প্রকাশ : ০৭ জুন ২০২৪, ০০:০০
আমার সাংবাদিকতা ও চাঁদপুর কণ্ঠ
আমার সাংবাদিকতার যাত্রা হয়েছিলো সাপ্তাহিক চাঁদপুর কণ্ঠে। প্রায় ৩ দশক আগে আমি সাংবাদিকতা শুরু করেছিলাম এই পত্রিকার মাধ্যমে। সাপ্তাহিক চাঁদপুর কণ্ঠের জন্মের ২ বছর পর থেকে আমি কাজ করছি। শুধু সাংবাদিকতাই নয়, আমার কর্মজীবনও শুরু হয়েছিলো ‘চাঁদপুর কণ্ঠ’ দিয়ে। আমার একমাত্র পেশা সাংবাদিকতা। পেশাদার সাংবাদিক হিসেবে কাজ করার চেষ্টা করলেও চাঁদপুরের মতো একটি ছোট শহরে পেশা হিসেবে সাংবাদিকতা সহজ বিষয় ছিলো না। কিন্তু তারপরও শুধু এই পেশায়ই চাঁদপুর শহরে টিকে আছি পেশাদার সাংবাদিক হিসেবে।
সাপ্তাহিক চাঁদপুর কণ্ঠ জন্ম দিয়েছে চাঁদপুরের অংসখ্য সাংবাদিককে। আমি তাদেরই একজন। সাপ্তাহিক চাঁদপুর কণ্ঠ থেকে দৈনিক চাঁদপুর কণ্ঠ জন্ম দিয়েছে অনেক সাংবাদিক ও অনেক পত্রিকার। চাঁদপুর কণ্ঠে কাজ করা অনেকে এখন পত্রিকার সম্পাদক ও প্রকাশক, প্রধান সম্পাদক, ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক, যুগ্ম সম্পাদক, নির্বাহী সম্পাদক ও বার্তা সম্পাদকসহ নানা পদের সাংবাদিক হিসেবে চাঁদপুরসহ দেশ-বিদেশে সুনামের সাথে কাজ করছেন। যেমন আমি বর্তমানে দৈনিক ইল্শেপাড়ের প্রধান সম্পাদক ও চাঁদপুর প্রেসক্লাবের ২০২৪ সালের সাধারণ সম্পাদক পদে অধিষ্ঠিত। এর আগে দৈনিক চাঁদপুর প্রবাহের প্রতিষ্ঠাকালীন একজন কর্মী (সিনিয়র সাব-এডিটর ও কম্পিউটার ইনচার্জ) হিসেবে কাজ করেছি। সেখান থেকে সহকারী সম্পাদক হিসেবে পদোন্নতি পেয়েও ২০০৫ সালের ডিসেম্বরে ব্যক্তিগত কাজের জন্যে চাঁদপুর প্রবাহ ছেড়ে আসতে হয়। ২০০৬ সালের প্রথম থেকে আবার নতুন পত্রিকা দৈনিক ইল্শেপাড়ের যুগ্ম সম্পাদক হিসেবে যোগদান করি। ২০১১ সালে পদোন্নতি পেয়ে প্রধান সম্পাদক হিসেবে এখনো একই পদে ইল্শেপাড়েই কাজ করছি।
সাংবাদিকতার প্রতি আমার ঝোঁক ছিলো কৈশোরকাল থেকে। ১৯৮৭ সালে যখন চাঁদপুর সরকারি কলেজে পড়ি তখন থেকেই। সে সময় ঢাকা থেকে প্রকাশিত ‘সাপ্তাহিক আলোর জগত’ নামের একটি পত্রিকায় চাঁদপুর জেলা প্রতিনিধি হিসেবে আবেদন করেছিলাম। তারা আবেদনটি আমলে নিয়ে আমার ঠিকানায় পত্রিকার সাংবাদিক আইডি কার্ডসহ কাগজপত্র পাঠিয়ে দিলো। কিন্তু তখন আর সাংবাদিক হিসেবে কাজ করা হয়ে ওঠেনি। তারপর ১৯৯১ সালে চাঁদপুর সেন্ট্রাল রোটার্যাক্ট ক্লাবের সেক্রেটারীর দায়িত্ব পালনের সময় সাংবাদিকদের সাথে ঘনিষ্ঠভাবে যোগাযোগ করা এবং ক্লাবের অনুষ্ঠানের প্রেস বিজ্ঞপ্তি বিভিন্ন