প্রকাশ : ১৯ মে ২০২৫, ২২:২৭
চাঁদপুরের ক্রীড়াঙ্গনের অতীত-বর্তমান এবং অনিবার্য করণীয়

বাংলাদেশের দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলের একটি ঐতিহ্যবাহী জেলা চঁাদপুর। মেঘনা, পদ্মা ও ডাকাতিয়া নদীর মিলনস্থলে অবস্থিত এই জেলা শুধুমাত্র ইলিশের জন্যে খ্যাত নয়, বরং ক্রীড়া সংস্কৃতির এক অনন্য মিলনক্ষেত্র হিসেবেও খ্যাত। চঁাদপুরের ক্রীড়া সংস্কৃতি দীর্ঘদিন ধরেই এলাকাবাসীর জীবনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখে এসেছে এবং এটি ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে গড়ে তোলার ক্ষেত্রেও অগ্রণী ভূমিকা পালন করছে।
চঁাদপুরের ক্রীড়ার ইতিহাস বেশ পুরোনো। স্থানীয়ভাবে ফুটবল, ভলিবল, ক্রিকেট, হ্যান্ডবল, কাবাডি এবং দড়ি টানাটানির মতো খেলার চর্চা চলে আসছে। চঁাদপুর জেলা ক্রীড়া সংস্থার স্টেডিয়াম, বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের মাঠ এবং পাড়া-মহল্লার খেলার মাঠগুলো তরুণদের প্রাণকেন্দ্র। তবে বর্তমানে কিছু মাঠ বাণিজ্যিকরণের ফলে খেলাধুলার কাজে ব্যবহৃত হচ্ছে না। অধিকাংশ স্কুল-কলেজে নেই খেলার উপযোগী বড়ো মাঠ। চঁাদপুর স্টেডিয়ামের পাশেই রয়েছে আউটার স্টেডিয়াম। দীর্ঘদিন ধরে জেলার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ক্রীড়াচর্চার স্থান হিসেবে ব্যবহৃত হয়ে আসছে এই দুটি মাঠ। স্থানীয় ও আঞ্চলিক টুর্নামেন্ট, স্কুল-কলেজের ক্রীড়া প্রতিযোগিতা এবং জাতীয় পর্যায়ের কিছু ইভেন্টও এখানে আয়োজিত হচ্ছে।
একসময় নৌকাবাইচ ও গ্রামীণ ক্রীড়া যেমন হাডুডু, ঘুড়ি উড়ানোর মতো ঐতিহ্যবাহী খেলার চর্চা ব্যাপক জনপ্রিয় ছিলো। এই খেলাগুলো চঁাদপুরের সংস্কৃতির অবিচ্ছেদ্য অংশ হিসেবে মানুষের মধ্যে ঐক্য ও সম্প্রীতির বার্তা পেঁৗছে দিতো। এখন অবশ্য পয়লা বৈশাখ উপলক্ষে এসব গ্রামীণ খেলা নজরে পড়ে। স্থানীয় প্রশাসনের আয়োজনে এসব খেলাধুলার আয়োজন করা হয়। এসব খেলা পৃষ্ঠপোষকতার অভাবে সবসময় আয়োজন করা সম্ভব হয়ে উঠছে না।
চঁাদপুর জেলা শহরে নতুন-পুরাতন কিছু ক্রীড়া সংগঠন রয়েছে, যেগুলোর অবদান জেলার ক্রীড়া উন্নয়নে উল্লেখযোগ্য। তন্মধ্যে রয়েছে : মোহামেডান স্পোর্টিং ক্লাব, আবাহনী ক্রীড়া চক্র, ব্রাদার্স ক্লাব, ভাই ভাই স্পোর্টিং ক্লাব, নাজিরপাড়া ক্রীড়া চক্র, গুয়াখোলা ক্রীড়া চক্র, নিতাইগঞ্জ ক্রীড়া চক্র, উদয়ন ক্লাব, সোনালী অতীত ক্লাব ইত্যাদি। এছাড়া ক্লেমন ক্রিকেট একাডেমি ও সোনালী অতীত ফুটবল একাডেমি ক্রীড়া শিক্ষায় ভূমিকা রাখছে। এসব ক্লাব ও একাডেমি মাঝে মধ্যে নানা রকম আয়োজন করে চঁাদপুরের ক্রীড়াঙ্গনকে এগিয়ে নেয়ার চেষ্টা করছে।
