বৃহস্পতিবার, ০৯ জানুয়ারি, ২০২৫  |   ১৬ °সে
আজকের পত্রিকা জাতীয়আন্তর্জাতিকরাজনীতিখেলাধুলাবিনোদনঅর্থনীতিশিক্ষাস্বাস্থ্যসারাদেশ ফিচার সম্পাদকীয়
ব্রেকিং নিউজ
  •   ফরিদগঞ্জের লক্ষ্মীপুরে কিশোর গ্যাংয়ের হামলায় গুরুতর আহত ৩ : এলাকায় আতঙ্ক
  •   শিক্ষা খাতে নজিরবিহীন রদবদল: একযোগে চার বোর্ড চেয়ারম্যানকে ওএসডি
  •   মধ্যরাতের আতঙ্ক
  •   চীনা সেনাদের ভারতের অরুণাচলে অনুপ্রবেশ: বিতর্কিত অঞ্চল নিয়ে উত্তেজনা তুঙ্গে
  •   আপনার টাকা কোথায় গেল?

প্রকাশ : ০৬ আগস্ট ২০২১, ০০:০০

চাঁদপুরে প্রশিক্ষণহীন ৬ শতাধিক স্বেচ্ছাসেবী চিকিৎসকের ভূমিকায়

অক্সিজেন সেবা দিতে গিয়ে বাড়াচ্ছে মৃত্যু ঝুঁকি : অভিজ্ঞজনের মন্তব্য

চাঁদপুরে প্রশিক্ষণহীন ৬ শতাধিক স্বেচ্ছাসেবী চিকিৎসকের ভূমিকায়
রাসেল হাসান ॥

‘এখন যৌবন যার, যুদ্ধে যাবার তার শ্রেষ্ঠ সময়’কবি হেলাল হাফিজের কবিতার এই পঙ্ক্তিটিই হয়তো বুকে ধারণ করেছেন চাঁদপুরের ৬ শতাধিক তরুণ। মহামারি করোনায় পুরো চাঁদপুর যখন বিপর্যস্ত তখন এই তরুণরা ঘরে বসে থাকেনি। কেউ ত্রাণ নিয়ে, কেউ সুরক্ষা সামগ্রী নিয়ে কাজ করেছেন নিজ নিজ এলাকায়। সচেতনতামূলক প্রচারণার পাশাপাশি করোনায় মৃত ব্যক্তির লাশের সৎকারেও কিছু তরুণের রয়েছে সাহসী ভূমিকা। যে কাজগুলোর প্রশংসা করেছে সর্বমহল।

সাম্প্রতিক সময়ে চাঁদপুরে হঠাৎ করেই বাড়তে থাকে করোনা সংক্রমণ। শনাক্তের হার ওঠানামা করছিলো চল্লিশের ঘরে। হাসপাতালে যখন রোগীর উপচে পড়া ভিড়, অক্সিজেনের তীব্র সংকট, বাড়ছে মৃত্যুর সংখ্যা, তখন এই তরুণরাই শুরু করেছে ফ্রি অক্সিজেন সেবা সার্ভিস। অক্সিজেনের অভাবে শ্বাসকষ্টে যেন চাঁদপুরের কোনো রোগী প্রাণ না হারায় তাই নিজেদের সঞ্চিত অর্থে কিংবা অনুদানে কিনে নেয় অক্সিজেন সিলিন্ডার। বাসা-বাড়িতে কেউ শ্বাসকষ্টে ভুগলেই ফোন আসে তরুণদের কাছে। দিনেতো বটেই গভীর রাতেও মানবতার টানে ছুটে যায় স্বেচ্ছাসেবীরা। রোগীর পরিস্থিতির অবনতি দেখলেই রোগীর মুখে অক্সিজেন লাগিয়ে শান্ত করেন তারা।

