যথেষ্ট সম্মানের চোখে দেখেন। আমি তাঁদের সাথে প্রাণ খুলে কথা বলি। এতে অফিসের দুএকজন জ্যেষ্ঠ সহকর্মীর অযাচিত উক্তি কখনও কখনও আমায় পীড়িত করে। যেমন- একজন তাঁর পাশের টেবিলের অন্যজনকে বলেন, আমাদের আজম সাহেব এখানে ইলেকশন করলে ভালো করতেন।

এখানকার বাজারে মাছ ও মুরগী মোটামুটি পাওয়া যায়। শাকসবজি খুবই সহজলভ্য কিন্তু ভালো গরু-খাসির গোশ্ত মেলে না। গোশ্ত কেনার জন্য পার্শ্ববর্তী মুরাদনগর থানার কোম্পানীগঞ্জ বাজারে যেতে হয়। এ বাজারটি খুবই প্রসিদ্ধ এবং দেবিদ্বারের নিকটবর্তী।

বকেয়া ঋণের টাকা আদায়ের জন্য দূরবর্তী অঞ্চলে গেলে সেদিন আর কর্মস্থলে ফেরা হয় না। রাতের বেলা স্থানীয় চেয়ারম্যান, মেম্বার কিংবা স্থানীয় কোনো গণ্যমান্য লোকের বাড়িতে রাত কাটাতে হয়। আদায়কৃত ঋণের টাকা ও আদায় রসিদবহি নিরাপদ হেফাজতে রাখতে হয়। রাস্তাঘাটের দুরবস্থা সহজেই চোখে পড়ে। কিছু কিছু এলাকায় রিক্সাযোগে ভ্রমণ করা গেলেও তা খুব ব্যয়বহুল। ইউনিয়ন পরিষদের চৌকিদারকে সাথে নিয়ে আমরা অনেক সময় গ্রামে ঢুকে পড়ি। যে কোনো লোকের নাম বললেই তারা নিজ থেকে ঋণ গ্রহীতার পিতার নামটিও তাৎক্ষণিক বলে দেয়। তাদের ধী-শক্তি দেখে অবাক হতে হয়। এরা ইউনিয়নের প্রায় সব বয়স্ক লোককে চিনে। ফলে ঋণ গ্রহীতা সনাক্তকরণের কাজটা অনেক সহজ হয়ে যায়। একদিনের ঘটনা এরকম। আমি ও আমার সিনিয়র সুপারভাইজার জনাব মোক্তার আহমেদ স্থানীয় ফতেয়াবাদ ইউপি চৌকিদার আব্দুল মতিনকে সঙ্গে নিয়ে এলাকার অবস্থাপন্ন লোক জনাব রমিজউদ্দিন সরকার এর অনুরোধে তাঁর বাড়িতে রাত্রিযাপন করি। তিনি শতভাগ আন্তরিকতা ঢেলে যে খাবারদাবারের আয়োজনে নৈশভোজ সম্পন্ন করাণ তা আমার নিকট আজও এক বিস্ময়। রাত নটার দিকে তাঁর বাড়ির উঠোনে হোগলা-চাটাই পেতে প্রায় শ’দুয়েক নারী পুরুষ বসা। লোকজনের কলকাকলীতে বাড়ির পরিবেশ কোলাহলময়। উঠোনের এককোণে চা-পান, বিড়ি-সিগারেট, বিস্কুট, মোয়া ও বাতাসার দোকান বসে যায়। কিছুক্ষণের মধ্যে বাইরে চেয়ার ও পার্টি বিছানো হয়। ততোক্ষণে ঢোল, বাঁশি, একতারা ও বেহালার শব্দ কানে ভেসে আসে। রমিজ উদ্দিন সাহেব এবার নড়েচড়ে উঠেন। তিনি আমাদেরকে নিয়ে অনুষ্ঠানস্থলে চেয়ারে বসান। রাত প্রায় দেড়টা পর্যন্ত গানবাজনা চলে। শ্রোতারা মন্ত্রমুগ্ধের মতো দূর গাঁ থেকে ভাড়াকরে আনা শিল্পীদের গান শোনে। পরে জেনেছি রমিজউদ্দিন সাহেব আমাদের মনোরঞ্জনের পাশাপাশি গ্রামবাসীর দীর্ঘদিনের আব্দার পূরণের জন্য এ আয়োজন রাখেন। আবিদ আলী বয়াতি ও পারুল বালার গানে মুগ্ধ হয়ে শ্রোতারা এক পর্যায়ে আনি-দুআনি, সিকি-আধুলি ও এক টাকার ধাতব মুদ্রা নিক্ষেপের বৃষ্টি ঝরাতে শুরু করেন। গায়ক গায়িকা অত্যন্ত খুশি মনে সে সব কুড়োতে থাকেন। আমি মোক্তার আহ্মেদ সাহেবের দৃষ্টি আকর্ষণ করি। তিনি ইশারায় বলেন, আমাদেরও কিছু একটা করা দরকার। আমি সাহস করে একখানা দশ টাকার নোট দ্বারা শিল্পীকে পুরস্কৃত করা মাত্র চারদিকে আনন্দের ঢেউ বয়ে যায়। রমিজ উদ্দিন সরকার সাহেব অবশ্য চুক্তির অতিরিক্ত কুড়ি টাকা বকশিস দিয়ে শিল্পীদের তুষ্ট করেন।

আব্বা আপনি শরীর স্বাস্থ্যের প্রতি খেয়াল রাখবেন ও নিয়মিত ঔষধ খাবেন এটি আমার প্রাণের দাবি। প্রয়োজনে চাঁদপুরের সিভিল সার্জন সাহেবের প্রাইভেট চেম্বারে গিয়ে তাঁর পরামর্শ নেবেন। আম্মাকে বলবেন আমার জন্য যেনো কোনোরূপ দুশ্চিন্তা না করেন। আমি আগামী ঈদের ছুটিতে বাড়ি আসবো ইনশাল্লাহ। আব্বা আমি একটি কথা বার বার বলতে চেয়েও বলতে পারিনি। আজ না লিখেও পাচ্ছি না। আপনি দয়া করে এটি অন্যভাবে নেবেন না বলে আমি আশাবাদী। আব্বা এলাকাবাসীর আব্দার অনুরোধ রক্ষাকল্পে আপনাকে প্রায়শ বিবাদ বিসম্বাদ মেটাতে স্থানীয় লোকজন এসে দরবার-সালিশ-বৈঠকে নিয়ে যান। অধিক রাত পর্যন্ত সেখানে অবস্থান করতে হয়। আপনার বর্তমান শরীর স্বাস্থ্য কোনোভাবেই এ চাপ নিতে পারে না। আপনি যদি দয়াকরে লোকজনকে বলেকয়ে আপনার অপারগতার কথা বুঝিয়ে এসব থেকে বিরত থাকেন তবে আমি অনেক প্রশান্তি অনুভব করবো।

আম্মা, দাদু ও আপনাকে আমার সশ্রদ্ধ সালাম ও ভাইবোনেদের প্রতি পরম স্নেহাশীষ রেখে ও সকলের দোয়া চেয়ে অদ্যকার মতো শেষ করছি।

ইতি

আপনার স্নেহধন্য জ্যেষ্ঠপুত্র

আজম।

  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়