এছাড়া স্কুল, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ভিত্তিক ক্রীড়া দলগুলোও জেলার ক্রীড়া পরিবেশ গঠনে ভূমিকা রাখছে। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোর বার্ষিক ক্রীড়া প্রতিযোগিতা এবং আন্তঃস্কুল ও আন্তঃকলেজ ক্রীড়া আয়োজন চঁাদপুরের তরুণদের মধ্যে প্রতিযোগিতার মনোভাব, শৃঙ্খলা ও আত্মবিশ্বাস গড়ে তুলছে।
চঁাদপুর জেলায় গর্ব করার মতো ক্রীড়াবিদদের অভাব নেই। জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে অনেক ক্রীড়াবিদ চঁাদপুর থেকে উঠে এসেছেন। সঁাতার, ক্রিকেট, ফুটবল এবং কাবাডির মতো খেলায় জেলার কৃতী খেলোয়াড়রা দেশেরই প্রতিনিধিত্ব করেছেন।
ক্রিকেটে জাতীয় দলে খেলা কয়েকজন ক্রিকেটারের জন্ম চঁাদপুরে। ফুটবলেও জাতীয় লীগে অংশগ্রহণকারী ক্লাবগুলোতে চঁাদপুরের খেলোয়াড়রা নিয়মিত খেলে আসছেন। এছাড়া মার্শাল আর্ট, অ্যাথলেটিক্স ও ভারোত্তোলনের মতো অপ্রচলিত ক্রীড়াতেও কিছু ব্যক্তি কৃতিত্ব অর্জন করেছেন।
দূরপাল্লার সঁাতারে মরহুম আবদুল মালেকের রয়েছে বিশ্বখ্যাতি। তিনি ইংলিশ চ্যানেল বিজয়ী। ১৯৬২ সালে ঢাকা-চঁাদপুর দূরপাল্লার সঁাতার প্রতিযোগিতায় তিনি প্রথম হন। ১৯৬৩ সালে ইতালিতে ‘কেপরী-নেপলস’ ৩৩ মাইল বিশ্ব দূরপাল্লার সঁাতার প্রতিযোগিতায় সারা বিশ্বে চতুর্থ এবং এশিয়ার মধ্যে প্রথম স্থান দখল করেন। ইংলিশ চ্যানেল ক্রসিং কমিটির উদ্যোগে ১৯৬৪ সালে নারায়ণগঞ্জ-চঁাদপুর, ১৯৬৫ সালে দাউদকান্দি-নারায়ণগঞ্জ এবং নারায়ণগঞ্জ-চঁাদপুর দূরপাল্লার সঁাতার প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ করে তিনটি প্রতিযোগিতাতেই প্রথম স্থান অধিকার করার গৌরব অর্জন করেন। অবিরাম সঁাতারে রয়েছে তঁার জাতীয় রেকর্ড। ১৯৫৯ সালে ঢাকাস্থ জাতীয় সুইমিং পুলে ৬০ মাইল সঁাতার কেটে তিনি এই রেকর্ড গড়েন।
সঁাতারু আব্দুল মালেকের ন্যায় সঁাতারে প্রয়াত অরুণ নন্দীরও রয়েছে বিশ্বখ্যাতি। তিনি ১৯৭১ সালে ভারতের কলকাতা বৌ-বাজার সুইমিং ক্লাব ও চঁাদপুর সম্মিলনীর যৌথ উদ্যোগে আয়োজিত অবিরাম সঁাতারে ৯০ ঘণ্টা ৫ মিনিট সঁাতার কেটে বিশ্ব রেকর্ড সৃষ্টি করেন এবং ‘সন্তরণশ্রী’ উপাধিতে ভূষিত হন। এছাড়া তিনি ১৯৭৪ সালে ঢাকার মীরপুর থেকে চঁাদপুর পর্যন্ত প্রায় ১১০ কিলোমিটার সঁাতার কেটে দূরপাল্লার সঁাতারে এশিয়ার সমস্ত রেকর্ড ভঙ্গ করেন। এছাড়া ১৯৬২ সালে ঢাকা-চঁাদপুর ও ১৯৬৫ সালে নারায়ণগঞ্জ-চঁাদপুর দূরপাল্লার সঁাতারসহ অবিরাম সঁাতারে রয়েছে অরুণ নন্দীর উল্লেখযোগ্য কৃতিত্ব। ১৯৬৭-৬৮ সালে ফরিদপুর, কুমিল্লা, ব্রাহ্মণবাড়িয়া, নোয়াখালী, ফেণী, বরিশাল ও চঁাদপুরে অবিরাম সঁাতার কেটে আলোড়ন সৃষ্টি করেন তিনি। চঁাদপুর শহরের জে.