প্রকাশ : ০৯ জুন ২০২৩, ০০:০০
সব শিশুর অন্তরে ঘুমিয়ে থাকে ভবিষ্যতের কর্ণধার। তাকে জাগিয়ে তুলতে হয়। কলিকে যেমন ফুল করে ফুটিয়ে তুলতে হয় তেমনি মানব শিশুদেরও ফুটিয়ে তুলতে হয় ধীরে ধীরে। এই প্রস্ফুটনের পুণ্য কাজে শিক্ষার প্রয়োজনীয়তা অপরিহার্য। এই শিক্ষা কখনো প্রাতিষ্ঠানিক আর কখনো স্কুলের পাঠের বাইরের উৎস হতে আসে। কবি-সাহিত্যিকেরা তাঁদের লেখার মাধ্যমে সেই শিক্ষাকে সহজ করে তোলেন। শিশুসাহিত্যিক জাকির হোসেন কামালের শিশুতোষ গল্পগ্রন্থ ' ' বইটি তেমনই এক মহৎ প্রয়াসের ফসল। এ গল্পগ্রন্থে মোট বারটি গল্প আছে। প্রত্যেকটি গল্পই মানবিকতাবোধের দীক্ষায় অপরিহার্য। গল্পগুলির শিরোনাম যথাক্রমে ময়না, বিশেষ কাজ, ভুতু, ভয়হীন রাফিন, মিয়াভাই, নূরা পাগলা, চোর, মুনিয়া, গোয়েন্দা মাসুদ, ওলা, সিরাজউদ্দৌলা ও রাখাল রাজা।
প্রথম গল্প 'ময়না'য় লেখক একটি স্বপ্নের মধ্য দিয়ে শিশু শ্রম ও শিশু নির্যাতনের বিরুদ্ধে তার বক্তব্য তুলে ধরেছেন। মানবিকবোধে উদ্বুদ্ধ শিহান স্বপ্নে শুনতে পায় এক ময়না তার কাছে আকুতি করছে তাকে বাঁচানোর জন্যে। শিহানের এই স্বপ্ন যেন আগামী প্রজন্মের ভেতরে মানুষের প্রতি, আর্তের প্রতি লেখকের বুদ্ধিবৃত্তিক নিবেদন। আমাদের শিশুদের বাঁচাতে হবে। তাদের দিয়ে শ্রমের কাজ করানো থেকে দূরে রাখতে হবে। আমাদের শিশুদের ওপর নির্যাতন বন্ধ করতে হবে। যেখানে এরকম নির্যাতনের ঘটনা ঘটবে সেখানেই প্রতিরোধ করতে হবে। গৃহকর্মে শিশুশ্রমকে ব্যবহার যেমন অন্যায় তেমনি তাদের ওপর শারিরীক আঘাতও অন্যায়।
দ্বিতীয় গল্পটির নাম হলো 'বিশেষ কাজ'। বিশেষ কাজে ব্যস্ত সাবু পড়াশুনায় প্রথমণ্ডদ্বিতীয় না হলেও তার মনে ছিন্নমূল মানুষের প্রতি আছে সহমর্মিতা। তার শ্রেণিকক্ষের শিক্ষক আড়াল হতে সাবুর এই মানবিক কাজের প্রকৃত রূপ দেখতে পেয়েছে। সাবু তাই মেধাবী না হলেও প্রকৃত মানুষ হয়ে উঠতে পেরেছে। এ গল্পের শিক্ষায় আরো একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ের অবতারণা করা হয়েছে। আমরা দেখেছি, সাবু তার ক্লাসের প্রথম,দ্বিতীয় ও তৃতীয় স্থান অধিকারীদের দিয়ে দুর্বল মেধার অনগ্রসর শিক্ষার্থীদের পাঠদানের ব্যবস্থা করেছে। এতে সামগ্রিক উন্নয়নই যে প্রকৃত উন্নয়ন তা পরিষ্কার হয়ে গেছে। শিশুরা সমবায়ের মাধ্যমে শিক্ষায় এগিয়ে গেলে রাষ্ট্র পৌঁছে যাবে কাঙ্ক্ষিত স্থানে।
