প্রকাশ : ২১ আগস্ট ২০২২, ০০:০০
এক.
একটানা নয়টা কন্যাসন্তান জন্ম দেয়ার পর আয়েশা বেগমের ঘর আলো করে এক পুত্রসন্তানের আগমন ঘটে। আকরাম হোসেন খুশিতে হাঁক ছাড়েন; ছেলের কাছে গিয়ে গলা ছেড়ে দিয়ে আযান দেন। খুশির চোটে তিনি যেন দিশেহারা হয়ে পড়েন। কী করবেন ভেবে উঠতে না পেরে পাড়ার সবচেয়ে মুরুব্বি জহুর মণ্ডলের কাছে গিয়ে বলেন, 'কাকা, সত্যিই কি আমার ছাওয়াল অইছে? আমার তো বিশ্বাস করতি কষ্ট অইচ্চে।'
জহুর মণ্ডল আকরাম হোসেনের বুকের উত্তাপ অনুভব করতে পারেন। তিনি তার অভিজ্ঞ চোখ হোসেনের দিকে মেলে দিয়ে বলেন, 'যা দেখতিছো সব সত্যি। আল্লাহ তুমার প্রতি দয়া করিছে। এহন পাড়ার সব মানুষরে মিষ্টি খাওয়াতি হবি। তুমি বাজারেত্তে প্রদীপ ময়রার দুকানে যাইয়ে সবচে দামি মিষ্টি নিয়ে আসবা।'
মণ্ডলের কাছাকাছি যারা দাঁড়িয়ে থাকে তারা শুনতে পায় তার কথা। অমনি হাঁক ছেড়ে বলে, 'হ। মণ্ডল কাকা ঠিক কতাই কইছে। আজকে মিষ্টি না খাওয়ালি চলবি নেনে।'
আকরাম হোসেন কিছুটা সুস্থির হন। তার ঘরে সূর্যের প্রথম রশ্মির মতো পবিত্র এক পুত্রসন্তান এসেছে। আজ তো তার জীবনের সবচেয়ে সুখের দিন। এই সুখ সারা গাঁয়ের মানুষের সঙ্গে ভাগাভাগি করে না নিলে কি চলে!
আকরাম হোসেন বাজারের ব্যাগ হাতে নিয়ে বেরিয়ে পড়েন।
পুত্রসন্তান জন্মের খবর পেয়ে সারা পাড়া যেন ভেঙে পড়েছে আকরামণ্ডআয়েশার ভাঙা কুঁড়েঘরে। এই ভাঙাচোরা ঘরেই এতগুলো সন্তান নিয়ে তারা বসবাস করেন। একটা কুঁড়েঘরের মেঝেতে জন্ম হয়েছে তার। সেখানেই রাখা হয়েছে তাকে। পাড়ার সকল মানুষ এসে দেখছে আর 'মারহাবা' বলে চলে যাচ্ছে। কেউ কেউ আবার একটু এগিয়ে গিয়ে বলছে, 'একেবারে চাঁন্দের টুকরোর মতো ছাওয়াল অইছে। চেহারা-সুরত দেইহে মনে অইচ্চে এই ছাওয়াল একদিন দ্যাশ জয় করবি। তুমরা কী কও?'
সবাই মাথা নাড়ে তার কথায়। তাদেরও একই মত। কাউকে কাউকে একথাও বলতে শোনা যায়, 'গবরের মদ্যি পদ্মফুল ফুটিছে একেবারে।'
আয়েশা বেগম কোনো কথা বলেন না। শুধু ছেলের মুখের দিকে তাকিয়ে থাকেন। তার দুচোখ অশ্রুতে পরিপূর্ণ হয়ে ওঠে। এ অশ্রু কৃতজ্ঞতার অশ্রু।
দুই.
