রবিবার, ২৪ নভেম্বর, ২০২৪  |   ১৯ °সে
আজকের পত্রিকা জাতীয়আন্তর্জাতিকরাজনীতিখেলাধুলাবিনোদনঅর্থনীতিশিক্ষাস্বাস্থ্যসারাদেশ ফিচার সম্পাদকীয়
ব্রেকিং নিউজ
  •   শনিবার চাঁদপুরে ৪ শতাধিক নারী-পুরুষের অংশগ্রহণে ম্যারাথন প্রতিযোগিতা
  •   মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডারের পুত্রবধূ মাদকসহ যৌথ বাহিনীর হাতে আটক।
  •   মহাখালীতে ট্রেন থামিয়ে শিক্ষার্থীদের হামলা, শিশুসহ কয়েকজন রক্তাক্ত
  •   কমিটি নিয়ে দ্বন্দ্বের জেরে শিক্ষক লাঞ্ছনা ও ভাংচুরের ঘটনা গৃদকালিন্দিয়া কলেজে শিক্ষার্থীদের মধ্যে উত্তেজনা ॥ পাঠদান স্থগিত
  •   চট্টগ্রামে মধ্যরাতে ছাত্রলীগের ঝটিকা মিছিল থেকে অর্থদাতাসহ দুজন গ্রেপ্তার।

প্রকাশ : ০৯ জুন ২০২৩, ০০:০০

বাল্যস্মৃতি

বাল্যস্মৃতি
বিমল কান্তি দাশ

মাতৃগর্ভ থেকে প্রাকৃতিক নিয়মে ভূমিষ্ঠ হয়েই এ পৃথিবীতে আলো-বাতাসের সংস্পর্শ এবং মায়ের চাঁদ-বদনখানা প্রত্যক্ষ করেছি। যদিও সে মুহূর্তে তাহা অব্যক্ত অনুভূতিতে সুপ্ত ছিল। মাতৃক্রোড়ে বেড়ে উঠে সোদ্যোগে প্রক্ষালন কক্ষ ব্যবহারের শিক্ষা পর্যন্ত মানুষের শৈশবকাল। পুরো শৈশবটা ব্যাপিয়া মায়ের শিখানো মৌখিক নৈতিক শিক্ষাগুলো জীবনে চলার পথের মোক্ষম পাথেয়। সীতানাথ বসাক রচিত আদর্শ লিপির প্রত্যেক বর্ণভিত্তিক একটি করে চিরন্তনী নৈতিক বাক্য মানব জীবনকে অর্থবহ করে তোলে। যেমন : অসৎ সঙ্গ ত্যাগ কর, ক্ষমা মহত্ত্বের লক্ষণ ইত্যাদি।

তখনো আমার বর্ণ পরিচয় ঘটেনি। মা কিন্তু বিরতিহীন প্রচেষ্টায় বর্ণভিত্তিক নীতিবাক্যগুলো প্রায় সব মুখস্থ করায়ে দিয়েছেন। আমার মা কিন্তু বাবুরহাট উচ্চ বিদ্যালয় থেকে মাইনর পর্যন্ত লেখাপড়া করেছেন। শৈশব শেষে বাল্যকালের প্রারম্ভে কোনো একদিন বাবা-মা আনুষ্ঠানিকভাবে আমার পড়া-লেখার হাতে খড়ি দিয়ে দিলেন। এ বয়সে মানব সন্তান সাধারণতঃ শ্রুতিধর হয়ে থাকে। আমার বর্ণ পরিচয় ঘটেছে মমতাময়ী মায়ের হাতে। বাল্যকালে কলা পাতার উল্টো দিকে বাঁশের কঞ্চির কলমে আর ধান সিদ্ধ করার কড়াইয়ের তলার কালির সাহায্যে ধারাবিহকভাবে বর্ণমালা লেখার অভ্যাস করাতেন। লেখা শেষে মা তাঁর কাজের ফাঁকে লেখাগুলো দেখতেন, ভুল-ত্রুটি সংশোধন করে দিতেন এবং পাতাগুলো পুকুরের জলে বিসজর্ন দিতে বলতেন। এভাবে কিছু দিনের মধ্যেই আমার বর্ণ পরিচয়ের সফল সমাপ্তি ঘটে।