প্রশ্ন হলো, রোগী অক্সিজেন পাবেন, কি পাবেন না এ সিদ্ধান্তটুকু নিবেন কে? গভীর রাতে অসুস্থ ব্যক্তির বাড়িতে স্বেচ্ছাসেবীরা যখন অক্সিজেন নিয়ে যান তখন কি সেখানে কোনো বিশেষজ্ঞ ডাক্তার উপস্থিত থাকেন? কে নির্ণয় করেন রোগীর পালস? ঠিক ওই মুহূর্তে রোগীকে কত লিটার অক্সিজেন দিতে হবে তা-ই বা নির্ধারণ করেন কোন্ চিকিৎসক? অক্সিজেন রোগীর মুখে লাগানোর পর রাতে যদি স্বাস্থ্যের উন্নতি বা অবনতি ঘটে তবে অক্সিজেনের প্রেশার বাড়ান কমান কে? চাঁদপুর কণ্ঠের অনুসন্ধানে গত দুদিন ধরেও মিলেনি এই প্রশ্নগুলোর সদুত্তর। যতগুলো সংগঠনের স্বেচ্ছাসেবীদের সাথে কথা বলা হয়, প্রত্যেকেরই উত্তর ছিলো, কোনো চিকিৎসকের মাধ্যমে নয়, তারা নিজেরাই পালস অক্সিমিটারের মাধ্যমে রোগীর পালস নির্ণয় করে অক্সিজেন দিয়ে থাকেন। স্বেচ্ছাসেবী কর্মীদের এমন উত্তরে তাদের দিকে তোলা হয় সবচেয়ে বড় প্রশ্নটি। তারা কি প্রশিক্ষণ প্রাপ্ত? প্রতিউত্তরে ‘না’ ছাড়া ‘হ্যাঁ’ বলতে শোনা যায়নি কাউকে।

চাঁদপুর জেলা সিভিল সার্জনের দেয়া তথ্য মতে, জেলার ৬৭টি স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনের মধ্যে চাঁদপুর রেড ক্রিসেন্ট ছাড়া আর কোনো সংগঠনই রোগীকে অক্সিজেন সরবরাহের প্রশিক্ষণ নেয়নি। বাকিরা কীভাবে, কোন প্রক্রিয়ায় রোগীকে অক্সিজেন দিচ্ছেন সে বিষয়ে তিনি অবগত নন। একই সুরে কথা বলে বিস্ময় প্রকাশ করেন চাঁদপুর সরকারি জেনারেল হাসপাতালের তত্ত্বাবধায়ক ডাঃ মোঃ হাবিব-উল-করিম। বলেন, অক্সিজেন একজন রোগীকে তখনই দেয়া হয় যখন রোগীর জীবন সংকটাপন্ন হয়। এমন সময় রোগীকে কী করা উচিত তা কেবল একজন বিশেষায়িত ডাক্তারই নির্ধারণ করবেন। স্বেচ্ছাসেবীরা সে সিদ্ধান্ত কী করে নেন?

চাঁদপুরের করোনার ঊর্ধ্বগতিতে প্রাথমিক ভাবে বিনামূল্যে অক্সিজেন সেবা কাজটি দু-একটি সংগঠন শুরু করলেও পর্যায়ক্রমে বাড়তে বাড়তে জেলায় অক্সিজেন সেবা দেওয়া সংগঠনের সংখ্যা দাঁড়ায় ৬৭টি। এর মধ্যে চাঁদপুর সদর উপজেলায় ১২টি, ফরিদগঞ্জ উপজেলায় ২১টি, হাজীগঞ্জ উপজেলায় ১৩টি, মতলব উত্তর উপজেলায় ৬টি, মতলব দক্ষিণ উপজেলায় ৫টি, কচুয়া উপজেলায় ৪টি, শাহরাস্তি ও হাইমচর উপজেলায় রয়েছে ৩টি করে সংগঠন বা সেবা সংস্থা।

প্রতিটি সংগঠনেই যুক্ত রয়েছেন গড়ে ১০ জন করে স্বেচ্ছাসেবী। যারা একেক জন একেক সময় রোগীর বাড়িতে অক্সিজেন সিলিন্ডার নিয়ে যান। সব মিলিয়ে পুরো জেলায় অক্সিজেন সার্ভিস সেবায় জড়িত সদস্য ৬ শতাধিক। সংগঠনগুলোর অধিকাংশের কাছে সিলিন্ডার মজুদ রয়েছে ১০-১৫টি। ২০টি সিলিন্ডার নিয়ে কাজ করছেন এমন সংগঠনের সংখ্যা ১১টি। খুব কম সংখ্যক সংগঠনই রয়েছে যাদের কাছে সিলিন্ডার আছে পাঁচের নিচে। সব মিলিয়ে পুরো চাঁদপুর জেলায় বাড়ি বাড়ি ঘুরছে ৮ শতাধিক অক্সিজেন সিলিন্ডার।