পত্রিকায় দিতে গিয়ে সাংবাদিকতার প্রতি ঝোঁক আরো বাড়লো। ১৯৯৬ সালে বাবার মৃত্যুর পর পারিবারিক কাজে ছোটাছুটির পর অবসরে লেখালেখির ঝোঁক বেড়ে যায়। আমি তখন রোটার্যাক্ট ক্লাব (রোটারী ক্লাবের যুব সংগঠন)সহ চাঁদপুরের বিভিন্ন সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সংগঠনে বিভিন্ন পদে (বর্ণচোরা নাট্যগোষ্ঠী ও গুয়াখোলা ক্রীড়া চক্রের সংগঠনিক সম্পাদক) দায়িত্বরত।
বন্ধু সাংবাদিক আলম পলাশের (দৈনিক প্রথম আলোর চাঁদপুর প্রতিনিধি) মাধ্যমেই মূলত সাংবাদিকতায় প্রবেশ। পলাশ নিয়ে এলো সাপ্তাহিক চাঁদপুর কণ্ঠের তৎকালীন ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক কাজী শাহাদাত সাহেবের কাছে। কাজী শাহাদাত সাহেব আমার ঘনিষ্ঠ বন্ধু কাজী আশ্রাফউদ্দিন আহমেদ মিলন (স্বত্বাধিকারী, অ্যাকটিভ প্রিন্টিং ও অ্যাকটিভ গার্মেন্টস্)-এর চাচা। মিলনের সাথে আমার পারিবারিক সম্পর্ক। সে হিসেবে শাহাদাত সাহেব আমারও ‘চাচা’।
এছাড়া সাংবাদিকতায় আমার প্রথম এবং একমাত্র গুরু অর্থাৎ শিক্ষক কাজী শাহাদাত সাহেব। তিনিই আমাকে সংবাদ তৈরি ও সম্পাদনা শিখিয়েছেন। তাঁর সাথে কাজ করতে করতে এবং প্রশিক্ষণের মাধ্যমে আমাদের সাংবাদিক হিসেবে গড়ে তুলেছেন কাজী শাহাদাত সাহেব। এছাড়া চাঁদপুর কণ্ঠ দৈনিক হিসেবে প্রকাশিত হওয়ার পর তিনি আমাদের ৪/৫ জনকে ৬/৭ মাসের একটি প্রশিক্ষণ দিয়েছিলেন। প্রশিক্ষণ নেয়া শুরু করেছিলাম আলম পলাশ (প্রথম আলোর চাঁদপুর প্রতিনিধি), মহিউদ্দিন সরকার (বর্তমানে দৈনিক যুগান্তরের যুগ্ম সম্পাদক ও সম্পাদক, ঢাকা পোস্ট), গিয়াসউদ্দিন মিলন (সম্পাদক ও প্রকাশক, দৈনিক মেঘনাবার্তা), রাশেদ শাহরিয়ার পলাশ (সম্পাদক, স্বদেশ বাংলা, ঢাকা) এবং আমি (প্রধান সম্পাদক, দৈনিক ইল্শেপাড়)। প্রশিক্ষণ শেষে আমাদের মধ্যে পরীক্ষাও হয়েছিলো। এদের মধ্যে গিয়াসউদ্দিন মিলন পত্রিকার কাজে বেশি ব্যস্ত হয়ে যাওয়ায় প্রশিক্ষণের শুরুতেই তাকে বাদ দেয়া হয়। বাকি আমরা ৪ জন প্রায় ৬/৭ মাস তাঁর কাছে প্রশিক্ষণ নিয়েছিলাম। তিনি আমাদের শব্দের বানান, শব্দের গঠন, বানানরীতি, শব্দের প্রয়োগ, বাক্যগঠন থেকে শুরু করে বাংলা ব্যাকরণ শিখিয়েছেন। এছাড়া সংবাদ তৈরি, সম্পাদনা এবং প্রুফ দেখাও শিখিয়েছিলেন এই প্রশিক্ষণের সময়। একটি পত্রিকা কীভাবে সততার সাথে প্রকাশ করা যাবে তাও তাঁর প্রশিক্ষণের অংশ ছিলো। প্রশিক্ষণের সময় ছিলো দুপুর ৩টা থেকে ৫টা। এরপর শুরু হতো পত্রিকার কাজ। একটানা