প্রকাশ : ২০ নভেম্বর ২০২৩, ০০:০০
ছোট অপরাধে বড় শাস্তি! অন্তরালে ভিন্ন উদ্দেশ্য। একসময় যা ছিলো কর্তব্য, সময়ের ব্যবধানে তা হয়ে গেলো অপরাধ। এক সময় অভিভাবকরা তাদের সন্তানকে শিক্ষকদের হাতে তুলে দিয়ে বলতো, ‘মাস্টার মশাই, আমার সন্তানকে আপনার হাতে তুলে দিলাম। মাংস আপনার, হাড্ডি আমার।’ বর্তমান সমাজে যা রূপকথার গল্পের মতোই শোনায়। যেদিন শিক্ষাঙ্গন থেকে শাসনের রূপান্তর ঘটতে শুরু হয়েছে, সেদিন থেকে সন্তানরা অনৈতিক কর্মকাণ্ডের সাথে আস্তে আস্তে নিজেদেরকে জড়িয়ে ফেলে, তৈরি হয় নতুন বাক্য ‘কিশোর গ্যাং’।
উপরের কথাগুলোর সাথে মিলে যায় ফরিদগঞ্জ উপজেলার ‘খাজুরিয়া ওল্ড স্কিম দাখিল মাদ্রাসা’র সুপার কেন্দ্রিক ঘটনাটি। ছাত্রীকে শাসন করতে গিয়ে সামান্য ভুলের জন্যে পাচ্ছেন বিরাট শাস্তি! অনেকেই এ রকম শাস্তির পিছনে দেখছেন ম্যানেজিং কমিটির ভিন্ন উদ্দেশ্য। হয়তো বিগত সময়ে বিভিন্ন নিয়োগের পিছনের গল্প তুলে ধরলে অথবা বিভিন্ন অনিয়মের অধিকতর তদন্ত করলে এর রহস্য বের হয়ে আসতে পারে।
ফরিদগঞ্জ উপজেলার খাজুরিয়া ওল্ড স্কীম দাখিল মাদ্রাসার সুপার মোঃ আবুল বাশারের বিরুদ্ধে যৌন হয়রানির অভিযোগ ওঠে। উপজেলা মাধ্যমিক শিক্ষা অফিসারের বরাবর ছাত্রীর ভাই মোঃ আরমান অভিযোগটি করেন। অভিযোগের আলোকে তদন্ত কমিটি মাদ্রাসার সভাপতি বরাবর তদন্ত প্রতিবেদনটি জমা দেন। প্রতিবেদনের আলোকে সভাপতি মোঃ বুলবুল আহাম্মেদ সুপার মোঃ আবুল বাশারকে প্রতিষ্ঠান থেকে এক মাসের জন্যে বরখাস্ত করেন। বরখাস্তে আবুল বাশার অবাক হন। কারণ তিনি মনে করেন, ‘এমন কোনো অন্যায় তিনি করেন নি যার জন্যে প্রতিষ্ঠান থেকে তাকে সাময়িক বরখাস্ত হতে হবে।’ ওইদিনই তিনি প্রতিকার চেয়ে উপজেলা মাধ্যমিক শিক্ষা অফিসারের বরাবর দরখাস্ত করেন।
দরখাস্তে তিনি উল্লেখ করেন, ‘নবম শ্রেণির শিক্ষার্থীদের ক্লাস নিতে গিয়ে তিনি বিরক্ত হন। কারণ শিক্ষার্থীরা একেতো ক্লাসে পড়া দিতে পারছে না, তার উপর তারা মোবাইল ফোন নিয়ে ক্লাসে আসে। এসব কারণে তিনি ক্ষিপ্ত হয়ে মারতে গেলে ছাত্রীর বাহুতে হাত লাগে।
এই হলো শিক্ষকের অপরাধ। এটাকে কিছু মানুষ রং লাগিয়ে যৌন হয়রানি বলার চেষ্টা করছেন। আদৌ এটাকে কি যৌন হয়রানি বলা যাবে? আরেকটি বিষয়, বহু শিক্ষার্থীর সামনে একজন শিক্ষক কি একটি ছাত্রীকে যৌন হয়রানি করতে পারে? এটা সম্ভব? ঘটনার সঠিক কারণ জানতে এবং অধিকতর তদন্ত করতে উপজেলা নির্বাহী অফিসার আরেকটি তদন্ত কমিটি গঠন করেন। এ কমিটির প্রধান ছিলেন উপজেলা পল্লী উন্নয়ন অফিসার (বিআরডিবি) মোঃ মশিউর রহমান ভূঁইয়া। তিনি কিছুটা সময় নিয়ে সব পক্ষের সাথে কথা বলে একটি প্রতিবেদন তৈরি করেন। প্রতিবেদনে তদন্ত প্রধানের মন্তব্যে তিনি উল্লেখ করেন, ‘তদন্তকারী অফিসার হিসেবে আমি মনে করি, একজন সুপার হুজুর সঠিক পাঠক্রম পরিচালনার জন্যে ছাত্র-ছাত্রীদেরকে শাসন করতে পারেন কিন্তু বিশেষত কোন ছাত্রীকে হাত দিয়ে তিনি প্রহার বা স্পর্শ করতে পারেন না। এটা সুপার হুজুরের ঠিক হয়নি। তবে এই প্রহার কিংবা আচরণকে যৌন হয়রানি হয়েছে বলে আমি মনে করি না। তাছাড়া শ্রেণিকক্ষে উপস্থিত ছাত্র-ছাত্রীদের সাক্ষাতে প্রতীয়মান হয় যে, তারা শ্রেণিকক্ষে থাকাবস্থায় অভিযোগের ব্যাপারে কিছুই দেখতে বা বুঝতে পারেনি। শ্রেণিকক্ষে উপস্থিত এত সকল ছাত্র-ছাত্রীদের সামনে একজন সুপার যৌন হয়রানি করতে পারে এটা চিন্তার বিষয়ও বটে!’