আকরাম হোসেনের ঘরের অভাব কোনোদিনই তাকে ছেড়ে যায়নি। এমনিতেই তিনি বাবার কাছ থেকে কিছুই পাননি। অনেক খেটেখুটে বাড়ির এই জমিটা কিনেছেন। বেশ বড় জায়গা। বাড়ির দক্ষিণ পাশে ছোটখাটো একটা পুকুরও রয়েছে। পুকুরে জমিয়ে রাখা মাছ এবং পাশের খাল-বিল থেকে ধরে আনা মাছ দিয়ে এই অভাবটা তার পূরণ হয়। কিন্তু ভাতের অভাব তো সহজে মিটতে চায় না। ঘরে তার সাতটা মেয়ে; বড়জনের বিয়ে হয়েছে গত বছর। তাদের সঙ্গে বৃদ্ধ মা। এতগুলো মানুষের খাবারের চাহিদা মেটানো সহজ কাজ নয়। মেয়েরা ময়লা-ছেঁড়া কাপড়-চোপড় দিয়ে কোনোমতে দিন পার করে দেয়। গরিব বাপের কাছে তারা কোনোদিন কোনো অভিযোগ নিয়ে আসে না। আর অভিযোগ করেও কোনো ফায়দা নেই। তারা বোঝে তাদের গরিব বাপের পক্ষে সবাইকে নতুন কাপড় কিনে দেয়া সহজ কাজ নয়।
এদিকে একমাত্র ছেড়ে সাজিদ বেড়ে উঠতে থাকে। তার চাহিদার কোনো শেষ নেই। সে এমন সব আব্দার মাঝেমধ্যে করে বসে, আকরাম হোসেন বেশ বিপদে পড়ে যান।
একদিন মধ্যরাত। হঠাৎ করে আকরাম হোসেনের বাড়ি থেকে তারস্বরে চিৎকারের শব্দ পাওয়া যায়। সাড়া পাড়া সচকিত হয়ে ওঠে। সাজিদ কান্না শুরু করেছে। তাকে এখন দোকান থেকে মিষ্টান্ন এনে দিতে হবে। এতরাতে মিষ্টান্ন কোথায় পাওয়া যাবে সেটা সে মোটেই বুঝতে চায় না। বাড়ির সবাই তাকে বোঝাতে ব্যস্ত হয়ে পড়ে। কিন্তু যতই বোঝানো হয়, ততই তার কান্নার বেগ বাড়ে। ফলে ধীরে ধীরে সবাই কেটে পড়ে। আকরাম হোসেন মহা বিপদে পড়ে যান। এই রাতদুপুরে তিনি কীভাবে ছেলের আব্দার পূরণ করবেন! পাশের বাড়ির কেউ একজন মিষ্টান্ন এগিয়ে দিয়ে সে যাত্রা তাদের রক্ষা করে।
তিন.
ছেলেটা ভয়ানক দুষ্টু ও দুরন্ত হলেও পড়াশোনায় বেশ ভালো। বরবরই সে ক্লাসে প্রথম স্থান দখল করে। আকরাম হোসেন ও আয়েশা বেগম মনে মনে স্বস্তি অনুভব করেন। পাড়ার লোকেরা বলাবলি করে, 'এট্টা ছাওয়াল কেনেদিনই কি ভালো অয়? ওই ছাওয়াল আকরামরে ভাত দিবি নাহি!'
আকরাম হোসেন কারও কোনো কথায় কান দেন না। তিনি ছেলের পড়াশোনার দিকে সমস্ত নজর নিবদ্ধ করেন। স্কুলে প্রতি ক্লাসে ফার্স্ট হলে সাজিদের সাথে সাথে হেডস্যারের রুমে আকরামেরও ডাক পড়ে। তিনি বেশ সঙ্কোচ বোধ করেন। এতবড় অফিসে জ্ঞানী-গুণী মানুষের সামনে তার মতো অশিক্ষিত একজন মানুষের যেতে কেমন বাঁধো বাঁধো ঠেকে। আয়েশা হলে তো সেখানে যেতেই পারতো না। আকরাম সমস্ত সঙ্কোচ ঝেড়ে ফেলে দিয়ে হেডস্যারের রুমে এগিয়ে যান। সবাই তাকে বেশ খাতির করেন।
হেডস্যার বলেন, 'আকরাম মিয়া, তোমার তো অনেকগুলো ছেলেমেয়ে তা দিনকাল চলছে কীভাবে? কোনো অসুবিধে হচ্ছে না তো!'
আকরাম হোসেন প্রথমে কিছুটা ঘাবড়ে যান। তারপর সামলে নেন নিজেকে।
'আল্লার রহমত আর আপনাগের দুয়ায় চলতিছে ভালো। কোনো সমস্যা নাই।'
আকরামের হাসিটা কেমন বোকা বোকা লাগে।
হেডস্যার বলেন, 'আপনার ছেলেটা পড়াশোনায় খুব ভালো। ওর খেয়াল রাখবেন। আমরা আশা করছি ওকে দিয়ে উপজেলায় আমাদের স্কুল এবার প্রথম হবে।'
হেডস্যারের সব কথা আকরাম বুঝতে পারেন না। তবে তিনি এটুকু বোঝেন, স্যার তার সন্তানের ভালোর কথাই বলছেন।
'টাকাপয়সার কোনো সমস্যা হলে আমাদের জানাবেন। ঠিক আছে?'
