প্রকাশ : ১৫ আগস্ট ২০২২, ০০:০০
পৃথিবীর বুকে বাঙালির কাঁধে সবচেয়ে ভারী বোঝা হলো আগস্ট। আগস্ট আমাদের মাথাকে এমনভাবে নুইয়ে দিয়েছে, হাজার চেষ্টা করলেও আমরা আর উন্নত শির হতে পারি না। আগস্ট যেন সবুজ ঘাসের ওপর ইটচাপা দেয়া বোঝার মতো চেপে রেখেছে বাঙালিকে। এ কেবল পিতার লাশের বোঝা নয়, এ কেবল ভাইয়ের লাশের বোঝা নয়। কিংবা এ কেবল মায়ের লাশের বোঝাও নয়। এ হলো পুরো একটা জাতিকে নিশ্চিহ্ন করার আবহমানকালের বোঝার মতো। যে আগস্টকে আমরা দেখেছি দ্বিজাতিতত্ত্বের বোঝা চাপিয়ে দিয়ে বাঙালিকে সাম্প্রদায়িকতার বিষবাষ্পে রক্তাক্ত করে তুলতে, সেই আগস্টই বাসুকীর ফণা নিয়ে ছোবল মেরেছে অসাম্প্রদায়িক চেতনার মর্মমূলে।
বাঙালি নিজে তার ইতিহাসকে কখনো পরিচালিত করতে পারেনি। বারে বারে তার ইতিহাসকে নিয়ন্ত্রণ করেছে। কিন্তু বঙ্গবন্ধু যখন রাজপথে সংগ্রামে নামলেন, তখন থেকেই বাঙালি তার নিজের ইতিহাসের নিয়ন্ত্রণ নিজেই নিতে শুরু করল। বাঙালির সেই ইতিহাস গৌরবের ইতিহাস, বাঙালির সেই ইতিহাস অর্জনের ইতিহাস। কিন্তু ধীরে ধীরে আবারো সাম্রাজ্যবাদী পুরানো শক্তির কূটচালে বাঙালি আটকা পড়ে গেল। মেকি দুর্ভিক্ষ সৃষ্টি করে বাঙালিকে করে তোলা হলো পর্যুদস্ত। বাসন্তী উপাখ্যান তৈরি করে বিশ্বকে জানিয়ে দেয়া হলো বাংলাদেশ এক তলাবিহীন ঝুড়ি। পঁচাত্তর এসে সেই নীল-নকশাকে বাস্তবায়ন করে দিল কতিপয় বাঙালির বিশ্বাসঘাতকতায়। বিশ্বমোড়লের ষড়যন্ত্রে বাঙালি পিতৃহন্তা হয়ে যায় কপালে স্বয়ং কলঙ্ক-তিলক লাগিয়ে।
যে রাত আমাদের স্বপ্নের বটবৃক্ষকে নির্মমভাবে হত্যা করল সে রাত কেমন ছিল? কেমন ছিল সে রাতের আকাশ ও আঁধার? সে রাতও বুঝি নিয়তির এই বেদনার ভারকে পারেনি সইতে। শেষ শ্রাবণের আকাশ ছিল রক্তগাঙের ধারা। মেঘ যেন মেঘ ছিল না, ছিল রক্তের চাকা চাকা প্রবাহ। আঁধারও পেয়েছিল লজ্জা মানুষরূপী বেপথু শ্বাপদের তাণ্ডবে। সাঁজোয়া যানের বহর নিয়ে মহড়ার মিথ্যে অভিনয় আমাদের জানিয়ে দিল সেই একাত্তরের গোল টেবিল বৈঠকের নামে তলে তলে আসা সামরিক শক্তির সমাবেশকে। সেদিনের সেই আয়োজনের সাথে পঁচাত্তরের নির্মম রাতের কোনো ভেদ নেই।
গুলির বৃষ্টিতে সে রাতের মৌনময়তা ভেঙ্গে খান খান হয়েছিল। আতঙ্ক গ্রাস করেছিল আঁধারের নির্জনতাকে। ধানমন্ডি বত্রিশ নম্বর বাড়িটি পরিণত হয়েছিল ইতিহাসের নৃশংসতম বধ্যভূমিতে। সন্তান-সম্ভবা মা থেকে শুরু করে দুগ্ধপোষ্য শিশু, কেউই সেদিন বাদ যায়নি ঘাতকের বুলেট-বৃষ্টি হতে। হিমালয়ের মতো মানুষটাকে তারা সেদিন এতোই ভয় পেয়েছিল যে, ঊনিশটি বুলেটের বৃষ্টি ছুড়ে মেরেছিল জাতির জনকের দেহ লক্ষ্য করে। যে সিঁড়িতে পিতা সেদিন লুটিয়ে পড়েছিলেন, সেই সিঁড়ি কালের বিবর্তনে হয়ে গেছে ইতিহাসের অমূল্য রথ। জনকের বুকের রক্ত আজ হয়ে গেছে রক্তগোলাপ। ধানমন্ডি বত্রিশ নম্বর হয়ে গেছে বাঙালির অনন্তকালের তীর্থ।
বহু চড়াই-উৎরাই পেরিয়ে বঙ্গবন্ধুর খুনিদের বিচার এ মাটিতে আজ সম্ভব হয়েছে। যারা এতদিন সগর্বে বুক ফুলিয়ে হেঁটেছিল দেশের বুকে তারা আজ সত্যের উদ্ভাসনের কাছে মাথা নত করেছে। ঘাতকেরা মনে করেছিল মুজিবকে দৈহিকভাবে মেরে ফেলতে পারলেই সব শেষ হয়ে যাবে। ঘাতক জানেনি, মুজিব দেহধারী নয়, মুজিব চেতনাধারী, মুজিব হলো আদর্শের আলোক-বর্ণালী। তাই আজ মুজিবের নামে বিশ্ব জয়ধ্বনি দেয়। মুজিবের আদর্শকে বুকে ধরে কোটি বাঙালি আজ উড়ায় লাল-সবুজের পতাকা।
কেউ কখনো ভাবেনি মুজিবকে এই বাংলার মাটিতে কোনো বাঙালি মারতে পারে। কিন্তু বাঙালির রক্তে মিশে আছে বেঈমানের রক্ত। মীর জাফর, নেত্রসেনদের রক্তধারা বাঙালি বহন করে বলেই কেউ কেউ হয়ে যায় খন্দকার মোশতাক, মেজর ফারুক, মেজর রশিদের মতো বিশ্বাসঘাতক। যে বাঙালি মুজিবকে পিতৃজ্ঞান করে নতুন দেশের, তারই কতিপয় কুলাঙ্গার সেনা মুজিবের পবিত্র রক্তের স্রোতে জাতির ললাটে লিখে দিবে কলঙ্ক-তিলক, এ ছিল বড়োই অকল্পনীয় নির্মমতা। কিন্তু সত্য কল্পনার চেয়েও ভয়াবহ। তাই পদ্মা-মেঘনা-যমুনার স্রোতধারায় মিশে যায় পঁচাত্তরের শ্রাবণের রক্তস্রোত। লক্ষ প্রাণের বিনিময়ে অর্জিত স্বাধীনতাকে পঁচাত্তরের রক্তগাঙে আমরা ভাসিয়ে দিলাম হায়েনাদের অপকর্মে। কিন্তু মুজিব তো চিরঞ্জীব। মুজিবেরা মরে না। মুজিবেরা বেঁচে থাকে সংগ্রামের প্রেরণা হয়ে।