বাংলাদেশের প্রখ্যাত ডায়াবেটিস ফুট সার্জারি বিশেষজ্ঞ ডাঃ জেআর ওয়াদুদ টিপু জানান, এই ৮শ’ সিলিন্ডারই ৮শ’ বোমা। ব্যবহারবিধি না জানা গ্রামের মানুষদের ঘরে অক্সিজেন সিলিন্ডার ঘটাতে পারে যে কোনো দুর্ঘটনা। রাসায়নিক পদার্থ হিসেবে বিস্ফোরণের সম্ভাবনাতো আছেই, তার পাশাপাশি নির্ভরযোগ্য চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী কোন্ পর্যায়ে কতটুকু অক্সিজেন পরিমাণে দিতে হবে বা আদৌ রোগীর অক্সিজেন সাপোর্ট লাগবে কি-না জানতে হবে তাও। অন্যথায় জীবন বাঁচাতে গিয়ে জীবন পড়তে পারে সংকটে।

পাশের গ্রামে ত্রাণ দিচ্ছে আমরাও দিবো। পাশের গ্রামে সুরক্ষা সামগ্রী দিচ্ছে আমরা কেন দিচ্ছি না? এমন ইতিবাচক প্রতিযোগিতা তরুণরা করতেই পারেন। তাই বলে কোনো প্রশিক্ষণ না নিয়ে চিকিৎসকের ভূমিকায় নামতে হবে? যে সিদ্ধান্তের উপর নির্ভর করে রোগীর বাঁচা মরা, সে সিদ্ধান্ত নিতে হবে? তরুণদের এই মানবিক মানসিকতাকে হাজারবার শ্রদ্ধা জানানো বোদ্ধারাই এখন শংকিত তাদের অক্সিজেন সেবা সার্ভিস নিয়ে।

ফ্রি অক্সিজেন সেবা নিয়ে কাজ করা হাইমচর উপজেলার নীলকমল এলাকার ‘আলোকিত ভবিষ্যৎ’ নামক সংগঠনের ফয়সাল মিয়ার সাথে কথা বলা হয় চাঁদপুর কণ্ঠ থেকে। ‘কীভাবে দিচ্ছেন ফ্রি অক্সিজেন সেবা’ জানতে চাইলে এই স্বেচ্ছাসেবী বলেন, সাধারণত আমরা বাসায় অক্সিজেন পৌঁছাই না। রোগীর স্বজনরা এসে নিয়ে যায়। নিয়ে গিয়ে তারা রোগীকে কিভাবে অক্সিজেন দেন, কোন্ প্রক্রিয়ায় দেন তা তারাই ভালো জানেন। তবে অক্সিজেন সিলিন্ডার নেয়ার সময় রোগীর স্বজনকে একটি কন্ট্রাক্ট পেপারে সাইন করতে হয়। যেখানে উল্লেখ থাকে যদি এই সিলিন্ডার হারিয়ে যায় তবে তার দায় রোগীর পরিবারের। বাজার মূল্য পরিশোধ করতে হবে তাদের।

‘অক্সিজেন সিলিন্ডার হারালে দায় পরিবারের, যদি এই অক্সিজেন অপব্যবহারের কারণে রোগীর জীবন হারিয়ে যায় তবে তার দায় কার?’ -এমন প্রশ্নে নিশ্চুপ ছিলেন তিনি।

হাজীগঞ্জের ধেররা এলাকার করোনাকালীন অক্সিজেন সেবাদানকারী দল ‘হ্যালো সেবা সেন্টার’-এর সুমন তালুকদার জানান, আমরা রোগীর প্রয়োজনে অক্সিজেন সিলিন্ডার বাসায় গিয়ে দিয়ে আসি। সারা রাত রোগীর পাশে থেকে সেবা দেয়া সম্ভব নয়। রাতে অক্সিজেন লেভেল বাড়বে নাকি কমবে তার দায়িত্ব রোগীর ফ্যামিলির। এটি আমাদের দায়িত্ব নয়।

‘বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের অনুপস্থিতিতে রোগীকে অক্সিজেন দেয়ার দায়িত্ব আপনাদের কি?’ -এমন প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে প্রসঙ্গ পাল্টিয়েছেন দ্রুত।

