শুক্রবার, ২২ নভেম্বর, ২০২৪  |   ২৭ °সে
আজকের পত্রিকা জাতীয়আন্তর্জাতিকরাজনীতিখেলাধুলাবিনোদনঅর্থনীতিশিক্ষাস্বাস্থ্যসারাদেশ ফিচার সম্পাদকীয়
ব্রেকিং নিউজ
  •   মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডারের পুত্রবধূ মাদকসহ যৌথ বাহিনীর হাতে আটক।
  •   মহাখালীতে ট্রেন থামিয়ে শিক্ষার্থীদের হামলা, শিশুসহ কয়েকজন রক্তাক্ত
  •   কমিটি নিয়ে দ্বন্দ্বের জেরে শিক্ষক লাঞ্ছনা ও ভাংচুরের ঘটনা গৃদকালিন্দিয়া কলেজে শিক্ষার্থীদের মধ্যে উত্তেজনা ॥ পাঠদান স্থগিত
  •   চট্টগ্রামে মধ্যরাতে ছাত্রলীগের ঝটিকা মিছিল থেকে অর্থদাতাসহ দুজন গ্রেপ্তার।
  •   রাষ্ট্রীয় পদে আসীন হচ্ছেন খবরে আসামিপক্ষে শুনানি করলেন না সমাজী।

প্রকাশ : ০৫ এপ্রিল ২০২২, ০০:০০

বাঘ জিতেছে সিংহের গুহায়

বাঘ জিতেছে সিংহের গুহায়
পীযূষ কান্তি বড়ুয়া

বাঘে-মোষে লড়াই শব্দ-বন্ধটা ইদানিং হারিয়ে যেতে বসেছে। বর্তমানে বঙ্গবন্ধু জাতীয় স্টেডিয়ামে অর্থাৎ তৎকালীন ঢাকা জাতীয় স্টেডিয়ামে এক সময় আশির দশকে বাঘে-মোষে লড়াইয়ের খবর পাওয়া যেত পত্রিকায়। বাংলাদেশের ফুটবলের সোনালি সময়ে আবাহনী-মোহামেডানের খেলা মানেই বাঘে-মোষে লড়াইয়ের শিরোনাম। পত্রিকাগুলো এই জন্মবৈরি দুই দলের লড়াইয়ের ইন্ট্রোটাও করতো রসিয়ে রসিয়ে। আজকাল সেই রসের আকাল পড়লেও মাঝে-মধ্যে বাংলাদেশের বাঘের গর্জন শোনা যায়। সেই গর্জন সুন্দরবনের ঘন অরণ্য ছাপিয়ে দক্ষিণ আফ্রিকার সিংহের ডেরায় গিয়েও পৌঁছে যায়। প্রোটিয়াসদের মোকাবেলায় টিম টাইগার যখন মাঠে নামে তখন খেলাটা বাঘে-মোষে না হলেও বাঘ-সিংহের মধ্যেই হয় বৈকি। দক্ষিণ আফ্রিকাতে এক সময় মোহনদাস করম চাঁদ গান্ধী নামের জাঁদরেল আইনজীবীটি দাপট দেখিয়েছিলেন উপমহাদেশের মেধার। তিনি স্বভূমে ফিরে স্বদেশী মহাত্মা গান্ধী হয়ে গেলেও আজও তাঁর সেই সুকীর্তির ফল্গুধারা সতত বহমান। সম্ভবত সেই ফল্গুধারার টানেই হয়তো ভারত-বাংলাদেশের বিপুল সংখ্যক মানুষ অভিবাসী হয়েছে দক্ষিণ আফ্রিকা তথা মাদিবার দেশে। তাই সঙ্গত কারণেই তিন ম্যাচের ওয়ানডে ক্রিকেট সিরিজে সদ্য বিজয়ী বাংলাদেশের অধিনায়ক, বাঁ-হাতি তামিম ইকবাল অকপটে বলে ফেলেন খেলা শেষে, 'মনে হয় আমরা ঢাকাতেই আছি।' অধিনায়কের এই মন্তব্য একদিকে যেমন মাঠে আগত স্বদেশি দর্শকদের প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে, তেমনি অন্যদিকে সেদেশে বিপুল সংখ্যক অভিবাসী বাঙালির কথাও মনে করিয়ে দেয়।