এম. সেনগুপ্ত রোডস্থ জোড় পুকুরে তঁার অবিরাম সঁাতার দেখতে এতোটা দর্শক হয়েছিলো যে, অবশেষে দর্শকদের চাপে পাকা পুকুর ঘাটলাও ভেঙ্গে পড়ে।
বিশ্বখ্যাত সঁাতারু আ. মালেক ও অরুণ নন্দীর কারণে সঁাতারে চঁাদপুরের সুনাম ও দাপট ছিলো দেশব্যাপী। তঁাদের পদাঙ্ক অনুসরণ করে রফিক, সালাম, মিন্টু, ফাতেমা, তপন, তকবির, বাদশা, রোকন ও ছানাউল্লাহসহ আরো অনেকে সঁাতারে চঁাদপুরের সুনাম রক্ষার প্রয়াস চালান। তঁাদের সমকালে ও পরবর্তীতে সেন্টু লোধ, আল-আমিন, সেলিম বেপারীসহ আরো কিছু সঁাতারু জাতীয় পর্যায়ে কৃতিত্ব প্রদর্শন করলেও পূর্বসূরিদের ন্যায় ধারাবাহিকতা রক্ষা করতে পারেন নি।
সঁাতারে বিশ্বখ্যাত সঁাতারু আ. মালেক ও অরুণ নন্দীসহ অন্য সঁাতারুদের দ্বারা সৃষ্ট চঁাদপুরের সুনাম এখন কেবল স্মৃতিতে পরিণত হয়েছে। সঁাতারের এই সুনামকে ধরে রাখতে চঁাদপুর জেলা ক্রীড়া সংস্থাসহ অন্য কারোরই স্বল্প ও দীর্ঘমেয়াদী কোনো পরিকল্পনা, পৃষ্ঠপোষকতা ও প্রণোদনা কিছুই নেই। চঁাদপুর স্টেডিয়ামে মালেক ক্রীড়া ভবন ও আউটার স্টেডিয়ামে অরুণ নন্দীর নামে সুইমিং পুল থাকলেও এ দুটি স্থাপনায় তঁাদের নামে কোনো স্মৃতিকক্ষ নেই। উপর্যুপরি পানি সরবরাহ বন্ধ থাকায় অরুণ নন্দী সুইমিং পুল বন্ধ হয়ে আছে বছরের পর বছর। এ সুইমিংপুল চালু করতে জেলা ক্রীড়া সংস্থার দৃশ্যমান কোনো তৎপরতা নেই। এই সংস্থায় সঁাতার উপ-কমিটিও এখন পুরোপুরি নিষ্ক্রিয়। সুইমিংপুল চালু থাকা অবস্থায় চঁাদপুরের সর্বস্তরের সঁাতারুদের সংগঠন চঁাদপুর সঁাতার পরিষদ সক্রিয় থাকলেও এখন তারা নিষ্ক্রিয়। এমতাবস্থায় সঁাতারে চঁাদপুরের সুনাম-ঐতিহ্য-গৌরব সব বিলুপ্তির পথে। এগুলো পুনরুদ্ধারে কেউ এগিয়ে আসবে কিনা সেটাই এখন দেখার বিষয়। তবে সম্প্রতি সুইমিংপুলের মেরামত কাজ শুরু হয়েছে, ঠিক কবে নাগাদ এটি চালু হবে সেটি এখনো বলা যাচ্ছে না।
ক্রিকেট অঙ্গনে চঁাদপুরের মুখ উজ্জ্বল করেছেন গাজী আলমগীর, শামীম পাটওয়ারী, মাহমুদুল হাসান জয়, মেহেদী হাসান রানা প্রমুখ। চঁাদপুর জেলার প্রথম ক্রিকেটার হিসেবে বাংলাদেশ জাতীয় দলে সুযোগ পেয়েছেন সফিউল আযম রাজন। এরপরে শামীম হোসেন পাটোয়ারী। তিনি অনূর্ধ্ব-১৯ দলের হয়ে গড়েছেন ইতিহাস। দেশকে এনে দিয়েছেন প্রথমবারের মতো যুব বিশ্বকাপ। এমন ক্রিকেটার গড়ে তোলার ক্ষেত্রে একজন নিভৃতচারী মানুষের কথা না বললেই নয়, তিনি হলেন চঁাদপুরের ক্রিকেট কোচ শামীম ফারুকী।
