প্রকাশ : ০৭ ফেব্রুয়ারি ২০২৪, ০০:০০
অতীত বর্তমান ভবিষ্যৎ
তৃপ্তি সাহা
স্বাধীনতার পরবর্তী অর্থাৎ ৭০-৮০ দশকে সরকারি স্কুল-কলেজগুলোর ছিলো দুর্দান্ত প্রতাপ। হাতেগোণা দু-একটি প্রাইভেট স্কুল-কলেজ ছিলো ভালোর তালিকায়। সে সময়ে আমরা পায়ে হেঁটে স্কুল-কলেজে যেতাম। আজকালকার বাবা-মায়েদের মতো তখনকার মা-বাবারা সারাদিন ছেলে-মেয়েদের পেছনে আঠার মতো লেগে থাকতেন না। তখনো যৌথ পরিবারের ভাঙ্গন মহামারি আকার ধারণ করেনি।
|আরো খবর
সদ্য রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের পর অনেক স্বপ্ন নিয়ে দেশ স্বাধীন হয়েছে। জনবসতি ছিলো গ্রামকেন্দ্রিক। যার জন্যে শহরের উপচেপড়া ভিড় মোটেই ছিলো না। বরং গ্রামগুলোই ছিলো বাংলার প্রাণ। বারমাসে তের পার্বণ। স্বপ্ন রঙিন জীবনযাত্রা। বাঙালির নাড়ির বন্ধন-এ গ্রাম।
যানবাহন ছিলো হাতেগোণা। চারদিকে পুকুর, খাল-বিল, নদী-নালা আর সবুজ-শ্যামলিমায় শান্ত শহরগুলো দিগন্তজোড়া আকাশের নিচে বিস্তৃৃর্ণ সবুজ মাঠ আর বিশাল জলরাশি-নিয়নের আলোয় ঝল্মলে শহরের জীবনযাত্রা।
তখন মানুষে মানুষে বিশ্বাসযোগ্যতা ছিলো। পাড়া-প্রতিবেশীদের সাথে ছিলো অকৃত্রিম হৃদ্যতা। বাবা-মায়েরা সাংসারিক, ব্যবসায়িক, চাক্রি-বাক্রি এককথায় যার যার কাজে ব্যস্ত থাকতো। আর তখন যুগটা ছিলো ‘আয় বুঝে ব্যয়’। অর্থাৎ যে যতো বেশি পরিশ্রম করবে, মেধা খাটাবে, কাজ করবে, সে ততোটাই উপার্জন করতে পারবে, আর সে অনুপাতে খরচ। দুর্নীতি বাঙালির রক্তে তখনো ঢুকেনি। আর এখন ‘ব্যয় বুঝে আয়’। এটা যে আমাদেরকে কোথায় নিয়ে গেছে বলাই বাহুল্য। হেন কাজ নেই যা করতে আমরা দ্বিধান্বিত হই। তো আমরা পাড়া-প্রতিবেশী, বন্ধু-বান্ধব, ভাই-বোন মিলে একসাথে স্কুল-কলেজে যেতাম, অবশ্যই পায়ে হেঁটে। কারণটা আগেই বলেছি ‘আয় বুঝে ব্যয়’। অবশ্য যানবাহনও ছিলো সীমিতসংখ্যক, রিক্সারও খুব একটা প্রচলন ছিলো না। আর আজকালতো বন্ধুত্বে বিশ্বাস নেই। এমনকি রক্তের বন্ধনেও চলে টানাপোড়ন। বাবা-মা, ছেলে-মেয়েদের হাতের মুঠোয় পুরে স্কুল-কলেজে নিয়ে যাচ্ছে-নিয়ে আসছে। বাড়ির বাইরে বেড়োনো নিষেধ। গ্রামগুলো হলো মানুষশূন্য। শহরগুলো জনারণ্যে পরিণত হলো। দেশটিরও হয়েছে সে হাল, নেই সবুজ বিস্তৃর্ণ মাঠ নেই, পুকুর, নেই খাল, নদীগুলো হচ্ছে সঙ্কোচিত, কোথাও বিলীন। দালানের পিঠে দালান, আর তালার উপর তালা-এ যে কী ভীষণ জ্বালা। কোনো নিয়মনীতি ছাড়া এসব দালান, এতোসব তালা রাতারাতি গড়ে উঠেছে। আর তাই এখনকার ছেলে-মেয়েকে ঘরে মোবাইল, ল্যাপটপ, ফেসবুকে বন্দী। ছেলে-মেয়েদের দোষ নেই-‘সময়’, ‘পারিপার্শ্বিকতা’ মানুষকে পাল্টে ফেলে, পাল্টে দেয়-অলিখিত দিকনির্দেশনায়।
আমরা স্কুলে স্কুলড্রেস পরে গিয়েছি। আর ড্রেস বলতে শুধু জামা প্যান্ট নয় বরং জামা, প্যান্ট, জুতো, মোজা। বড় বিশ্বাস নিয়ে দেশ গড়ার শপথ পাঠ করতাম। জাতীয় সংগীত গাইতাম। কোরআন তেলাওয়াত, গীতা পাঠ ইত্যাদি হতো। আগে মানুষের প্রাচুর্যতা ছিলো না বরং বলা যায় একটু অভাবীই ছিলো। কিন্তু! দৈন্যতা ছিলো না নিঃসন্দেহে। কিন্তু এখন মানুষের প্রাচুর্যতা বেড়েছে বহুলাংশে, কিন্তু দৈন্যতার চিত্রটা আরও প্রকট। আগে মানুষের স্টাইল ছিলো, ফ্যাশন খুবই কম ছিলো। এখন আমাদের নিজস্বতা, স্বকীয়তা অর্থাৎ স্টাইলটি হারিয়ে সর্বাঙ্গীনভাবে ফ্যাশনেবল হয়েছি। এখানেও দৈন্যতার চিত্রটি প্রকট।
