প্রকাশ : ২১ জানুয়ারি ২০২৫, ১৬:৩২
ট্রাম্পের নির্বাহী আদেশ: মার্কিন অভিবাসন নীতিতে পরিবর্তন এবং এর বৈশ্বিক প্রভাব
অভিবাসন নীতিতে বৈপ্লবিক পরিবর্তন
ট্রাম্পের নির্বাহী আদেশ: মার্কিন অভিবাসন নীতিতে পরিবর্তন এবং এর বৈশ্বিক প্রভাব
মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প তার দ্বিতীয় মেয়াদে শপথ গ্রহণের সঙ্গে সঙ্গেই বেশ কিছু কঠোর নির্বাহী আদেশে সই করেছেন, যা অভিবাসন নীতিতে গভীর পরিবর্তনের ইঙ্গিত দেয়। এর মধ্যে সবচেয়ে বিতর্কিত হলো জন্মসূত্রে মার্কিন নাগরিকত্ব নীতি বাতিলের উদ্যোগ। এই সিদ্ধান্ত কেবল যুক্তরাষ্ট্রের অভ্যন্তরীণ নীতিতে নয়, বৈশ্বিক অভিবাসন ব্যবস্থায়ও গভীর প্রভাব ফেলবে বলে ধারণা করা হচ্ছে।
জন্মসূত্রে নাগরিকত্ব নীতি: ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট মার্কিন সংবিধানের ১৪তম সংশোধনীর মাধ্যমে ১৮৬৮ সালে প্রণীত জন্মসূত্রে নাগরিকত্ব নীতি যুক্তরাষ্ট্রের আইনি কাঠামোর একটি অন্যতম মূলভিত্তি। এই নীতির উদ্দেশ্য ছিল দাসপ্রথার অবসান এবং আফ্রিকান-আমেরিকানদের নাগরিক অধিকার সুনিশ্চিত করা।
তবে বর্তমানে এই নীতির মাধ্যমে অনেক অভিবাসী পরিবার যুক্তরাষ্ট্রে থাকার সুবিধা পাচ্ছে বলে মনে করছেন ট্রাম্প। তিনি দাবি করেন, এই নীতির অপব্যবহার যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনৈতিক এবং সামাজিক কাঠামোকে দুর্বল করে তুলেছে।
ট্রাম্পের যুক্তি: প্রয়োজনীয়তা নাকি রাজনীতি?
ট্রাম্পের অভিমত অনুযায়ী, জন্মসূত্রে নাগরিকত্ব একটি 'হাস্যকর' নীতি যা বৈশ্বিক অভিবাসনের সংকটকে আরও বাড়িয়ে তুলেছে। তার মতে, এই নিয়মের মাধ্যমে যুক্তরাষ্ট্রে প্রবেশকারী অভিবাসীরা শুধুমাত্র নাগরিকত্ব পাওয়ার উদ্দেশ্যে সন্তান জন্ম দিচ্ছেন।
তবে সমালোচকরা একে রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত বলে আখ্যা দিয়েছেন। ট্রাম্প তার নির্বাচনী প্রচারণায় সবসময়ই অভিবাসন ইস্যুকে প্রাধান্য দিয়ে আসছেন। বিশেষত, "আমেরিকা ফার্স্ট" নীতির আলোকে তিনি অভিবাসন ব্যবস্থায় পরিবর্তন আনার প্রতিশ্রুতি দেন।আইনি জটিলতা এবং সংবিধানের বাধা:
যুক্তরাষ্ট্রের সংবিধানে জন্মসূত্রে নাগরিকত্বের বিধান সুরক্ষিত। ফলে, এই নীতি বাতিল করতে হলে সাংবিধানিক সংশোধনের প্রয়োজন হবে। শুধু নির্বাহী আদেশের মাধ্যমে এই নীতি পরিবর্তন সম্ভব নয়।
বিশেষজ্ঞদের মতে, এই সিদ্ধান্তটি আদালতে গুরুতর আইনি চ্যালেঞ্জের মুখে পড়বে। অনেকেই মনে করেন, এটি মানবাধিকার লঙ্ঘনের সমতুল্য এবং আন্তর্জাতিক আইনের সঙ্গেও অসামঞ্জস্যপূর্ণ।লাখো ভারতীয়ের নাগরিকত্ব হারানোর শঙ্কা; পিউ রিসার্চ সেন্টারের তথ্য অনুসারে, যুক্তরাষ্ট্রে প্রায় ৪৮ লাখ ভারতীয়-আমেরিকান বাস করেন। এর মধ্যে ১৬ লাখ ব্যক্তি জন্মসূত্রে নাগরিক। ট্রাম্পের সিদ্ধান্ত কার্যকর হলে তারা এই নাগরিকত্ব হারাতে পারেন। এই পরিস্থিতি ভারতীয় সম্প্রদায়ের মধ্যে তীব্র উদ্বেগ সৃষ্টি করেছে। মার্কিন অর্থনীতি এবং সমাজে ভারতীয় অভিবাসীদের বিশাল ভূমিকা থাকলেও তাদের ভবিষ্যৎ এখন অনিশ্চিত।
