প্রকাশ : ২১ ডিসেম্বর ২০২৪, ১০:৫০
শীতের এক সকালে
আজ সকাল থেকে আকাশে সূর্যের বিন্দুমাত্র আলো দেখা যাচ্ছিল না। পূর্বের গভীর রাত থেকে কুয়াশা পড়েছে। সকাল হলেও ঘন কুয়াশা কাটেনি। যার জন্য সূর্য দূর আকাশ থেকে কুয়াশা ভেদ করে আলো ছড়াতে পারছে না। দুপুর গড়িয়ে এলে সূর্য একটু একটু করে উঁকি দিতে শুরু করে। মাসটি ছিল পৌষ মাস। তাই তো শীত পড়ছিল। শীতের মৌসুমে কুয়াশা পড়েই থাকে। কুয়াশা কেটে যাচ্ছে, বেলাও বাড়তে লাগলো। কুয়াশা কেটে যাবার পর সূর্যের তাপও বাড়লো।
প্রচণ্ড শীতে সবাই যখন কাতর হয়ে পড়ে রয়েছে ঠিক সে সময় দিপুর ঘুম ভেঙে গেল। শীতের পশমি কাপড় গায়ে জড়িয়ে দুটি চোখে ঘুম আনতে পারছিল না। চোখের সামনে কে যেন বারবার ভেসে উঠতে লাগলো। অর্থাৎ স্বপ্ন যেন তাকে বারবার হাতছানি দিয়ে ডাকছে। তাই তো দিপুর বারবার ঘুম ভেঙ্গে যাচ্ছিল। কাকডাকা ভোর হতে না হতেই দিপু বিছানা ছেড়ে ঘর থেকে রাস্তায় বের হয়ে আসে। মা জিজ্ঞাসা করে বাবা এত সকালে তুমি কোথায় যাচ্ছ? জবাবে দিপু বলে রাতে ঘুমুতে পারিনি তাই একটু রাস্তা থেকে হেঁটে আসি। এই বলে দিপু বাসা থেকে বের হয়ে আসে। সকাল থেকে হাঁটাহাঁটি করে নয়টায় বাসায় ফিরে আসে। মনটা কেন যেন খারাপ। বাসায় ফিরে দিপু পড়ার টেবিলে গিয়ে বসে বই নিয়ে। পড়ালেখা করার ফাঁকেই মা দিপুর জন্য নাস্তা নিয়ে আসে। মা আবারো জানতে চায় বাবা আজ সকাল থেকে তোর মনটা খারাপ দেখছি। না মা রাতে ঘুম হয়নি। কেবলি বাজে সব স্বপ্ন চোখের সামনে ভেসে উঠে ছিল। এই বলে দিপু আবার পড়া শুরু করে। সামনে ডিগ্রি পরীক্ষা। সেই প্রস্তুতি নিতেই ব্যস্ত।
দিপুদের গ্রামের বাড়িতে শীতে বড় উৎসব হয় কয়েক দিনের। গ্রামের যারা শহরে থাকে তারা বছরের এদিন গ্রামের বাড়ি ছুটিতে আসে। এবার দিপুরাও গ্রামের বাড়ি যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। উৎসবের দুদিন আগেই দিপুরা গ্রামের বাড়ি যায়। গ্রামের মানুষ দিপুকে চিনে না। কারণ দিপু ছোটবেলা থেকেই শহরের পরিবেশে বড় হয়েছে। দিপুও গ্রামের মানুষদের তেমন চিনতো না। বিকেলে গ্রামের দোকানে কাকাতো-জেঠাতো ভাইদের সাথে গেলে সবাই জানতে চায় কে ও। তখন কাকাতো-জেঠাতো ভাইরা বলে আমাদের ভাই। অমুকের ছেলে, তখন গ্রামবাসী চিনে। এমনিভাবে সে দিনটি কেটে যায়। দেখতে দেখতে উৎসবের প্রথম দিন চলে আসে। সেদিনও উৎসবে লোকসমাগম তেমন একটা হয় না। পরদিন উৎসবে যেন মানুষের ঢল নেমে আসে। দিপু বাড়ির সামনের রাস্তায় একা দাঁড়িয়ে আছে। হঠাৎ চোখে পরে সুন্দরী এক তরুণীকে। তরুণীটি তার পরিবারের সাথে উৎসবে আসে। দিপুকে দেখে সে হাসছিল। দিপু বিষয়টি বুঝতে পারেনি। উৎসবে হাজারো মানুষ, দিপু সেই উৎসবে গিয়ে ঘুরছে। আবারো সেই তরুণী দিপুকে দেখে দূর থেকে হাসছিল। এবার তরুণী দিপুর কাছে