শনিবার, ২১ ডিসেম্বর, ২০২৪  |   ২২ °সে
আজকের পত্রিকা জাতীয়আন্তর্জাতিকরাজনীতিখেলাধুলাবিনোদনঅর্থনীতিশিক্ষাস্বাস্থ্যসারাদেশ ফিচার সম্পাদকীয়
ব্রেকিং নিউজ
  •   প্রাইভেটকারের ধাক্কায় বুয়েট শিক্ষার্থী নিহত: ডোপ টেস্টে ধরা পড়ল মাদকাসক্তি
  •   সাতক্ষীরায় ব্যবসায়ীর ২৩ লাখ টাকা ছিনতাই: স্বেচ্ছাসেবক দল নেতার বিরুদ্ধে অভিযোগ
  •   চাকা পাংচার হওয়ায় এনজিও কর্মকর্তার মৃত্যু
  •   বরগুনায় টিকটক নিয়ে পারিবারিক কলহ: স্ত্রীকে হত্যা, স্বামী আত্মহত্যার চেষ্টা
  •   মানব পাচারের চক্রের বিরুদ্ধে বিজিবির সফল অভিযান: কিশোরী উদ্ধার, তিন আটক

প্রকাশ : ০৭ অক্টোবর ২০২৪, ১৯:২৮

পদ্মা-মেঘনায় ইলিশের বিচরণ কম

মধ্যস্বত্বভোগীদের কারণে চাঁদপুরে দাম আকাশচুম্বি

মির্জা জাকির
মধ্যস্বত্বভোগীদের কারণে চাঁদপুরে দাম আকাশচুম্বি

আর মাত্র পাঁচ দিন অর্থাৎ ১২ অক্টোবর পর্যন্ত চাঁদপুরে ইলিশ বেচাকেনা চলবে। ১৩ অক্টোবর থেকে ৩ নভেম্বর পর্যন্ত ২২ দিন মা ইলিশ রক্ষায় প্রজনন জোন হিসেবে চাঁদপুরের নৌ সীমানায় ইলিশ ধরা বন্ধ থাকবে। তাই শেষ সময় হিসেবে দেশের অন্যতম ইলিশের বাজার খ্যাত চাঁদপুর মাছঘাট সংশ্লিষ্টরা অনেকটা ব্যস্ত সময় পার করছেন।

মিঠা পানির রূপালী ইলিশের বিরাট একটি অংশ চাঁদপুরের পদ্মা-মেঘনা নদী হতে আহরিত হয়। এই ইলিশের জন্যে ব্র্যান্ডিং জেলা চাঁদপুর। আর এই ব্র্যান্ডিং জেলাতেই দেশের অন্যান্য স্থানের চেয়ে ইলিশের দাম অনেক বেশি।

ইলিশ জাতীয় মাছ। আর এই মাছের জন্যেই দেশজুড়ে চাঁদপুরের খ্যাতি। দেশের যে কোনো প্রান্তের মানুষ চাঁদপুরের ইলিশ খোঁজে। অথচ এই চাঁদপুরেই সাধারণ মানুষের ক্রয় ক্ষমতার বাইরে ইলিশ। এর কারণ হিসেবে জানা যায় ৩-৪ হাত বদলের কথা। এরা হচ্ছে--মধ্যস্বত্বভোগী, ফড়িয়া, আড়তদার ও খুচরা বিক্রেতা। এদের হাত বদলে ইলিশের দাম বেড়ে যায়। শুধু চাঁদপুর নয়, দেশের অন্যান্য ইলিশের মোকামেও একই চিত্র।

এবার নদীতে ইলিশ ধরা পড়ছে একেবারেই কম। সাগর বা উপকূলীয় এলাকা থেকে আহরিত ইলিশ চাঁদপুর মৎস্য অবতরণ কেন্দ্রে পৌঁছাতে গিয়ে জ্বালানিসহ আনুষঙ্গিক খরচ বেশি পড়ছে বলে এখানে ইলিশের দাম দেশের অন্য স্থানের তুলনায় বেশি।

পদ্মা-মেঘনা ছাড়াও গভীর সমুদ্র থেকে আহরিত ইলিশ চাঁদপুর এসে বাজারজাত হওয়া পর্যন্ত কয়েক হাতবদল হয়ে বিক্রি হয়। এর ফলে এখানে মাছের দাম বৃদ্ধি পেয়ে থাকে বলে মাছঘাট সংশ্লিষ্টদের অনেকে জানান।

তবে এবার দাদনদারদের কাছ থেকে এখানকার বেশিরভাগ ব্যবসায়ীর ইলিশ মাছের প্রাপ্তি অনেকটা তলানিতে গিয়ে ঠেকেছে বলে জানা যায়।

