প্রকাশ : ২৭ ডিসেম্বর ২০২২, ০০:০০
বাংলাদেশের শীর্ষস্থানীয় শিল্প প্রতিষ্ঠান আকিজ গ্রুপের প্রায় ৪ কোটি টাকার চিনি লাইটারেজ জাহাজ থেকে নামিয়ে চাঁদপুরে মেঘনা নদীর চিহ্নিত চোরাকারবারী জাহাঙ্গীর আলম গাজী ওরফে মরু হাজীর (৫০) মাধ্যমে বিক্রি করেছে বলে অভিযোগ উঠেছে। ভারত থেকে চট্টগ্রাম বন্দরের বহির্নোঙ্গরে থাকা জাহাজ থেকে পণ্যবাহী দেওয়ান মেহেদী-২ নামের লাইটারেজ জাহাজে করে ২০ হাজার ৩০০ বস্তা চিনি নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জ যাওয়ার উদ্দেশ্যে রওনা হয়।
পথিমধ্যে মতলব উত্তরের মোহনপুর মেঘনা নদীতে নোঙ্গর করে ৮ হাজার বস্তা চিনি রাতের অন্ধকারে চোরাকারবারি জাহাঙ্গীর আলম মরু গাজী, তার সহযোগী রঘুনাথপুর এলাকার শাহজাহান, পুরাণবাজারের ফজল ও ১নং ঘাটের আলী খার মাধ্যমে পাচারের পর অন্যত্র বিক্রি করে দেয়।
এই ঘটনায় আকিজ গ্রুপ অব কোম্পানীর পক্ষ থেকে মতলব থানায় একটি মামলা দায়ের করা হয়। অবশেষে মোহনপুর নৌ-পুলিশ ফাঁড়ির ইনচার্জ মনিরুজ্জামান সঙ্গীয় ফোর্স নিয়ে দেওয়ান মেহেদী-২ লাইটারেজ জাহাজের মাস্টার সহ ১১ জনকে আটক করে আদালতে প্রেরণ করেন। তাদের স্বীকারোক্তি অনুযায়ী চাঁদপুরে চিহ্নিত চোরাকারবারি জাহাঙ্গীর আলম মরু হাজী সহ চারজনের নাম প্রকাশ পায়।
সেই চোরাকারবারিরা আকিজ গ্রুপ অব কোম্পানির ৮ হাজার বস্তা চিনি সেই লাইটারে জাহাজ থেকে স্টীলবডি ট্রলারে নামিয়ে ফরিদপুরের বাকিতুল্লাহ বিশ্বাসের কাছে বিক্রি করে। সেই চিনি ফরিদপুর, মাদারীপুর ও কুষ্টিয়ায় পাচার হয়েছে বলে তথ্য মিলেছে।
নৌ-পুলিশ জানিয়েছে, গত ১৮ ডিসেম্বর রাতে চট্টগ্রাম থেকে চিনি নিয়ে নারায়ণগঞ্জ যাওয়ার পথে দেওয়ান মেহেদী-২ লাইটারেজ জাহাজ থেকে ৮ হাজার বস্তা চিনি পাচার হয়ে যায়। সেই ঘটনায় জাহাজের মাস্টার সহ ১১ জনকে আটক করার পর চাঁদপুরের চিহ্নিত চোরাকারবারিদের নাম বেরিয়ে আসে। এই ঘটনায় সেই চোরাকারবারিদের ধরার জন্য পুলিশ তৎপর রয়েছে। তবে অভিযুক্ত চোরাকারবারিরা গা ঢাকা দিয়েছে।
খোয়া যাওয়া মালের মূল্য প্রায় ৪ কোটি টাকা বলে জানিয়েছেন আকিজ গ্রুপ অব কোম্পানির কর্তৃপক্ষ।
চাঁদপুর নৌ থানার ওসি কামরুজ্জামান জানান, এ ঘটনায় জড়িত চাঁদপুরের চোরাকারবারীদের ধরার চেষ্টা চলছে। এ ব্যাপারে নৌ পুলিশের তদন্ত অব্যাহত রয়েছে।
এদিকে স্থানীয়রা জানিয়েছেন, চাঁদপুরের চিহ্নিত চোরাকারবারিদের গডফাদার জাহাঙ্গীর আলম গাজী ওরফে মরু হাজী (পিতা মৃত কেরামত গাজী সাং চাঁদপুর শহরের স্ট্র্যান্ড রোড) দীর্ঘ বছর যাবত নদীতে লাইটারেজ জাহাজ থেকে বিভিন্ন পণ্য চোরাচালানির মাধ্যমে ক্রয়-বিক্রয় করে আসছে। সে এই কাজ করে কমপক্ষে শত কোটি টাকার মালিক বনে গেছে। তার নামে-বেনামে বাড়ি ও জায়গা জমি রয়েছে। চাঁদপুর শহরের স্ট্র্যান্ড রোডে তার নিজস্ব পাঁচতলা আলিশান বাড়ি রয়েছে। এই বাড়িতেই সে বসবাস করে। তাকে ধরলেই মেঘনা নদীতে চোরাচালান কমবে বলে মনে করছেন সচেতন মহল।
এদিকে দৈনিক জনকণ্ঠ পত্রিকায় এবং তাদের অনলাইনে প্রকাশিত ২২ ডিসেম্বর ‘হাজার টন চিনি নিয়ে লাপাত্তা জাহাজের সন্ধান মিলেছে’ শিরোনামে রিপোর্ট থেকে জানা যায়, চট্টগ্রাম বন্দরের বহির্নোঙরের একটি জাহাজ থেকে এক হাজার টন চিনি নিয়ে লাপাত্তা হওয়া লাইটার জাহাজটির অবশেষে সন্ধান মিলেছে। তবে সে জাহাজ থেকে লোপাট হয়ে গেছে অর্ধেকেরও বেশি চিনি। লুট হওয়া চিনির মূল্য ১০ কোটি টাকারও বেশি। নৌ-পুলিশের অভিযানে উদ্ধার হওয়া জাহাজটির সকল নাবিককে আটক করে জিজ্ঞাসাবাদ করা হচ্ছে। এ ব্যাপারে একটি মামলাও দায়ের হয়েছে।