তদন্ত প্রতিবেদনের মূল কথা হলো, যৌন হয়রানির অভিযোগ সত্য নয়। তবে গায়ে হাত দিয়ে প্রহার করা ঠিক হয়নি। শাসন আর হয়রানি এক বিষয় নয়। ম্যানেজিং কমিটির সভাপতি বুলবুল আহম্মেদ যে অতি উৎসাহী হয়ে অথবা সুপারের উপর হিংসা বা ক্ষোভের বশীভূত হয়ে এবং ভিন্ন উদ্দেশ্য বাস্তবায়ন করার জন্যে সুপারকে বারবার বরখাস্ত করছেন--তা স্পষ্ট।
উপজেলা নির্বাহী অফিসার মৌলি মন্ডলের করে দেওয়া তদন্ত কমিটির প্রতিবেদনকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে সভাপতি সেই সুপারকে আবারও ৫ মাসের জন্যে বরখাস্ত করেন। সেই সাথে ‘খাজুরিয়া ওল্ড স্কীম দাখিল মাদ্রাসার সুপারিনটেনডেন্ট (সুপার)-এর পদ থেকে কেন চূড়ান্ত বরখাস্ত করা হবে না’ জানতে চেয়ে আবারও শোকজ করেন।
ছাত্রীকে শাসন করার অপরাধে একজন শিক্ষকের চাকরি চলে যেতে পারে না। এটা তার প্রতি জুলুম হয়েছে বলে অন্য শিক্ষকরা মনে করছেন। প্রথমে যে সাময়িক (এক মাসের) বরখাস্ত ছিলো সেটাই তার জন্য যথেষ্ট শাস্তি ছিলো বলে অনেকেই মনে করছেন। আর এই শাস্তিতে সন্তুষ্ট হয়ে অভিযোগকারী তার অভিযোগ তুলেও নেন।
বাদী-বিবাদী মিলে যাওয়া এবং সর্বশেষ তদন্ত কমিটির তদন্ত প্রতিবেদনে ঘটনাটি যৌন হয়রানি নয় বলে উল্লেখ করার পরও উক্ত প্রতিষ্ঠানের সভাপতি সুপারকে ৫ মাসের জন্যে বরখাস্ত এবং চূড়ান্তভাবে বাদ দেওয়ার যে ব্যবস্থা করছেন, তাতে স্পষ্ট, এটা সভাপতির ক্ষোভ। সুপারের উপর সভাপতির কেন এতো ক্ষোভ সে কারণ খুঁজতে গিয়ে বেশ ক’টি ঘটনা এ প্রতিবেদকের সামনে চলে আসে। তার একটি হলো, মাদ্রাসার সভাপতি নির্বাচনের আগে বরখাস্তকৃত সুপার আবুল বাশার বর্তমান সংসদ সদস্য মুহম্মদ শফিকুর রহমানের প্রতিনিধি সোহেল মাস্টারকে সভাপতি করতে চেয়েছিলেন।
চাকরি হারিয়ে আবুল বাশার মানসিকভাবে ভেঙ্গে পড়েছেন। একেতো সম্মানহানি তার ওপর চাকরি নেই। সন্তানদের পড়ালেখার খরচ, সংসার চালানো তার এই চাকরির সুবাদে। তার এই সামান্য ভুলের জন্যে ক্ষমা চেয়ে এবং ভবিষ্যতে এমন কাজ আর হবে না প্রতিশ্রুতি দিয়েও তিনি সভাপতির দয়া পেলেন না। তিনি সুপারকে ক্ষমা করেন নি। এখন প্রশ্ন হলো, একজন সভাপতি কি এই সামান্য ভুলের জন্যে একজন সুপারকে চাকরিচ্যুত করতে পারেন?