বর্তমানে চাঁদপুরে এক কেজি ওজনের একটি ইলিশ কিনতে হলে গুণতে হচ্ছে ১৮০০ শ' থেকে ১৯০০ শ' টাকা। ৭০০-৮০০ গ্রাম ওজনের ইলিশ বিক্রি হচ্ছে ১ হাজার ৫০০ শ' থেকে ১ হাজার ৬০০ শ' টাকা কেজি দরে। আর আধা কেজি ওজনের ইলিশের কেজি হাজার থেকে ১ হাজার ৩০০ শ' টাকার মধ্যে। ২০০ থেকে আড়াইশ গ্রাম ওজনের জাটকা ইলিশের কেজি ৬০০ থেকে ৭০০ টাকা দরে বিক্রি হচ্ছে।

দাম বাড়ছে যে কারণে

গত কয়েক বছর ধরে ইলিশের দাম বেড়েই চলছে। কেনো ইলিশের দাম এতো বাড়ছে, এ মাছ চড়া দামে বিক্রিতে লাভবান হচ্ছেন কারা--এসবের নেপথ্যে জানা যায়, একাধিক হাত বদলের কারণেই ইলিশের দাম বাড়ছে।

মূলত ইলিশ ব্যবসা এখন দাদনদার আর আড়তদারদের কাছে অনেকটা জিম্মি। ইলিশের একেকটি ঘাট থেকেই মোবাইল ফোনের মাধ্যমে পুরো দেশের ইলিশ বাজার নিয়ন্ত্রণ করা হয়। প্রশাসন যদি সত্যিকার অর্থে এসব ঘাট নিয়ন্ত্রণ করে, সত্যিকারের জেলেদের সুযোগ- সুবিধা নিশ্চিত করে, তাহলে বর্তমানে যে দামে ইলিশ বিক্রি হচ্ছে, তার অর্ধেক দামে ইলিশ বিক্রি করা সম্ভব হবে বলে এখানকার কয়েকজন জেলে জানান। তারা জানান, জেলেদের জাল ও ট্রলার সবই দাদন ব্যবসায়ীদের জিম্মায় থাকে। অনেক ক্ষেত্রে ট্রলারে দাদন ব্যবসায়ীদের প্রতিনিধি থাকেন। পানি থেকে ইলিশ উঠতেই দাদন ব্যবসায়ীদের নিয়ন্ত্রণে চলে যায়। এদিকে মা ইলিশ বা জাটকা রক্ষা মওসুমে প্রকৃত জেলে নির্ণয় করে তাদের সুযোগ -সু্বধিা নিশ্চিত করা প্রয়োজন বলে জেলেরা মনে করেন।

চাঁদপুরের হরিণায় বাড়ি সাধারণ জেলে তাফাজ্জল গাজীর। তিনি জানান, তাদের ট্রলারে ৮ জন জেলে এবং একজন মাঝি রয়েছেন। নয়দিন আগে ট্রলার নিয়ে হরিণাঘাট থেকে তারা নোয়াখালীর হাতিয়া ও সন্দ্বীপ এলাকায় যান ইলিশ ধরতে। যাওয়ার আগে তারা ২০ হাজার টাকার চাল-ডাল, বরফসহ আনুষঙ্গিক জিনিসপত্র কিনেন। আর ট্রলারের জ্বালানি তেল (ডিজেল) কিনেন ৫০ হাজার টাকার। মোট ৭০ হাজার টাকা খরচ হয়েছে তাদের। মাছ পেয়েছেন দেড় লাখ টাকার।

এই টাকার লাভের অর্ধেক পাবেন ট্রলার মালিক। বাকি টাকা ১০ ভাগে ভাগ হবে। দুভাগ ট্রলারের মাঝির, বাকি ৮ ভাগ ৮ জন জেলের। মূলত লাভের বড়ো একটি অংশ পেয়ে থাকেন ট্রলার মালিক।

বহরিয়ার জেলে বারেক দর্জি জানান, নদী বা সমুদ্র থেকে জেলেরা মাছ ধরে ঘাটে আনার পর সে মাছের নিয়ন্ত্রণ আর তাদের হাতে থাকে না। জেলে বা ট্রলার মালিক ইচ্ছে করলেও সরাসরি বেপারী বা ক্রেতার কাছে মাছ বিক্রির ক্ষমতা রাখে না। জেলে নৌকার মাছ সরাসরি চলে যায় মহাজনের কাছে। মহাজনের নিয়োজিত কর্মী প্রাথমিকভাবে একটি দাম নির্ধারণ করে ‘নিলাম’ ডাকেন। একের পর পর দাম হাঁকানোর পর যে কোনো একজন বেপারী সে মাছ কিনে নেন। এরপর তারা বিক্রি করেন আড়তে বা খুচরা বিক্রেতাদের কাছে। খুচরা বিক্রেতাদের হাত হয়ে যায় ক্রেতাদের হাতে। মহাজন থেকে শুরু করে ক্রেতা পর্যন্ত যে চার হাতবদল হয়, তাদের প্রত্যেকেই শতকরা ১০ থেকে ১৫ শতাংশ লাভ করে থাকে। এভাবেই ঘাট থেকে শুরু করে খুচরা ক্রেতা পর্যন্ত হাতবদলে ইলিশ মাছের দাম বেড়ে যায় অনেক বেশি।