বর্তমানে চঁাদপুরে ক্রীড়াচর্চা আগের তুলনায় কিছুটা ভিন্ন রূপ ধারণ করেছে। আধুনিক প্রযুক্তি এবং ইন্টারনেটের প্রসারে তরুণদের অনেকেই ভার্চুয়াল গেম এবং অনলাইন ভিত্তিক বিনোদনের দিকে ঝুঁকেছে। ফলে মাঠ পর্যায়ের খেলাধুলার চর্চা কিছুটা কমে গেছে। তবে স্কুল ও কলেজ পর্যায়ে ক্রীড়ার প্রতি আগ্রহ এখনো বিদ্যমান। সরকারি ও বেসরকারি সংস্থার উদ্যোগে কিছু নতুন ক্রীড়া সামগ্রী ও কোচিং ব্যবস্থা চালু হওয়ায় আবারো মাঠে ফেরার আগ্রহ বাড়ছে। জেলা ক্রীড়া অফিসের অধীন বিভিন্ন প্রশিক্ষণ কর্মসূচি এবং প্রতিযোগিতার মাধ্যমে তরুণদের খেলাধুলায় উৎসাহিত করা হচ্ছে।
চঁাদপুরে ক্রীড়া সংগঠক ও খেলোয়াড় হিসেবে যারা জাতীয় পর্যায়ে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখেছেন, তারা হচ্ছেন : আবুল, মুকুল ( ফুটবলার), মরহুম এম ফরিদ উল্যাহ, মরহুম শাহ্ মো. সাদেক হোসেন (নান্নু মিয়া), প্রয়াত ভানু মজুমদার, কামরুজ্জামান চৌধুরী, মুনির আহমেদ, বাফুফের সাবেক সভাপতি এসএ সুলতান টিটু, বাংলাদেশ সুইমিং ফেডারেশনের সাধারণ সম্পাদক মাহবুবুর রহমান শাহীন, পুরাণবাজারের কৃতী সন্তান মরহুম বাচ্চু চৌধুরী, আলহাজ্ব মো. জাহাঙ্গীর আখন্দ সেলিম, উল্লেখযোগ্য। জাতীয় পর্যায়ে চঁাদপুরের সাম্প্রতিক কৃতী ফুটবলাররা হলেন : বাদল দাস, নুরুল হক মানিক, রেজাউল করিম রেজা, রিয়াদুল হাসান রাফি প্রমুখ।
চঁাদপুরে নারী খেলোয়াড়ের সংখ্যা ক্রমশ বাড়ছে। মেয়েরা ক্রিকেট, ফুটবল, ব্যাডমিন্টন, বাস্কেটবল ও দৌড় প্রতিযোগিতায় অংশ নিচ্ছে। এটা একটি ইতিবাচক পরিবর্তনের সূচক।
চঁাদপুরের ক্রীড়াঙ্গনকে ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্যে উপযোগী করতে হলে কিছু সুপরিকল্পিত উদ্যোগ নেয়া যেতে পারে। তার মধ্যে উন্নত ক্রীড়াসুবিধা নিশ্চিত করার লক্ষ্যে বিদ্যমান স্টেডিয়ামের আধুনিকায়ন, প্রশিক্ষণ কেন্দ্র এবং জিমনেশিয়াম স্থাপন করা, প্রশিক্ষকের অভাব দূর করা, দক্ষ ও অভিজ্ঞ প্রশিক্ষক নিয়োগ এবং নিয়মিত প্রশিক্ষণ কর্মসূচির ব্যবস্থা করা, স্কুল পর্যায়ে বাধ্যতামূলক ক্রীড়া-পাঠক্রমে ক্রীড়া বিষয়ক কার্যক্রমকে আরো গুরুত্ব দেয়া, নারী ক্রীড়াবিদদের উৎসাহিত করতে নিরাপদ পরিবেশে আলাদা প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা, বিভিন্ন খেলায় পৃষ্ঠপোষকতায় সরকারি ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠানকে ক্রীড়াক্ষেত্রে বিনিয়োগে আগ্রহী করা ইত্যাদি।