কাজ। রাতটা চাঁদপুর কণ্ঠে কাটানো ছিলো নিয়মিত অভ্যাস। প্রেসে পত্রিকা ছাপার পর তা নিজ চোখে দেখে তারপর ঘুমুতে যাওয়া। দুপুর ১২টা থেকে ১টার মধ্যে উঠে ২টার মধ্যে অফিসে আসা। তারপর পত্রিকার কিছু কাজ সেরে ৩টা থেকে আবারো প্রশিক্ষণ। দৈনিক চাঁদপুর কণ্ঠের প্রতিষ্ঠাকালীন সময় থেকে যতোদিন ছিলাম চীফ রিপোর্টার হিসেবে দায়িত্ব পালন করি। ওই পদে থাকায় বেশ কিছু দায়িত্বও পালন করতে হতো। এছাড়া তো রয়েছে পত্রিকার সার্কুলেশনের কাজে মাসে অন্তত একবার বিভিন্ন উপজেলাগুলোতে ট্যুর দেয়া।
চাঁদপুর কণ্ঠ ১৯৯৮ সালের ১৫ ডিসেম্বর পর্যন্ত সাপ্তাহিক হিসেবে বের হতো। ১৯৯৮-এর ১৬ ডিসেম্বর দৈনিক হিসেবে প্রথম কপি বের হয়। আনুষ্ঠানিক আত্মপ্রকাশ সংখ্যা বের হয় ১৯৯৯ সালের ৩১ জানুয়ারি। মোট ৬০ পৃষ্ঠার সেই সংখ্যা। কিন্তু কীভাবে পত্রিকার সম্পাদক ও প্রকাশক অ্যাডভোকেট আলহাজ্ব ইকবাল-বিন-বাশারের মধ্যে চাঁদপুর কণ্ঠকে দৈনিক হিসেবে প্রকাশ করার আগ্রহ সৃষ্টি হলো তা হয়তো চাঁদপুর কণ্ঠের সাথে ঘনিষ্ঠ সিনিয়র কয়েকজন ছাড়া কেউ জানেন না। তাছাড়া কেউ হয়তো গভীরভাবে ভেবেও দেখেননি বিষয়টি।
১৯৯৮ সালের ৬ সেপ্টেম্বর। বন্যায় সারা দেশ ডুবে আছে। বিএনপি চেয়ারপার্সন ও সংসদে বিরোধী দলীয় নেতা বেগম খালেদা জিয়া বন্যার্তদের দেখার জন্যে সেদিনই ঢাকা থেকে একটি লঞ্চের বহর নিয়ে বিকেলে চাঁদপুর পৌঁছলেন। বড়স্টেশনস্থ রেলওয়ে যাত্রী ছাউনির পাশে তার পথসভার জন্যে প্যান্ডেল করা হলো। খালেদা জিয়ার ভাষণ শেষ হতে সন্ধ্যা হয়ে গেলো। ঐদিন চাঁদপুরে বন্যার পানি রেকর্ড পরিমাণ বেড়েছিলো। চাঁদপুর শহর বন্যার পানিতে তলিয়ে গেলেও রেল লাইনে পানি উঠেনি। কিন্তু ওইদিন রেল লাইনেও পানি উঠলো। খালেদা জিয়ার বক্তব্য শেষ হওয়ার পর সংবাদ সংগ্রহ করতে যাওয়া আমি মোটরসাইকেল নিয়ে বড়স্টেশন থেকে ফিরতে বেশ বিপাকে পড়ি। কোনো মতে রেলপথের হাঁটু পানি ভেঙ্গে ঝুঁকি নিয়ে বড়স্টেশন থেকে কালীবাড়ি রেলস্টেশন দিয়ে হকার্স মার্কেটস্থ চাঁদপুর কণ্ঠ (সাপ্তাহিক) অফিসে আসি। অফিসে ঢুকে তো অবাক! পত্রিকার সম্পাদক ও প্রকাশক অ্যাডভোকেট ইকবাল-বিন-বাশারসহ বেশ ক’জন বসে আছেন। কারণ, ইকবাল ভাই দু-চার মাস পর পর কোনো উপলক্ষে অফিসে আসতেন। অফিসে বসা ক’জনের মধ্যে মূল ব্যক্তি আহমেদ নজির, বেগম খালেদা জিয়ার তৎকালীন প্রেস সচিব। তাকে ঢাকায় খালেদা জিয়ার সংবাদ পাঠাতে হবে। তাই ইকবাল ভাই তাঁকে কণ্ঠ অফিসে নিয়ে এসেছেন নিউজ কম্পিউটারাইজড এবং