কচুয়া উপজেলার সাচার ইউনিয়নের ‘সেইভ লাইফ সাচার ব্ল্যাড ডোনেটিং ফাউন্ডেশন' এর তপু পোদ্দারকে করা হয় একই প্রশ্ন। কোনো উত্তর না দিয়েই বললেন, আমাদের সংগঠনের সভাপতি মেডিকেল এক্সপার্ট ডায়মন্ড হসপিটালের ম্যানাজার মোঃ সুজন মিয়ার সাথে কথা বলুন। সুজন মিয়াকে প্রশ্ন করা হলো ‘কী করে বুঝেন অক্সিজেনের লেভেল কত চলছে? রোগী কত লিটার পাচ্ছেন অক্সিজেন?’ তিনি বলেন, ‘ভিতরে (সিলিন্ডারের) গুল্লির মত একটা দৌড়াদৌড়ি করে। ওটা অল্প একটু উঠলেই চলে। শ্বাস কষ্ট বেশি হলে গুল্লিটা আরেকটু বাড়িয়ে দেই।’

‘রোগীর জীবন যখন সংকটাপন্ন তখন অক্সিজেন দেয়া না দেয়ার সিদ্ধান্ত কি আপনারা নিতে পারেন?’ এমন প্রশ্নে সুজন মিয়া বলেন, আরে ভাই, অক্সিজেন দিলে কিচ্ছু হয় না। আপনি দশ মিনিটের জায়গায় ১ ঘণ্টা লাগিয়ে রাখলেও কোনো সমস্যা নাই। আমরাতো এমনিতেই সারাদিন অক্সিজেন নেই। ওটা প্রাকৃতিক আর বোতলেরটা বানানো। অক্সিজেন বেশি দিলেও রোগী মরবে না কনফার্ম।

যদিও আত্মবিশ্বাসী স্বেচ্ছাসেবী এক্সপার্ট সুজন মিয়ার কথার সাথে পুরোপুরি দ্বিমত পোষণ করছেন বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকগণ। চাঁদপুর জেলা সিভিল সার্জন ডাঃ মোঃ সাখাওয়াত উল্যাহ বলেন, আমরা বহু পর্যবেক্ষণের পর একজন রোগীকে অক্সিজেন দেই। দিলেও কিছু সময় পর রোগী অক্সিজেন পাবেন কি-না তা নির্ণয় করে লেভেল কমানো বাড়ানো হয়। কিন্তু গ্রামে বহু বাড়িতে রোগীর মুখে দীর্ঘ সময় ধরে অক্সিজেন লাগিয়ে রাখার কথা শোনা যাচ্ছে অহরহ। এতে রোগীর ফুসফুসজনিত বিভিন্ন রোগ দেখা দিতে পারে।

চাঁদপুর সরকারি জেনারেল হাসপাতালের তত্ত্বাবধায়ক ডাঃ মোঃ হাবিব-উল-করিম বলেন, নির্দিষ্ট লেভেলের বাইরে অক্সিজেন পেলে রোগীর দেহের অভ্যন্তরীণ অঙ্গের সমস্যা হবে। মেডিকেলের ভাষায় যাকে বলে ইন্টারনাল হোমিও স্ট্যাসিস। এতে ফুসফুস সহ যে কোনো অঙ্গের বড় ধরণের ক্ষতি হতে পারে। অতি মাত্রায় লেভেল ক্রস করলে মৃত্যুঝুঁকিও রয়েছে। রোগীর অক্সিজেন লাগবে কি-না তা বিশেষজ্ঞ ডাক্তার ছাড়া অন্য কেউ নির্ধারণের সুযোগ নেই।

ফরিদগঞ্জ উপজেলার ৬নং গুপ্টি ইউনিয়নের ‘আদর্শ সেবা টিম’ নামক সংগঠনের সমন্বয়ক শামীম হোসেন জানান, আমরা পালস অক্সিমিটার দিয়ে পালস মাপি। পালস ৭০-এর নিচে থাকলে দেড় পয়েন্ট দেই। ৭০-এর উপরে হলে ১ পয়েন্ট দেই। ‘রোগী কখন কত লিটার গ্রহণ করবেন বা প্রয়োজন তা কী করে নির্ণয় করেন’ জানতে চাইলে শামীম হোসেন বলেন, আমি লিটার বুঝি না, পয়েন্ট বুঝি।