পদ্মা-মেঘনা নদীতে ইলিশ কমে গেছে

এখানকার মৎস্যজীবী, মৎস্য কর্মকর্তা ও বিশেষজ্ঞরা বলছেন, পানির পরিমাণ যতো বেশি হবে, ইলিশের বিচরণ ততো বাড়বে। কিন্তু পদ্মা-মেঘনায় পলি মাটি ও চর জেগে উঠায় নদীর গভীরতা দিন দিন কমছে। ফলে মাছের বিচরণও কমে গেছে। এছাড়া পাহাড়ি উজান থেকে নেমে আসা ঢলের পানির সঙ্গে প্রতিনিয়ত পলি মাটি এসে নদী ভরাট হচ্ছে। আবার নদীতে বিভিন্ন এলাকায় ভাঙ্গনের ফলে নদীর তলদেশ ভরাট হয়ে গভীরতা কমছে। অবৈধ ও অপরিকল্পিতভাবে বালু উত্তোলনের ফলেও নদীর গভীরতা কমছে। নৌযানের কারণেও দূষিত হচ্ছে নদীর পানি। এতেই গভীর সমুদ্র থেকে এখন আর নদীতে মাছ আসতে পারছে না।

দেশের বিশিষ্ট ইলিশ গবেষক ড. আনিছুর রহমান ইলিশ কমে যাওয়ার পেছনে অনেক কারণ রয়েছে বলে জানান। তিনি চাঁদপুর বেল্টে নদী দূষণ, ডুবোচর, কারেন্ট জাল দিয়ে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি, বালু উত্তোলনের পাশাপাশি গ্লোবাল ক্লাইমেট চেঞ্জ হয়ে যাওয়াকে ইলিশ কমে যাওয়ার ক্ষেত্রে অনেকটা কারণ বলে চাঁদপুর কণ্ঠকে জানান।

চাঁদপুর জেলা মৎস্য কর্মকর্তা মো. গোলাম মেহেদী হাসান বলেন, গত ক'দিনের চেয়ে এখন ইলিশ কিছুটা ধরা পড়ছে। যদিও ভরা মৌসুম হিসেবে সেটা আশানুরূপ নয়। বড়ো মাছের চেয়ে ছোট মাছের পরিমাণটাই বেশি। 'কেনো ইলিশ কম ধরা পড়ছে' এ বিষয়ে মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউট স্টাডি করছে বলে জানান তিনি।

এদিকে চাঁদপুর মাছ ঘাটে শেষ সময়ে গড়ে এক হাজার মণ ইলিশ আসছে, যা চাহিদার তুলনায় একেবারেই নগণ্য। অথচ বিগত বছরের এ সময় চাঁদপুর মাছঘাটে প্রতিদিন তিন-চার হাজার মণ ইলিশ আমদানি হতো। এখানে প্রতিনিয়তই বাড়ছে ইলিশের চাহিদা।

চাঁদপুর বড়ো স্টেশন মাছ ঘাটে আগে ফিশিং বোটে বেশিরভাগ ইলিশ আসতো। বর্তমানে সড়কে পিকআপ ও মাঝারি ট্রাকযোগে আসছে বেশিরভাগ ইলিশ। সব মিলে গত সপ্তাহের তুলনায় চলতি সপ্তাহে মাছের আমদানি কিছুটা বেড়েছে। দেশের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে প্রতিদিন বহু খুচরা ক্রেতা আসছেন মাছ কিনতে। চাহিদা বেশির সুযোগে এখানকার খুচরা বিক্রেতারাও কেজি প্রতি দুই-তিনশত টাকা বেশি দামে বিক্রি করছেন।

চাঁদপুর বড়ো স্টেশন মাছঘাট ব্যবসায়ী সমিতির সভাপতি আবদুল বারী জমাদার মানিক জানান, ইলিশের আমদানি একেবারেই কম। তাই আমদানির ওপর নির্ভর করে দাম। ইলিশের দাম বাড়লে ক্রেতা কমে যায়। তাতে খুচরা ব্যবসায়ীরাই বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়। তিনি বলেন, জ্বালানি হতে শুরু করে ফিশিং বোট, জেলে ও ট্রলারের খরচ তিন গুণ বেড়েছে। সে জন্যে মাছের দামতো বাড়বেই। জ্বালানি খরচ বেড়ে যাওয়ায় এবার ট্রলারযোগে এখানে ইলিশ খুবই কম এসেছে। যেসব ইলিশ এখানে আসছে, বেশিরভাগই আসছে ট্রাকযোগে।

এসব বিষয়ে একই সমিতির সাধারণ সম্পাদক হাজী শবে বরাত সরকার বলেন, এ সময় এ ঘাটে প্রচুর ইলিশের আমদানি হয়। কিন্তু এবার সে অনুপাতে ইলিশ নেই। তবে গত কয়েক সপ্তাহের তুলনায় এখন মাছ কিছু বেড়েছে। কিন্তু এই মাছগুলোর বেশিরভাগই কোয়ালিটি সম্পন্ন না এবং সাইজে ছোট।

  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়