ফ্যাক্স করার জন্যে (তখন ই-মেইলের সুবিধা ছিলো না)। সহকর্মী মহিউদ্দিন সরকারের সহযোগিতায় তাদের সংবাদ পাঠানোর ব্যবস্থা হলো। আমি ছিলাম কাছেই। আহমেদ নজির সাহেব ইকবাল ভাইকে বললেন, ‘চাঁদপুর শহর থেকে যেহেতু কোনো দৈনিক পত্রিকা প্রকাশিত হয় না চাঁদপুর কণ্ঠকেই দৈনিক হিসেবে প্রকাশের ব্যবস্থা করো’। যেই বলা সেই কাজ। ইকবাল ভাই পরদিন থেকেই লাগলেন সাপ্তাহিক চাঁদপুর কণ্ঠকে দৈনিকে রূপান্তরের কাজে। তবে সাপ্তাহিক হিসেবে প্রকাশিত হওয়ার সময় অফসেট প্রেসে ছাপা হওয়া, বিশাল পাঠক সৃষ্টি এবং চাঁদপুরের মানুষের ভালোবাসায় চাঁদপুর কণ্ঠকে দৈনিক করার তাগিদ অনুভব করেছেন ইকবাল ভাইসহ অন্যরা। তবে মনে হয় দৈনিকায়নের যে বিশাল কর্মযজ্ঞ সেই সাহস তাঁরা করেননি। আহমেদ নজির সাহেবের কথায় ইকবাল ভাই আশ্বস্ত হয়ে নেমে পড়লেন। আমরাও নেমে গেলাম কাজে।
তৎকালীন ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক কাজী শাহাদাত ও ম্যানেজার গিয়াসউদ্দিন মিলনসহ সবাই লেগে গেলাম কীভাবে চাঁদপুর কণ্ঠকে দৈনিকে প্রকাশ করা যায় সেই চেষ্টায়। যে যার ক্ষেত্রে চেষ্টা করতে লাগলেন। যেহেতু পত্রিকার মালিক তথা সম্পাদক ও প্রকাশক তৎকালীন বিরোধী দল বিএনপির জেলা পর্যায়ের নেতা এবং পত্রিকার সম্পাদকম-লীর সভাপতি এসএ সুলতান টিটু জেলা বিএনপির সভাপতি, সেজন্যে দৈনিকায়ন করা এতো সহজ হচ্ছিলো না। অবশেষে ডিসেম্বরের ১৫ তারিখ বিকেলে চাঁদপুরের তৎকালীন জেলা প্রশাসক রেজাউল করিম দৈনিক চাঁদপুর কণ্ঠ প্রকাশের অনুমতি দিলেন। অবশ্য এজন্যে তৎকালীন সহকর্মী রোকনুজ্জামান রোকন (সম্পাদক, দৈনিক চাঁদপুরজমিন ও দৈনিক অনুপমা)-এর চেষ্টা ছিলো অপরিসীম। অনুমতির চিঠি হাতে পেয়েই সিদ্ধান্ত, ২৪ ঘণ্টার মধ্যে পত্রিকার প্রথম কপি বের করতে হবে। শুরু হয় বাণী তৈরি, সংশ্লিষ্টদের অনুমতি এবং সংবাদ তৈরি করা, কম্পোজ করা, পেস্টিং ও প্রিন্টিং এবং পরদিন হকারদের কাছে পত্রিকা পৌঁছানো। এর পরের কাহিনি হয়তো অনেকের জানা- ১৯৯৯ সালের ৩১ জানুয়ারি আনুষ্ঠানিক আত্মপ্রকাশের পর এ পর্যন্ত। তবে আনুষ্ঠানিক সংখ্যার ৬০ পৃষ্ঠা প্রকাশে ৩/৪ দিন-রাত আমাদের ৫/৭ জনের নির্ঘুম কাটাতে হয়েছিলো।