‘আপনার সরবরাহকৃত অক্সিজেন সিলিন্ডারের কারণে যদি রোগীর বাসায় কোনো দুর্ঘটনা ঘটে বা রোগীর কোনো সমস্যা হয়, তবে এর দায় কে নিবে?’ এমন প্রশ্নে ক্ষীণ কণ্ঠে শামীম হোসেনের উত্তর, দুর্ঘটনার কথা আগে ভেবে দেখি নাই। তবে পালস অক্সিমিটার দিয়ে মেপে যেহেতু অক্সিজেন দেই, রোগীর সমস্যা হবে না।

রোগীর সমস্যা হবে কি-না তা নিয়ে কথা বলা হয় বিশিষ্ট চিকিৎসক ও লেখক ডাঃ পীযূষ কান্তি বড়ুয়ার সাথে। তিনি বলেন, আগে স্বেচ্ছাসেবীকে জিজ্ঞাসা করতে হবে তাকে রোগীর মুখে অক্সিজেন লাগানোর লাইসেন্স দিয়েছে কে? তরুণরা অন্তত চিকিৎসকের ভূমিকায় হিরোইজম দেখানো উচিত নয়। পালস অক্সিমিটারে পালস মেপে অক্সিজেন রোগীর মুখে ফিট করে দিলেই দায়িত্ব শেষ নয়। সারা রাত অসংখ্যবার রোগীর পালস ওঠানামা করতে পারে, তার জন্য একজন অভিজ্ঞ ডাক্তারের পর্যবেক্ষণে থাকা জরুরি। অক্সিজেন সেবা খুব ক্রিটিক্যাল একটি কাজ। যে কেউ চাইলেই এটি করতে পারে না। যদি স্বেচ্ছাসেবীরা অক্সিজেন কোনো হসপিটালকে দিতো, কোনো চিকিৎসকের হাতে তুলে দিতো তাহলে কাজটি যথোপযুক্ত হতো। কিন্তু প্রশিক্ষণহীন তরুণরা নিজেরা বাড়ি গিয়ে নিজেরাই অক্সিজেন সাপোর্ট দেয়াটা ঝুঁকিপূর্ণ।

শাহরাস্তি উপজেলার ‘দিশারী সমাজকল্যাণ সংস্থা’র মহিবুল করিম তামীম জানান, আমরা রোগীর পরিবারকে অক্সিজেন সিলিন্ডার দিয়ে দেই। কীভাবে চালাবে এটা তারা জানে। বোতল খালি হলে আমরা গিয়ে নিয়ে আসি। ‘আপনার সিলিন্ডারের মাধ্যমে যদি বাসায় কোনো বিস্ফোরণ ঘটে বা রোগীর স্বাস্থ্য সমস্যা হয় তবে এর দায় কার?’ প্রতিউত্তরে তিনি বললেন, আমরা উপরের নির্দেশে কাজ করি। আমাদের ক্ষতি হবে কেন? চাঁদপুরের ডিসি আমাদের নিয়ে মিটিং করেছেন। তিনি তার সিদ্ধান্ত উপজেলার ইউএনওকে জানিয়েছেন। গত তিনদিন আগেও হাজীগঞ্জ ইউএনও অফিসে আমাদের মিটিং হয়। সেখানে আমাদের দিক নির্দেশনা দেয়া হয়। কাজেই দায় আমাদের হবে কেন?

স্বেচ্ছাসেবী মহিবুল করিম তামিমের কথার সত্যতা খুঁজতে ঘটনার আরও গভীরে যাওয়া হয়। আসলেই কি চাঁদপুর জেলা প্রশাসনের নির্দেশেই চলছে তরুণদের এমন ঝুঁকিপূর্ণ কর্মযজ্ঞ? এ প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে চাঁদপুর কণ্ঠ থেকে কথা বলা হয় হাজীগঞ্জ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মোমেনা আক্তারের সাথে। তিনি বলেন, আমার অফিসে কোনো মিটিং হয়েছে কথাটি সত্যি নয়। উনারা কয়েকটি সংগঠন আমার সাথে দেখা করতে এসেছেন। আমি বলেছি অক্সিজেন সরবরাহের বিষয়ে যেন বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের পরামর্শ নিয়ে রোগীকে সার্ভিস দেয়া হয়। বিশেষজ্ঞ ডাক্তারের পরামর্শ ছাড়া যদি কোনো স্বেচ্ছাসেবী একাই চিকিৎসকের ভূমিকা পালন করেন তবে কোনো দুর্ঘটনা ঘটলে দায়টা তাদেরকেই নিতে হবে।