এমন একটা দিন ছিল যখন দক্ষিণ আফ্রিকার মাঠেই সাদা বিদ্যুৎ খেলে যেত। সাদা বিদ্যুৎ নামধারী অ্যালেন ডোনাল্ডের বলে বড় বড় দলগুলোর ব্যাটসম্যানেরাই চোখে সর্ষে ফুল দেখতো, আর তখনকার নড়বড়ে বাংলাদেশ দলের খেলোয়াড়দের কথা তো বলাই বাহুল্য। তো ক্রিকেটে এখন আর সেদিন নেই। এখন ওদের সাদা বিদ্যুতের বদলে আমাদের তাসকিন জ্বলে উঠেছে। তবে তার বলে বিদ্যুৎ আছে কি না তা নিশ্চিত না হলেও গতিতে যে বিষ আছে উইকেট সংহারের, সে কথা নিশ্চিত। তা না হলে দক্ষিণ আফ্রিকার ইতিহাসে যেখানে ওয়ানডেতে এর আগে কেবল টু-ডাব্লিউ তথা ওয়াসিমণ্ডওয়াকার এবং বিশেষ ভঙ্গিমার লঙ্কান বোলার লাসিথ মালিঙ্গাই এক ম্যাচে পাঁচ উইকেট পেয়েছেন, সেখানে দীন-দুখিনী বাংলা মায়ের তাসকিনের নামটা যোগ হতো না। তিন ম্যাচ সিরিজের শেষটাতে তিনি একে একে কাইল ভেরেনে, জানেমান মালান, ডেভিড মিলার, ডুয়াইন প্রেটোরিয়াস ও কাগিসো রাবাদারের উইকেট নিয়ে নিজেকে সেই বিরল তালিকায় যুক্ত করেন।

অতি স্বাপ্নিকও কখনো ভাবেনি সিংহের ডেরা হতে বাঘেরা অক্ষত ফিরে আসবে। কেননা, এর আগে দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে ৩-০ ম্যাচে সিরিজ হারা বাংলাদেশ গত কিছুদিন যাবৎ নিজেদের ব্যবস্থাপনাজনিত কারণে বিশৃঙ্খলায় ভুগছিলো। নিউজিল্যান্ডের বিরুদ্ধে পর্যুদস্ত হয়ে প্রোটিয়াদের বিরুদ্ধে তাদের দেশে গিয়ে মোকাবেলা করা এ সময় তাই দুঃস্বপ্নের নামান্তর ছিলো। কিন্তু বাঘ তো বাঘই। কখন যে গর্জায় আর কখন জেগে ঘুমোয় তা অনুমানের ক্ষমতা স্বয়ং কিরোরও নেই।

প্রথম ম্যাচে লিটন আর সাকিবের কল্যাণে আটত্রিশ রানে বিজয়ী বাংলাদেশ যখন অঘটন ঘটিয়েই ফেললো তখন দেশে থাকা ভক্তদের আলাদীনের আশ্চর্য প্রদীপের জিনিসকে হাতে পাওয়ার মতোই সুখ অনুভূত হলো। সাকিবের এত অনিয়ম আর সেলিব্রিটিসুলভ আচরণকে মন থেকে ঝেড়ে ফেলে তাকে বুকে টেনে নিতে পারলেই যেন বাঁচে। আর লিটনকে যারা সাম্প্রদায়িকতার দৃষ্টিতে দেখতো, তারাই ভেবে বসলো, লিটন বাংলাদেশ দলে অপরিহার্য। এই ঘটনায় আবারো সেই পুরানো প্রবাদ মনে চলে আসে, “ঠরপঃড়ৎু যধং সধহু ভধঃযবৎং, ফবভবধঃ হড়হব.” আশার শিখা প্রজ্বলিত করে বাঘেরা বাঙালিকে স্বপ্ন দেখাতে শুরু করে আফ্রিকার ঘন নিবিড় অরণ্যেও। কিন্তু পরের ম্যাচেই সাত উইকেটের পরাজয় সে আশাকে স্তিমিত করে দেয়।