স্কুলে যেতাম, ব্যাগভরে বই নিতাম। কলেজেও যতোটা নেয়া যায় ততোটা নিয়েছি। আর এখন একদম শিশু বয়সে ব্যাগের ওজন বয়ে নেয়া যা কষ্টকর কিন্তু কলেজে উঠতে না উঠতেই খাতা হাতে, তারপর খাতা পকেটেও চলে এলো এবং এ নিয়ে কলেজে প্রবেশ করছে ছাত্র-ছাত্রীরা (ব্যতিক্রমও আছে)।
সে সময়ে যারা শিক্ষকতা পেশায় থাকতেন তারা ছোটবেলা থেকেই বুকের মধ্যে মানুষ গড়ার, দেশ গড়ার হাতিয়ার হবে-এভাবেই নিজেদের মডেলটা আদর্শ শিক্ষকের জায়গায় রেখে নিজেকে তৈরি করতেন, ভাবতেন ও হৃদয়ে ধারণ করতেন। তাই তাঁদের চোখে-মুখে সে সৌন্দর্য, আন্তরিকতা আর জ্যোতি ফুটে উঠতো ছাত্র-ছাত্রীদের মস্তক অবনত হতো সে সৌন্দর্যের কাছে শ্রদ্ধায়।
কিন্তু বর্তমানে বাধ্য হয়ে, অগতির গতি (ব্যতিক্রম আছে) অনেকটা স্বপ্ন ভঙ্গের মতো একান্ত নিরূপায় হয়ে শিক্ষকতা পেশা গ্রহণ করেন। বর্তমানে শিক্ষা হয়ে গেছে পণ্য। যার যতো বেশি অর্থনৈতিক অবস্থা ভালো, শিক্ষা তার পকেটে। এদেশের কতো গরিব কৃষকের ছেলে মেধার তালিকা থেকে আকাশের তারার মতো ঝরে গেলো কেউ খবর রাখেনি সে সব। নেশা- সময়ের পরিবর্তনে শুধু চেহারাটা পরিবর্তিত হয়েছে। সবসময় ছিলো ইভটিজিং, কখনো নীরব, কখনো সরব, কখনো সচেতনতার মধ্যে, কখনো অসচেতনতার মধ্যে।
আগে কলেজগুলোর ওয়ালে কতো ধরনের কুরুচিপূর্ণ লেখা দেখা যেতো। রাস্তাঘাটেও কম যেতো না। টেলিভিশন, মোবাইল, কম্পিউটার তথা ইন্টারনেটের মাধ্যমে এখন সারাপৃথিবী মানুষের হাতের মুঠোয়। তাই আজ-কালকার ছেলে-মেয়েরা ওয়ালে এসব লিখে না, তারা ফেসবুকে তাদের আবেগ, তাদের অনুভূতি শেয়ার করে। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই সেখানে নান্দনিকতা বিরাজমান।
পূর্বে তামাক ছিলো অনেকটা আভিজাত্যের চিহ্নস্বরূপ। রাজা-রাজারা হুকো নামক তামাকজাতীয় দ্রব্য গ্রহণ করতো। সাধারণ ঘরগুলোতে আরো বেশি পরিমাণে এর বিস্তার ছিলো। পুরুষ ব্যক্তিটি এবং গৃহিণী উভয়ই এ তামাকজাতীয় হুঁকো পান করতেন। তেমনিভাবে বিড়ি, সিগারেট নিম্নশ্রেণী থেকে উচ্চশ্রেণী পর্যন্ত বিস্তৃতি ছিলো। আগে মানুষ এ নিকোটিনের ভয়াবহতা সম্পর্কে সচেতন ছিলেন না। তারা সাময়িক আনন্দ, অল্প বয়সে বিয়ে এবং অল্প বয়সে কর্তৃত্ব গ্রহণের অহমিকা, মেয়েদের বাল্য বয়সে বিধবা, অবহেলা ইত্যাদির কারণে তামাকজাতীয় দ্রব্যাদি গ্রহণ করতো।
বর্তমানে আনুপাতিকহারে এ নিকোটিনের ব্যবহার অনেক কম। ছেলে-মেয়েদের হতাশা, ব্যর্থতা থেকে তামাকজাতীয় দ্রব্যাদি, ভয়াবহ ড্রাগ গ্রহণ করে। একশ্রেণীর মুনাফালোভী নীতিবর্জিত অসাধু ব্যবসায়ী আমাদের নিষ্পাপ ছেলে-মেয়েদের হাতের নাগালে এসব মরণ ড্রাগ পৌঁছে দিচ্ছে।
ছেলেমেয়েদের উপর থেকে আমাদের অত্যন্ত বেশি চাওয়া-পাওয়াগুলো কমিয়ে ওদের আরো কাছাকাছি থাকার প্রচেষ্টা অব্যাহত রাখা দরকার। তবেই সমস্ত অসঙ্গতি থেকে মুক্তি পাবে আজকের তরুণসমাজ, ছাত্রসমাজ।
জয় হোক তারুণ্যের, জয় হোক তরুণ সমাজের-এটাই আমাদের প্রত্যাশা।