প্রকাশ : ২৭ ডিসেম্বর ২০২৩, ০০:০০
জাতি প্রত্যয়ী ও সুস্বাস্থ্যের অধিকারী হবে যেভাবে
ছেলেবেলায় মায়ের একদিনের কড়া শাসনের কথা আমার খুব মনে আছে। সাধারণত দুপুরে খাওয়ার পরেই খেলতে বেরিয়ে পড়তাম। কিন্তু মা বলতেন, ‘খাওয়ার পরে একটু বিশ্রাম নিয়ে তারপর বিকালে খেলতে বেরোতে হবে।’ তার এই উপদেশের অবাধ্য হওয়ায় একদিন কড়া শাসন করেছিলেন। তার শাসনের ৪৩ বছর পরে আজ মনে হয় অনেক পিতা-মাতাই হয়তো তাদের সন্তাদেরকে শাসন করছেন। তবে খেলতে যাওয়ার জন্য নয় বরং ল্যাপটপ বা মোবাইলের মধ্যে মুখ গুঁজে পড়ে থাকার জন্য। গ্রাম-শহর যেদিকে তাকাই দেখি ছোট ছোট সোনামনিরা ওবেসিটিতে ভুগছে। এমনিতেই জনবহুল দেশ হওয়ায় খেলার মাঠ বা ফাঁকা জায়গা নেই বললেই চলে। যারা খেলতে ইচ্ছুক তারা খেলতে পারে না। তাই সবাই মোবাইল বা কম্পিউটার-নামক ভার্চুয়াল দুনিয়ায় নিজেদেরকে মগ্ন রাখছে। আমরা যখন ছোট ছিলাম এক জায়গা থেকে আরেক জায়গায় হেঁটে গিয়েছি। কিন্তু অটোরিকশার সহজলভ্যতায় এখন হাঁটানামক শারীরিক প্রয়োজনীয়তাটি আমাদের জীবন থেকে হারিয়ে যেতে বসেছে। ‘পরিশ্রম করব না কিন্তু ভোগ করব’ ব্যাবসায়িক এই স্লোগানটিকে সামনে রেখে অনলাইন ফুড ডেলিভারি, অনলাইন শপিং, অনলাইন ওষুধ কেনাকাটা—এসব কিছুই আমাদের প্রাত্যহিক জীবনের নড়াচড়া একেবারেই কমিয়ে দিয়েছে। আমরা হাঁটার প্রয়োজনীয়তা এখন অনুভব করি কেবলমাত্র হার্ট ব্লক বা ডায়াবেটিসের মতো অসুখে আক্রান্ত হওয়ার পর।
সম্প্রতি এক খবরে দেখলাম গ্রামেও উচ্চ রক্তচাপ ও ডায়াবেটিসের রোগীর সংখ্যা দিনদিন বেড়েইে চলেছে। আরেকটি জাতীয় দৈনিকের খবরের শিরোনাম, ‘চিকিৎসার লাগামহীন ব্যয়ে নিঃস্ব মানুষ।’ খবরে প্রকাশ, সরকারি সংস্থা স্বাস্থ্য অর্থনীতি ইউনিটের গবেষণা বলছে—স্বাস্থ্য খাতে ব্যক্তির নিজের ব্যয় ধারাবাহিকভাবে বেড়েই চলেছে। চিকিৎসা ব্যয়ের ৬৮ দশমিক ৬ শতাংশ ব্যক্তি নিজেই বহন করেন। আর এ ব্যয় করতে গিয়ে বছরে ৮৬ লাখের বেশি মানুষ দারিদ্র্যসীমার নিচে চলে যাচ্ছে। গবেষণায় দেখা যায়, ২০১৫ সালের তুলনায় ২০২০ সালে দেশে মানুষের চিকিৎসা খাতে ব্যক্তিগত ব্যয় (আউট অব পকেট এক্সপেনসেস) আরো বেড়েছে। এ অতিরিক্ত ব্যয় ২০১৫ সালে ছিল ৬৭ শতাংশ, যা ২০২০ সালে দাঁড়িয়েছে ৬৯ শতাংশে। ২০২০ সালে বাংলাদেশে মোট স্বাস্থ্য ব্যয়ের দুই-তৃতীয়াংশ বা ৬৮ দশমিক ৫ শতাংশ ব্যয় হয়েছে ব্যক্তির নিজ খরচে।