বর্তমান বিশ্বে প্রযুক্তির প্রভাব প্রতিটি ক্ষেত্রে যেমন গভীর, তেমনি ক্রীড়াক্ষেত্রেও এর প্রভাব অনস্বীকার্য। চঁাদপুরের তরুণরাও এর বাইরে নয়। স্মার্টফোন, সোশ্যাল মিডিয়া এবং ভিডিও গেমসের প্রতি আসক্তির কারণে মাঠের খেলাধুলার প্রতি আগ্রহ কিছুটা কমেছে। তবে এটিকে কেবল নেতিবাচক হিসেবে দেখা ঠিক নয়। যদি সঠিকভাবে পরিকল্পনা করা যায়, তাহলে প্রযুক্তিকে ক্রীড়ার উন্নয়নের একটি শক্তিশালী হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করা সম্ভব। যেমন ডিজিটাল প্রশিক্ষণ ও টিউটোরিয়ালে ইউটিউব ও অ্যাপের মাধ্যমে খেলোয়াড়রা অনলাইনে প্রাথমিক প্রশিক্ষণ নিতে পারে। ই-স্পোর্টস প্রতিযোগিতায় ভার্চুয়াল গেমের প্রতিযোগিতা আয়োজনে তরুণদের আগ্রহকে ইতিবাচক দিকে প্রবাহিত করা যেতে পারে। ক্রীড়া সংক্রান্ত মোবাইল অ্যাপে স্থানীয় পর্যায়ে খেলোয়াড়দের তথ্য সংরক্ষণ, রেজিস্ট্রেশন ও স্কোর ট্র্যাকিং চালু করা যেতে পারে।
চঁাদপুরে দ্রুত নগরায়ণের ফলে খেলার মাঠের সংকট দিন দিন প্রকট হচ্ছে। নতুন আবাসন, বাজার এবং বিভিন্ন নির্মাণ প্রকল্পের জন্যে পুরাতন মাঠগুলোর অনেক অংশ হারিয়ে গেছে। খেলাধুলা চর্চার জায়গা না থাকলে নতুন প্রজন্মের খেলোয়াড় হিসেবে গড়ে ওঠা কঠিন। এ সমস্যার সমাধানে প্রয়োজন প্রতিটি ওয়ার্ডে খেলার মাঠ নিশ্চিত করা, মাঠ ব্যবস্থাপনায় স্থানীয় প্রশাসনের সক্রিয় ভূমিকা, বিদ্যালয় ও কলেজগুলোর খোলা মাঠ সংরক্ষণে কঠোর আইন প্রণয়ন, ক্রীড়াবিদদের সামাজিক ও অর্থনৈতিক নিরাপত্তা। চঁাদপুরের অনেক প্রতিভাবান ক্রীড়াবিদ মাঠে দুর্দান্ত পারফরম্যান্স করলেও পর্যাপ্ত পৃষ্ঠপোষকতা এবং আর্থিক নিরাপত্তার অভাবে তারা অন্য পেশায় চলে যেতে বাধ্য হন। এই পরিস্থিতি পরিবর্তনে সরকার ও স্থানীয় শিল্পপতিদের এগিয়ে আসা দরকার। ক্রীড়াবিদদের জন্যে হতে পারে স্কলারশিপ ও স্পন্সরশিপ, কর্মসংস্থানভিত্তিক ক্রীড়া স্কিম, চিকিৎসা ও ইনস্যুরেন্স সুবিধা এবং মেয়েদের খেলাধুলায় অংশগ্রহণ বাড়ানো। একসময় ধারণা ছিলো, খেলাধুলা কেবল ছেলেদের কাজ। কিন্তু সময় বদলেছে। চঁাদপুরের মেয়েরা এখন স্কুল ও কলেজ পর্যায়ে ক্রীড়ায় অংশ নিচ্ছে। তারা বিভিন্ন জেলা ও বিভাগীয় টুর্নামেন্টে অংশগ্রহণ করে সাফল্যও অর্জন করছে। তবে এখনও পরিবার ও সমাজের কিছু বাধা তাদের পুরোপুরি উন্মুক্তভাবে অংশগ্রহণ থেকে বিরত রাখে। এই বাধা দূর করতে চাই নারীবান্ধব ক্রীড়া অবকাঠামো, নারী কোচ ও প্রশিক্ষকের নিয়োগ, মেয়েদের জন্যে আলাদা ক্রীড়া ক্যাম্প ও নিরাপদ পরিবেশ।
