প্রকাশ : ০৮ আগস্ট ২০২২, ০০:০০
আগস্ট বোধহীন এক ব্যাধের মতো। শিকার যেন তার নেশা। আগস্টের শিকার কবিগুরু, বঙ্গবন্ধু আর নজরুল- বাঙালির এই তিন মহীরুহ। নজরুলের ‘নারী’ কবিতাটি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান পশ্চিম পাকিস্তানে রাজনৈতিক গুরু সোহরাওয়ার্দীকে দর্শন করতে গেলে তাঁর আইনজীবী বন্ধুদের আবৃত্তি করে শোনান। তাদের আগ্রহে অবশ্য আরো বেশ কটি কবিতা শোনানো হয়, যা স্বয়ং সোহরাওয়ার্দী সাহেব তাৎক্ষণিক ইংরেজিতে তরজমা করে দিচ্ছিলেন। ‘নারী’ কবিতার বিখ্যাত দুটো লাইন বঙ্গবন্ধুর জীবনে পরম সত্য হয়ে আছে। নজরুল যেমন বলেছিলেন, ‘একা কোনদিন হয়নিকো জয়ী পুরুষের তরবারি/প্রেরণা দিয়েছে সাহস দিয়েছে বিজয়ী লক্ষ্মী নারী’, তেমনি বঙ্গবন্ধুর জীবনেও তাঁর আশৈশব সঙ্গী বেগম ফজিলাতুন্নেসা মুজিব ওরফে রেণুর ভূমিকা অপরিহার্য ও অনস্বীকার্য। একজন রেণুর জন্ম যদি না হতো তবে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান হয়তো বা আজকের এ মহৎ উচ্চতায় আসীন হতে পারতেন না। গ্রামীণ পরিবেশের এক পিতৃমাতৃহারা, দাদার স্নেহে মানুষ হওয়া সরলা কিশোরী নিজের যোগ্যতায় আজ হয়ে উঠেছেন বঙ্গমাতা। কেবল মুজিবপত্নী বলেই নয়, বরং নিজের বিচক্ষণতা, সহনশীলতা এবং ধৈর্য দিয়েই তিনি হয়ে উঠেছেন আজকের বঙ্গমাতা। আট আগস্ট এই মহীয়সী সংগ্রামীর জন্মবার্ষিকী। তাঁর জন্মদিনে বিন¤্র শ্রদ্ধা।
টুঙ্গিপাড়ার শেখ বংশেই বঙ্গবন্ধু পেয়ে যান তাঁর উপযুক্ত সহধর্মিণী। এই সহধর্মিণী এমন বন্ধনে তাঁর সাথে বেঁধেছেন গ্রন্থি, মরণেও সে বন্ধন এতটুকু শিথিল হয় নি। দুজনে একসাথেই অনন্তগমনে যাত্রা করেছেন শোকজর্জর আগস্টের রক্তগঙ্গা পেরিয়ে। বেগম মুজিবের তাগাদা না হলে, বেগম মুজিবের সরবরাহ করা খাতাণ্ডকলম না হলে আমরা বঙ্গবন্ধুর লেখা ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’ শিরোনামে অসাধারণ গ্রন্থটি পেতাম না। আর এই গ্রন্থটি না হলে আমাদের জানা হতো না ভাষা আন্দোলনে বঙ্গবন্ধু অসামান্য অবদানের কথা। বেগম মুজিব দৃঢ় ছিলেন বলেই মুজিবকে জেলে রেখে সরকার ও দলীয় কর্মীদের ছয় দফাকে হীন করার পাঁয়তারা রুখে দিয়েছেন শক্ত হাতে বড় মেয়ে শেখ হাসিনাকে পাশে পেয়ে। নিজ হাতে যদি সংসার না চালাতেন বেগম মুজিব, তবে বাংলাদেশের জন্ম যেমন বিলম্বিত হতো তেমনি আজকের আধুনিক বাংলাদেশের নির্মাতা প্রধানমন্ত্রীও তৈরি হতো না। মুজিবের অনুপস্থিতিতে বেগম ফজিলাতুন্নেসা মুজিব নিজেই দলীয় অসচ্ছল নেতা-কর্মীকে সহযোগিতা করেছেন সামর্থ্য অনুযায়ী। অথচ নিজে একসময় সংসার চালাতে ঘরের ফ্রিজ বিক্রি করে দিয়েছেন। দিনের পর দিন ছেলেমেয়েদের খিচুড়ি খাইয়েছেন। রাজনীতি করতে গেলে টাকাণ্ডপয়সা লাগবেই। শেখ মুজিব কোনো পেশায় থিতু না হয়ে রাজনীতি করতেন বলে তাঁর অর্থের যোগানদার ছিলেন দুজন। একজন তাঁর বাবা শেখ লুৎফর রহমান, আর অন্যজন তাঁর প্রিয়তমা পত্নী শেখ ফজিলাতুননেসা মুজিব। শেখ ফজিলাতুননেসাকে তাঁর দাদা সকল সম্পত্তি লিখে দিয়ে যান। এই সম্পত্তি হতে প্রচুর আয় হতো, যা বেগম মুজিব তাঁর স্বামীকে দিতেন পকেট খরচ হিসেবে। এ কথা ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’তে শেখ মুজিব নিজেই উল্লেখ করেছেন।
জেলগেটে যখন মুজিবকে দেখতে যেতেন বেগম মুজিব, তখন তিনি বড় মেয়ে শেখ হাসিনার কোলে রাসেলকে দিয়ে মুজিবকে পই পই করে তার বাসায় আসা নেতা-কর্মীদের সব কথা ও সিদ্ধান্ত জানিয়ে দিতেন। এত পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে জানাতেন যে, তাঁকে এক পর্যায়ে তাঁরই মেয়ে টেপ রেকর্ডার হিসেবে নাম দেন। মা ও মেয়ের মধ্যে বয়সের ব্যবধান খুব একটা বেশি ছিল না। তাই তারা দুজনের সম্পর্ক অনেকটাই বন্ধুর মতো। মা বেগম মুজিব যখন কোনো সংকটে পড়তেন, তখন তা বড় মেয়ে হাসিনার সাথেই আলাপ করতেন। ফলে মাকে টেপ রেকর্ডারের মতোই স্মৃতিধর হিসেবে কন্যা সহজেই আবিষ্কার করেন।
বেগম মুজিব একজন সহজ সরল পল্লিবালা, যিনি প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার সময় ও সুযোগ না পেলেও অসম্ভব মেধাবী ছিলেন। এই মেধার জোরেই তিনি এক প্রধানমন্ত্রীর বউ আর এক প্রধানমন্ত্রীর মা হয়ে বাংলার ইতিহাসে স্বর্ণাক্ষরে লেখা থাকবেন। তিনি বঙ্গমাতারূপে বাংলার নারীদের কাছে ধৈর্য ও সহ্যের, কর্তব্যবোধ ও মমতার প্রতীক হয়ে চিরস্মরণীয় হয়ে থাকবেন। বঙ্গমাতার জন্মদিন বাঙালির জন্যে হয়ে উঠুক পবিত্র এক উৎসবের আনন্দ ফোয়ারা। তাঁর জন্মদিন বাঙালির জন্যে পরম পবিত্র এক প্রাপ্তির উৎস। তাঁকে যথার্থভাবেই কবি মুহাম্মদ নূরুল হুদা ‘বঙ্গজাতিমাতা’ হিসেবে অভিধাসিক্ত করেছেন। অমর হয়ে থাকুন ইতিহাসের এই অদম্য প্রেরণা। জয় বাংলা।