সম্পাদক ও প্রকাশক অ্যাডভোকেট ইকবাল-বিন-বাশার, প্রধান সম্পাদক কাজী শাহাদাত ও ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক অ্যাডঃ শাহ মোঃ ওবায়েদুল্যা সাহেব ছাড়াও প্রতিষ্ঠাকালীন সময়ে দৈনিক চাঁদপুর কণ্ঠে সহকর্মী হিসেবে কাজ করতেন সিনিয়র সাংবাদিক এমএমএ বাতেন (বিশেষ প্রতিনিধি), আলম পলাশ (সাব-এডিটর), গিয়াসউদ্দিন মিলন (ম্যানেজার), আমি মাহবুবুর রহমান সুমন (চীফ রিপোর্টার), নজরুল ইসলাম স্বপন (বিশেষ প্রতিনিধি), রাশেদ শাহরিয়ার পলাশ (সহকারী বার্তা সম্পাদক), রোকনুজ্জামান রোকন (চীফ ফটোগ্রাফার ও সিনিয়র স্টাফ রিপোর্টার), আঃ গণি (সিনিয়র স্টাফ রিপোর্টার), শাহ্ মোঃ সেলিম (স্টাফ রিপোর্টার), নূর আহমেদ নূরু (কম্পিউটার অপারেটর), মহিউদ্দিন সরকার (স্টাফ রিপোর্টার ও কম্পিউটার অপারেটর), আবু সাঈদ কাউসার (স্টাফ রিপোর্টার ও কম্পিউটার অপারেটর), নাজমুস শাহরিয়ার মিরন (কলেজ রিপোর্টার), শাহ আলম মল্লিক (স্টাফ রিপোর্টার), নজরুল ইসলাম (অফিস সহকারী), টিএম দেলোয়ার (পেস্টার), সফি মাহমুদ (শিক্ষানবিশ স্টাফ) ও হেলাল গাজী (অফিস সহায়ক)।
চাঁদপুর কণ্ঠের প্রতিষ্ঠাকালের কথা বলতে গেলে বলতে হয় চাঁদপুর কণ্ঠের প্রাণ ছিলেন হাজী মির্জা জাকির (প্রতিষ্ঠাকাল থেকে বার্তা সম্পাদক)। সাপ্তাহিক হিসেবে প্রকাশিত হওয়ার পর থেকে দিবা-রাত্রি তিনি পত্রিকার কাজ করতেন। অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ তাঁকে তাঁর অনুপস্থিতিতেও পত্রিকার বার্তা সম্পাদক পদে অধিষ্ঠিত রাখা হয়েছিলো। এমনকি দৈনিক হিসেবে যখন আত্মপ্রকাশ করে তখন তিনি ব্রুনাই অবস্থান করলেও তাঁকে বার্তা সম্পাদকের পদেই রেখেছিলেন ইকবাল ভাই। এছাড়া পত্রিকার জন্যে শ্রম দিয়েছিলেন শহরের বকুলতলা রোডের মোবারক এবং পুরাণবাজার ওসমানিয়া মাদ্রাসার সাবেক শিক্ষক মির্জা মোঃ আলী (বর্তমানে মৃত) নামের একজন। তাদের শ্রমে-ঘামে চাঁদপুর কণ্ঠের যাত্রা শুরু হয়েছিলো। তাছাড়া ঐ সময়ে বিভিন্নজনকে চাঁদপুর কণ্ঠের সাথে যুক্ত করা হয়। আমি রোটার্যাক্ট ক্লাবের বিভিন্ন সংবাদ মির্জা জাকিরের কাছে পৌঁছে দিতাম। সে সুবাদে তাঁর সাথে আমার ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ ছিলো। কয়েক বছর পর ব্রুনাই থেকে ফিরে আবারো চাঁদপুর কণ্ঠে যোগ দিয়ে এখনো কাজ করছেন হাজী মির্জা জাকির। আনুষ্ঠানিক সংখ্যা বেরোবার কয়েক মাস পরে চাঁদপুর কণ্ঠে যোগ দেন এসএম আন্ওয়ারুল করীম, বিএম হান্নান ও রহিম বাদশা (অবশ্য রহিম বাদশা চাঁদপুর কণ্ঠের বাবুরহাট প্রতিনিধি হিসেবে কাজ করছিলেন)। এরপর আরো অনেকে। যারা পরবর্তীতে চাঁদপুরের বিভিন্ন পত্রিকায় সুনামের সাথে কাজ করছেন।