ক্রিকেট ও ফুটবল ছাড়াও চঁাদপুরে বেশ কিছু বিকল্প ক্রীড়ার সম্ভাবনা রয়েছে। কাবাডি ও হ্যান্ডবল গ্রামীণ এলাকায় জনপ্রিয় এবং খরচ কম। অ্যাথলেটিক্সে খোলা মাঠে এবং সঁাতারে পুকুর, নদীতে চর্চার সুযোগ বেশি।
দাবায় মানসিক দক্ষতা বৃদ্ধির পাশাপাশি নেতৃত্বের গুণাবলি গড়ে উঠে। নৌকাবাইচ ও গ্রামীণ খেলা পর্যটনের সঙ্গে সংযুক্ত করে স্থানীয় অর্থনীতিও চাঙ্গা করা সম্ভব।
চঁাদপুরের ক্রীড়া সংস্কৃতি সংরক্ষণে ও ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্যে একটি সুগঠিত ক্রীড়ানীতির প্রয়োজন, যার মূল বিষয়গুলো হতে পারে : জেলা ক্রীড়া নীতিমালা প্রণয়ন, ক্রীড়ার প্রতিটি ধারা ও স্তরের জন্যে পৃথক পরিকল্পনা গ্রহণ, বার্ষিক জেলা ক্রীড়া উৎসব, প্রতিভা অন্বেষণ ও নতুন খেলোয়াড় খুঁজে বের করতে উৎসবভিত্তিক টুর্নামেন্ট, স্কুল পর্যায়ে ক্রীড়া জরিপ, যেটি খেলোয়াড়দের তথ্য সংরক্ষণ ও তাদের উন্নয়নের পরিকল্পনা তৈরিতে সহায়ক।
ক্রীড়ার উন্নয়নে স্থানীয় মিডিয়ার ভূমিকা থাকতে হবে। স্থানীয় খেলোয়াড়দের সাফল্য প্রচার করে উৎসাহ প্রদান করতে হবে।
চঁাদপুরে ক্রীড়া সাংবাদিক অ্যাড. ইয়াসিন আরাফাত ইকরাম (চৌধুরী ইয়াসিন ইকরাম) ও মিজানুর রহমান দীর্ঘদিন লেখালেখি করছেন খেলাধুলার বিষয় নিয়ে। এদের মতো সাংবাদিকরা জেলার বিভিন্ন প্রান্তের খেলাধুলা বিষয়ক নিউজ, ফিচার ও প্রতিভাবান খেলোয়াড়দের সাক্ষাৎকার প্রচার করলে এখানকার ভবিষ্যৎ প্রজন্ম খেলাধুলায় আগ্রহী হয়ে উঠবে। প্রতিটি স্থানীয় ও জাতীয় পত্রিকায় খেলাধুলার প্রচার এবং দৈনিক চঁাদপুর কণ্ঠের মতো ‘ক্রীড়াকণ্ঠ’ ফিচার পাতা বের করে জেলার খেলোয়াড়দের আগ্রহী করা যেতে পারে। ‘এক ওয়ার্ড, এক খেলার একাডেমি’ প্রকল্প নিয়ে প্রতিটি ওয়ার্ড বা উপজেলায় একটি নির্দিষ্ট খেলার একাডেমি গড়ে তোলা যেতে পারে। চঁাদপুর জেলায় শেখ মনজুরুল কাদের সোহেল, অ্যাডভোকেট নূরুল আমিন খান আকাশ, জায়েদ আল রিফাইয়ের মতো ক্রীড়া সংগঠক তৈরি করে খেলাধুলায় ছেলেমেয়েদের আগ্রহী করে তোলা যেতে পারে।
চঁাদপুরের ক্রীড়া সংস্কৃতি কেবল অতীতের গর্ব নয়, বরং ভবিষ্যতের এক সম্ভাবনার দিগন্ত। বর্তমান তরুণ প্রজন্ম যদি সঠিক দিকনির্দেশনা, প্রশিক্ষণ ও পৃষ্ঠপোষকতা পায়, তাহলে তারা শুধু চঁাদপুরের নয়, গোটা দেশের মুখ উজ্জ্বল করতে পারে। আমাদের দায়িত্ব হচ্ছে, এই ক্রীড়া ঐতিহ্যকে বঁাচিয়ে রাখা এবং আধুনিক প্রজন্মের প্রয়োজন অনুযায়ী নতুন ক্রীড়া পরিবেশ গড়ে তোলা। কারণ ক্রীড়া শুধু শারীরিক উন্নয়ন নয়, এটি মানসিক শৃঙ্খলা, নেতৃত্ব ও জাতি গঠনেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে।