'জি। জানাবো আপনাকে।'
চার.
আকরাম হোসেন গল্পের সেই গণি মিয়ার মতো; নিজের কোনো জমি নেই। বাবা তাকে একেবারে শূন্য হাতে রেখে গিয়েছেন। ফলে অন্যের জমি বর্গা নিয়ে চাষ করা ছাড়া তার কোনো উপায় নেই।
গ্রামে একসময় বর্গা জমি চাষ করা খুব কঠিন ছিল। জমির মালিক কড়ায়-গ-ায় হিসাব বুঝে নিতো; পারলে চাষীর ভাগ থেকেও কৌশলে নিয়ে নিতো। সারাবছর কঠোর পরিশ্রম করে কৃষকের ঘরে খুব সামান্য ফসলই উঠতো।
জমির মালিক জোর করে কৃষকের ওপর আরেকটা বিষয় চাপিয়ে দিতো। এটা মেনে নেওয়া স্বাধীনচেতা কোনো মানুষের পক্ষে বড় কঠিন হয়ে পড়তো। কৃষককে বাধ্যতামূলকভাবে জমির মালিকের সঙ্গে দল করতে হতো। প্রয়োজনে মালিকের নির্দেশে লাঠি হাতে প্রতিপক্ষের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়তে হতো।
এমনই এক মনোমালিন্যের কারণে আকরাম হোসেনকে প্রথমে দল থেকে বের করে দেওয়া হয়। তারপর চাষের সমস্ত জমি জোর করে ছিনিয়ে নেওয়া হয়। মাঠে তিনি ধান লাগিয়েছেন। পাকা ধান কেটে বাড়ি আনা আর হয় না। তিনি অশ্রুসিক্ত চোখে ফসলের দিকে চেয়ে থেকে ঘরে ফিরে আসেন; মালিকের কাছে নতি স্বীকার করেন না।
পাঁচ.
পুরনো দিনের কথা ভাবতে ভাবতে আকরাম হোসেন বড় গভীরে চলে যান। সেই অতলান্তিক সমুদ্র থেকে ফিরে আসতে তাকে বড় বেগ পেতে হয়। অতীতে তিনি বড় দুঃখণ্ডদুর্দশা সয়ে এসেছেন। অনেকেই ভেবেছিল, তিনি বানের জলে খড়কুটোর মতো ভেসে যাবেন। কিন্তু ঠিকই তিনি এখনও শক্ত পায়ে দাঁড়িয়ে আছেন। খোদা ঠেকিয়ে রাখলে কে উড়িয়ে দিতে পারে!
ছেলেটা তার বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সুযোগ পেয়েছে; দেশের নামীদামী বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি। তিনি নিজে এসব ব্যাপারে খুব একটা ভালো বোঝেন না। গ্রামের শিক্ষিত লোকজন বলাবলি করছে।
সাজিদ বিশ্ববিদ্যালয়ে চলে যাবে। ছেলেটা এতদিন বাড়িতেই ছিল। তাই তাকে ছেড়ে দিতে কষ্ট হচ্ছে বড়। আয়েশা বেগম হু হু করে কাঁদছেন। আকরাম কাঁদতে পারেন না। তবে তার বুকের মধ্যে পদ্মার ঢেউ উথালপাথাল করছে বুঝতে পারেন।
যাবার বেলায় ছেলের মাথায় হাত রাখেন তিনি।
'বাপজান, শুনিছি বড় জাগায় গিলি মানুষ পরিবর্তন অয়ে যায়। তয় যিডাই অও না কেন- আমাগের সাতে যোগাযোগ কইরো।'
বাবা কী বলতে চাচ্ছেন সাজিদ তা ঠিকই বুঝতে পারে। বাবার হাতটা নিজের হাতে নিয়ে সে বলে, 'আব্বা, যে মানুষটা তার অতীত ভুলে না যায়, সে সহজে খারাপ হতি পারে না। আপনার কষ্টের কতা ভুলে যাওয়া সম্ভব না।'
সাজিদ চোখ মোছে। সে জানে, বুকের মধ্যে করে বাবা-মায়ের ছবি সে নিয়ে যাচ্ছে। এই ছবি জীবন্ত থাকা অবস্থায় সে কখনও পথভ্রষ্ট হতে পারে না।