এমন অবস্থা থেকে পরিত্রাণ জরুরি। এর জন্য সর্বাগ্রে যেটা দরকার তা হলো—শরীরচর্চার সুযোগ রেখে দিনপঞ্জি তৈরি করা। আমরা সবকিছু যখন উন্নত বিশ্বের অনুকরণে করার চেষ্টা করছি, তখন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, কর্মক্ষেত্র সবখানেই শরীরচর্চা ও খেলাধুলার ব্যবস্থা রাখা জরুরি। এ বিষয়ে আমি বিদেশে অধ্যয়নকালীন আমার বাস্তব অভিজ্ঞতার কথা তুলে ধরছি- উনিশ শ বিরানব্বই সাল, ইউরোপের একটি দেশের ন্যাশনাল টেকনিক্যাল ইউনিভার্সিটিতে স্নাতক পর্যায়ে অধ্যায়ন করছি। ওখানে পড়াশোনার ক্ষেত্রে শারীরিক সুস্থতা ও সক্ষমতাকে খুবই গুরুত্ব দেওয়া হয়। ধরে নেওয়া হয়, শারীরিকভাবে সুস্থ না হলে তারা সুনাগরিক হতে পারে না। তাই শরীরচর্চার জন্য সাঁতার থেকে শুরু করে হেন কসরত নাই যার ব্যবস্থা সেখানে নেই। এরই ধারাবাহিকতায় আমরা ২২ জন বিদেশি কিক বক্সিন শিখতে শুরু করি। ৩০ বছর আগের কথা এখনো আমার মনে আছে। প্রথম দিন কিক বক্সিনের কোনো কলাকৌশল নয়, শুধু বুকডন ও বেলিপ্রেস দেওয়ানো হলো। এক ঘণ্টার মধ্যে কতবার যে বুকডন আর বেলিপ্রেস দিলাম, স্মরণ নেই। কেন বেলিপ্রেস আর বুক ডন দেওয়ানো হলো? জিগ্যেস করে জানলাম, বেলিপ্রেসের ফলে পেটে পেশি তৈরি হয়, এর ফলে প্রতিপক্ষের ঘুসিতে পেটে আঘাত লাগলে ধরাশায়ী হওয়ার সম্ভাবনা নেই। আর বুকডন দেওয়া হয় এজন্য যে, বক্সিনের সময় বাহুতে প্রচণ্ড শক্তি আসে। কারণ যা-ই হোক না কেন, পরের দিন আমাদের শিক্ষার্থীদের সবার গায়ে ব্যথায় জ্বর চলে এসেছিল। এরপর দিন দুয়েক আর অনুশীলনে যেতে পারিনি। ব্যথা ও জ্বর কমলে আবার সবাই যাওয়া শুরু করলাম। শুরু হলো আমাদের জীবনের নতুন অধ্যায়।
এমন একটি মল্লযুদ্ধের প্রশিক্ষণ হৃদয়ের গভীরে গেঁথে গিয়েছিল। যা এখনো কাজে লাগে। জীবনে কখনোই মারামারি করার প্রয়োজন পড়েনি, কিন্তু মানুষকে ট্রেনিংয়ের মাধ্যমে সহ্য ক্ষমতার কোথায় নিয়ে যাওয়া যায়, তা বাস্তব অভিজ্ঞতা থেকে শিখেছি। আমার মনে আছে, ট্রামে চড়ে তিন স্টপেজ গিয়ে বিশাল হলরুমে আমাদেরকে ট্রেনিংগুলো করতে হতো। এক ঘণ্টার শারীরিক কসরতের পর ট্রেইনার যখন শেষ করার জন্য বাঁশি দিতেন, তখন মনে হতো এটাই স্বর্গসুখ। ট্রেনিংয়ে গিয়ে অভ্যস্ততাবশত ২৫ সেকেন্ডে ৪০টি বুকডন দিতে পারতাম। এই ট্রেনিং আমার মানসিক শক্তিকে এক অনন্য উচ্চতায় নিয়ে গিয়েছিল। এখনো জীবনের যে কোনো সমস্যা এলে আমার মনে হয়, আমি যে কষ্ট সহ্য করে এসেছি এর চেয়ে বেশি কষ্টে তো আর বর্তমান সমস্যা আমাকে ফেলতে পারবে না। ফলে আমার মানসিক শক্তি সবসময়ই অটুট থাকে।