চুপিসারে আমি উপনীত হয়ে গেলাম বাল্যকালে। এ সময়ে যা ঘটার তা-ই ঘটলো। একদিন বাবার হাত ধরে চলে গেলাম বাকিলা উচ্চ ইংরেজি বিদ্যালয় সংলগ্ন প্রাথমিক বিদ্যালয়ে প্রথম শ্রেণিতে ভর্তি হওয়ার জন্যে। যথারীতি উপস্থিত হয়ে দেখলাম, বাবা সুন্দর-গম্ভীর-শান্ত চেহারার লম্বা শ্মশ্রƒতিমণ্ডিত একজন শিক্ষকের কাছে নিয়ে গেলেন। তিনিও বিনীতভাবে বাবাকে একটি কেদারায় বসালেন। আমাকে শিক্ষক মহোদয় ওনার কাছে নিয়ে মাথায় হাত দিয়ে বিভিন্ন প্রশ্ন করতে থাকলেন। এখানে প্রসঙ্গত বলা যায় যে, আমার বাবা অত্র এলাকার একজন প্রথিতযশা আয়ুর্বেদিক চিকিৎসক ছিলেন। প্রধান শিক্ষক উমেদ আলী মিয়ার সাক্ষাৎকার চলাকালীনই উপস্থিত হয়ে গেলেন অপর দুজন শিক্ষক ফাজিলদ্দিন পণ্ডিত এবং কমরউদ্দিন মিয়া (যিনি এলাকায় মিয়া মাস্টার নামে সমধিক পরিচিত)। পণ্ডিত মহোদয়ের জিজ্ঞাসা ছিলো, শতাকিয়া পার কি? উত্তরে বলেছিলাম, আমার মা শিখিয়েছেন। এবার বলার পালা ছিল ১ থেকে ১০ পর্যন্ত আবার ১০ থেকে ১ পর্যন্ত।

তখনকার প্রাথমিক বিদ্যালয় গুলো ছিল প্রত্যেক উচ্চ ইংরেজি বিদ্যালয় সংলগ্ন। যাতে সরকারের নামমাত্র অনুদান ছিল। কিন্তু সম্মানিত শিক্ষকগণ অনেক বড় মাপের পণ্ডিত ছিলেন। তাঁরা প্রবেশিকা কোর্সের আদলে শিক্ষিত ছিলেন। তখন প্রাথমিক শিক্ষার প্রান্তিক পর্ব ছিল 'মাইনর' তথা ষষ্ঠ শ্রেণি পর্যন্ত (মতান্তরে অষ্টম)। আমরাই প্রথম দল যারা ষষ্ঠ শ্রেণি থেকেই উচ্চ ইংরেজি বিদ্যালয়ের সাথে যুক্ত হই। তখন আমি কৈশোরে পদার্পণ করি।

ষষ্ঠ শ্রেণিতে আমরা শিখেছি যে, বাংলায় এগারটি স্বরবর্ণের সাহায্য ব্যতীত ঊনচল্লিশটি ব্যঞ্জনবর্ণ উচ্চারিত বা লিখিত হতে পারে না। যেমন ই ()ি উ ( ু ) ইত্যাদি। আবার ইংরেজীতেও ছাব্বিশটি বর্ণের মধ্যে স্বরবর্ণের ন্যায় ক্রিয়াশীল ৫টি ভাওয়েল (a, e, i, o, u) ভাষা তৈরির ব্যাপারে মুখ্য ভূমিকা রাখে। ষষ্ঠ শ্রেণিতে পাটিগণিতীয় দশটি মূল অঙ্ক যেমন (১,২,৩,৪,৫,৬,৭,৮,৯ এবং ০)-এর স্থানীয় মান নিয়ে বিভিন্ন সমস্যা এবং তার সমাধান করেছি। ইতিহাসে পড়েছি সিন্ধু সভ্যতা থেকে মৌর্য বংশ-পাল বংশ- মোঘলদের সূচনা পর্যন্ত।

ভুগোলে পড়েছি ঋতু পরিবর্তনের কারণ, জোয়ারভাটা-দিবা-রাত্রির হ্রাস-বৃদ্ধি, পূর্ব পাকিস্তানের মানচিত্র ইত্যাদি। পরীক্ষায় হেন্ডেল যুক্ত নিব্ দিয়ে দোয়াত কালিতে লেখা হতো। দুই প্রকারের নিব্ পাওয়া যেত। একটা টিন জাতীয় পদার্থের অপরটি পিতলের। প্রথমটির মূল্য ছিল এক পয়সা, দ্বিতীয়টির মূল্য ছিল দুই পয়সা। তখন চৌষট্টি পয়সায় এক টাকা ছিল। ৬ষ্ঠ শ্রেণির বার্ষিক পরীক্ষায় আমি দ্বিতীয় স্থান অধিকার করে সপ্তম শ্রেণিতে উন্নীত হই। প্রথম স্থান পেয়েছিলেন আমারই বন্ধু মোঃ খলিলুর রহমান। তিনি সচিবালয়ে চাকুরি থেকে অবসর নিয়ে বর্তমানে পরলোকগত।