চঁাদপুরের ক্রীড়া সংস্কৃতি শুধুমাত্র অতীতের গৌরবময় অধ্যায়ের সাক্ষী নয়, এটি একটি জীবন্ত ঐতিহ্য, যা বর্তমান ও ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্যে আরো সৃজনশীল ও কার্যকর ভূমিকা পালন করতে পারে। বর্তমানে ক্রীড়া সংস্কৃতির একটি টেকসই ভবিষ্যৎ তৈরি করার জন্যে বেশ কিছু কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে। চঁাদপুরের ক্রীড়াবিদদের মনোভাব, সরকারি সহযোগিতা এবং সমাজের অংশগ্রহণের মাধ্যমে এটিকে আরও সমৃদ্ধ করা সম্ভব।
চঁাদপুরে বর্তমানে ক্রীড়া প্রশিক্ষণের পর্যাপ্ত ব্যবস্থা নেই। কিছু স্কুল ও ক্লাবে কোচ থাকলেও তাদের শিক্ষাদান কার্যক্রম একেবারে সীমিত। প্রাতিষ্ঠানিক প্রশিক্ষণের অভাব এবং কাঠামোগত উন্নয়নের শূন্যতার কারণে অনেক তরুণ ক্রীড়াবিদ তাদের সম্ভাবনা পুরোপুরি বাস্তবায়ন করতে পারেন না। চঁাদপুরে ক্রীড়াবিদদের প্রশিক্ষণের জন্যে বিশেষ অবকাঠামো স্থাপন করা দরকার। এতে বিশেষত বিভিন্ন খেলার নির্দিষ্ট কোর্সের ব্যবস্থা থাকবে। বিশেষজ্ঞ প্রশিক্ষক নিয়োগ ও নিয়মিত প্রশিক্ষণ কার্যক্রম চালু করা যাবে। আধুনিক প্রশিক্ষণের জন্যে ভার্চুয়াল রিয়েলিটি বা উন্নত ক্রীড়া বিশ্লেষণ সফটওয়্যার ব্যবহার করা যেতে পারে।
এখন পর্যন্ত চঁাদপুরে আন্তর্জাতিক মানের ক্রীড়া প্রতিযোগিতার আয়োজন হয়নি। এমনকি বেশিরভাগ স্থানীয় প্রতিযোগিতাও ছোট আকারে আয়োজন করা হয়। তবে, যদি জেলা পর্যায়ে আন্তর্জাতিক মানের প্রতিযোগিতার আয়োজন করা হয়, তাহলে সেখান থেকে ক্রীড়াবিদদের অভিজ্ঞতা বৃদ্ধি পাবে এবং তারা নতুন নতুন কৌশল রপ্ত করতে পারবে ও চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন হলেও তা সমাধানের উপায় খুঁজে বের করতে পারবে।
স্থানীয় পর্যায়ে বিদেশি ক্রীড়াবিদদের আগমন ঘটানো সম্ভব হলে চঁাদপুরের ক্রীড়াঙ্গনে আন্তর্জাতিক অভিজ্ঞতা যুক্ত হবে। এছাড়া ক্রীড়া পরিচালনার মান বৃদ্ধিতে সফলভাবে আন্তর্জাতিক মানের প্রতিযোগিতা আয়োজন করতে হবে। এতে চঁাদপুরের ক্রীড়া পরিবেশের মান বৃদ্ধির সুযোগ তৈরি হবে।
ক্রীড়ার উন্নয়নে পৃষ্ঠপোষকতার প্রয়োজন অপরিহার্য। ক্রীড়ার উন্নয়ন ও সমৃদ্ধির জন্যে যথাযথ পৃষ্ঠপোষকতা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। চঁাদপুরের ক্রীড়ার প্রতি ব্যক্তি এবং প্রতিষ্ঠান উভয়েরই দায়বদ্ধতা থাকতে হবে। স্থানীয় ব্যবসায়ীরা যদি ক্রীড়া প্রতিযোগিতায় পৃষ্ঠপোষকতা দেন, তবে ক্রীড়াবিদদের জন্যে অনেক সুযোগ তৈরি হবে। সরকার ক্রীড়ার জন্যে বরাদ্দ বাড়ালে তার সুফল সরাসরি খেলার অবকাঠামো ও প্রশিক্ষণের দিকে আসবে।