এসে দাঁড়ায়। বলে আপনার নাম কী? দিপু ঘার ঘুরিয়ে দেখে তরুণীটি। তখন বলে আমার নাম দিপু। তোমার নাম কী? জবাবে তরুণী বলে মিঠু। থাকো কোথায়? বলে কুমিল্লা ঠাকুরপাড়া। আপনার বাসা কোথায়? জবাবে দিপু বলে চাঁদপুর শহরে থেকে কলেজে পড়ালেখা করছি। কিসে পড়েন? দিপু বলে সামনে ডিগ্রি পরীক্ষা দিবো। এখানে কোথায় এসেছেন। মিঠু বলে মামার বাড়ি। আপনি কোথায় এসেছেন। আমার বাপ-দাদার ভিটেমাটিতে। আচ্ছা কুমিল্লায় কী করো তুমি? মিঠু বলে পড়ালেখা করছি। কিসে পড়ো জবাবে মিঠু বলে সামনে মেট্রিক পরীক্ষা দিবো। এখানে কদিন থাকা হবে? দু-তিন দিন থাকবো। তুমি, আমিও এমনই থাকবো। গুড বাই বলে মিঠু চলে যায়। দিপু উৎসবস্থলে থেকে যায়। গ্রামে প্রচণ্ড শীত। তাছাড়া সন্ধ্যা হলেই যেন ভূতুরে পরিবেশ। কোনোমতে রাত পার করেছে দিপু। দুপুরের পর আবারো মিঠু তার এক বান্ধবীকে সাথে নিয়ে উৎসবস্থলে আসে। আজকে আসার কারণ হলো মিঠু দিপুর সাথে মন খুলে কথা বলবে। তাইতো উৎসবে এসে চারদিকে দিপুকে খুঁজছে মিঠু। দেখা হয়ে যায় দুজনার। অনেক কথা হয়, হয় অজানা কত গল্প। মিঠু যাবার সময় বলে তুমি পারলে সন্ধ্যায় আমার মামার বাড়িতে এসো। সন্ধ্যা ঘনিয়ে আসে মিঠু তার এক মামাকে ম্যানেজ করে দিপুর কাছে পাঠায়। সে এসে বলে তুমি দিপু আমাদের বাড়ি এসো। দিপু বলে তোমাকে তো চিনলাম না। আমাকে চিন না? মিঠুকে তো চিনো। হ্যাঁ, সেই পাঠিয়েছে তোমাকে নিতে। দিপু জানতে চায় তোমার নাম কী? জবাবে সে বলে আমার নাম শ্যামল, মিঠুর মামা হই আমি। দিপু শ্যামলের সাথে তাদের বাড়ির যায়। অনেক রাত পর্যন্ত শ্যামলদের ঘরে বসে গল্প চলে দিপু আর মিঠুর। দিপু কিছুটা অসুস্থবোধ করছিল। মিঠু দিপুর কপালে হাত দিয়ে দেখে জ্বরে গা পুরে যাচ্ছে। তখন মিঠু গায়ের চাঁদরটা দিপুর শরীরে জড়িয়ে দেয়। না পারতে দিপু বলে আজ চলি শরীর ভাল থাকলে কাল হয়তো দেখা হবে। বিদায় নিয়ে দিপু বাড়ি চলে আসে। রাতে দিপুর জ্বরের মাত্রা আরো বেড়ে যায়। সারা রাত দিপুর মাথায় জলপট্টি দিয়ে জেগে বসে থাকে মা। সকাল হলে দিপুকে নিয়ে যাওয়া হয় ডাক্তারের কাছে। সিরিয়াল দিয়ে ডাক্তারের অপেক্ষায় বসে থাকতে হয় ক’ঘণ্টা। বেশ কিছু পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে ঔষধ লিখে দেয়। এ দিকে মিঠু দিপুদের বাড়িতে এসে খুঁজতে থাকে দিপুকে। কিন্তু দিপুর দেখা কোথাও মিলছে না। কাকে জিজ্ঞাসা করবে দিপুর কথা। এমন সময় দেখা হয় দিপুর মায়ের সাথে। মা দেখে বলে তুমি মিঠু না। মিঠুও দেখে চিনতে পারে। বলে পিসি মা তোমাদের বাড়িতে দিপু নামের ছেলেটা ও কোথায়? ওরতো অনেক জ্বর ডাক্তারের কাছে গিয়েছে। আচ্ছা তুমি চিন কিরে। না উৎসবে পরিচয় হয়েছে। ও আমার ছোট ছেলে, ডিগ্রিতে পড়ে। দিপু শহরে বেরে উঠায় গ্রামের পরিবেশের সাথে মানিয়ে নিতে পারছে না। তাই তার অসুস্থ হয়েছে।