সপ্তম শ্রেণিতে উন্নীত হয়েই দেখলাম ইংরেজি গ্রামার ৭ম-১০ম পর্যন্ত। P.K. Dey And Irshadulla যৌথভাবে প্রণীত। এর মধ্যে শ্রেণি ওয়ারী বিভাজন ছিল। অনুরূপ ভাবে ৭ম থেকে ১০ম শ্রেণি পর্যন্ত মোঃ আলী আকবর রচিত পাটিগণিত এবং এলজাবরা নিয়ে প্রণীত একখানা বই। আর যাদব চন্দ্র চক্রবর্তী রচিত জ্যামিতি বই। এখানে উল্লেখ্য যে, ইতিপূর্বে সকল শ্রেণিতে যাদব চন্দ্র চক্রবর্তীর গণিত বই পাঠ্য ছিল। সে যুগের শিক্ষকরা সকলেই ভার্সেটাইল জিনিয়াস ছিলেন। এমন একজন চিত্তাকর্ষ গণিত শিক্ষক ছিলেন আহম্মেদ উল্লাহ বি.এস.সি, যার মধ্যে প্রচণ্ড সৃজনশীলতা ছিল এবং জ্যামিতির এক্সট্রা কে তুলোধুনো করে শিক্ষার্থীদের কাছে অত্যন্ত সহজভাবে বুঝাতেন। যেটি তৎকালীন সময়েও অনেক শিক্ষকের যোগ্যতার বাইরে ছিল। এমন একজন মহীয়ান ইংরেজি শিক্ষক পরেশ চন্দ্র চক্রবর্তীকে সৌভাগ্যক্রমে পেয়েছিলাম, যিনি আমাদের ইংরেজিতে অনুবাদ করা একটি প্যাসেজ কে যতবার দেখতেন তত স্টাইলে অনুবাদ করে দিতেন। এখানে উল্লেখ্য যে, মেট্রিকুলেশান পরীক্ষায় ইংরেজি দ্বিতীয় পত্রে ৫০ নম্বর ছিল Passage, ত্রিশ নম্বরের ২টি রচনা, দশ নম্বরের লেটার ও দশ নম্বরের ছিল প্রসিস। অপর একজন গুণধর প্রধান শিক্ষক বাবু রাজেন্দ্র নাথ রায় চৌধুরীকে অনুক্ষণ মনে পড়ে যিনি ভুগোল এবং English Grammar পড়াতেন। ভুগোল পড়ানোর সময় নজর থাকতো ক্লাশ মুখী- হাতে থাকতো ছড়ি- পেছনে ঝুলানো থাকতো মানচিত্র। সঠিকভাবে কাঠির মাথায় নির্দেশ করতেন, এখানে ভিসুভিয়াস, এখানে নায়াগ্রা--এটা অন্ধকারাচ্ছন্ন মহাদেশ। এমন নিখুঁত নির্দেশনা বিস্ময়কর বটে। গ্রামার শিক্ষা এতোটাই ফলপ্রসূ ছিলে যে, সবাই বাড়ির কাজ সমাধা করে আসতেন। ৬ষ্ঠ শ্রেণি পর্যন্ত ব্যবহৃত পাথরের শ্লেট আর পাথরের পেন্সিল। দুটোই ছিল ভঙ্গুর। সপ্তম শ্রেণি থেকে ব্যবহৃত হতো খাতা আর কাঠ পেন্সিল। যার উপর বাড়িতে এসে নিব্ যুক্ত হেন্ডেল দিয়ে দোয়াতের কালিতে লেখা হতো। পরীক্ষার হলেও দোয়াত-কলমণ্ডচোষ কাগজ ব্যবহৃত হতো। এ সমস্ত স্মৃতি আজ স্বপ্ন। মন নামক উৎকৃষ্ট ভিডিও প্লেয়ারটি পুরানো স্মৃতিগুলো উদ্ঘাটন করে আমাদেরকে নিয়ে যায় ৭০-৭৫ বছরের পুরনো স্মৃতি রোমন্থনে। তাইতো কবি বলেছেন, ‘মিথ্যাতো শুনিনি ভাই, মনের চেয়ে বড় মন্দির-কাবা নাই’। কারণ কাবা সংস্কার বা নির্মাণ করেছেন হযরত ইব্রাহীম খলিল আর মনের স্রষ্টা স্বয়ং সৃষ্টিকর্তা।

বিমল কান্তি দাশ : কবি ও প্রবন্ধকার; অবসরপ্রাপ্ত সিনিয়র শিক্ষক, বলাখাল যোগেন্দ্র নারায়ণ উচ্চ বিদ্যালয় ও কারিগরি কলেজ, বলাখাল, হাজীগঞ্জ, চাঁদপুর।

  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়