শারীরিক চাপ গ্রহণের ক্ষেত্রে মানুষ যখন একটা সীমা অতিক্রম করে তখন প্রাত্যহিক যে কোনো চাপ তার কাছে তুচ্ছ মনে হয়। জীবন মানেই একটি যুদ্ধক্ষেত্র। এখানে প্রতি মুহূর্তে রয়েছে ভীষণ মানসিক চাপ। চাপ যে শুধু বাইরের তা নয়, পারিবারিক চাপ, পড়াশোনার চাপ, জীবনকে এগিয়ে নেওয়ার চাপ, প্রেমঘটিত বিচ্ছেদের চাপ। এমন চাপসংকুল পৃথিবীতে চাপ সহ্য করতে না পারলেই হেরে যেতে হবে। আমার মতে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে খেলাধুলা, সাঁতার, কারাতে, কিক বক্সিনসহ যে কোনো ধরনের শারীরিক কসরত করানোর সক্ষমতা থাকা উচিত। ইস্পাতকঠিন মানসিকতার যে কোনো ব্যক্তিই জীবনকে দেখে দায়িত্ব পালনের ইতিবাচক ক্ষেত্র হিসেবে।
সম্প্রতি আমার এক পরিচিত ব্যক্তির সন্তান বিজ্ঞান বিভাগের কোনো এক বিষয়ে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়েছে। প্রথম বর্ষে তিন ঘণ্টা দাঁড়িয়ে ব্যাবহারিক ক্লাসের পরীক্ষণগুলো করা তার জন্য বেশ কঠিন বলে সে প্রায়ই তার বাবার কাছে অভিযোগ করছে। আমরা প্রায়ই বলি, জনশক্তিই আমাদের সম্পদ। কিন্তু জনবল যদি দুর্বলতার কারণে মানসিক শক্তি অর্জন না করে তাহলে শিক্ষিত হয়েও তারা খুব বেশি এগোতে পারবে না। ভয়, উৎকণ্ঠা হবে তাদের নিত্যদিনের সঙ্গী। দক্ষিণ কোরিয়া দেশটির সমগ্র জাতির তরুণ প্রজন্মকে কঠোর শারীরিক প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়। এর কারণ হলো চিরবৈরী সম্পর্কের দেশ উত্তর কোরিয়ার সঙ্গে যুদ্ধ হলে যাতে তারা যুদ্ধ করার মনোবলসম্পন্ন পর্যাপ্ত তরুণ পায়। যুদ্ধ কবে লাগবে, এ বিষয়ে কোনো ধারণা না থাকলেও এটি নিশ্চিতভাবে বলা যায় যে, সুস্থ-সবল নাগরিক হওয়ার ফলে তাদের নবপ্রজন্ম যে কোনো মানসিক চাপ মোকাবিলায় সক্ষম। দক্ষিণ কোরিয়ার শিক্ষা, জ্ঞান-বিজ্ঞান ও শিল্পের উন্নয়নের সূচক জাতিগত সুস্থতা ও সক্ষমতার নির্ণায়ক।
আমাদের দেশে শারীরিক পরিশ্রমকে খুব একটা ভালো চোখে দেখা হয় না। ধরে নেওয়া হয় কৃষক বা শ্রমিকরা কায়িক পরিশ্রম করবেন। আমিও এর বাইরে ভাবতে পারতাম না। কিন্তু বিদেশে অধ্যয়ন করতে গিয়ে দেখি ‘শরীরের নাম মহাশয় যা সওয়াও তা-ই সয়’। এমন একটি জীবনদর্শন নবপ্রজন্মের মনে শিশুকাল থেকে গেঁথে দিতে পারলে তারা সফলকাম হবেই। আমাদের সন্তানদেরকে স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়ে খেলাধুলাসহ নানান শারীরিক ব্যায়ামের মাধ্যমে চাপ নেওয়ার ক্ষমতা তৈরি করাই সত্যিকার মানুষ তৈরির প্রকৃত পদক্ষেপ বলে আমি মনে করি।
লেখক : উপাচার্য, চাঁদপুর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়।