এ বিষয়ে চাঁদপুর জেলা প্রশাসন অবগত কি-না জানতে চাইলে চাঁদপুরের জেলা প্রশাসক অঞ্জনা খান মজলিশ বলেন, চাঁদপুরের কোথায় কোন্ সংগঠন কীভাবে অক্সিজেন সেবা দিয়ে যাচ্ছেন এ সম্পর্কে আমি অবগত নই। কোনো সংগঠন আমার সাথে এ বিষয়ে কোনো প্রকার আলাপ করেনি। বরং আমি মনে করি খুব বড় ধরণের একটি ঝুঁকি নিচ্ছে এই তরুণরা। কোন্ রোগীর কতটুকু অক্সিজেন লাগবে তা শুধু একজন বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকই নিতে পারবেন। স্বেচ্ছাসেবীরা এ দায়িত্ব কী করে নিতে পারেন? মাত্রার চেয়ে অধিক পরিমাণ অক্সিজেন গ্রহণ করলে কোনো রোগী করোনা থেকে সুস্থ হলেও পরবর্তীতে সে বিভিন্ন ধরণের রোগে ভুগতে পারেন।

জেলা প্রশাসক শঙ্কা প্রকাশ করে বলেন, এ ধরণের অক্সিজেন সিলিন্ডারে দু'ধরণের অক্সিজেন থাকে। একটি মেডিকেল, অপরটি ক্যামিকেল। কোনো কারণে যদি মেডিকেল অক্সিজেনের পরিবর্তে ক্যামিকেল অক্সিজেন সিলিন্ডার বদল হয়ে যায় তবে মারাত্মক ধরণের ক্ষতি হয়ে যাবে। যা একজন বিশেষজ্ঞ ডাক্তারই নির্ধারণ করতে পারবেন। তরুণদের মানবিক প্রচেষ্টাকে স্বাগত জানাই। তবে তাদের কাজ করার আরো সেক্টর রয়েছে। যে সেক্টরে মৃত্যুঝুঁকি রয়েছে সে সেক্টরে কাজ না করাই ভালো।

এখানেই শেষ নয়, আরেকটি প্রশ্নের উত্তর জানা এখনো বাকি রয়ে গেছে। ৬৭টি সংগঠন থেকে প্রাপ্ত তথ্যের ভিত্তিতে জানা যায় ৮শ'র মত অক্সিজেন সিলিন্ডার পুরো জেলায় বিভিন্ন বাড়িতে ঘুরছে। সম্প্রতি চাঁদপুর কণ্ঠে প্রকাশিত এক সংবাদে উঠে আসে ‘চাঁদপুর জেনারেল হাসপাতালে রোগীদের উপচে পড়া ভিড়, উপজেলার হাসপাতালগুলোতে ফাঁকা রয়েছে করোনা বেড’। প্রশ্ন হলো উপজেলা হাসপাতালগুলোতে যদি বেড খালি থাকে তবে বিভিন্ন উপজেলায় রোগীরা বাসায় অক্সিজেন নিতে ব্যস্ত কেন? গত দুই দিনের অনুসন্ধানে মিলেছে তারও উত্তর।

প্রতিদিন জেলায় যে সকল মানুষ করোনায় আক্রান্ত হচ্ছেন তাদেরকে ফোন করে জানিয়ে দেয়া হয় স্থানীয় উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স থেকে। অভিযোগ রয়েছে, হাসপাতাল থেকে রোগীদের ফোনে বলা হয়, আপনার করোনা পজিটিভ এসেছে। আগামী ১৪ দিন বাসায় থাকুন। শ্বাসকষ্ট বাড়লে একটা অক্সিজেন এনে রাখুন বাসায়। তেমনই অসংখ্য ঘটনার একটি হাজীগঞ্জ পৌরসভার ৫নং ওয়ার্ডের ৫০ বছর বয়সী মেহেরুন্নেছার সাথে ঘটেছে। বুধবার রাতে তার রিপোর্ট পজিটিভ আসলে হাসপাতাল থেকে ফোনে মেহেরুন্নেছার জামাতাকে এসব কথা বলা হয়। করোনা আক্রান্ত মেহেরুন্নেছার জামাতা চাঁদপুর কণ্ঠকে বলেন, আমাকে বলা হয়েছে রোগীকে বাসায় রাখার জন্যে। শ্বাসকষ্ট থাকলে একটা অক্সিজেন ম্যানেজ করে বাসায় রাখতে, পালস অক্সিমিটার ম্যানেজ করতে, পালস ৮০’র নিচে নেমে গেলে মুখে অক্সিজেন দিতে। আমি স্থানীয় স্বেচ্ছাসেবীদের কাছ থেকে একটি অক্সিজেন নিজে গিয়ে নিয়ে এসেছি। আজ (বৃহস্পতিবার) আম্মার পালস ৮০-এর নিচে নেমে যাওয়ায় অক্সিজেন দিয়েছি। পরে ৮০-এর উপরে উঠায় খুলে ফেলেছি।