কিন্তু সেঞ্চুরিয়ন নাটকের পা-ুলিপি লিখে রেখেছিল নিজের মতো করে। এখানে সিংহের ডেরায় বাঘের গর্জনই শোনা গেছে শুধু। টসে জিতে দক্ষিণ আফ্রিকার দলনেতা টেম্বা বাভুমা ব্যাটিং নিয়ে বুঝিয়ে দেন, স্বদেশি উইকেটের সাথে তার প্রেম ছিল না। না হলে তিনি বুঝতে পারতেন, সেদিনের উইকেটে ব্যাটসম্যান বধের বিষ মাখানো ছিল। মাত্র তিরাশি রানে প্রোটিয়াদের পাঁচ উইকেটের পতন বাঙালি মহাকাব্যের শিল্প-সুষমাকে প্রকটিত করে। অবশেষে ক্যাসিগো রাবাদাকে মোকাবেলা করে সাকিবের ব্যাটেই এলো বিজয়ের বরমাল্য। দলীয় সংহতির এক বিরাট উপমা এই সিরিজ জয়। শেষ ম্যাচে তামিমের জ্বলজ্বলে সাতাশি রান, লিটনের আটচল্লিশ আর তাসকিনের পাঁচ উইকেট এবং সাকিবের দুটোয় বাংলাদেশের রণতরী ভিড়লো কূলে। আমাদের এ বিজয়ের ফলে গর্ব করে আমরা বলতেই পারি, দক্ষিণ আফ্রিকায় গতির সূতিকাগার পিচে সিরিজ জিতে এক-এক সমতায় আমরাই আছি অনন্য হয়ে।

অধিনায়ক তামিমের ভাষায় দর্শক যেমন বড় শক্তি ছিলো, তেমনি তামিম নিজেও সেদিন অধিনায়ক হিসেবে বেশ গণিত কষেছেন। আগের ম্যাচে ফিজকে চার নম্বরে বোলিং করানো তামিম শেষ ম্যাচে তাকে দিয়েই ওপেন করান আক্রমণের। মোস্তাফিজ, মিরাজ, তাসকিন ও শরীফুলের ব্যাটারি ভালোই কাজে দিয়েছে। সাথে বিশ্বসেরা ওয়ানডে অলরাউন্ডারের ভেলকিতে নয় উইকেটের বিশাল জয়ে আমরা স্পর্শ করি স্বপ্নের আকাশ। অগ্নিঝরা মার্চে আমাদের আগুনের ফুলকি জ্বলে ওঠে ইতিহাসে সবচে’ বেশি শোষিত মানুষদের বনস্পতিতলে। সাকিবের চুলচেরা বিশ্লেষণে ধরা পড়ে এ সিরিজ জয়ের গোপন কথাটি। বর্তমানে বাংলাদেশ দলের কোচিং স্টাফের অধিকাংশই দক্ষিণ আফ্রিকান। তারা যেমন তাদের কন্ডিশন সম্পর্কে অবগত, তেমনি খেলোয়াড়ি কৌশল উন্মোচনেও তারা সফল। তাদের এই শিক্ষাই শিষ্যদের খেলায় মাঠজুড়ে অনূদিত হয়েছে সাফল্যে। এ সফর আমাদের জানিয়ে দিয়েছে, আমাদের পেস আক্রমণ বিশ্বমানের, আমাদের ব্যাটের ধার বিশ্বজয়ী। খেলার মাঠজুড়ে এ রকম গৌরবময় বিজয়ের ধারাবাহিকতায় রচিত হোক আগামী দিনের ইতিহাস। জয় বাংলা।

  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়