চট্টগ্রাম বন্দর বহির্নোঙরে এমভি লয়েলিটি নামের একটি মাদার ভেসেল থেকে এক হাজার ১৫ টন চিনি খালাস করে গত ১৫ ডিসেম্বর নারায়ণগঞ্জের উদ্দেশে যাত্রা করেছিল এমভি দেওয়ান মেহেদী-২ নামের লাইটারেজ জাহাজ। মোট ২০ হাজার ৩শ’ বস্তা চিনি ছিল জাহাজটিতে। এ চিনির আমদানিকারক প্রতিষ্ঠান আকিজ গ্রুপ। আকিজ ফুড অ্যান্ড বেভারেজের জন্য এগুলো আমদানি করা হয়েছিল।
বহির্নোঙরে খালাস নেয়ার পরও যথাসময়ে গন্তব্যে না পৌঁছায় চিনির আমদানিকারক প্রতিষ্ঠানসহ সংশ্লিষ্ট পক্ষগুলোর খোঁজাখুঁজি শুরু হয়। আমদানিকারকদের পক্ষে স্কট থাকার পরও কিভাবে জাহাজটি থেকে চিনি লোপাট হলো তা নিয়ে প্রশ্ন দেখা দিয়েছে।
জাহাজের নাবিকরা বলছে, সংঘবদ্ধ একটি ডাকাত দল তাদের অস্ত্রের মুখে জিম্মি করে চিনিগুলো লুটে নিয়েছে। অপরদিকে পরিবহনের দায়িত্বে নিয়োজিত ঠিকাদারের অভিযোগ, জাহাজের নাবিকরাই সুকৌশলে এসব চিনি বিক্রি করে দিয়েছে। তবে অভিযোগের ভিত্তিতে নৌ-পুলিশ সদস্যরা অভিযান চালিয়ে বুধবার ভোরে জাহাজটির সন্ধান পেয়েছে চাঁদপুরের মোহনপুর এলাকায়। কিন্তু দেখা যায়, যে পরিমাণ চিনি বোঝাই করা হয়েছিল তার অর্ধেকও নেই।
চট্টগ্রাম বন্দরের বহির্নোঙর থেকে যাত্রা করা চিনিবোঝাই জাহাজটি যখন সময় মতো পৌঁছালো না, তখনই এর ভাগ্য নিয়ে সন্দেহ দেখা দেয়। প্রথমে আমদানিকারক প্রতিষ্ঠানের পক্ষ থেকে জাহাজে যোগাযোগ করা হলে মাস্টার জানান, ইঞ্জিন সমস্যার কারণে জাহাজ মেরামত করতে হচ্ছে। সচল হলে চিনি পৌঁছে যাবে। কিন্তু এরপরও সময় গড়াতে থাকে। একপর্যায়ে জাহাজের সঙ্গে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। সকল নাবিকের মোবাইল ফোন বন্ধ পাওয়া যায়।
উদ্ধারের পর জিজ্ঞাসাবাদে জাহাজটির নাবিকরা জানায়, অস্ত্রধারী সন্ত্রাসীদের একটি দল তাদের জিম্মি করেছিল। এরপর মেঘনা, ষাটনল ও এখলাসপুর নিয়ে চিনিগুলো লোপাট করেছে। কিন্তু ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান বলছে, একটি জাহাজ জিম্মি করে তিনদিন ধরে লুটপাট চালানো বিশ্বাসযোগ্য নয়। নাবিকরাই বাইরে যোগসাজশ করে এ ঘটনা ঘটিয়েছে।
অভ্যন্তরীণ রুটে চলাচলকারী জাহাজ নিয়ন্ত্রণকারী সংস্থা ওয়াটার ট্রান্সপোর্ট সেলের (ডব্লিউটিসি) নির্বাহী পরিচালক মাহবুব রশিদ সাংবাদিকদের জানান, চিনি পরিবহনের জন্য লাইটারেজ জাহাজটির বরাদ্দ নেয়া হয়েছিল গত ১২ ডিসেম্বর। জাহাজ থেকে চিনি লোপাট হওয়ার বিষয়ে কোনো মন্তব্য না করে তিনি বলেন, এ ব্যাপারে মামলা হয়েছে। জড়িত সন্দেহে অনেককে আটক করা হয়েছে। জিজ্ঞাসাবাদ ও তদন্তের মাধ্যমে প্রকৃত ঘটনা উদ্ঘাটিত হবে।
জাহাজটির মালিকানার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠান এমএসটি মেরিন এন্টারপ্রাইজ লিমিটেডের নির্বাহী পরিচালক প্রদীপ চক্রবর্ত্তী জানান, ওই জাহাজের সকলকে আটক করেছে পুলিশ। নিরাপত্তার জন্য স্কট থাকার পরও কীভাবে এতগুলো চিনি খোয়া গেল-তা তদন্ত করছে পুলিশ। সরাসরি মন্তব্য না করলেও এর সঙ্গে স্কটে থাকা লোকদের যোগসাজশ থাকতে পারে বলে ধারণার কথা জানান তিনি। এ ব্যাপারে চাঁদপুর মোহনপুর নৌ থানায় মামলা হয়েছে।