তৃতীয় গল্পের নাম হলো 'ভুতু'। ভুতু একজন অসামাজিক মানুষ। কারও সাথে কথা বলে না, কারও সাথে তেমন মিশে না। ভুতু গভীর রাতে মাছ ধরতে যায় একা একা। সবাই ভুতুকে ভূত বলে ভুল করে। ভুতুকে সবার সাথে মিলেমিশে থাকার জন্যে পরামর্শ দেয় লোকজন। অর্থাৎ ভুতু গল্প মানুষের সমাজবদ্ধতার মূলবাণীকে ফুটিয়ে তুলেছে।
চতুর্থ গল্পের নাম 'ভয়হীন রাফিন'। এ গল্পে দানশীলতার বিষয়টির ওপর জোর দেয়া হয়েছে। দরিদ্র মানুষের প্রতি দানের হাত খোলা রাখার শিক্ষা আমরা পাই রাফিনের গল্প থেকে। পঞ্চম গল্পের নাম হলো 'মিয়াভাই।' বলার অবকাশ রাখে না, এই মিয়াভাই হলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। তিনি পাশে থাকলে ছোট কর্মীও সাহস পেতো যুদ্ধ জয়ের। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান যেমন মানবিক ছিলেন, মানুষের দুঃখণ্ডদুর্দশায় তাঁর মন যেমন কেঁদে উঠতো তেমনি আগামী প্রজন্মের মানুষগুলোর মধ্যেও এই মানবিক কোমল মনের চর্চা হোক। ষষ্ঠ গল্পের নাম নূরা পাগলা। নাম ভূমিকায় যে লোকটি আছেন তিনি খুব অদ্ভুত কিন্তু পরোপকারী। এই গল্পের মূল সুরই হচ্ছে পরোপকার। এমনকি ক্ষুদ্র প্রাণীর প্রতিও যাতে সহিংসতা না দেখানো হয়, এটাই এই গল্পের মৌলিক শিক্ষা।
সপ্তম গল্পটির নাম চোর। এই গল্পের শিক্ষা সেই চিরন্তন বাণী : মানুষ মানুষেরই জন্যে। আজকের শিশুদের এই মহামন্ত্রটি জানতেই হবে। কেননা কেবল নিজেকে নিয়েই ব্যস্ত থাকলে হবে না। পাড়া-প্রতিবেশি কে কেমন আছে তা জানতে হবে। তাদের দুর্দিনে পাশে দাঁড়াতে হবে। তবেই মানব জন্মের সার্থকতা। গল্পে মানিক ও তার দলবল এক পল্লি মায়ের গাছের কাঁঠাল চুরি করে। কিন্তু সেই কাঁঠাল বিক্রি করেই দরিদ্র না তার ছেলের পড়ার খরচ ও সংসার চালান। তাই মায়ের কান্নায় কাঁঠাল চোরের নেতা মানিকের মনে মানবতা জেগে ওঠে। সে পরবর্তীকালে মায়ের দুঃখণ্ডদারিদ্র্য দূরীকরণে তার পাশে দাঁড়ায়। এই মা-ই পরে কাঁদতে থাকে মানিক চোরকে না দেখে। কারণ মায়ের স্নেহাতুরা মনকে যে মানিক হরণ করেছে তার মানবিক কর্ম দিয়ে। আমাদের এমন প্রজন্মই গঠন করতে হবে যাদের জন্যে মানুষ ভালোবেসে কাঁদে।
অষ্টম গল্পে মুনিয়া নামের এক পাখির সাথে কথা বলে সময় কাটায় গৃহবন্দি বালক যার বাবা-মা উভয়েই কর্মজীবী। এই গল্পটি শিশুদের অধিকারের বিষয়টি তুলে ধরে। প্রতিটি শিশুই বাবা-মায়ের আদর-স্নেহ ও তদারকিতে বেড়ে উঠতে হয়। ব্যস্ত বাবা-মায়ের সন্তানেরা কারো যত্ন পায় না। ফলে তারা একাকী বড় হতে হতে অস্বাভাবিক হয়ে যায়। মুনিয়া গল্পে মুনিয়া পাখি যেন আমাদের সেই সত্য চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেয়। নবম গল্পে আমরা মাসুদের গোয়েন্দাগিরি দেখতে পাই যেখানে সে এক বাণী চিরন্তনী দিয়েই চোর সনাক্ত করে। অতি ভক্তি চোরের লক্ষণ - এই মন্ত্র দিয়েই মাসুদ তার কাজ শেষ করে। এই সত্য আগানী প্রজন্মের জানা দরকার, কেননা