বর্তমানে চঁাদপুরের তরুণদের মধ্যে ক্রীড়ায় আগ্রহ আগের তুলনায় কিছুটা কমে গেছে। এটা প্রধানত শহুরে জীবনের ব্যস্ততা এবং প্রযুক্তি নির্ভর বিনোদনের কারণেই। তবে তরুণদের খেলাধুলার প্রতি আগ্রহ ফিরিয়ে আনা সম্ভব, যদি ক্রীড়াকে বিনোদন এবং ব্যক্তিগত উন্নয়নের উপায় হিসেবে তুলে ধরা হয়। ক্রীড়াকে শিক্ষার অংশ হিসেবে গ্রহণে বিদ্যালয়ের পাঠক্রমের সঙ্গে খেলাধুলাকে যুক্ত করতে হবে। এতে শিক্ষার্থীরা কেবল পাঠ্য বিষয়েই নয়, শারীরিক ও মানসিক বিকাশেও সচেতন হবে। তরুণদের জন্যে খেলাধুলার প্রয়োজনে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ক্লাব গঠন করলে দলবদ্ধভাবে খেলার অভ্যেস গড়ে উঠবে। ক্রীড়ামুখী সংস্কৃতির প্রচারে স্কুল-কলেজের প্রোগ্রাম এবং মিডিয়ার মাধ্যমে ক্রীড়ার প্রচার বর্তমানের চেয়ে আরো বৃদ্ধি করা প্রয়োজন।
চঁাদপুরের ঐতিহ্যবাহী গ্রামীণ কিছু খেলা যেমন নৌকাবাইচ, বলীখেলা, লাঠিখেলা এবং দড়ি টানাটানি এক সময় অনেক জনপ্রিয় ছিলো, কালক্রমে আধুনিক খেলার প্রভাবে যেগুলো অনেকটাই পিছিয়ে পড়েছে। এই খেলাগুলোর মধ্যে এমন কিছু বৈশিষ্ট্য রয়েছে যা কেবল শারীরিক নয়, সাংস্কৃতিকভাবেও গুরুত্বপূর্ণ। ঐতিহ্যবাহী এই খেলাগুলোর আয়োজন করা হলে তা কেবল চঁাদপুরের সংস্কৃতির ধারক হবে না, পাশাপাশি পর্যটন শিল্পেও অবদান রাখবে। চঁাদপুরের বিভিন্ন উৎসব এবং মেলাগুলোর অংশ হিসেবে এসব ঐতিহ্যবাহী খেলার প্রতিযোগিতার আয়োজন করা যেতে পারে।
চঁাদপুরের ক্রীড়াঙ্গন ভবিষ্যতেও তার ঐতিহ্য বজায় রাখবে, যদি দেশের পরিবর্তিত পরিস্থিতি এবং আধুনিক চাহিদার সঙ্গে খাপ খাইয়ে নিতে পারে। তরুণ প্রজন্মের মধ্যে খেলাধুলার আগ্রহ বৃদ্ধির মাধ্যমে তারা শুধুমাত্র শারীরিক সক্ষমতা অর্জন করবে না, বরং মানসিক দৃঢ়তা, নেতৃত্বের গুণাবলি এবং সমাজের প্রতি তাদের দায়বদ্ধতা বাড়াবে। এই প্রক্রিয়াটি দ্রুত বাস্তবায়িত করতে হলে জেলা প্রশাসন, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, ক্রীড়া সংগঠন এবং স্থানীয় জনগণের সম্মিলিত প্রচেষ্টা প্রয়োজন। বস্তুত একযোগে কাজ করার মাধ্যমেই চঁাদপুরের ক্রীড়া সংস্কৃতিকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া সম্ভব।
তথ্যসূত্র : জেলা ক্রীড়া সংস্থা।
উজ্জ্বল হোসাইন : প্রাবন্ধিক ও সাংবাদিক, চঁাদপুর।