প্রকাশ : ০১ নভেম্বর ২০২৩, ০০:০০
দেখতে অনেকটা আমাদের দেশের হাঁসের মতো। নাম পিয়াং হাঁস। তোমরা ভাবছ এটা আবার কোন দেশের হাঁস? না, অন্য কোনো দেশের নয়, এটা আমাদের দেশেরই হাঁস। তবে গ্রামের পুকুরে যে হাঁস সাঁতার কাটে, এটা সে হাঁস নয়।
এটি হাঁস প্রজাতির পরিযায়ী পাখি। অর্থাৎ সারা বছর সে আমাদের দেশে থাকে না। কিছু সময় অন্য দেশে থাকে। এ রকম আরো অনেক পরিযায়ী পাখি আছে।
সারা বছর এ দেশেই থাকে যেসব পাখি তাদের আবাসিক পাখি বলে। ভাবছ পাখিরা কি স্কুলে যায়, যে আবাসিক-অনাবাসিক বিভাগ আছে? আছে তো।
বাংলাদেশে প্রায় ৬৬০ প্রজাতির পাখি দেখা গেছে বলে জানা যায়। এর মধ্যে ৩৬০ প্রজাতি আবাসিক ও ৩০০ প্রজাতি অনাবাসিক বা পরিযায়ী।
এ দেশে গরম পড়লে পরিযায়ী পাখিদের প্রায় ৮০ শতাংশ হিমালয়ের কাছাকাছি অঞ্চলের দেশ ও ২০ শতাংশ সুদূর সাইবেরিয়াসহ মধ্য ও উত্তর এশিয়ায় চলে যায়। আবার শীতের সময় ফিরে আসে। তবে সব পরিযায়ী পাখি শীতের সময় আসে না। ৩০০ প্রজাতির মধ্যে ২৯০টি শীত মৌসুমে ও ১০টি গ্রীষ্ম মৌসুমে এ দেশে দেখা যায়। এ ছাড়া দু-তিনটি পাখি আছে, যারা বছরের বিভিন্ন সময় ঘুরতে ঘুরতে এ দেশে আসে খানিক সময়ের জন্য।
এদের তুমি পর্যটক পাখি বলতে পারো। পাখি গবেষকরা অবশ্য এদের বলেন পান্থ-পরিযায়ী। এ ছাড়া যে পাখি বেশি দেখা যায়, তাদের নামের আগে সুলভ আর যে পাখি কম দেখা যায় বা দেখা যায় না তাদের নামের আগে দুর্লভ, বিরল, বিপন্ন বা মহাবিপন্ন শব্দ বসানো হয়। এখন আর দেশে ৬৬০ প্রজাতির পাখি নেই। ৩০-৩২টি পাখি বিলুপ্ত হয়ে গেছে আমাদের দেশ থেকে।
পিয়াং হাঁস : শুধু শীত মৌসুমেই দেখা যায় এদের। বাংলাদেশের সুলভ পরিযায়ী পাখি। দেশে যেসব পরিযায়ী পাখি আসে, তাদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি দেখা যায় এদের। এরা হাওরের জলাশয়ে থাকতেই বেশি পছন্দ করে। তাই এদের দেখতে হলে যেতে হবে সিলেটের হাওর অঞ্চলে। লম্বায় এরা ১৮ থেকে ২২ ইঞ্চি। পুরুষ হাঁস আকারে খানিকটা বড়। ওজন প্রায় এক কেজির কাছাকাছি। আর মেয়ে হাঁস ৮৫০ গ্রাম। আমাদের যেমন ছেলেমেয়ের চেহারায় পার্থক্য রয়েছে, তেমনি পার্থক্য রয়েছে এদের ছেলেপাখি ও মেয়েপাখির চেহারায়ও। পুরুষ হাঁস খয়েরি-বাদামি রঙের মিশেল। আর মেয়ে হাঁসের শরীরে বাদামি রঙের ছোপ ছোপ দেখা যায়। পানিতে ডুব দিয়ে এরা খাবার জোগাড় করে। এদের খাবার তালিকায় আছে জলজ উদ্ভিদ, শৈবাল, ঘাস, নলখাগড়া, হোগলা পাতা, আগাছা ও উদ্ভিদের বিভিন্ন অংশ যেমন পাতা, মূল, কাণ্ড, বীজ ইত্যাদি। এরা একসঙ্গে ৮ থেকে ১২টি ডিম দিতে পারে। ২৫ দিনের মাথায় ডিম থেকে ছানা ফোটে।