বৈশ্বিক অভিবাসনের ওপর প্রভাব: ট্রাম্পের এই সিদ্ধান্ত শুধু যুক্তরাষ্ট্র নয়, বরং বৈশ্বিক অভিবাসন ব্যবস্থায়ও প্রভাব ফেলবে। অনেক দেশ থেকে অভিবাসীরা মার্কিন মাটিকে তাদের নিরাপদ আশ্রয় হিসেবে দেখেন। তবে এই সিদ্ধান্ত তাদের স্বপ্ন চূর্ণ করতে পারে। বিশেষ করে, উন্নয়নশীল দেশগুলোর নাগরিকদের জন্য যুক্তরাষ্ট্রের নাগরিকত্ব একটি মূল্যবান সুযোগ। এই পরিবর্তন তাদের জন্য অভিবাসনের পথে বড় বাধা সৃষ্টি করবে।
অন্য আদেশ এবং তাদের প্রভাব: ট্রাম্প জন্মসূত্রে নাগরিকত্ব বাতিল ছাড়াও আরও কিছু উল্লেখযোগ্য নির্বাহী আদেশ জারি করেছেন, যেগুলোর প্রভাব ব্যাপক। এর মধ্যে রয়েছে:
১. জাতীয় জরুরি অবস্থা জারি: যুক্তরাষ্ট্র-মেক্সিকো সীমান্তে দেয়াল নির্মাণ এবং নিরাপত্তা জোরদারের জন্য।
২. প্যারিস জলবায়ু চুক্তি থেকে সরে আসা: জলবায়ু পরিবর্তনের বিরুদ্ধে বৈশ্বিক প্রচেষ্টায় যুক্তরাষ্ট্রের ভূমিকা কমে যাবে।
৩. বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (ডব্লিউএইচও) থেকে প্রত্যাহার: মহামারি মোকাবিলায় বৈশ্বিক সহযোগিতা দুর্বল হবে।পরিকল্পনার দীর্ঘমেয়াদি প্রভাব: ট্রাম্পের সমর্থকরা মনে করেন, এই সিদ্ধান্ত যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনৈতিক ভারসাম্য এবং জাতীয় নিরাপত্তা সুরক্ষিত করবে। তবে অভিবাসনপন্থী এবং মানবাধিকার সংস্থাগুলো এটিকে মানবাধিকারের লঙ্ঘন এবং বৈষম্যমূলক পদক্ষেপ বলে আখ্যা দিয়েছে।
অর্থনৈতিক প্রভাব: অভিবাসীদের ভূমিকা যুক্তরাষ্ট্রে অভিবাসীরা দীর্ঘদিন ধরে অর্থনৈতিক উন্নয়নের অন্যতম চালিকাশক্তি। তারা প্রযুক্তি, স্বাস্থ্যসেবা, ব্যবসা এবং শিক্ষাসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখছেন।
ভারতীয়-আমেরিকানরা মার্কিন অর্থনীতিতে অন্যতম শীর্ষস্থানীয় অবদানকারী। তারা সিলিকন ভ্যালি থেকে শুরু করে স্থানীয় ব্যবসায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছেন। ট্রাম্পের সিদ্ধান্ত তাদের অবদান কমিয়ে দিতে পারে।
আন্তর্জাতিক প্রতিক্রিয়া: ট্রাম্পের সিদ্ধান্ত আন্তর্জাতিক অঙ্গনে মিশ্র প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করেছে। কানাডা, অস্ট্রেলিয়া এবং ইউরোপীয় ইউনিয়নের নেতারা উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন।
বিশ্ব নেতারা মনে করেন, এই পদক্ষেপ বৈশ্বিক অভিবাসন ব্যবস্থাকে দুর্বল করবে এবং বৈশ্বিক শরণার্থী সংকট আরও বাড়াবে।
পরিকল্পনার দীর্ঘমেয়াদি প্রভাব: ট্রাম্পের সিদ্ধান্ত যুক্তরাষ্ট্রকে আরও বিচ্ছিন্নতার দিকে ঠেলে দিতে পারে। বহুজাতিক সংস্কৃতির ওপর ভিত্তি করে গড়ে ওঠা একটি দেশ হিসেবে যুক্তরাষ্ট্রের জন্য এই সিদ্ধান্ত আর্থসামাজিকভাবে ক্ষতিকর হতে পারে।
উপসংহার: ডোনাল্ড ট্রাম্পের নির্বাহী আদেশ শুধু অভিবাসন নীতিতে পরিবর্তন নয়, বরং বৈশ্বিক রাজনীতিতে বড় ধরনের পরিবর্তনের সূচনা করেছে।
এই নীতি যুক্তরাষ্ট্রের মূল্যবোধ এবং সাংবিধানিক কাঠামোর সঙ্গে কতটা সামঞ্জস্যপূর্ণ, তা নিয়ে প্রশ্ন রয়ে গেছে। তবে এটি নিশ্চিত যে, এই সিদ্ধান্ত আগামী দিনগুলোতে যুক্তরাষ্ট্র এবং বৈশ্বিক অভিবাসন ব্যবস্থায় বড় ধরনের প্রভাব ফেলবে।
লেখক: মো. জাকির হোসেন তথ্য ও গবেষণা সম্পাদক, চাঁদপুর জেলা বিএনপি।
ডিসিকে/এমজেডএইচ