এত কদিন দুজনার পরিচয় কে কার কী হয় কেউ জানতো না। মিঠু আর দিপু মামাকো আর পিশাতো ভাই বোন। তবে কাছের নয় দূর্সম্পর্কের। তারা সেই একদিনের শীতের সকালে পরিচয়ের মাধ্যমে এত ঘনিষ্ট হয়ে যায়। এখন কেউ কাউকে এক নজর না দেখে থাকতে পারে না। দিপুর অসুস্থতায় যেন মিঠুও অসুস্থ হয়ে পড়েছে। বিকালে দিপু রাস্তায় যায়। সেখানেই মিঠুর সাথে দেখা হয়ে যায়। দিপু বলে আমি তো অসুস্থ কাল শহরে চলে যাবো। পরীক্ষা শেষ না হওয়া পর্যন্ত হয়তো গ্রামের বাড়ি আসবো না। মিঠু বলে তোমার সাথে যোগাযোগ করবো কীভাবে? পরীক্ষা শেষে আমি গ্রামের বাড়ি এসে কিছু দিন থাকবো। এই বলে দিপু বাড়ি চলে আসে। মিঠু তার পিছন পিছন বাড়ি আসে। দিপুর মা অর্থাৎ পিশি মার কাছ থেকে শহরের ঠিকানা সংগ্রহ করে নেয়। দিপু শহরে চলে গেলে সেই ঠিকানায় মিঠু যোগাযোগ শুরু করে।
এক দিনের ঘটনা। মিঠুর বাবা সরকারি চাকুরি করে। মিঠু তার দ্বিতীয় সন্তান। বড় মেয়ের বিয়ে হয়েছে। মিঠু প্রাপ্তবয়স্ক হওয়ায় বাবা মা মেয়ের বিয়ে দেয়ার জন্য ব্যস্ত হয়ে পড়েছে। একেরপর এক পাত্র দেখা চলছে। মিঠু সবেমাত্র কলেজে ভর্তি হয়েছে। সে আরো পড়ালেখা করতে চায়। পরিবার বিয়ের চাপ দিয়েই যাচ্ছে। এ যন্ত্রণা সহ্য করতে না পেরে মিঠু দিপুকে খবর দেয়। কিন্তু পরীক্ষা সামনে তাই দিপু কোনো সারা দেয় না। দিপু মনে করে মিঠু হয়তো তাকে দেখার জন্য এমন করছে। আর দিপুর কাছ থেকে কোনো সদোত্তর না পেয়ে বাবা মাকে বলে দেয় আমি এক ছেলেকে ভালোবাসি। তার নাম দিপু, সে শহরে থাকে। বাবা মা বলে দেয় আমরা তোমাকে যেখানে বিয়ে দেব সেখানেই হবে। তোমার পছন্দে হবে না। এমনিভাবে মিঠুকে চাপে রেখে বাবা অফিসে চলে যায, মা মার্কেটে যায়। মিঠু একা ঘরে থেকে যায়। দিপুর কাছ থেকে সাড়া না পাওয়া, বাবা-মায়ের বিয়ের চাপ এত যন্ত্রণা সহ্য করতে না পেরে শেষমেষ মিঠু আত্মহত্যার পথ বেছে নেয়।
পরীক্ষা শেষে কয়েক মাসের জন্য গ্রামের বাড়ি যায় দিপু। এ সময় মিঠুর গ্রামে আসার কথা ছিল। মিঠুর মামা শ্যামলের সাথে বিকালে দেখা হয়। দিপু শ্যামলকে ডেকে চায়ের দোকানে নিয়ে যায়। চা খেতে খেতে গল্প করে দুজন। হঠাৎ শ্যামল বলে দিপু তুই কি কিছু জানিস? কোন বিষয়ে জানতে চাই দিপু। শ্যামল বলে তিন মাস হলো মিঠু আত্মহত্যা করেছে। একথা শোনা মাত্র যেন বিশাল আকাশ ভেঙ্গে পড়ল দিপুর মাথায়। মনে মনে ভাবে সেদিন মিঠু যে চিঠি দিয়েছিল তাহলে সে বিপদে পড়িয়ে দিয়েছিল। কেন আমি তাকে সায় দিলাম না? সেদিন ওর চিঠির জবাব দিলে হয়তো মিঠুকে পৃথিবী ছেড়ে যেতে হতো না।
আজ দিপু নিঃসঙ্গ একাকী। কার জন্য বেঁচে থাকা। মিঠু যে ভালোবাসা দিয়ে দিপুকে আগলে নিয়েছিল, সে ভালোবাসা হয়তো আর কখনোই দিপুর জীবনে আসবে না।