অতিভক্তিকারী খন্দকার মোশতাকই পঁচাত্তরে আমাদের জাতির জনককে হত্যা করিয়েছিল। অতি ভক্তি প্রদশর্নকারীরাই পিঠে ছুরি মারে। দশম গল্প হলো ওলা। লেখক খুব দারুণ মুন্সীয়ানার সাথে ওলা বা বড় হিংস্র পিঁপড়ার মধ্যে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীকে চিত্রিত করেছেন। মুজিব-তনয় রাসেল বাঙালির আজীবন বেদনার প্রতীক। এ গল্পের মাধ্যমে লেখক দেশপ্রেমকে জাগ্রত করতে চেয়েছেন। কারণ যদি আমাদের মনে থাকে আমাদের শত্রু কারা তবে আর বিপদে পড়ার আশঙ্কা নাই। একাদশ গল্প সিরাজউদ্দৌলা আর কিছু নয় দেশপ্রেমিক বঙ্গবন্ধুর প্রতিচ্ছবি। এই গল্পে পঁচাত্তরের পনর আগস্টের বিয়োগান্তক ঘটনাকে বিধৃত করা হয়েছে। দ্বাদশ গল্পের নাম রাখাল রাজা। এই গল্পের মূল উপজীব্য বিষয় বঙ্গবন্ধু এবং তাঁর সারল্য। রাখাল রাজা যেমন বাঁশিতে সুর তোলার জাদু জানতেন তেমনি বঙ্গবন্ধুর আহ্বানের মধ্যেও জাদু উপচে পড়তো। তাঁর সেই গল্পে ইতিহাসের রাখাল রাজা বঙ্গবন্ধু চমৎকার অবয়ব পেয়েছে।
শিশুসাহিত্যিক জাকির হোসেনের বড় দক্ষতা হলো সহজ ভাষায় শিশুদের জন্যে গল্প বলা ও তার মাধ্যমে মানবিক বোধের উত্তরণ ঘটানো। তরুলতা যত সহজে বড় হয়, মানুষ তা হয় না। মানুষকে মানুষরূপে গড়ে তুলতে হলে তার ভেতর মূল্যবোধের চর্চা স্ফূরণ ঘটাতে হয়। জাকির হোসেন কামালের গল্পগুলো তেমন শক্তি নিয়েই নির্মিত। আগামী প্রজন্ম বিনির্মাণে এই গল্পগুলো এক একটি কার্যকর হাতিয়ার। গল্পের ভেতরে গ্রামীণ পরিবেশের যে মধুর বর্ণনা আছে তাতে আজকের শিশুদের চোখে গ্রামের সৌন্দর্য সজীব হয়ে মন কেড়ে নিবে। শিশুরা অ্যাডভেঞ্চার প্রিয়। গল্পের ভেতরে অ্যাডভেঞ্চারের বর্ণনা তাদের আকৃষ্ট করে অধিক। গল্পকার তার গল্পে শিশুতোষ অ্যাডভেঞ্চার ও কৌতূহলের চমৎকার সন্নিবেশ ঘটিয়েছেন। তিনি সরাসরি নীতিকথা না বলে গল্পের রসে মূল্যবোধের অমৃত মিশিয়ে দিয়েছেন। ফলে উদ্দিষ্ট পাঠকের তা মনপ্রাণ দিয়ে আহরণে দ্বিমত কিংবা আয়াসের প্রয়োজন হয়নি। প্রথম ফ্ল্যাপের কিঞ্চিৎ মুদ্রণ প্রমাদ ব্যতিরেকে গল্পবলার মুন্সীয়ানা, গল্পের বিষয়বস্তু, প্রয়োজনীয় অলংকরণ ও পরিচর্যায় বইটি শিশুদের জন্যে একটি আদর্শ গ্রন্থ হিসেবে পরিগণিত হবে।