‘সাপ্তাহিক চাঁদপুর কণ্ঠ’ দৈনিকের অনুমতি চেয়ে আবেদন করলেন অ্যাডভোকেট ইকবাল ভাই। কিন্তু দৈনিক হিসেবে প্রকাশিত হলে রেলওয়ে হকার্স মার্কেটের ছোট ঘরটিতে তো আর অফিস হিসেবে কাজ করা যাবে না। প্রয়োজন কমপক্ষে ৩/৪ কক্ষের একটি অফিস, প্রয়োজন কম্পিউটারের যন্ত্রপাতি। ১৯৯৮ সালের অক্টোবর মাসের কোনো এক রাতে ১০টার পরে কাজ শেষ করে পত্রিকা অফিস থেকে শাহাদাত কাকাসহ বের হই। তাঁর বাসায় পৌঁছে (প্রফেসরপাড়ায় দেশের বিশিষ্ট গীতিকার মিলন খানের বাসায় তখন তিনি ভাড়া থাকতেন) দিচ্ছি মোটরসাইকেলে। তিনি জানালেন, বড়ো অফিসের কথা। আমি জানালাম, শপথ চত্বরের পাশে গুয়াখোলা রোডের একটি বাসার নিচতলা ৪ রুমবিশিষ্ট খালি হবে। তিনি বললেন, বিষয়টি আমি জানি। ঐ বাসায় ডাঃ সৈয়দা বদরুন্নাহার চৌধুরী থাকেন। তিনিও বিষয়টি বলেছেন। কিন্তু বর্তমান অবস্থা থেকে তো ভাড়া ৩/৪ গুণ। এছাড়া কম্পিউটারের বিষয়। আমি বললাম, কাকা, বাবার মৃত্যুর পর আমি বিভিন্ন কারণে চাঁদপুরে অবস্থান করছি। তেমন কিছু করা হয়ে উঠে না পত্রিকায় কাজ ছাড়া। যদি বড়ো বাসা নিয়ে অসুবিধা বোধ করেন তবে একটি রুম আমাকে দেবেন। আমি ধার্যমতো ভাড়া পরিশোধ করবো এবং সেখানে একটি কম্পিউটার ট্রেনিং সেন্টার গড়ে তুলবো। তিনি জানালেন, আমাদের টানাটানি চলছে, যদি বাসাটা পেয়ে যাই তবে পত্রিকার সাথেই তোমার কম্পিউটার সেন্টারটি থাকবে। পত্রিকা দৈনিক হিসেবে অনুমতি পাওয়ার পর কম্পিউটার সেন্টার করার জন্যে ঢাকায় গিয়ে কম্পিউটার কিনে এনে শুরু করি ‘চাঁদপুর কণ্ঠ কম্পিউটার’। কম্পিউটার প্রতিষ্ঠানের কিছু অংশের পার্টনার থাকলো দৈনিক চাঁদপুর কণ্ঠ ও গিয়াসউদ্দিন মিলন। চাঁদপুর শহরে শুধুমাত্র মিশনারী ছাড়া বাণিজ্যিক বা ব্যক্তিগতভাবে কারো স্ক্যানার ছিলো না। ছিলো শুধু আমার ‘চাঁদপুর কণ্ঠ কম্পিউটার’-এর। প্রথম প্রথম পরিচিত ২/১জন কম্পিউটারের কাজ নিয়ে আসতো। কিন্তু পত্রিকার ভেতরে প্রতিষ্ঠানটি হওয়ায় অনেকে তেমন একটা স্বাচ্ছন্দ্যবোধ না করায় সেখানে আসতেন না। এর মধ্যে আমাদের অন্যতম কাস্টমার ছিলেন সিরাজ অফসেট প্রেসের কর্ণধার মরহুম সিরাজ ভাই। তাদের স্ক্যানার না থাকায় প্রায়ই ছবি স্ক্যান করে প্রিন্ট নিতো তারা। আর কম্পিউটার প্রশিক্ষণ ছিলো পত্রিকা সংশ্লিষ্টদের জন্যেই। দু-একজন কিছু টাকা দিয়েছে, আর কেউবা শিক্ষানবিশ হিসেবে কাজ করেছে। এদের মধ্যে প্রয়াত সাংবাদিক এমএমএ বাতেন তার ছেলে রাজনকে নিয়ে এলেন কম্পিউটার শিখাবেন বলে। তিনি নগদ ১ হাজার টাকা দিলেন। পরে রাজন এই বিভাগে কাজ করেছে কিছুদিন। তবে এর আগেই দৈনিক চাঁদপুর প্রবাহের ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক (তখন চাঁদপুর কণ্ঠের শিক্ষানবিশ স্টাফ রিপোর্টার) রহিম বাদশাও এখানে কম্পিউটার শিখেন। পরে শিক্ষানবিশ হিসেবে কাজও করেছে কম্পিউটার বিভাগে। অবশ্য ঐ সময় আমাদের একমাত্র কম্পিউটার জানা ব্যক্তি মহিউদ্দিন সরকারের কাছেই আমার কম্পিউটার শিখনের হাতেখড়ি। সে যাক, পত্রিকা সংশ্লিষ্ট হওয়ায় ‘চাঁদপুর কণ্ঠ কম্পিউটার’ নিয়ে আমি আর্থিকভাবে লাভবান হতে পারিনি। শুধুমাত্র কম্পিউটারের খরচ বাবদ চাঁদপুর কণ্ঠ থেকে কিছু টাকা দেয়া হতো। আর্থিকভাবে লাভবান না হলেও চাঁদপুর কণ্ঠে কর্মকালীন বিশাল অভিজ্ঞতা অর্জনই মনে করি আমার অনেক প্রাপ্তি।
সাপ্তাহিক চাঁদপুর কণ্ঠ লেটার প্রেসে ছাপানো হতো। চাঁদপুরে প্রথম পত্রিকা হিসেবে অফসেট প্রেসে তা’ ছাপানোয় অনেকে হিংসাও করেছিল। কেউ কেউ আড়ালে-আবডালে বলতেন, দেখা যাক ক’দিন ছাপতে পারে। কিন্তু যেই ক’দিন চাঁদপুর কণ্ঠ সাপ্তাহিক হিসেবে ছাপা হয়েছিল অফসেট প্রেসেই ছাপা হয়েছে। বর্তমান ডিজিটাল যুগে দৈনিক চাঁদপুর কণ্ঠেরও ডিজিটালাইজেশন হয়েছে। পত্রিকার ওয়েবসাইট হয়েছে। নিয়মিত আপডেট হচ্ছে। ই-মেইল, হোয়াটস অ্যাপ বা অন্যান্য ডিজিটাল মাধ্যমে সংবাদ আদান-প্রদান হচ্ছে। ফেসবুকে চাঁদপুর কণ্ঠের লিংক পাওয়া যাচ্ছে। অফিসে শীতাতপ নিয়ন্ত্রণের ব্যবস্থা হয়েছে। কিন্তু আগের দৈনিক চাঁদপুর কণ্ঠ যেভাবে যত্ন নিয়ে তৈরি হতো বর্তমান ডিজিটাল যুগে মনে হয় ততোটা যত্ন নেয়া হয় না বা যায় না। মানে বিভিন্ন সংবাদ যেভাবে সম্পাদনা এবং প্রুফ দেখা হতো যেভাবে করা হয় না। আর হলেও তখন যেভাবে পত্রিকায় সংবাদ ছাপা হতো এখন মনে হয় সেরকমভাবে হয় না। কীভাবে এবং কী কারণে তা বর্তমান কর্তৃপক্ষই জানেন।
৩০তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর এই শুভক্ষণে চাঁদপুর কণ্ঠের সম্পাদক ও প্রকাশক অ্যাডভোকেট ইকবাল-বিন-বাশার, প্রধান সম্পাদক কাজী শাহাদাত ও বার্তা সম্পাদক এএইচএম আহসান উল্লাহসহ পত্রিকা সংশ্লিষ্ট সবাইকে জানাই আন্তরিক শুভেচ্ছা ও অভিনন্দন।
চাঁদপুরের মানুষের আশা-আকাঙ্ক্ষার প্রতীকে পরিণত হওয়া চাঁদপুর কণ্ঠের প্রতি রইলো আমার শুভ কামনা। শুভ হোক জন্মদিন, সুন্দর হোক চাঁদপুর কণ্ঠের আগামী দিনের পথচলা।
লেখক : সাধারণ সম্পাদক (২০২৪), চাঁদপুর প্রেসক্লাব; প্রধান সম্পাদক, দৈনিক ইল্শেপাড়। প্রতিষ্ঠাকালীন চীফ রিপোর্টার, দৈনিক চাঁদপুর কণ্ঠ; সেক্রেটারী (২০২৪-২৫), চাঁদপুর রোটারী ক্লাব।