পাতিকুট : ভীষণ চেঁচামেচি করা পাখি এরা। এ সময় উপকূলে এদের হাঁকডাকে কান ঝালাপালা হয়ে যায়। ঊপকূলের কাদা চরে ও হাওরের জলাশয়ে এদের দেখা যায়। পাতিকুটের ছেলেপাখি ও মেয়েপাখি কিন্তু দেখতে একই রকম। সারা শরীর কালো। কেবল ঠোঁট আর কপাল ধবধবে সাদা। লম্বায় ১৩ থেকে ১৭ ইঞ্চি পর্যন্ত হতে পারে। আর ওজন ৫৮৫ থেকে এগার শ গ্রাম। পানির উদ্ভিদ, অঙ্কুর, বীজ, পোকা, কেঁচো ও শামুক খায় এরা। একসঙ্গে ৫ থেকে ১২টি ডিম দিতে পারে। ২১ দিনে ডিম থেকে ছানা বেরোয়।
উত্তুরে ল্যাঞ্জাহাঁস : এটিও সুলভ পরিযায়ী পাখি। অন্য হাঁসের তুলনায় এর লেজ ও গলা একটু বেশিই লম্বা। এদেরও ছেলেপাখি ও মেয়েপাখির চেহারায় পার্থক্য রয়েছে। পার্থক্য রয়েছে আকারেও। লম্বায় ২২ থেকে ৩০ ইঞ্চি পর্যন্ত হয় এরাও। আর ওজন ৫০০ গ্রাম থেকে এক কেজিরও বেশি। মাথা দেখলে চকোলেটের কথা মনে পড়বে। বুক সাদা। পিঠ আর দুপাশ ধূসর। তবে মেয়েরা হয় হালকা খয়েরি আর মাথা ধূসর খয়েরি। মেয়েদের লেজ ছেলেপাখির চেয়ে ছোট। এরা আবার নিশাচর পাখি। দিনের বেলা পড়ে পড়ে ঘুমায়। রাতে ঘুরে বেড়ায়। খাবার খোঁজে। উপকূলীয় বড় নদী, মোহনা ও কাদা চরে এদের বেশি বিচরণ। তবে বাসা বানায় মাটিতে। এদের দেখতে চাইলে যেতে হবে ভোলা, নোয়াখালীসহ উপকূলের কাদা চরগুলোতে। জলজ উদ্ভিদ, পানির অমেরুদণ্ডী প্রাণী ও লতাপাতা এদের খাদ্য। এপ্রিল থেকে সেপ্টেম্বর এদের ডিম দেওয়া ও ছানা ফোটানোর সময়। এরা একসঙ্গে ৭ থেকে ৯টি ডিম দেয়। ২১ থেকে ২২ দিনের মাথায় ডিম থেকে ছানা বেরোয়। আর ৪০ থেকে ৪৫ দিনে ছানার গায়ে ওড়ার পালক গজায়।
ইউরেশীয় সিঁথি হাঁস : এ পাখিদের দেখতে হলে যেতে হবে দেশের বিভিন্ন ঊপকূল আর হাওরে। সংখ্যায়ও থাকে প্রচুর। পুরুষ হাঁসের মাথা লালচে বাদামি ও মাথার ওপরের অংশ সাদা। বুক গোলাপি ও পেট সাদা। পেছনের অংশ খয়েরি। পাখা হয় সবুজ। মেয়ে হাঁস হালকা বাদামি রঙের। মাথা ধূসর বর্ণের। লম্বায় এরা ১৭ থেকে ২০ ইঞ্চি পর্যন্ত হয়। আর ওজন ৫০০ থেকে এক কেজিরও বেশি। জলাশয়ে থাকলেও এরা বাসা বানায় মাটিতে। তবে পানির কাছাকাছি। ভেজা ঘাস, পানির উদ্ভিদ, পোকামাকড় ও লার্ভা হচ্ছে এদের খাবার। এক মৌসুমে ৭ থেকে ১২টি ডিম দিতে পারে। ডিম থেকে বাচ্চা ফোটে ২৪ থেকে ২৫ দিনে।
ছোট ধুলজিরিয়া : ছোট আকারের পাখি এরা। লম্বায় সাড়ে সাত ইঞ্চির বেশি হয় না। আর ওজন ৫০ গ্রামেরও কম। এর কপাল ও পেট সাদা এবং পিঠ বাদামি রঙের। সৈকতের কাছাকাছি থাকতে পছন্দ করে। তাই উপকূলের জলাভূমি বা কাদা চরে একে বেশি দেখা যায়। ছানা ফোটানোর সময় ছাড়া এদের ছেলেপাখি ও মেয়েপাখি দেখতে প্রায় একই রকম। মাটির ওপর থেকে পোকা খায় ও অন্য সময় কাদায় লুকানো কেঁচোই হচ্ছে এদের মূল খাবার। একসঙ্গে ডিম দিতে পারে ২ থেকে ৩টি। ২২ থেকে ২৪ দিনে এদের ডিম থেকে বাচ্চা ফোটে এবং ৩০ থেকে ৩৫ দিনে ছানারা বাসা ছেড়ে উড়তে পারে।