‘আপনিতো চিকিৎসক নন, এ কাজটি আপনার পরিবর্তে একজন অভিজ্ঞ চিকিৎসক করলে রোগীর জন্য ভালো হতো না?, এমন প্রশ্নে তিনি বলেন, অবশ্যই ভালো হতো। এখন ডাক্তাররা যেভাবে নির্দেশনা দিয়েছেন, আমিতো সেভাবেই করেছি। বাকিটা হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ জানেন।

‘হাজীগঞ্জ উপজেলা হাসপাতালে কি করোনা ওয়ার্ড খালি নেই?’ নিশ্চিত হতে কথা বলা হয় হাজীগঞ্জ উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা ডাঃ এস.এম. সোয়েব আহমেদ চিশতীর সাথে। তিনি জানান, বর্তমানে হাজীগঞ্জ উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে ২০টি করোনা বেডের মধ্যে ৮টি খালি রয়েছে। ভর্তিকৃত ১২ জন রোগীর মধ্যে ৬জন রোগীকে নিয়মিত অক্সিজেন সেবা দিয়েও অক্সিজেন মজুদ আছে আরও ৪ থেকে ৫টি সিলিন্ডার।

‘হাসপাতালে বেড খালি থাকার পরও কেন করোনা পজেটিভ রোগী যার পালস ৮০’র নিচে ওঠানামা করছে তাকে বাসায় চিকিৎসা নিতে হচ্ছে? পর্যাপ্ত অক্সিজেন মজুদ থাকার পরও কেন স্বেচ্ছাসেবীদের কাছ থেকে অক্সিজেন সংগ্রহ করে অনভিজ্ঞ ব্যক্তি দ্বারা রোগীকে অক্সিজেন দিতে হচ্ছে’ জানতে চাইলে বিস্ময় প্রকাশ করে ডাঃ এস.এম. সোয়েব আহমেদ চিশতী বলেন, আমার হাসপাতালে এ ধরণের কাজ হচ্ছে আমি এই প্রথম শুনলাম। বিষয়টি খুবই দুঃখজনক। আমার নির্দেশনা দেওয়া আছে, করোনা পজিটিভ রোগীর কোনো প্রকার স্বাস্থ্য অবনতি ঘটলেই তাকে হাসপাতালে নিয়ে আসতে হবে। আমরা তার স্বাস্থ্য পর্যবেক্ষণ করবো। অবস্থার অবনতি ঘটলে জেলায় রেফার করবো। স্বেচ্ছাসেবীদের কাছ থেকে অক্সিজেন নিয়ে বাসায় চিকিৎসা চালানোর মত কথা কোনো দায়িত্বশীল অফিসার বলতে পারেন না। আমি বিষয়টি খতিয়ে দেখছি।

তবে কি প্রতিটি উপজেলার সরকারি হাসপাতালের চিত্রই এমন? এজন্যেই কি উপজেলার হাসপাতালগুলোর করোনা বেড ফাঁকা? প্রশ্ন থেকেই যায়। যদি তা সত্যিই হয় তবে জীবন বাজি রেখে অর্থ ব্যয় করে ফ্রি অক্সিজেন সার্ভিস দেয়া প্রশিক্ষণহীন স্বেচ্ছাসেবীদের দিকে আঙ্গুল না তুলে আঙ্গুল তোলা উচিত জেলার চিকিৎসা ব্যবস্থার দিকে।

  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়